মিয়ানমারের রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধরা আবার নির্যাতন, নিপীড়ন, খুন, নারী- ধর্ষণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মুসলিমবিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতার সুযোগে তাদের মানবতাবিরোধী পাশবিক তৎপরতা এখন চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। সংবাদমাধ্যমের খবরে দেখা যাচ্ছে, দেশটির সেনাবাহিনী ঘোষণা দিয়ে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ এর ব্যানারে হেলিকপ্টার ও অ্যাম্বুসের মাধ্যমে গুলি করে নিরীহ রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে। জ্বালিয়ে দিচ্ছে রোহিঙ্গাবসতি। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা যুবকদের গলা কেটে ও ঘরে আবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে মারছে। নারীদের ওপর চালানো হচ্ছে পাশবিক নির্যাতন। শিশুরাও মগসেনা এবং উগ্র বৌদ্ধদের নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তাদেরকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। যারা বেঁচে আছে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দিচ্ছে। এ পর্যন্ত পাঁচ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশে আসার পথে অনেকেই নৌকা ডুবে মারা গেছে। যারা শরণার্থী হয়ে এসেছে তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও শতাধিক গুলিবিদ্ধ রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রায় সবাই নারী, শিশু এবং বয়োবৃদ্ধ। এ বিষয়ে শরণার্থীদের মত হচ্ছে, যুবকরা নিখোঁজ। আশংকা করা হচ্ছে, যুবকদের ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর যে সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নির্যাতন চলছে, তাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, আসল ঘটনা গণহত্যা। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যা হচ্ছে, তা ‘গণহত্যা’ এবং জাতিগত নির্মূল অভিযান। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব ২৬০ (৩) এর অধীনে গণহত্যাকে এমন একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, যা প্রতিরোধে সকল রাষ্ট্র অঙ্গীকারবদ্ধ। এই গণহত্যার সংজ্ঞা শুধু ‘হত্যা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং একটি জাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা নৃতাত্ত্বিকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে, এমন কর্মকাৃকে গণহত্যা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। গণহত্যার সংজ্ঞায় বিবেচ্য বিষয়গুলো হলো, ক. পরিকল্পিতভাবে একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য তাদের সদস্যদের হত্যা বা নিশ্চিহ্নকরণ, খ. তাদের নিশ্চিহ্ন করবার জন্য শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিসাধন, গ. পরিকল্পিতভাবে একটি জাতিকে ধ্বংসসাধনকল্পে এমন জীবননাশী অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে তারা সম্পূর্ণ অথবা আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, ঘ. এমন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যাতে একটি জাতি বা গোষ্ঠীর জীবন ধারণে শুধু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিই নয়, তাদের জন্ম প্রতিরোধ করে জীবনের চাকাকে থামিয়ে দেওয়া এবং ঙ. একটি জাতি বা গোষ্ঠীর শিশু সদস্যদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে তাদের জন্মপরিচয় ও জাতিগত পরিচয় মুছে ফেলা। রাখাইন রাজ্যেও রোহিঙ্গাদের নির্মূলে মিয়ানমার সরকার পাশবিক সব আচরণই করছে।
মিয়ানমার সরকার প্রচার করছে, রোহিঙ্গারা জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত। ভাবটা এ রকমের যে এরা আইএসের সঙ্গে যুক্ত, তাই দমন করাটা কর্তব্য। সরকার যে হত্যাকাৃ চালাচ্ছে, তা বর্ণবাদী গণহত্যা, যার চরিত্র ফ্যাসিবাদী। মিয়ানমারের সংখ্যাগুরুরা চায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের দেশছাড়া করে তাদের ভৌত সম্পদ, জায়গাজমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘরবাড়ি, সবকিছু দখল করে নিজেদের সম্পদ বাড়াবে। সভ্যতা, মানবিকতা এবং বৌদ্ধ ধর্মের মর্মবাণীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে অসহায় রোহিঙ্গাদের। রাখাইন রাজ্যের অবস্থাকে নরকের সঙ্গে তুলনা করেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। প্রকৃত অর্থে সেখানে নির্বিচারে গণহত্যা চলছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টির উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে মগসেনারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। নির্বিচারে হত্যা করছে। গণতন্ত্রের মানসকন্যা খ্যাত শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচির সরকারের শাসনামলে এমন গণহত্যার ঘটনা মেনে নেয়া যায় না। এটি একটি চরম ঘৃণিত মানবতাবিরোধী অপরাধ।
দৃশ্যত রোহিঙ্গা মুসলমানদের পুরোপুরি মিয়ানমার ছাড়া করার নীতি গ্রহণ করেছে মিয়ানমার। গত অক্টোবরেও মিয়ানমারে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের সময় রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগ তদন্তে জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদ মিয়ানমারে ‘তদন্তদল’ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেও সেই দলের মুখোমুখি হওয়ার সৎসাহস দেখায়নি সু চির সরকার। এখন চলছে পুরোপুরি জাতিগত নির্মূল অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি উপগ্রহ-চিত্র তুলে ধরে বলেছে, রোহিঙ্গা মুসলমান অধ্যুষিত একটি গ্রামেই সাত শরও বেশি বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ধ্বংসলীলার মাত্রা আগে যা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি। সু চির বর্তমান ভূমিকার নিন্দা জানিয়ে প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক ওয়াশিংটন পোস্ট এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেছে, “সু চি নোবেল পুরস্কার গ্রহণের সময় যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা পুনর্বার পাঠ করে দেখতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত এমন এক বিশ্ব গড়ে তোলা যেখানে থাকবে না কোনো বাস্তুহীন, ঘরহীন, আশাহীন মানুষ। সে বিশ্ব হবে সত্যিকারের এক অভয়ারণ্য, যার বাসিন্দাদের থাকবে শান্তিতে বসবাসের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। ’ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিশ্বটা আজ মোটেই এ রকম নয়। ”
প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে কলামিস্ট জর্জ মনবিয়ট নিবন্ধ লিখেছেন ‘অং সান সু চির নোবেল পদক ছিনিয়ে নাও, তিনি এর যোগ্য নন’ শিরোনামে। তিনি লিখেন, ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘে গৃহীত ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ এ পাঁচটি অপরাধের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এর যেকোনো একটি যখন ‘কোনো জাতীয়, নৃতাত্ত্বিক, সম্প্রদায়বিশেষ বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে পুরোপুরি বা আংশিক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে করা হয়, তখন তা গণহত্যা বলে বিবেচিত হবে। অং সান সু চি দেশটির সাম্প্রতিক রাজনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণের পর রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করার সুস্পষ্ট এবং প্রায়শ প্রকাশ্য উদ্দেশ্য নিয়েই পাঁচ অপরাধের অন্তত চারটি কমবেশি নিরবচ্ছিন্নভাবে করে যাচ্ছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। ’
বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী নিউজ উইক ‘ইজ জেনোসাইড অকারিং এগেইনস্ট দ্য রোহিঙ্গা ইন মিয়ানমার’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে লন্ডনের মিডলসেক্স ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক আইন বিভাগের অধ্যাপক উইলিয়াম স্কাবাস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারে যে আচরণ করা হচ্ছে তা নিঃসন্দেহে মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। সিমন-স্কট সেন্টার ফর প্রিভেনশন অ জেনোসাইড (যুক্তরাষ্ট্রের হলোকাস্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়ামের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান) এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার আন্দ্রিয়া জিটলম্যান বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠান ২০১৫ খ্রিস্টাব্দেই রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ গণহত্যার শামিল হয়ে থাকতে পারে বলে উদ্বেগ ব্যক্ত করে। মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি গণহত্যা অপরাধের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
সেনাবাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি রাখাইন প্রদেশ কর্তৃপক্ষ মুসলিমবিরোধী মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিচ্ছে। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে দুই বছর আগে গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে মিয়ানমার। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার রক্ষার পরিবর্তে সরকার নানা ভাবে তাদের নির্মূলে সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদীদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। গত অক্টোবরে এক পুলিশ চেকপোস্টে অতর্কিত হামলায় ৯ পুলিশ নিহতের পর বিদেশি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে অভিযোগ তুলে রাখাইন প্রদেশে ব্যাপকভিত্তিক সেনা অভিযান শুরু হয়। এই অভিযানে রাখাইনে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে নির্বিচারে হত্যা, মহিলা ও কিশোরীদের ধর্ষণ, তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ব্যাপক অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত বছরের ১০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চিরুনি অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে এ পর্যন্ত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নরনারী রাখাইন প্রদেশ থেকে পালিয়েছে। এদের একটি বড় অংশ সীমান্তপথে বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে। প্রসঙ্গত, দেশটির উত্তরাঞ্চলের রাখাইন রাজ্য দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর একটি। সেখানে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাস করে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাস কয়েক প্রজন্ম ধরে হলেও সরকার বরাবরই দাবি করে আসছে, রোহিঙ্গা মুসলিমদের বেশির ভাগই বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। তবে, তাদের বক্তব্যের সমর্থনে কোনো প্রমাণ পেশ করতে পারেনি এখনও। তারা এখন গণহত্যার মাধ্যমে রাখাইনকে রোহিঙ্গা শূন্য করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সাল থেকেই অরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস। সপ্তম শতাব্দীতে আরব বণিকরা আরাকানে আসলে সেখানে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয় তারা। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. আবদুল করিমের একটি গবেষণাগ্রন্থে আরাকানে সপ্তম শতাব্দীর একটি মসজিদের চিত্রসহ বিশদ বর্ণনা আছে। নানা ইতিহাসবিদও অকপটে স্বীকার করেছেন, আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাস হাজার হাজার বছর ধরে। তারা সেখানকার ভূমিজসন্তান। এক সময় আরাকান স্বাধীন ছিল। নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বার্মার শাসকরা আরাকান দখলে নিয়েছে। এমনকি ব্রিটিশদের কাছ থেকে বার্মা স্বাধীনতা লাভের সময় আরাকান চট্টগ্রামের সাথে যুক্ত হয়ে পূর্বপাকিস্তানে যোগ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু নানা ষড়যন্ত্রের শিকার ও রোহিঙ্গাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে তা হয়নি। কিন্তু মিয়ানমারের শাসকরা কোনো সময়ে ইতিহাসের এই সত্যকে মেনে নিতে চায়নি। তারা রোহিঙ্গাদের বহিরাগত ‘বাঙালি’ হিসেবেই চিহ্নিত করতে চেয়েছে সব সময়। ফলে সংকট দিনদিন ঘনীভূত হয়েছে।
মূলত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঠিক পরিচয়কে স্বীকৃতি দিতে মিয়ানমার সরকারের অনিচ্ছা থেকে সমস্যার সূত্রপাত হয়েছে। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মতো রোহিঙ্গারাও বসবাস করে এলেও সরকার তাদের বহিরাগত বাঙালি বলে পরিচিত করার চেষ্টা করে আসছে। অথচ দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে থেকে অংশগ্রহণ ছিল। কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সামরিক বাহিনী পরিচালিত এক অভিযানে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। একপর্যায়ে সংখ্যাটি দু’লাখের ওপর পৌঁছে যায়। দীর্ঘ কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনার একপর্যায়ে মিয়ানমার এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তির অধীন আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিয়ে যায়। কিন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতির বিষয়ে কোনো অভ্যন্তরীণ উদ্যোগ না নিয়ে বরং ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করেছিল যা রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে নাগরিক পরিচয় থেকে বঞ্চিত করেছে। ১৯৯১-৯২ দু’দেশের সম্পর্ক আবারও উত্তেজনাকর হয়ে ওঠে নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কারণে। এ সংখ্যা আড়াই লাখে গিয়ে পৌঁছায়। কূটনৈতিক দরকাষাকষির মধ্য দিয়ে তখন প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইউএনএইচসিআরের উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাসকারী নিবন্ধিত ২৫ হাজার মানুষ ছাড়া সব রোহিঙ্গাই সে সময় প্রত্যাবাসিত হয়েছিল। নিবন্ধিত এ রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই করার নামে মিয়ানমার কালক্ষেপণ করেছে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ওদেশে বসতি গেড়েছে মিয়ানমারের এ ধররের যুক্তি সমস্যাকে জিইয়ে রেখেছে বলে বলা যায়।
বিশ্বের চরম নিগৃহীত গোষ্ঠী রোহিঙ্গারা এখন এক ভয়াবহ দুঃসময়ের মধ্যে টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জীবন তাদের নিভু নিভু সলতের মতো; যেন দপ করে নিভে যাওয়ার অপেক্ষা কেবলই। সবহারা হয়ে সর্বস্বান্ত মানুষগুলো নিপীড়ন-নির্যাতনের মুখে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘ তাদের নাগরিকত্ব ও জন্মভূমিতে বসবাসের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিপরীতে কোন শক্তপোক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারছে না। কোফি আনান রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার দেয়ার পরামর্শ দিলেও মিয়ানমার তাতে রাজি নয়। বরং সুপারিশ পেশের পরই নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া শুধু নয়, বেপরোয়া গুলি, বোমা চালিয়ে হত্যা করা হচ্ছে শিশু, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে। মূলত গণহত্যা চলছে সেখানে এবং তা সুপরিকল্পিতভাবেই। আশা করা হয়েছিল, মিয়ানমারে ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক পালাবদলে শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সু চির দল ক্ষমতায় যাওয়ার পর রোহিঙ্গা সঙ্কট অবসানের একটি পথরেখা তৈরি হবে। কিন্তু হয়েছে তার বিপরীত। তারা রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের পথরেখাই তৈরি করেছে। এখন সেনাবাহিনী ও উগ্রবাদী বৌদ্ধদের মাধ্যমে সে পথরেখার নির্মম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তারা বলছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে হাজার বছর ধরে বসবাসের পরও যদি রোহিঙ্গারা সেখানকার নাগরিক না হয়, তাহলে উড়ে এস জুড়ে বসা উগ্র মগরাই সেখানকার নাগরিক? প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে রোহিঙ্গারা সেখানে বাস করে আসছেন, সেই মিয়ানমারেই যদি তাদের আবাস না হয়, তাহলে তাদের আবাস কোথায়? এই প্রশ্নটি অং সা সু চিকে করেছেন, শান্তিতে নোবেল জয়ী মালালা ইউসুফজাইসহ অন্য সবাই।
কিন্তু মিয়ানমার সরকার কোনো যুক্তি মানতে নারাজ। এখন তাদের সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে বিনিয়োগ সুবিধালোভী ভারত, চীন ও রাশিয়া। ফলে তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছে। উল্লেখ্য, রাখাইন রাজ্যে ভারত এবং চীন বিনিয়োগ সুবিধা নিচ্ছে মিয়ানমার থেকে। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে রাখাইনে জ্বালানির বিশাল মজুদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর তাতে চীনের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মিয়ানমারের কিয়াউকফিউ বন্দর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিং নগরী পর্যন্ত তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করে চীন। এর মাধ্যমে চীনের জন্য মালাক্কা প্রণালীকে পাশ কাটিয়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় অপরিশোধিত তেল সরবরাহের পথ তৈরি হয়। একইসঙ্গে গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে মিয়ানমারের উপকূলবর্তী ক্ষেত্র থেকে চীনে হাইড্রোকার্বন সরবরাহের পথও উন্মুক্ত হয়। যে সময় এই চীন-মিয়ানমার জ্বালানি প্রকল্প গড়ে উঠছিল, ঠিক একই সময়ে অর্থাৎ ২০১১-১২ খ্রিস্টাব্দে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়।
শুধু রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমরা নয়, মিয়ানমারে সব মুসলিমই নির্যাতিত বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন বার্মা হিউম্যান রাইটস নেটওয়ার্ক (বিএইচআরএন)। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে সব শ্রেণি-পেশার মুসলিমরা সিস্টেমেটিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। ২০১২ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই নির্যাতন-নিপীড়ন কয়েক গুণ বেড়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি মিয়ানমারের অন্যান্য অঞ্চলেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে সরকারের পরিকল্পিত নির্যাতন চলছে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে সব ধরনের নির্যাতনের পেছনে রয়েছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী, বৌদ্ধ মৌলবাদী ও উগ্র জাতীয়তাবাদী নাগরিকরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিগত সহিংসতায় লিপ্ত রয়েছে।
মিয়ানমারে বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ শুরু হওয়ার পর শিল্পাঞ্চল ও অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সে দেশের সরকার রাখাইন রাজ্যকে বেছে নিয়েছে। এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারার মতো সুফল আসবে বলে সামরিক জান্তার মদদপুষ্ট কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের নীতি-নির্ধারক মহলের ধারণা। বহুজাতিক কোম্পানিসহ বিদেশীদের মোটা অঙ্কের পুঁজি বিনিয়োগ যাতে হাতছাড়া না হয় সে লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের হত্যা ও বিতাড়িত করে রাখাইন রাজ্যকে বিনিয়োগবান্ধব করে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা রোহিঙ্গাদের ওপর মরণ কামড় দিয়েছে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হলেও এখন শুরু হয়েছে সমূলে নিধন ও বিতাড়ন প্রক্রিয়া।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে জাতিসংঘ এবং ওআইসিসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তেমন সরব নয়। জাতিসংঘ কিছু নরম বিবৃতি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে। উল্লেখ্য, যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হয়েছে, সেখানে প্রয়োগ করা হয়েছে ‘রেসপনসিবিলিটি টু প্রোটেক্ট’ (আরটুপি) তথা ‘মানবিকতা রক্ষায় হস্তক্ষেপ’ তত্ত্ব। ‘আরটুপি’ তত্ত্ব মূলত জাতিসংঘ কর্তৃক উদ্ভাবিত ও অনুমোদিত। ২০০৫ সালে জাতিসংঘ আয়োজিত বিশ্ব সম্মেলনে এ তত্ত্ব গ্রহণ করা হয়। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নিরীহ জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করা এবং তাদের মানবাধিকার নিশ্চিত করা। সাধারণ ক্ষেত্রে আরটুপি তত্ত্ব সামরিক অভিযান কিংবা বিমান হামলার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবদমান গ্রুপগুলোর মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করে সেখানে নিরপরাধ মানুষদের হত্যার হাত থেকে রক্ষা করা হয়। আরটুপি’র ১৩৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার জনগণকে সব ধরনের গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান থেকে রক্ষা করবে। আরটুপি’র ১৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জাতিসংঘের মাধ্যমে গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান, মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধে কূটনৈতিক, মানবিক উদ্যোগসহ প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ গ্রহণ করবে। উদ্দেশ্য জনগণকে গণহত্যা থেকে রক্ষা করা। লিবিয়া, সিরিয়া, কেনিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই বিধান প্রয়োগ করেছে জাতিসংঘ। অথচ মিয়ানমারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে না। হয়তো রোহিঙ্গারা মুসলিম বলেই জাতিসংঘের এমন নীরবতা।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিমবিশ্বের তৎপরতা নেই কেনো? তুরস্ক, ইরান, ইন্দোনেশিয়া কিছুটা তৎপরতা দেখালেও অন্যরা এখন নীরব। ওআইসি তো ঘুমে আছে। যদি এ অবস্থা চলতে থাকে তাহলে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা আর ফিরে যেতে পারবে না। মিয়ানমারের নীলনকশাই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে। এতে সাফল্য পেলে ফিলিপাইনের মুরু, চীনের উইঘুর, রাশিয়ার চেচেন, ভারতের কাশ্মীরী মুসলমানদের ওপরও জাতিগত নির্মূল অভিযান শুরু হবে। সংগত কারণে এখনই সারা মুসলিম দুনিয়াকে সোচ্চারকণ্ঠ হতে হবে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূল অভিযানের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে আলেমসমাজকেই রাখতে হবে মূল ভূমিকা। এদিকে রাখাইন রাজ্যে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং তাৎক্ষণিকভাবে মানবিক সহায়তা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করতে ইন্দোনেশিয়া মিয়ানমারকে ‘ফর্মুলা ৪+১’ নামে একটি প্রস্তাব দিয়েছে। এ ফর্মুলার চারটি মূল বিষয় হলো, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সর্বোচ্চ সংযম ও অহিংস পন্থা অবলম্বন, ধর্ম ও গোষ্ঠী-নির্বিশেষে রাখাইন রাজ্যে সবার সুরক্ষা এবং জরুরি মানবিক সহায়তা প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি। মিয়ানমারের নেপিডোতে স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির সঙ্গে বৈঠকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি এ প্রস্তাব দেন। অন্য ফর্মুলাটি হলো আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন। ইন্দোনেশিয়ার ‘ফর্মুলা ৪+১’-এর প্রতি বাংলাদেশেরও সমর্থন রয়েছে। আমরা চাই অবিলম্বে রাখাইনে শান্তি ফিরুক। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে বহিরাগত অপবাদ দিয়ে সহিংস পথে উচ্ছেদের এই প্রচেষ্টা খুবই ঘৃণিত। এই তৎপরতা সভ্য ও বিবেকবান মানুষ মেনে নিতে পারে না। এটি মানবসভ্যতার জন্যে চরম কলংকের। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার বহুমাত্রিক প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। কাজেই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই গণহত্যা ও উচ্ছেদকরণের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার হতে হবে।