মাস্টার মুহাম্মদ আবদুল জলিল (রহ.)

0

সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার অন্যতম মুরিদ মুহাম্মদ আবদুল জলিল (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) আমাদের অনেকের নিকট বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে বিস্মৃতপ্রায় নাম। মাস্টার আবদুল জলিল নামেই তিনি অধিক খ্যাত। ‘মাস্টার’ উপাধিটি প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধকপুরুষ কুতুবুল আউলিয়া গাউসে জামান হযরতুল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রদত্ত। বার্মার (মায়ানমার) রাজধানী রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গুন) জলিল সাহেব ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলে শিকতা করার সুবাদে হুজুর স্নেহধন্য মুরিদকে মাস্টার বলে সম্বোধন করতেন। কালক্রমে এ নামেই তিনি অধিক পরিচিত হন।
আবদুল জলিল শিা-দীায় ধর্ম অনুশীলনে প্রাগ্রসর জনপদ বহু আধ্যাত্মিক সাধকের চারণভূমি রাউজান উপজেলার ডাবুয়া ইউনিয়নের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দিকে ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মুহাম্মদ শোকর আলী পেশায় ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। ঐতিহ্যবাহী এ পরিবারের পূর্বপুরুষ ছিলেন পশ্চিম থেকে আগত ধর্মপ্রচারক হযরত গোলামী খলীফ ও হযরত এয়াছিন শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। বর্তমান এয়াছিন নগর গ্রাম হযরত এয়াছিন শাহর নামানুসারে হয়েছে। পুত্রের শিা-দীার ব্যাপারে উচ্চ শিতি পিতা ছিলেন অত্যন্ত সচেতন। পারিবারিক বলয়ে স্থানীয় মক্তবে ও প্রাথমিক শিা শেষে উত্তর চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ রাউজান আর আর সি ইনস্টিটিউশনে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পুত্রকে ভর্তি করিয়ে দেন। রাউজান তথা চট্টগ্রাম এর কৃতিসন্তান হুজুর ক্বিবলার অত্যন্ত স্নেহষ্পদ ফানাফিশ্ শেখ কুতুবুল আউলিয়ার খলীফা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের সহপাঠী হন। উভয়ে এক সাথে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রাস পাস করেন। খালেক সাহেব চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। আর জলিল সাহেব আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিা লাভে কলকাতায় পাড়ি জমান। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে আবদুল জলিল সাহেব ‘সিস্টিংশন’ নিয়ে বি.এ পাশ করেন। পরবর্তীকালে রেঙ্গুনে চাকরিরত পিতার নিকট চলে যান। রেঙ্গুনের স্বনামধন্য শিা প্রতিষ্ঠান ইস্পাহানী পাবলিক স্কুলে শিক হিসেবে জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করেন। সেসময়ে পিতা এবং চট্টগ্রামবাসীর সান্নিধ্যে এসে অনুপ্রাণিত হয়ে আওলাদে রাসূল কুতুবুল আকতাব হযরত সৈয়্যদ আমহদ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন। ফলে তার জীবন নতুন দিকে মোড় নেয়। পারিবারিকভাবে ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও মন তাঁর উচাটন হয়ে ওঠে, না পাওয়ার এক অদম্য বাসনা। দ্বীন মাযহাব, মিল্লাত, সিলসিলার কাজে তিনি গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন। হুজুরের সান্নিধ্যে থাকার জন্য সচেষ্ট হন। যুবক আবদুল জলিলের মধ্যে নবী, অলীপ্রেমের তীব্র আগ্রহ ল্য করে হুজুর ক্বিবলা কাছে টেনে নিলেন প্রিয় এ শিষ্যকে। শিকতা করতেন বলেই মুর্শিদ ‘মাস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেব মাস্টার সাহেবের সাথে প্রথম রেঙ্গুনে গমন করেন এবং বাইয়াত গ্রহণ করেন।
কিছুকাল রেঙ্গুনে কাটিয়ে পুনরায় দেশে ফিরে ফটিকছড়ির সম্ভ্রান্ত পরিবার খান বাহাদুর মকবুল হোসোনের ভাগ্নী স্বনামধন্য সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান মোখলেছুর রহমানের কন্যা মোছাম্মৎ বাচেরা বেগমের সাথে বিবাহ্ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অতঃপর একদিন সস্ত্রীক রেঙ্গুনে প্রত্যাবর্তন করেন। তার সহধর্মিণীকেও মুর্শিদ ক্বিবলার হাতে বাইয়াত করিয়ে নেন। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আপন মুর্শিদের ও পীরভাইদের অনেক খেদমত আঞ্জাম দিতে থাকেন। শিতি, মার্জিত সৎচ্চরিত্রের অধিকারী, নিরহংকার ও নিঃস্বার্থজন হিসেবে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে সকলের প্রিয় হয়ে উঠেন। জহুরি যেমন প্রথম দেখাতেই খাঁটি সোনা পরখ করতে পারে তেমনি একজন কামেল ওলী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে যে কারো অন্তরের খবর পেতে পারেন। হযরত সিরিকোটি রাহামাতুল্লাহি আলায়হি জলিল সাহেবের অন্তরের খবর জানতে পেরেছিলেন বলেই কাছে টেনে নেন। সর্বপ্রকার পরীায় উত্তীর্ণ হন এ শিষ্য। এ জন্য তাকে খেলাফত দানে ধন্য করেন। অর্থাৎ ‘ফানাহ্ ফিশ্ শেখ’ এর মর্যাদা লাভ করে গৌরবোজ্জ্বল স্তরে তিনি অধিষ্ঠিত হন। শিা-দীা, মেধা-মনন, আচার-ব্যবহার, নৈতিকতা-সামাজিকতা সর্বোপরি মানবদরদী এবং নিঃসংকোচ মনে সকল অনুভূতি নিয়ে আল্লাহ্-রাসূলের প্রেমে বিভোর হয়ে আপন পীরের কদমে নিঃশর্তভাবে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন তিনি। প্রতিদানে পাওয়া গেল পীরের রেজামন্দি। আর কি চাই! সার্বণিকভাবে সিলসিলা মাযহাবের খেদমতে পীরের ইচ্ছায় নিবেদিত হলেন তিনি। শিকতা পেশা ত্যাগ করে রেঙ্গুনের শিানুরাগী, সমাজ সেবক, মরহুম আবদুল বারী চৌধুরীর মালিকানাধীন বেঙ্গল নেভিগেশান কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি গ্রহণ করেন।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কক্সবাজার সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে নতুন চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম শহরে প্রত্যাবর্তন করে আন্দরকিল্লায় ইসলামাবাদ টাউন কো-অপারেটিভ এ ম্যানেজার হিসেবে চাকরি নেন। ১৯৪৮ সালে বন্ধু আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারসহ তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন। দেশে ফিরে পুরনো চাকরিতে যোগ না দিয়ে চট্টগ্রামের প্রখ্যাত কোম্পানি মেসার্স এলাহী বক্স অ্যাণ্ড কোম্পানিতে অ্যাকাউন্টেন্টের চাকরি গ্রহণ করেন। এরপর চিটাগাং কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি (নাসিরাবাদ) গঠিত হলে পূর্ববর্তী চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি সুপারিন্টেডেন্ট হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ চাকরি।
আনজুমানে শু’রায়ে রহমানিয়া বর্তমান আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সুযোগ্য প্রথম সেক্রেটারী হিসেবে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। আপন পীরের ইচ্ছাই ছিল তাঁর ইচ্ছা এবং পীরের নির্দেশ বাস্তবায়নে ছিলেন আন্তরিক ও দৃঢ়। তিনি ও তাঁর সমসাময়িক পীর ভাইদের খেদমতের বদৌলতে আনজুমান, জামেয়া ও গাউসিয়া কমিটি এক বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়েছে। গাউসে জমান সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলতেন, ‘‘বা-জী-নে রোজা রাখকা, আউর হাম ঈদ মানাতা,’’ আসলেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে বৃ রোপণ করে গেছেন, তার ফল আমরা খাচ্ছি। এঁদের সকলেই স্বীয় যোগ্যতা, নিঃস্বার্থ কর্মফল প্রিয় মুর্শিদের স্নেহধন্য ও আস্থাভাজন হয়ে খেলাফত প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে তিনি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের সেক্রেটারীর দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম জজ আদালতের সম্মানিত ‘জুরার’ হিসেবেও তিনি বহুদিন দায়িত্বরত ছিলেন।
তিনি ছিলেন ৫ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তানের জনক। ১ম পুত্র মুহাম্মদ জমিল অগ্রণী ব্যাংকে এজিএম ছিলেন। ২য় পুত্র আহমদ জমিল একই ব্যাংকের এসপিও ছিলেন, ৩য় পুত্র মুহাম্মদ সাবের জমিল ও ৫ম পুত্র তাহের জমিল ম্যানোলা কোম্পানির অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলেন। এঁরা সকলেই পূর্বে ইন্তেকাল করেন। জয়নগর আবাসিক এলাকার বাসভবনে থাকতেন ৪র্থ পুত্র আলহাজ্ব মুহাম্মদ জাহেদ জমিল। তিনি অগ্রণী ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকের পদ হতে অবসরে যান কিছুদিন রোগাক্রান্ত থাকার পর সম্প্রতি তিনিও ইন্তেকাল করেন। গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ চট্টগ্রাম মহানগরী শাখার চকবাজার ওয়ার্ডের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। মাস্টার আবদুল জলিলের জীবনকর্ম এতোদিন অনেকেরই অল্েয ছিল। তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা তাহেরা বেগম আমেরিকায় অসুস্থ অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন এবং কনিষ্ঠ কন্যা তৈয়্যবা বেগম চকবাজারে জয়নগরে অবস্থান করছেন। উল্লেখ্য, মরহুম আবদুল জলিল সাহেবের পুত্র-কন্যাদের নামকরণ করেছেন স্বয়ং হুজুর ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি।
কুতুবুল আউলিয়া আওলাদে রাসূল হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১৯৬১ সালে আমাদের ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করলে তিনিও শোকাতুর হয়ে পড়েন। পরবর্তী বছরে ১৯৬২ সালের ২৪ মে হুজুর ক্বিবলার খলিফা, আনজুমান-জামেয়ার অন্যতম স্তম্ভ, সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরয়িার নির্ভীক নিবেদিত খাদেম আমাদের সকলের শ্রদ্ধাষ্পদ আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবদুল জলিল নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরম স্রষ্টার সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁকে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন কবরস্থানে দাফন করা হয়।
একটি নির্মল আদর্শ চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জীবন ব্যবস্থা, ধর্ম, সমাজ, জাতি সর্বোপরি মহান সিলসিলার গুরুদায়িত্ব পালনে ন্যায়-নিষ্ঠা ও বিচণতার নিদর্শন রেখে যাওয়া এ মহানুভব ব্যক্তিত্বের প্রতি ল্য করলে দেখতে পাব তিনি যেন আল্লাহর রাসূল ও প্রিয় মুর্শিদের সন্তুষ্টি (রেজামন্দি) অর্জনের ল্েয পরিচালিত এক অনুপম অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সিলসিলার কার্যক্রম পরিচালনা ও মুর্শিদ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনে যে গভীর নিষ্ঠা আন্তরিকতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা যে, কোন তরিকতপন্থীর নিকট অনুকরণীয়। এ মহৎ ব্যক্তির আদর্শকে সামনে রেখে পথ চলতে পারলে আমরাও সফল হতে পারব। মুর্শিদের সন্তুষ্টি চর্চা করে ষড়রিপুর তাড়না থেকে যদি আমরা মুক্ত হতে পারি তাহলেই আমাদের জীবন সার্থক হয়ে ওঠবে।
সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার এ মহান সাধকের আলমের বরযখের জীবনে নেমে আসুক অনাবিল সুখ ও শান্তি। রাব্বুল আলামীন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব কারুন আমিন।
পুনশ্চ: মাস্টার মুহাম্মদ আবদুল জলিল (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) যেন এতোদিন অলইে ছিলেন আমাদের নিকট। মরহুমের পুত্র মুহাম্মদ জাহেদ জামিলের নিকট হতে যৎকিঞ্চিৎ ধারণা নিয়ে আমি সামান্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কোন তথ্য বিভ্রান্ত হয়ে থাকলে ও জীবন চরিত্রের কোন দিক উম্মোচিত না থাকলে তজ্জন্য আমি দুঃখিত ও মাপ্রার্থী। ভবিষ্যতে আরো বৃহত্তর পরিসরে তার জীবনী আলোচনার দ্বার উম্মুক্ত করে দিলাম মাত্র।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •