ছালেহ্ আহমদ সওদাগর রহমাতুল্লাহি আলায়হি স্মরণে

0

রাউজান উপজেলার সর্ব দক্ষিণপ্রান্ত ঘেঁষে ঐতিহাসিক কর্ণফুলী নদী আসামের লুসাই পাহাড় হতে সৃষ্ট নদী চট্টগ্রাম জেলার মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হয়েছে যে নদী তাঁর নাম কর্ণফুলী। আর নদী তীরবর্তী একটি বর্ধিষ্ণু জনপদের নাম নোয়াপাড়া। নোয়াপাড়া কেন নাম হল এটার সঠিক ইতিহাস গবেষকরা এখনো খুঁজে বের করতে পারেননি। তবে অত্র এলাকায় অতীতে বহু স্বনামধন্য, বিপ্লবী, কবি ও ধার্মিক ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, যাদের অনেকের খ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ কর্ণফুলী তীর সংলগ্ন দক্ষিণ নোয়াপাড়ার এক ধার্মিক পরিবারে মরহুম হাজি ইসমাইল ছাহেবের ঐরসে এক শিশু জন্মগ্রহণ করেন। (২১ মার্চ ১৯২১ খ্রষ্টাব্দে) পারিবারিকভাবে ১ম সন্তানের নাম রাখা হল ‘ছালেহ্ আহমদ’। বর্তমানে ঐ বাড়ির নাম হয়েছে ‘নুরুল হক চেয়ারম্যানের বাড়ি। শৈশবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে দক্ষিণ রাউজানের প্রসিদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নোয়াপাড়া হাইস্কুলে অভিভাবকরা ভর্তি করিয়ে দেন। বাড়ির কাছেই স্কুল। হেসে-খেলে বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া হতো। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে নোয়াপাড়া হাইস্কুল হতে এন্ট্রার্স পাশ করে।
পড়া-লেখার পাঠ চুকিয়ে জীবিকার অন্বেষণে পুরোদমে নেমে পড়েন। শুরু করেন ব্যবসা। একটু একটু করে ব্যবসার উন্নতি হতে লাগলো। প্রথমে ঠিকাদার অর্থাৎ কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন। কক্সবাজার বিমানবন্দরের প্রাথমিক নির্মাণ কাজ তিনিই করেছিলেন। ব্যবসায়ে সফলতা অর্জন করার পর ১৯৪৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এক বিদূষী রমণীর সাথে। এক সময় প্রসিদ্ধ ক্যামিকেল ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সততা, নিষ্ঠা, শ্রম ও অধ্যবসায় গুণে খাতুনগঞ্জ-বক্সিরহাট’র একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। আর্থিক উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি ধর্মীয় আচার-আচরণ নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। এক কথায় ধর্মভীরু ছিলেন। মানুষের সুখ-দুঃখে তিনি সবসময় উদার হস্ত ছিলেন। আত্মীয় স্বজন ও এলাকায় তিনি সমাদৃত ছিলেন। তাঁর একমাত্র ছোট ভাইকে চিকিৎসা পেশায় চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ডা. জাফর আহমদ লন্ডন প্রবাসী ছিলেন। শশ্রুমন্ডিত মুখ গোল্ডেন ফ্রেমের সাদা চশমা মাথায় ইস্ত্রি করা লম্বা সূতি কাপড়ের
টুপী পরিহিত অবস্থায় মরহুমের চেহারার ঐজ্জ্বল্য সকলকে আকৃষ্ট করতো। আশেকে নবী-অলী প্রেমিক মানুষের নুরানী চেহারার দ্যুতি মনে হতো যেন ঝিলঝিল করছে তার চেহারায়-কপালে। কঠিন জীবন সংগ্রামে জয়ী হয়ে সাংসারিক জীবন শুরু করেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে। উত্তরোত্তর সাফল্য জীবনে ধরা দিয়েছে তাই পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি কখনো। প্রভুত অর্থ বিত্তের মালিক হলেও নিজেকে ধর্মীয় কাজে, মানবতার কাজে অধিকতর সম্পৃক্ত রাখেন। তার নসীব ভাল। আল্লাহ্ জাল্লাশানহু ও তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম যার ওপর সন্তুষ্ট থাকেন তার কপালে ভাগ্যে অনেক বড় নিয়ামত অপেক্ষা করে। সওদাগর ছাহেবের ভাগ্যেও তেমনি এক নিয়ামত অপেক্ষা করছিল।
বার আউলিয়া পদধুলি ধন্য পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র সূতিকাগার। এদেশের সরলপ্রাণ মুসলিম জনতাকে নবী-অলী-প্রেমিক বিরোধী করার সুপরিকল্পিতভাবে বাতিলপন্থীরা জোর প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যচ্ছিল ঠিক সে মুহূর্তে চট্টলার মাটিতে পর্দাপণ করেন গাউসে জমান, কুতুবুল আউলিয়া আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলায়হি। তাঁর শুভাগমনে সকল সুন্নী জনতা, ওলামা মাশায়েখ খুবই উল্লসিত হন। হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহে আলায়হির নেতৃত্বে বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে এক জেহাদ শুরু হলো। গ্রাম-গঞ্জে শহরে-নগরে হুজুরের ওয়াজ নসিহত ও সিলসিলায়ে আলিয়া ‘কাদেরিয়ায় বাইআত’ করানোর মাধ্যমে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি শরীয়ত ও তরীক্বতের উভয় শাখাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া নামে একটি দ্বীনি সংগঠন ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার ন্যায় এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। প্রকৃত ইসলামের অনুসারী হচ্ছে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ আর একে সুদূর ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন মুজাদ্দিদে জমান আ’লা হযরত আহমদ রেযা খাঁন রহমাতুল্লাহি আলায়হি। এ মহান সাধকের নীতি ‘মসলকে আ’লা হযরত’-এর বাস্তব প্রয়োগ ও প্রচারের জন্যই ‘জামেয়া’র গোড়াপত্তন করা হয়। দ্বীন-মাযহাব-মিল্লাত নবী অলী প্রেমিক বান্দাদের রক্ষাকবচ হিসেবে এ
জামেয়া জন্মলগ্ন হতে অবদান রেখে আসছে। হুজুর কেবলা এরশাদ করেন ‘ইয়ে জামেয়া কিস্তিয়ে নূহ্ হ্যায়’ মুঝে দেখনা হ্যায় তো মাদ্রাসা কো দেখো।
এ মহান আধ্যাত্মিক সাধক হুজুর কেবলা হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১১ জিলক্বদ ছিরিকোট শরীফে ইন্তেকাল করেন। হুজুরের ছাহেবজাদা দরবারে আলিয়া কাদেরিয়ার সাজ্জাদানশীন পীর আওলাদে রাসূল (৪০তম) হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রিয় আব্বাজানের নির্দেশে এ মহান মিশনের দায়িত্বগ্রহণ করেন। তিনি সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দ হতে নিয়মিত আসা শুরু করেন। ১৯৬৪-৬৫ সালের কোন এক সময় ছালেহ আহমদ সওদাগর রহমাতুল্লাহি আলায়হি হুজুর ক্বেবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। সে শুভক্ষণ হতে তিনি আনজুমান, জামেয়াসহ সিলসিলার যাবতীয় কাজে নিজেকে সরাসরি সম্পৃক্ত করেন। হুজুর যখনই চট্টগ্রামে শুভাগমন করতেন। সওদাগর সাহেবের বাড়িতে বা কাটাপাহাড়স্থ বাসায় প্রতিবারই পদধুলি দিতেন। হুজুর ক্বেবলা তাঁকে খুবই ¯েœহ করতেন, ভালবাসতেন।
মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল ভবনের অধিকাংশ কাজ তিনি নিজ অর্থ ব্যয়ে করে দিয়েছেন। জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার অধ্যক্ষ মহোদয়ের পুরনো অফিস ভবন এবং প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে নুতন ছয়তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করেছেন নিজ অর্থে।
এভাবে জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া ঢাকা, কক্সবাজার, মাদরাসায়ে তৈয়্যবিয়া তাহেরিয়া সুন্নিয়াসহ আনজুমান পরিচালিত মাদরাসা, মসজিদ, খানকাসহ অনেক দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে তিনি অকাতরে দান করেছেন। বদরপাতি মসজিদের দ্বিতল নিজ অর্থে নির্মাণ করেছেন এ দানবীর। অঢেল সম্পদের অধিকারী হয়েও তিনি নিজেকে গর্বিত মনে করতেন না। আনজুমান ট্রাস্ট ও ‘জামেয়া’ পরিচালনা পর্ষদের আজীবন সদস্য হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। এ ছাড়াও তিনি জমিয়তুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদ স্থাপনকালে প্রথম উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন। নোয়াপাড়া ডিগ্রী কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর পরিবারের সকলেই সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার জন্য নিবেদিত প্রাণ। তাঁর সুযোগ্য পুত্র জনাব এস.এম. গিয়াস উদ্দিন সাকের আনজুমান ট্রাস্ট সদস্য ও জনাব মনোয়ার হোসেন মুন্না গাউসিয়া কমিটি মহানগর শাখার অর্থ সম্পাদক হিসেবে সিলসিলার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সাথে। তাদের বড় ভাই মুহাম্মদ সেলিম জাহাঙ্গীরও আনজুমান-জামেয়ার খেদমতের সাথে সক্রিয় আছেন, অন্য ভাইয়েরাও আনজুমান, জামেয়া গাউসিয়া কমিটির খেদমত করে যাচ্ছেন।
মরহুম মুর্শিদের সফরসঙ্গী হয়ে পবিত্র হজ্ব পালন, বাগদাদ শরীফ, রেঙ্গুন ও আজমির শরীফ ভ্রমণ করেন। এ মহান ব্যক্তি ২১ মহররম ১৪২৮ হিজরী, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সকাল সোয়া দশটার সময় ৮৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। ফানাপীর শায়খ আশেকে অলি রছুল ও আশেকে হিসেবে তিনি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের সমাপ্তি হলেও কর্মের মাঝে তিনি আমাদের সাথে চির জাগরুক থাকবে। মরহুমের ছেলে মেয়েরা পিতার আদর্শকে সামনে রেখে চলতে সচেষ্ট। আমরা মরহুমের রাফে’ দরজাত কামনা করছি আল্লাহর দরবারে এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরিদের দীর্ঘ জীবন কামনা করছি। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে মুর্শিদে বরহক এর নির্দেশিত পথে চলার তওফিক এনায়েত করুন, আমিন।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •