সম্পাদকীয়

0

দাফে’ঈ কুফর ওয়া দালালাত রাহবরে রাহে হুদা-আহদে হাজের রা মুজাদ্দিদ আঁ ইমামে বাছফা’ অর্থাৎ : তিনি ছিলেন গোমরাহী ও কুফরীর প্রতিরোধকারী। পক্ষান্তরে সঠিক পথের প্রদর্শক। সত্যিকার অর্থে বর্তমান যুগের মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক। উল্লিখিত ফার্সি পঙক্তিটি এ উপমহাদেশের সুন্নিয়তের অন্যতম দিশারী শেরে বাংলা হজরতুল আল্লামা আজিজুল হক আলকাদেরীর। তাঁর রচিত ‘দিওয়ানে আজিজ’ এ চতুর্দশ শতাব্দির মুজাদ্দিদ আ’লা হযরত আহমদ রেযা খান ফাজেলী বেরেলভীর উদ্দেশে শ্রদ্ধাভরে নিবেদিত পঙক্তিমালার অংশবিশেষ। আ’লা হযরত ছিলেন বহুমুখী সংস্কারক।
আ’লা হযরতের সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান কীর্তি আকায়েদ সংশোধন করা। তখন ছিল ইংরেজদের রাজত্ব। শাসনামল দীর্ঘায়িত করার জন্য তারা মুসলমানদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টির কৌশল নেয়। তাদের চক্রান্তে পা দেয় আরবের নজদি-ওহাবীর ভাবশিষ্যরা। সৃষ্টি হলো ওহাবী, কাদিয়ানী, বাহাইসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়। ইংরেজদের মদদে এক শ্রেণির আলেম ইসলামের মৌলিক আকিদার বিপরীতে অবস্থান নেয়। তারা কলম ধরে ঈমান-আকিদা বিধ্বংসী রচনায়। ব্যাপক হারে চালাতে থাকে জঘন্য প্রচার প্রচারণা। একদিকে মূল আকিদায় বিশ্বাসী সুন্নি সম্প্রদায়, অন্যদিকে নব্যসৃষ্ট বাতেল ফের্কাগুলো। শুরু হলো আকিদাগত দ্বন্দ্ব। ওহাবীরা কিতাবুত তাওহীদ, তাকভীয়াতুল ঈমান, তাহজিরুন্নাছ, সিরাতে মুস্তাকিম,ফতোয়ায়ে রশিদিয়া, বারাহীনে কাতেয়া, হেফজুল ঈমান ইত্যাদি নামে ইসলামের আকিদাবিরোধী গ্রন্থ রচনা করে। মুসলমানদের এমন দুর্দিনে যুগের চাহিদা পূরণে ঝলসে উঠে আ’লা হযরতের কলম তরবারি। অবিরাম চলতে থাকে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী। তাদের অপব্যাখ্যা ইসলামের আলোকে অকাট্য যুক্তি ও তথ্যনির্ভর বক্তব্যের মাধ্যমে খৃন করতে থাকেন। শুধু কলমে নয়, ওয়াজ নসিহত মোনাজারার মাধ্যমেও তিনি ভ্রান্ত মতবাদীদের মোকাবেলা করেন। এভাবে বাতিলদের খপ্পর থেকে ইসলামের মৌলিকতা রক্ষায় তিনি নিরলসভাবে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সরলপ্রাণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের ঈমান আকিদা সুরক্ষায় ভূমিকা রাখেন। সে কারণে আ’লা হযরতের আকায়েদের সংস্কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম। ওই ধারাবাহিকতা এখনো ক্রিয়াশীল এ উপমহাদেশে। ‘মসলকে আ’লা হযরত’ বর্তমানেও হক পন্থিদের নির্ভরযোগ্য ঠিকানা, বাতিলদের মোকাবেলায় শানিত চেতনা, ঈমান আকিদা সুরক্ষার উজ্জীবনী শক্তি ও নবীপ্রেমে সিক্ত হওয়ার প্রেরণা।
রেকটা উল্লেখযোগ্য ও বিম্ময়কর দিক হলো এ কলম সম্রাটের বিশাল রচনা ভাৃার। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রায় ৭০টি শাখায় বিচরণ করে দেড় হাজার গ্রন্থ রচনা করেন। ৫৫ বছরব্যাপী তিনি যেসব ফতোয়া দিয়েছেন সবগুলো সন্নিবেশিত করে ‘ফতোয়ায়ে রেজভীয়া’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। ফতোয়ায়ে আলমগীরির পর এটাই বিশ^ মুসলিমের জন্য নির্ভরযোগ্য ফতোয়া গ্রন্থ। আ’লা হযরতের প্রতিটি রচনা আমাদের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ। কারণ তাঁর লেখাগুলো সত্যের পথে চলার ও অটল থাকার প্রেরণা যোগায়। হৃদয়কে নবীপ্রেমে উদ্ভাসিত করে। খোদাদ্রোহী- নবীদ্রোহীদের প্রতি তীব্র ধিক্কার সঞ্চার করে। যুগ সমস্যার সমাধান দেয়। সর্বোপরি নিজেকে ইনসানে কামেল হিসাবে গড়ে তোলার পথনির্দেশনা দেয়। সে কারণে বর্তমানে বিশ^ব্যাপী আ’লা হযরত চর্চা বাড়ছে। তাঁর লেখালেখি নিয়ে গবেষণা চলছে বিভিন্ন দেশের নামিদামি বিশ^বিদ্যালয়ে। এ জগৎ থেকে চলে যাবার ৯৬ বছর পরও তাঁর কীর্তিগুলো আমাদের আলোর পথ দেখাচ্ছে। আমরা উপকৃত হচ্ছি এ মহান ব্যক্তিত্বের জীবনদর্শন থেকে। ২৫ সফর এ মহান সংস্কারক আ’লা হযরত আহমদ রেযা খান বেরেলভীর (রহ.) ওফাতবার্ষিকী। এ উপলক্ষে কামনা করি তাঁর ফয়ুজাত।
আমাদের মাঝ থেকে আকস্মিক চলে গেলেন জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম। গত ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫৩ বছর বয়সে এ নশ^র জগৎ ছেড়ে চলে যান যোগ্য ও প্রিয় এ শিক্ষক। পরদিন জামেয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে তার বিশাল নামাজে জানাজা এটা প্রমাণ করে সর্বস্তরের মানুষ তাকে কতই ভালবাসত। সদা হাস্যোজ্জ্বল এ প্রিয় মুখ এতো তাড়াতাড়ি হারিয়ে যাবে তা কেউ চিন্তাও করেনি। তিনি মাসিক তরজুমান এরও অন্যতম লেখক ছিলেন। আগামী ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে তার কাছে চিঠিও দেয়া হয়েছিল। সানন্দে তিনি লেখা পাঠাতেন কিন্তু পরিতাপের বিষয় এ সময়ে তার চলে যাওয়ায় সেই লেখা আর পেলাম না। ইতিপূর্বে আমরা হারিয়েছিলাম জামেয়ার আরেক বিজ্ঞ ও প্রিয় শিক্ষক মওলানা আমিনুল করিমকে। গত রমজান মাসে এ জগৎ থেকে চলে গেলেন আরেকজন অভিজ্ঞ আলেম অধ্যক্ষ আল্লামা নুরুল আলম খান। এভাবে তাদের অসময়ে চলে যাওয়া শিক্ষাঙ্গন ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।
এদিকে গত ১১ অক্টোবর আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ঢাকা শাখার সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকার মুহাম্মদপুর কাদেরীয়া তৈয়্যবিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা পরিষদের সাবেক সভাপতি আলহাজ মুহাম্মদ আশরাফ আলী ইন্তেকাল করেন। তিনি মাদ্রাসা ও সিলসিলার জন্য দীর্ঘদিন নিরলস কাজ করেছেন। এ সিলসিলার একজন প্রবীণ মুরিদ হিসাবে তার অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আমরা তাদের ইন্তেকালে গভীর শোক প্রকাশ করছি। সমবেদনা জানাই মরহুমদ্বয়ের শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি। মহান আল্লাহ পাক যেন তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করেন- এ ফরিয়াদ জানাই।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •