দরসে হাদীস: ইসলামে আত্মহত্যা হারাম- অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভী

0

عَنْ ابى هريرة رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم قال من تردّى من جبل فقتل نفسه فهو فى نارجهنم يتردّى فيه خالدًا مخلدًا فيها ابدًا ومن تحسّى سمًّا فقتل نفسه فسمه فى يده يتحسّاه فى نار جهنم خالدًا مخلدًا فيها ابدًا ومن قتل نفسه بحديدة فحديدته فى يده يجأبها فى بطنه فى نار جهنم خالدًا مخلدا فيها ابدًا [رواه البخارى] অনুবাদ : হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজে কোন পাহাড় থেকে পড়ে আত্মহত্যা করল সে জাহান্নামে যাবে। সে সেখানেই অনন্তকাল পতিত হতে থাকবে এবং সেখানেই সর্বদা অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি বিষ পানে আত্মহত্যা করল, সে বিষ দোযখেও তার হাতে থাকবে। যা সে জাহান্নামের আগুনে পান করতে থাকবে। আর অনন্তকাল সেখানেই থাকবে। আর যে ব্যক্তি লোহা জাতীয় কো
Poster-2ন হাতিয়ার দ্বারা আত্মহত্যা করল, সে হাতিয়ার তার হাতে থাকবে। যা সে জাহান্নামের আগুনে সর্বদা নিজের পেটে মারতে থাকবে। সে অনন্তকাল সেখানেই অবস্থান করবে।
[বুখারী শরীফ: হাদীস নম্বর ৫৪৪২, মুসলিম শরীফ, হাদীস: ১০৯, আবু দাঊদ শরীফ, হাদীস নম্বর ৩৮৭২, তিরমিযী শরীফ: হাদীস নম্বর ২০৪৪]

রাবী পরিচিতি
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী প্রসিদ্ধ সাহাবী। ৬ষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পর তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৩০ বছর। ৫৭ হিজরিতে ৭৮ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরত ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বর্ণনা মতে তিনি প্রায় ৮০০ সাহাবী ও তাবেয়ীদের নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেন। তাঁর নিকট থেকে বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা ৫৩৭৪। বুখারী ও মুসলিম শরীফে যৌথভাবে বর্ণিত হয়েছে ৩২৫টি। এককভাবে ইমাম বুখারী ৭৯টি ইমাম মুসলিম ৯৩টি মতান্তরে ৭৩টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। হযরত ওলীদ ইবনে ওকবা ইবনে আবূ সুফিয়ান তাঁর নামাযে জানাযায় ইমামতি করেন। তিনি মদীনা মুনাওয়ারায় প্রসিদ্ধ কবরস্থান জান্নাতুল বাক্বীতে শায়িত আছেন।

প্রাসঙ্গিক আলোচনা
বর্ণিত হাদীসটি বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট ও জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যবহ। চলমান অবস্থার নিরিখে সমাজ দেশ ও জাতির এ ক্রান্তিকালে হাদীসের শিক্ষা ও নির্দেশনা যথার্থ প্রাসঙ্গিক ও বাস্তবতার সাথে সংগতিপূর্ণ। বর্তমান সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের এক ভয়ানক ব্যাধি গোটা বিশ্বকে অশান্ত ও অস্থির করে তুলেছে। সন্ত্রাসবাদের কালো থাবা বিশ্বমানবতার শান্তি শৃঙ্খলা স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা বিঘিœত করছে প্রতিনিয়ত।
আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশও আজ সন্ত্রাসীদের সর্বগ্রাসী ষড়যন্ত্র ও হুমকির সম্মুখীন। ঘরে বাইরে, শহরে বন্দরে, গ্রামে গঞ্জে, অফিসে আদালতে, মসজিদে মন্দিরে, গীর্জাতে জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কোথাও মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নেই। সর্বত্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠা, ভয়-ভীতি আতঙ্ক সন্দেহ সংশয় মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। ইসলাম নামধারী এক শ্রেণির উগ্রবাদী, ভ্রান্তমতবাদী বিকৃত মস্তিষ্ক দিকভ্রান্ত পথভ্রষ্ট বিপথগামীতা কতিপয় মানুষের অপকর্মের কারণে বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা আজ নিন্দিত, লাঞ্চিত ও অপমানিত অথচ ইসলাম মানে শান্তি, মুসলমান অর্থ শান্তিকামী। যিনি মুসলমান হবেন তিনি কখনো জঙ্গি তথা সন্ত্রাসী হতে পারেন না। যিনি জঙ্গি তিনি কখনো মুসলমান হতে পারেন না। ইসলাম জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসবাদকে কখনো সমর্থন ও অনুমোদন করে না।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
المسلم من سلم المسلمون من لسانه ويده
অর্থ: মুসলমান সেই ব্যক্তি যার জিহ্ববা ও হাত থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে। [নাসায়ী: হাদিস নম্বর ৪৯৯৫] মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অন্যত্র মুমিনের পরিচয় ব্যক্ত করে এরশাদ করেন-
المؤمن من امنه الناس على دما ئهم واموالهم
অর্থ: মু’মিন সেই ব্যক্তি যার কাছে মানুষ নিজের রক্ত ও সম্পদকে নিরাপদ মনে করে। [তিরমিযী: হাদীস নম্বর ২৫৫১]

জীবন এক পবিত্র আমানত
মানবজাতির জীবন মৃত্যুর মালিক একমাত্র আল্লাহ্। এ জীবন মানুষের প্রচেষ্টা ও সাধনার দ্বারা অর্জিতও নয়। এটি আল্লাহ্ প্রদত্ত এক পবিত্র আমানত। জীবন আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক মহান নি’মাত। এ কারণে যে কোন মানুষের জীবনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা অপর মুসলমানের উপর অপরিহার্য। মুসলমানের প্রাণ ও জীবন বিপন্ন করা অপর মুসলমানের জন্য হারাম করা হয়েছে।
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
المسلم على المسلم حرام دمه وماله وعرضه
অর্থ: মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের রক্ত সম্পদ ও সম্ভ্রম (সম্মান বিনষ্ট করা) হারাম। [সহীহ্ মুসলিম: হাদীস ২৫৬৪] তাইতো পবিত্র ইসলাম ধর্মে অন্য মানুষের জীবন ধ্বংস করা, বিপন্ন করা, সংহার করা, কাউকে হত্যা করা তো দূরের কথা, এমনকি নিজের জীবন সংহার করা বা নিজকে নিজে হত্যা করা তথা আত্মহত্যা করাকেও অনুমোদন দেয়নি। ইসলাম কখনো মানুষকে আত্মহত্যার স্বাধীনতা দেয়নি। বরং আত্মহত্যা করা জঘন্যতম অপরাধ ও হারাম অপকর্ম হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
ইসলাম আত্মহত্যা নয় বরং নিজের জীবনকে নিজের শরীর প্রাণ অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ সযতœ লালন, সুস্থ পরিচর্যা ও আদর্শ সুন্দর জীবন গঠনের তাগিদ দিয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-فِانَّ لجسدك عليك حقًا অর্থাৎ তোমার উপর রয়েছে তোমার শরীরের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার।

ইসলামে আত্মঘাতী হামলা নিষিদ্ধ
ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহানভূতির ধর্ম। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সহিঞ্চুতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন ইসলামের এক অনুপম আদর্শ। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী মুসলিম অমুসলিম সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছে ইসলাম। এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিবেচনায় পার্থক্য বিধানের কোন সুযোগ ইসলামে নেই। আজকের সমাজে একটি বিপথগামী গোষ্ঠী সমাজের শিক্ষিত ছাত্র যুবকদেরকে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা ও কুরআন সুন্নাহ’র মনগড়া বিকৃত অর্থ করে মগজ ধোলাই করে তথাকথিত জেহাদের নামে মানুষ হত্যা করাকে ঈমানি দায়িত্ব মনে করা ও তাদেরকে সহজে জান্নাতী হওয়ার প্রলোভন দেয়া, ‘বাচলে গাজী’ মরলে শহীদ’ ইত্যাদি বিভ্রান্তিকর বুলি আউড়িয়ে ছাত্র যুব সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা, ভয়াবহ নারকীয় তান্ডবের সৃষ্টি করা, বোমা ও বিস্ফোরক দ্রব্যাদির মাধ্যমে আত্মঘাতী হামলা চালিয়ে অসংখ্য জীবন ও সম্পদ ধ্বংস করা নিজকেও আত্মঘাতী হামলা বা আত্মহত্যার মাধ্যমে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া অজ্ঞতা, মূর্খতা, বোকামী ছাড়া আর কিছু নয়। এসব কিছু সন্ত্রাস বৈ কিছু নয়। জেহাদ আর সন্ত্রাস এক নয়। আজকে বিশ্বব্যাপী যা ইসলামের নামে ঘটছে মূলত উগ্রবাদীরা এসব অপকর্মের মাধ্যমে ইসলাম বিদ্বেষী মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী ইয়াহুদি নাসারাদের স্বার্থ রক্ষা করছে এবং তাদের ইসলাম বিরোধী নীলনকশা ও এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
ইসলামে আত্মহত্যা ও আত্মঘাতী হামলা সম্পর্কে পরকালীন ভয়াবহ পরিণতি তথা জাহান্নামী হওয়ার বার্তা বিঘোষিত হয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه عن النبى صلى الله عليه وسلم الذى يطعن نفسه انما يطعنها فى النار والذى يتقحّم فيها يتقحّم فى النار والذى يحنق نفسه يخنقها فى النار [رواه البخارى] অর্থ: হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, যে ব্যক্তি কিছু মুখে দিয়ে নিজের জীবনকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল, সে দোযখেও নিজেকে অনুরূপভাবে হত্যা করতে থাকবে। একইভাবে যে ব্যক্তি নিজের জীবনকে কূপ ইত্যাদিতে নিক্ষেপ করত বিপন্ন করল, সে দোযখেও এরূপ করতে থাকবে। যে ব্যক্তি ফাঁসি লাগিয়ে নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল, সে জাহান্নামেও অনুরূপ করতে থাকবে। [সহীহ্ বুখারী: হাদীস নম্বর ১২৯৯] তাই আসুন সমাজে ইসলামের অপব্যাখ্যা দিয়ে কুরআন সুন্নাহর মনগড়া তাফসির করে যারা মানুষকে বিভ্রান্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। ইসলামের সঠিক আক্বিদা বিশ্বাস ইসলামী নীতি আদর্শ থেকে বিচ্যুতির কারণেই তারা ইসলামকে কলংকিত করছে। দেশ ও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান নিরপরাধ ও নিষ্পাপ মুসলমানদেরকে এবং অপরাপর ধর্মাবলম্বীকে হত্যা করে যারা ইসলামের বদনাম করে যাচ্ছে, তারা প্রকৃত মুসলমান নয়। এ অশুভচক্রের অপতৎপরতা কঠোরভাবে দমন করা আজ সময়ের দাবী। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে সর্বস্তরের জনতার ঐক্যবদ্ধ সম্মিলিত প্রয়াস সফল হবেই। মহান আল্লাহ্ আমাদের দেশ ও জাতিকে হেফাযত করুন। আমীন।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •