সিরিকোট শব্দটি বিবর্তিত হয়েছে ‘সের-ই-কোহ্’অর্থাৎ পর্বতশীর্ষ শব্দ থেকে। বর্তমান পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশের যে পাহাড়-পর্বতঘেরা অঞ্চলের সর্বোচ্চ স্থানে এই জায়গাটি রয়েছে এর নাম ‘কোহে গঙ্গর’অর্থাৎ গঙ্গর উপত্যকা। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। এ পাহাড় দেশের উপরে আরো উপরে যাওয়ার পর শীর্ষেই সিরিকোট শরীফ। গাউসে যামান, পেশোয়ায়ে আহলে সুন্নাত, আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মাযার শরীফ ঠিক এখানেই। একদিন পাহাড় ঘেরা এই অঞ্চলের মাথার ওপরই হয়েছিল তাঁর জন্ম। যেখান থেকে আজ সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া তথা শাহেনশাহে বাগদাদ গাউসুল আজম আবদুল কাদের জিলানী রদিয়াল্লাহু আনহুর পতাকা হাতে তিনি আমাদের এই অঞ্চল পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিলেন। এই গঙ্গর উপত্যকা এক সময় ছিল অমুসলিমদের অধিকারে। এর অন্ধকার দূর করতেই একদিন সেখানে স্থায়ী আস্তানা স্থাপন করেছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষগণ। তাঁরা এর পূর্বে আফগানিস্তান এসেছিলেন বাগদাদ শরীফের নিকটস্থ ‘আউস’নামক অঞ্চল থেকে। এরও আগে তাঁদের ঠিকানা ছিল মদীনা শরীফ। তাদের যে মহাত্মা পূর্বপুরুষ সর্বপ্রথম ৪০০ হিজরীতে ইসলাম প্রচারের কাজে আফগানিস্তান এসেছিলেন তাঁর নাম ‘হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ গীসুদারাজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি’। ইমাম হুসাইন রদিয়াল্লাহু আনহুর বংশধর এই আওলাদে রসূলর বংশধরগণ সমগ্র আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্ত প্রদেশব্যাপী বসতিস্থাপন করেছে শত শত বছর ধরে এবং এদের মধ্যে শত শত অলি আল্লাহ্ ছিলেন যাঁদের হাতে উক্ত এলাকায় সেই সময় (৪০০-৪২১ হিজরী) থেকে এ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল ইসলামের এক বিশাল খিদমত হয়ে আসছে।
ইতিহাসের আলোকে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচারে সফলতা এনেছিলেন হযরত খাজা গরীবে নাওয়াজ রহমাতুল্লাহি আলাইহি। অথচ, এরও শত বর্ষ আগে শাহেনশাহে সিরিকোট রহমাতুল্লাহি আলাইহির পূর্বপুরুষ গীসুদারাজ আওয়াল এখানে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটিয়ে ছিলেন। আজও তাঁর বংশধরগণ ইসলামের বিশাল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন পূর্বপুরুষদের মতো। বিগত শতাব্দিতে তাঁর যে উত্তরাধিকারের হাতে ইসলামের এক বিশাল উন্নতি সাধিত হয়েছিল। তিনি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ৩৯তম অধঃস্তন বংশধর। হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি (১৮৫৭-১৯৬১ খ্রি.)। পারিবারিক তত্বাবধানে প্রাথমিক শিক্ষা, নিকটস্থ পাঞ্জাবের ছসজিলআটকের একটি মাদরাসা থেকে হিফজ শেষ করে তিনি ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কোরআন-সুন্নাহর উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে প্রাতিষ্ঠানিক সর্বশেষ সনদ অর্জন করেন ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষেই তিনি একই মাসওয়ানী আওলাদে রসূল পরিবারের এক মহীয়সী কন্যা সৈয়্যদা খাতূনের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর এক পর্যায়ে বংশীয় ঐতিহ্য অনুসরণ করে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে চলে যান দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে তিনি হালাল ও সুন্নতি রুজির জন্য ব্যবসায় এবং স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ বেদ্বীনদের মধ্যে দ্বীনি তাবলীগ শুরু করে এতটা সফল হয়েছিলেন যে, দলে দলে এক বিশাল জনগোষ্ঠী তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়। হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি অন্ততঃ ১৬ বছরের মতো অবস্থান করে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টাউন, মোম্বাসা, জাঞ্জিবারসহ বিভিন্ন এলাকায় সফলভাবে ইসলাম প্রচার শেষে দেশে ফিরে আসবার প্রাক্কালে নবদীতি মুসলমানদের জন্য ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে সেখানকার সর্বপ্রথম জামে মসজিদটি নিজ হাতে নির্মাণ করে আসেন। যা, ড. ইব্রাহীম এম. মাহ্দী রচিত ‘এ শর্ট হিস্টোরী অব মুসলিমস ইন সাউথ আফ্রিকা’গ্রন্থসূত্রে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের কয়েকজন খ্যাতনামা লেখক ও দ্বীনী ব্যক্তিত্ব যেমন- আল্লামা আবদুল হাকিম শরফ কাদেরী রহমাতুল্লাহি আলাইহি, আল্লামা সৈয়দ আমির শাহ্ জিলানী, প্রফেসর ড.মাসঊদ আহমদসহ অনেকেই তাঁর আফ্রিকায় ইসলাম প্রচার বিষয়ক তথ্য তাঁদের গ্রন্থে তুলে ধরেছেন।
আফ্রিকা থেকে ফিরে এসে তাঁর তাপসী বিবি সৈয়্যদা খাতূনের প্রেরণায় এক সময় পৌঁছে যান তাঁর পীর গাউসে দাওরাঁ খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর সান্নিধ্যে। প্রথম দর্শনেই অন্যন্ত দূরদর্শী চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই হীরক খন্ডকে দেখে তাঁর ভিতরের হুসাইনী রক্তের মহাশক্তি সম্পর্কে টের পেয়ে যান এবং অত্যন্ত হিকমত সহকারে বুকে টেনে নেন। হরিপুর বাজারে কাপড়ের দোকান এবং নিকটস্থ দরবারের পীর খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির সাক্ষতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতেই পথিমধ্যে এক তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎ ঘটে গেল দু’জনায়। যেন দু’জনেই দু’জনকে ঠিক ঠিক চিনে ফেললেন। যদিওবা ইতোপূর্বে কখনো দেখা হয়নি।
দরবারের বাইরে কাজে ব্যস্ত নূরানী লোকটিকে দেখে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বললেন হযরত সিরিকোটী। আর উত্তরে এক বিশেষ চাহনী ভঙ্গি এবং সূরে খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন ‘ওয়া আলাইকুমুস্ সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহূ’। শুধু সালামের জবাব দিয়ে শেষ করেন্ নি, এরপরই জিজ্ঞেস করলেন, ‘চান্দে কেত্তে আয়ে’ পাঞ্জাবী ভাষার এই কথার অর্থ হলো, এই চাঁদের মতো মানুষটি আপনি কোত্থেকে এসেছেন?। চাঁদ বদন এ আউলাদে রসূল উত্তর দিলেন। ‘গঙ্গর ছে’ অর্থাৎ গঙ্গর উপত্যাকা থেকে এসেছি। কি করেন, কেন এসেছেন জিজ্ঞেসে তিনি উত্তর দিলেন যে, নিকটস্থ হরিপুর বাজারে একটি দোকান দিয়েছেন নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। প্রতি উত্তরে চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন, তাহলে তো ভালো কথা, আমি আমার লোকদের বলে দেবো যে, হরিপুর বাজারে ‘আমার’ একটি দোকান আছে এবং তারা যেন সেখান থেকে কেনাকাটা করে। সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ক্রমশই দুর্বল হতে লাগলেন চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র এক একটা কথা শুনতে শুনতে। যেন বড়ই আপনজন। এবার সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী করছিলেন এখানে? উত্তর এলো একটি নয়া মসজিদ তৈরির কাজ করছিলাম। সিরিকোটী হুজূর পকেট থেকে একটি টাকা বের করে তাঁর হাতে দিলেন এবং বললেন এ দ্বীনী কাজে তাঁকে শরীক করতে। খুব আগ্রহ সহকারে এই টাকা কবুল করে মুনাজাত করলেন খাজা চৌহরভী। এভাবে শুরু হল প্রথম দিনের রহস্যভরা কথোপকথন এবং তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎ পর্ব। ……. তাই প্রথম দিনেই যেন অর্ধেক কাজ হয়ে গেল। এতোদিন যাঁর দরবারে আসতে এতো আপত্তি আজ থেকে সে দরবার ছাড়া যেন জীবনই অসার হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর। পোশাকী ব্যবসা লাটে ওঠল আর জমে ওঠল প্রেম বাজার আর সেই বাজারে আল্লামা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেকে বিক্রি করে দিলেন চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির করতলে। নিজের বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট রাখলেন্ না। আমিত্ব, অহঙ্কার ধুলোয় মিশে গেল। ১৮ মাইল দূরে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে সিরিকোটের পাহাড় থেকে লাকড়ি নিয়ে নিজ কাঁদে করে পৌঁছাতেন চৌহর শরীফের লঙ্গরখানায়। এভাবে বহু বছর একটানা। এই প্রেম বাজারের বাইরের দর্শকরা এমন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব সৈয়্যদ জাদা, বিখ্যাত আল্লামা, হাফেজ, ক্বারী অধিকন্তু আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসায়ীর ঘাড়ে লাকড়ি দেখে কেউ হাসলো, আবার কেউ আফসোস করলো, কেউ হলো হতবাক। ফানাফিস্ শায়খ এর স্তর অতিক্রম করে ‘ফানা ফির রসূল’র স্তরে উন্নীত হতে তিনি দেহ-মন-আত্মা দিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমেছিলেন যেন। শুধু দুনিয়াবী লোভ-লালসা নয়, এমনকী বহির্জগতের মোহ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন পীরের ভালবাসার কাছে। এ জন্য হযরত খিজির আলাইহিস্ সালাম এর মত এক বিরল আধ্যাত্মিক সত্ত্বাকে হাতের কাছে পেয়েও তিনি ভ্রুপেও করেন্ নি সেদিকে। কারণ, তাঁর পীর খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’ই হয়ে ওঠেছিলেন তাঁর জীবন-মরন-আখিরাত সবকিছু। পীর খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির প্রতি তাঁর আত্ম্যোৎসর্গ কোন পর্যায়ের তা বুঝানোর জন্য উপমহাদেশের খ্যাতনামা ইসলামী চিন্তাবিদ এবং শতাধিক গন্থের প্রণেতা আল্লামা আবদুল হাকিম শরফ কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান রহমাতুল্লাহি আলাইহি রচিত ‘শরহুল হুকূক’নামক গ্রন্থের উর্দূ অনুবাদের ভূমিকায় প্রসঙ্গক্রমে বলেন, হযরত সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর পীরভক্তি ছিল ঠিক সেই মজযূব অলীর মতোই যে কিনা হযরত নিজাম উদ্দীন মাহবূবে ইলাহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র পালকীর নিচে অবস্থান নিয়েছিল। কথিত আছে, উক্ত মজযূব একটি মাসআলার উত্তর জানতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আর এমন এক ব্যতিব্যস্ত অবস্থায় নিজাম উদ্দীন মাহবূবে ইলাহী রহমাতুল্লাহি আলাইহি পালকিতে চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। উক্ত মজযূব এ সময় কোন এক কারণে তাঁর পালকীর নিচে আশ্রয় নিতেই উক্ত মাসয়ালাটির উত্তর তাঁর জানা হয়ে যায় এবং সাথে সাথে উক্ত মজযূব অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও উৎফুল্ল চিত্তে বলে ওঠেন যে, আমার পীর সাহেবের বদৌলতেই এই নেয়ামত লাভ করেছি। অর্থাৎ এটা মাহবূবে ইলাহী নয় বরং তাঁর পীরের মেহেরবানী ছিল। প্রকৃত অর্থে, সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহিও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে পীরের জন্য এমনভাবে উৎসর্গ করেন্ যে, শেষ পর্যন্ত পীর আর তাঁর সম্পর্ক হয়ে যায় দেহ আর প্রাণের সম্পর্কের মতো। সূফী কবির ভাষায়- মান তূ শুদম তূ মান শুদী, মান তন শুদম তূ জাঁ শুদী, তু কছ না গুয়দ বা‘দ আযীঁ, মান দীগরম তূ দি গরী। অর্থাৎ তুমি আমি হলে, আমি হলাম তুমি; আমি শরীর হলাম আর তুমি হলে প্রাণ; কেউ আর না বলে যেন তুমি আর আমি পৃথক সত্ত্বা।’’ এ কথাটি চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজেও তাঁর আখেরী চিঠিতে সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন- যখন সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর পীরের অবর্তমানের অসহায়ত্বের আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন যে- ইঞ্জিন থেকে বগি আলাদা হয়ে গেলে বগির অবস্থা কি হবে? খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি উত্তরে বললেন- ‘মান তু শুদম’ কবিতাটি, অর্থাৎ কে বলছে তুমি আর আমি দু’জনা। সত্যিকার অর্থেই সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র প্রধান খলিফাই ছিলেন্ না বরং ছিলেন তাঁর সফল রহস্য ও ফুয়ূজাতের উৎস স্থল- (আল্লামা শরফ কাদেরী)। আপন মুর্শিদের সন্তুষ্টি এবং আধ্যাত্মিক মতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি যখন শরীয়ত-তরীকতের এক বিশাল মিশনের নেতৃত্বের যোগ্যতা অর্জন করলেন, তখন তাঁকে খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি নির্দেশ দিলেন এই মিশন নিয়ে রেঙ্গুন যেতে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যখন সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করেন তখন তাঁর বয়স ষাটের উপর। এমন বয়সে মানুষ বিদেশ থেকে ঘরে ফিরে আসে। জীবনের শেষ সময়ে একটু বিশ্রাম নিতে। অথচ তিনি করলেন উল্টোটা। আশি বছর বয়স পর্যন্ত তিনি রেঙ্গুনে থেকে এবং শত বছর বয়স পর্যন্ত চট্টগ্রামে আসা-যাওয়া করে সুন্নিয়ত ও সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার এক নজির বিহীন খিদমত আঞ্জাম দেন।
১৯২০ থেকে ১৯৪১ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ বাইশ বছরে রেঙ্গুনের হাজার হাজার স্থানীয় বার্মিজ নাগরিক এবং বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এসে কর্মরত প্রবাসীদের মধ্যে অসংখ্য অমুসলিম-মুসলিম নির্বিশেষে তাঁর আধ্যাত্মিক ও অলৌকিক আকর্ষণে উপকৃত হয়েছিলেন। এদের কেউ ভিন্ন ধর্ম থেকে ইসলামে আবার কেউ অন্ধকার জীবন থেকে আলোর দিকে ফিরে এসেছিলেন। রেঙ্গুনের বিখ্যাত বাঙালী মসজিদের ইমামত ও খেতাবতের পাশাপাশি রেঙ্গুনসহ সমগ্র ব্রহ্মদেশে সত্যিকারের দ্বীন ও তরীক্বতের প্রসার ঘটাতে সম হয়েছিলেন যা এখনো পর্যন্ত সেখানে বিদ্যমান। এ সময় সমগ্র রেঙ্গুনে তাঁর অসংখ্য কারামাতের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং দলে দলে লোকজন তাঁর কাছে এসে দুনিয়া-আখিরাতের অমূল্য নিয়ামত লাভে ধন্য হয়। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের অপ্রতিদ্বন্ধি মুজাহিদ আলেমে দ্বীন, ইমামে আহলে সুন্নাত, মুজাদ্দিদে মিল্লাত হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ আযীযুল হাক্ব শেরেবাঙালা রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর রেঙ্গুন সফরের সময় কুতুবুল আউলিয়া, গাউসে যামান আল্লামা শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি সম্পর্কে লোকজনের কাছে জানতে পেরে বাঙালি মসজিদে গিয়ে তাঁর সাথে মুলাক্বাত করেন এবং দীর্ঘণ আলাপ-আলোচনা ও পর্যবেণের পর তাঁর মধ্যে বিশাল বেলায়তী মতা অবলোকন করে তিনি তাঁকে চট্টগ্রামে তাশরীফ আনার জন্য অনুরোধ জানান। এ ছাড়াও চট্টগ্রামের সংবাদ শিল্পের পুরোধা দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মাস্টার আবদুল জলিলসহ চট্টগ্রাম নিবাসী তাঁর অসংখ্য মুরীদের আবেদন-নিবেদন উপো করতে না পেরে পরবর্তীতে ১৯৩৫-৩৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি রেঙ্গুন থেকে পাকিস্তান যাওয়ার পথে চট্টগ্রামে কিছু দিনের জন্য যাত্রা বিরতি করতেন। এ কয়েক দিনের যাত্রা বিরতিতে ও তাঁর অলৌকিক শক্তির আকর্ষণে এখানকার মানুষ আকষ্ট হতে থাকে এবং এখানে তাঁর মুরীদ’র সংখ্যা বাড়তে থাকে দিন দিন।
এভাবে, ১৯৪১ এর শেষ দিকে এসে তিনি রেঙ্গুন থেকে স্থায়ীভাবে এই মিশন নিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল এবং বার্মা ছিল অত। কিন্তু আল্লাহর এ মহান অলী হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর অলৌকিক অদৃশ্য শক্তিতে দেখলেন যে, শিগগিরই রেঙ্গুন শহরে বোমা হামলায় তছনছ হয়ে যাবে এবং অসংখ্য লোকের প্রাণহানি ও সম্পদহানি ঘটবে। তিনি তাঁর মুরীদ এবং পরিচিত সকলকে দ্রুত রেঙ্গুন ত্যাগের নির্দেশ দেন এবং নিজেও রেঙ্গুন ছেড়ে চলে আসেন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে রেঙ্গুনে বিদ্যমান গাউসে জমান আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর খলিফা ইসমাঈল বাগিয়া সাহেব জানান যে, তাঁর আব্বা হাফেজ মুহাম্মদ দাঊদ জী বাগিয়া উক্ত নির্দেশ পেয়ে ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে তাদের পুরো পরিবার নিয়ে রেঙ্গুন ছেড়ে লৌèৌতে নিজ দেশে ফিরে আসেন। অন্যান্যরাও চলে যান যার যার দেশে। আর ২৩ ডিসেম্বর ১৯৪১ তারিখে রেঙ্গুন শহরে বোমা বর্ষণ শুরু হয়। অপর একটি বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায় যে, শেষের দিকে হুজূর কেবলা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি রেঙ্গুন ছাড়বার সময় তাঁর খাদেম ফটিকছড়ি নিবাসী মরহুম ফজলুর রহমান সরকারকে রেখে আসেন তাঁকে হুজূর কেবলার বিছানায়। আরো তিন দিন থাকার পর রেঙ্গুন ছাড়ার পরামর্শ দেন। ফজলুর রহমান সরকার নির্দেশমত তিন দিন থেকে চলে আসেন এবং এর পরপরই বোমা বর্ষণ শুরু হয়। যারা হুজূর কেবলার নির্দেশ মেনে এবং বিশ্বাস করে রেঙ্গুন ছেড়েছিল তাদের সকলের প্রাণ বেঁচে যায় এবং সম্পদও রা পায় অনেকাংশ। আর অন্যদের অবস্থা হয় বিপরীত ধরণের। শেষ পর্যন্ত সকলকেই রেঙ্গুন ছাড়তে হয়েছিল যুদ্ধের ভয়াবহতা শুরু হবার পর, কিন্তু তাদের কেউ আর স্বাভাবিক এবং সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পারেনি। হেটে হেটে আসবার সময় অনেকে পথিমধ্যেই ক্ষুধায় এবং শক্তিহীন হয়ে মারা যান।
যা হোক, তাঁর রেঙ্গুন জীবনের শুরুতে ১৯২৪ সালের দিকে তাঁর পীর খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁকে স্থলাভিষিক্ত করে শরীয়ত-তরীক্বতের বিশাল দায়িত্ব এবং আধ্যাত্মিক মতা প্রদান করে দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নেন। পীরের ইন্তিকালের পরপরই তিনি উক্ত অর্পিত দায়িত্বাবলী যথাযথভাবে আঞ্জাম দেয়ার লক্ষে তাঁর পীরের নামেই একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯২৫ সনের ১৫ ফেব্র“য়ারী ‘আন্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া’ নামক এই সংস্থা স্থাপিত হলে খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রতিষ্ঠিত হরিপুরস্থ রহমানিয়া মাদরাসা পরিচালনা, তাঁর রচিত ৩০ পারা বিশিষ্ট দরূদ শরীফের অদ্বিতীয় কালজয়ী গ্রন্থ ‘মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ প্রকাশনা সহ যাবতীয় দায়িত্ব এ সংস্থা কর্তৃক সুচারুরূপে পরিচালিত হতে থাকে। ‘আন্জুমান-এ-শুরায়ে রহমানিয়া’রেঙ্গুন’র চট্টগ্রাম শাখা স্থাপিত হয় ১৯৩৭ সনের ২৯ আগস্ট একই উদ্দেশ্য আঞ্জাম দেয়ার প্রয়োজনে। শুরুতে এ সংস্থা রেঙ্গুনের শাখা হিসেবে কাজ শুরু করলেও ১৯৪২ থেকে চট্টগ্রামের এই সংস্থাই হয়ে ওঠে হুজূর কেবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মিশনের প্রধান অবলম্বন। ১৯৪২-১৯৫৪ পর্যন্ত অন্তত: ১২ বছর পর্যন্ত এই সংস্থার মাধ্যমেই চট্টগ্রাম থেকে আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হতো হরিপুরের রহমানিয়া মাদরাসার জন্য। সুন্নিয়ত ও তরিক্বতের অন্যান্য কাজও এ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হতো। পঞ্চাশের দশকে এসে বাঁশখালির শেখেরখীলের এক মাহফিলে দরূদ শরীফ বিরোধীদের বেআদবীপূর্ণ আচরণের প্রতিক্রিয়ায় সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি চট্টগ্রামে এদের মোকাবেলার জন্য একটি শক্তিশালী মাদরাসা কায়েম করার ঘোষণা দেন। ১৯৫৪ সনের ২২জানুয়ারী এই নয়া মাদরাসা বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয় ‘আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামক অপর এক সংস্থা। সিরিকোটী হুজূরের উপস্থিতিতে এই নয়া আন্জুমানের ১৭ ফেব্র“য়ারী ১৯৫৪ তারিখের এক ঐতিহাসিক সভায় প্রস্তাবিত মাদরাসার নাম রাখা হয় ‘মাদরাসা-এ-আহমদিয়া সুন্নিয়া’ ২৫ জানুয়ারী ১৯৫৬ তারিখের এক সভায় এ মাদরাসাকে পর্যায়ক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার লক্ষে মাদরাসার নামের সাথে “জামেয়া” (বিশ্ববিদ্যালয়) শব্দটি যুক্ত করে এ মাদরাসার নাম রাখা হয় ‘ জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’। চট্টগ্রামের ষোলশহরে স্থাপিত এই মাদরাসা আজ অর্ধশতাব্দিকাল ধরে দেশে সুন্নিয়তের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। ১৮ মার্চ ১৯৫৬ তারিখে ইতিপূর্বে গঠিত আন্জুমান দ্বয়ের পরিবর্তে ‘আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া’ নামক নতুন একক আন্জুমান প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এই আন্জুমান দেশের প্রধান বেসরকারী দ্বীনী সংস্থা হিসেবে সর্বমহলে পরিচিত। আন্জুমান পরিচালিত এই ‘জামেয়া’কে এশিয়ার অন্যতম খ্যাতনামা সুন্নি মারকাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জামেয়ার এতটুকু সফলতার কারণ হলো এই প্রতিষ্ঠানটি আল্লাহর দরবারে কবূল হয়েছে।
জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রোপট এবং ল্য বিবেচনায় দেখা যায়- বাঁশখালীর এক মাহফিলে হুজূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দরূদ-সালামকে ইনকার করার তীব্র প্রতিক্রিয়া হিসেবে এদের বিরুদ্ধে আদর্শিক মেধাভিত্তিক লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রস্তুতি হিসেবেই তৎকালীন ‘নয়া মাদরাসা’ এই জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জায়গা নির্ধারণ, ভিত্তি স্থাপন থেকে শুরু করে এর যাবতীয় পদপে নেয়ার ক্ষেত্রে হযরত সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি যেন অদৃশ্য কারো ইঙ্গিতের অনুসরণ করছিলেন। তাঁর ঘোষণা অনুসারে “শহর ভি নাহো, গাঁও ভি নাহো, মসজিদ ভি হ্যায়, তালা-ব ভি হ্যায়” এমন ধরণের জায়গাটি যখন অনেক যাঁচাই-বাছাই শেষে চট্টগ্রাম ষোলশহরস্থ বর্তমানের মাদরাসা এলাকাটি নির্ধারণ করা হয়। তখন এর মাটি থেকে ইলমে দ্বীন’র সুগন্ধি পাওয়া গিয়েছিল।
এই মাদরাসার পৃষ্ঠপোষকতা কে কোত্থেকে করবেন সে সম্পর্কে তিনি অনেক রহস্যময় মন্তব্য করেছিলেন। কেয়ামত পর্যন্ত এই মাদরাসা পরিচালনার ভার স্বয়ং আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছেন বলে তিনি তাঁর মুরীদদের অভয় দেন। তিনি বলেন- “আমার কানে আওয়াজ আসছে যে, ইয়ে নয়া মাদরাসা হাম খোদ চালাওঙ্গা” অর্থাৎ এই নতুন মাদরাসা আমি নিজেই চালাবো। সত্যিকার অর্থেই এই মাদরাসা চলছে যেন অদৃশ্য শক্তির ব্যবস্থাপনায়। টাকা-পয়সা যখন যা প্রয়োজন তা ভাবনা-চিন্তা করতে না করতেই চলে আসছে। শুধুমাত্র মাদরাসার টাকা নেয়ার জন্যই আজ আলাদা অফিস খুলে বসতে হয়েছে। কত চেনা-অচেনা লোক এসে হাদিয়া, সদক্বা, মান্নত, নিয়্যতের টাকা, যাকাত-ফিতরা ইত্যাদির টাকা দিয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। মান্নতকারীদের আশাভঙ্গ করেনা এই জামেয়া -তাই, আজ জামেয়া মান্নত পূর্ণ হওয়ার কথা মানুষের মুখে মুখে। শাহ্ সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছিলেন- “মুঝেহ দেখনা হ্যায় তো, জামেয়া কো দেখো, মুঝসে মুহাব্বত হ্যায় তো, জামেয়া কো মুহাব্বত করো।”ভ্রান্ত মতবাদীদের বিরুদ্ধে ইসলামের মূলধারা সুন্নিয়তকে বিজয়ী করতে ইশ্ক্বে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ভিত্তিতে এই মাদরাসা তৈরি করেছিলেন। ফলে, আজ ভেজাল থেকে আসল ইসলামকে রার অতন্দ্র প্রহরী ‘সাচ্চা আলেম’ বের হচ্ছে এই মাদরাসা থেকে।
আল্লামা সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি জামেয়ার কারিকুলাম সম্পর্কে বলেন, এই মাদরাসায় প্রয়োজনীয় সকল ভাষাজ্ঞানসহ বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়গুলোর উপরও শিা দিতে হবে। তিনি ভবিষ্যতে ইউরোপ-আমেরিকায় ইসলাম প্রচারে সম হয় এমন ইংরেজী ও জ্ঞান বিজ্ঞানে দ সুন্নী আলেম তৈরির জন্য এই জামেয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল জামেয়ার সাচ্চা আলেমরা শুধু মোল্লা না হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখা-প্রশাখায় পারদর্শী হয়ে বহির্বিশ্ব পর্যন্ত যেন ইসলামের সঠিক আক্বীদা ও মূল্যবোধের বিস্তার ঘটাতে সম হন। সিরিকোটী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সময় বলেছিলেন, তোমরা ত্রিশ বছর পর্যন্ত হরিপুর রহমানিয়া মাদরাসার খিদমত করেছো। তাই, তোমাদের জন্য এই নয়া মাদরাসা (জামেয়া) দেয়া হয়েছে। যদি এই জামেয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে আঞ্জাম দাও তবে জেনে রেখো, এরপর তোমাদের জন্য আরো অনেক বড় বড় দায়িত্ব অপো করছে। আর এই বড় দায়িত্ব যে ‘হুকুমত’ তাও তিনি কয়েক দফা উল্লেখ করেছেন। সুতরাং, মনে হচ্ছে, এখনো আমরা এই দায়িত্ব কাক্সিতভাবে পালন করতে পারিনি, তাই আজ হুকুমতও আমাদের হাতে নেই। কারণ, হুকুমতের যোগ্য লোক এখনো আমরা তৈরি করতে সম হইনি। তাই, আমাদের এই লক্ষে এগিয়ে যাওয়া উচিত।