সম্পাদকীয়

0

আকাশে মহররম মাসের চাঁদ উদিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আরেকটি হিজরি বর্ষের সূচনা। কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনায় সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে গেল ১৪৩৮ হিজরি। স্বাগতম হিজরি নববর্ষ ১৪৩৯। মহররম হিজরির প্রথম মাস হিসাবে আলাদা বৈশিষ্টের দাবিদার হলেও এ মাসকে কেন্দ্র করে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। বিশেষ করে মহররমের ১০ তারিখ অর্থাৎ আশুরার দিনে রয়েছে উল্লেখযোগ্য বহু ঘটনাপ্রবাহ। এগুলোর মধ্যে বিশে^র মানুষের মনে বেশি নাড়া দিয়েছে কারবালার হৃদয়বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা। যে স্মৃতি এখনো মানুষের অন্তরকে বিষাদের কালো মেঘে ঢেকে দেয়। সৃষ্টির আদিকাল থেকে চলে আসছে বিশে^ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব। আল্লাহর পরীক্ষিত বান্দারা এ সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্বীকার করেছে নজিরবিহীন ত্যাগ। ৬১ হিজরির ১০ মহররম এমন এক পরীক্ষার মুখোমুখী হয়েছিলেন নবী করিম (দ.) এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রাদি.)। ইসলামের সুশোভিত বাগানকে স্বৈরাচার দুরাচার ও পাপিষ্ঠ ইয়াজিদের খপ্পর থেকে রক্ষার জন্য এদিনে তিনি এবং পরিবারের সদস্য ও সহচরদের নিয়ে ৭২ জনের ক্ষুদ্র অথচ ঈমানী তেজে উজ্জীবিত দল বিশাল বাহিনীর সাথে লড়ে অবশেষে শাহাদতের সুধা পান করেন। এ বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে তিনি এ শিক্ষা দিয়ে গেছেন একজন মুসলমান মাত্রই অন্যায়-অবিচার, স্বেচ্ছাচার, জুলুম, অরাজকতা ও ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে মাথা নত করতে পারে না। দুরাত্মা ইয়াজিদের প্রেতাত্মারা বর্তমানেও বিশে^ সক্রিয়। বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের উপর নির্যাতন নিপীড়নে নিত্য নতুন কারবালার সৃষ্টি করছে। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, বসনিয়া-চেচনিয়ার পর বর্তমান মিয়ানমার মুসলিমদের উপর সবচে নৃশংসতম বর্বর হত্যাযজ্ঞ চলছে। এ অত্যাচার নিপীড়ন নির্যাতন রুখতে বিশ^ মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কারবালার চেতনাকে ধারণ করতে হবে।
রোহিঙ্গা নিপীড়ন নির্যাতন হত্যা সাম্প্রতিক বিশে^র সবচে বর্বরতম ঘটনা। রোহিঙ্গাদের গুলি করে হত্যা, তাদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, যুবক ও শিশুদের আগুনে নিক্ষেপ করে মারা, মহিলাদের গণধর্ষণ ও হত্যা ইত্যাদি ঘটনা আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক নিহতের সংখ্যা এর মধ্যে ১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এটা নিঃসন্দেহে জাতিগত নিধনই। বস্তুত বসনিয়ার সেব্রোনিৎসার মুসলিম গণহত্যার মতোই অথবা তার চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর বর্তমানের রোহিঙ্গা নিধন। বাংলাদেশে এর মধ্যে পালিয়ে এসেছে চার লাখ রোহিঙ্গা। ফলে এদেশের জন্য তৈরি হয়েছে কঠিন চাপ। ইউরোপের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোতে যেখানে হাজারের হিসাবে শরণার্থী ঢুকলেই চোখ কপালে উঠে, সেখানে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অর্থনীতির বাংলাদেশে পূর্বের ৫-৬ লাখের সাথে যুক্ত আরও ৪ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে। তাদের আশ্রয় দিয়ে মানবাধিকার প্রশ্নে বাংলাদেশ উচ্চমাত্রার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ চাপ বাংলাদেশ কতকাল বহন করতে পারবে? আর এ দায় কি শুধু বাংলাদেশের? ঘটনাচক্রে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় প্রাণের ভয়ে বিপদাপন্ন রোহিঙ্গারা এখানে প্রবেশ করছে। এর মানে এই নয় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার রক্ষায় এবং বাংলাদেশের দুর্দশায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে না। রোহিঙ্গারা শুধু মিয়ানমারের অধিবাসী নয়, তারা বিশ^বাসীরই অংশবিশেষ এবং নিপীড়িত অংশ বটে। মিয়ানমার সরকার আরাকান রোহিঙ্গাদের নয়- দাবি করে সেখান থেকে তাদের পৈশাচিক পন্থায় বিতাড়িত করছে। তারা বাস্তব ইতিহাসকে অস্বীকার করছে। অথচ সেখানে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস শত শত বছরের। খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ১৫০০ বছর আগে তাদের পূর্বপুরুষরা আরাকান রাজ্যে পূর্ব ভারত থেকে এসে বসতি গড়ে তোলে। ১৭০০-১৮০০ সালের দিকে আরব ব্যবসায়ীরা আসেন আরাকানে। বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে মানুষ বাণিজ্য সংক্রান্ত বিষয়ে আরাকান আসে। এরমধ্যে ভারতীয়, বাঙালি, আরব পার্শিয়ান, আফগান, পর্তুগীজ ছাড়াও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এসেছে। তখন এ আলাদা আলাদা জনগোষ্ঠী আরাকানের স্থানীয় মানুষের সাথে মিশে যায়। রোহিঙ্গা প্রশ্নে প্রয়োজন ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা। যে সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা বাংলাদেশের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। এর মোকাবিলায় অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিভিন্ন দেশের সাথে কথা বলে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা এবং মিয়ানমার সরকারের মিথ্যাচার খণ্ডন করা দরকার। এ সংকটের স্থায়ী সমাধানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দাতা অন্য দেশগুলোকে নিয়ে বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করতে পারে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দানকারী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থাইল্যান্ড ও ভারতসহ মিয়ানমার সংকট নিয়ে কথা বলা পশ্চিমা দেশগুলো নিয়ে এ সম্মেলনের আয়োজন করা যেতে পারে।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের কয়েকদিন পর নতুন করে রোহিঙ্গা নির্যাতন ও বিতাড়ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আনান কমিশনের রিপোর্ট সামনে রেখেই এ সম্মেলন হতে পারে। আমরা মনে করি আনান কমিশনের রিপোর্টের আলোকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে সম্পৃক্ত করার এটাই উপযুক্ত সময়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আমরা স্থায়ী সমাধান চাই, কোন মলমী সমাধান নয়। জরুরি ভিত্তিতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আবাসস্থল ও অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যেমন সম্মিলিত প্রয়াস দরকার, তেমনি প্রয়োজন রোহিঙ্গাদের সসম্মানে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা।
মহান বব্বুল আলামীনের অশেষ রহমতে মাসিক তরজুমান এ সংখ্যা থেকে পদার্পণ করছে নিয়মিত প্রকাশনার ৩৯তম বর্ষে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পত্রিকা ইসলামী মূল্যবোধ সৃষ্টি, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের আদর্শ তুলে ধরা, ঈমান আকিদা দৃঢ়করণে ও কাদেরিয়া সিলসিলার প্রসারে কার্যক্রম চালিয়ে আসছে। সুন্নি জামাতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকা হিসাবে এটা শুধু বাংলাদেশে নয় বহির্বিশে^ও সমাদৃত হচ্ছে। আজকে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত, মোর্শেদে বরহক হজরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ (রহ.) কে, যাঁর প্রেরণা ও দিকনির্দেশনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে হক পন্থিদের আলোর দিশারী এ পত্রিকা।
যারা মূল্যবান লেখা দিয়ে মাসিক তরজুমানকে সমৃদ্ধ করছেন, যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে সহযোগিতা করছেন এবং যারা এটার বিপণনে, প্রচার-প্রসারে সহায়তা দিচ্ছেন তাদের জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। আগামীতেও এ সহযোগিতার হাত আরো প্রসারিত হবে- এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি। হিজরি নববর্ষ ও মাসিক তরজুমান এর ৩৯ বছরে পদার্পণে সম্মানিত পাঠক, লেখক, গ্রাহক, এজেন্ট, বিজ্ঞাপনদাতা ও শুভানুধ্যায়ীদের জানাই হৃদয় নিংড়ানো শুভেচ্ছা। সবাইকে মোবারকবাদ। কামনা করি, সকলের সুন্দর, সুখ-শান্তিময় নিরাপদ জীবন।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •