আ‘লা হযরত কিংবদন্তি মহাপুরুষ- মাওলানা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

0

আ‘লা হযরত কিংবদন্তি মহাপুরুষ
মাওলানা মুহাম্মদ নেজাম উদ্দীন

আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হিজরি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে অর্থাৎ ১২৮৬ হিজরি সাল হতে তাঁর তাজদিদী (সংস্কার) কার্যক্রম শুরু করেন। আর হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দশকে তাঁর তাজদিদী কার্যক্রম জনসমুক্ষে প্রকাশ পেতে থাকে। তিনি ১৩৪০ হিজরির ২৫ সফর (১৯২১ খ্রি.) ইন্তেকাল করেন। এ হিসেবে আগামী ১৪৪০ হিজরি তার ওফাত শতবার্ষিকী পালিত হবে। ওফাতের একশত বছর অতিক্রান্ত হতে চললেও তাঁর শিক্ষা, আদর্শ, দর্শন ও লেখনি তাঁর যুগে যেমন বিশ্ব মুসলিম তথা বাংলা-পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছিলো। তেমনি বর্তমান যুগেও দিচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও দিতে থাকবে নিঃসন্দেহে। আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যে যুগে জন্মগ্রহণ করেন ওই যুগে অনেক জগৎ বিখ্যাত আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, সুফী, দার্শনিক, লেখক-গবেষক ছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি যেভাবে একাই ওহাবী-দেওবন্দী-শিয়া-কাদিয়ানী ইত্যাদি বাতিল ফিরকাগুলোর ভ্রান্ত মতবাদের সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁর যুগের সত্যান্বেষী সকল আলিম বিনা ইখতিলাফে (মতভিন্নতা) আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে চতুর্দশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ বলে স্বীকার করে নেন।
উল্লেখ্য, আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সংস্কার কার্যক্রমের প্রধান দিক ছিলো আকাঈদের সংশোধন। ‘বিভক্ত করো, শাসন করো’ এ নীতির ওপর ইংরেজরা এ উপমহাদেশে আরব থেকে ওহাবী মতবাদকে আমদানী করে দেওবন্দী, কাদিয়ানী, বাহায়ী, আহলে হাদীস (সালাফী) ইত্যাদি নামে নতুন নতুন দল উপদল মুসলমানদের মাঝে সৃষ্টি করলো। এ দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে উপমহাদেশে ইংরেজরা নিজেদের প্রভূত্ব বিস্তার করে। ইংরেজদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় উপমহাদেশের মুসলিম জনজবীনে আরবের ওহাবী ইজম প্রচার ও কার্যকরী করার স্বপ্নে দেওবন্দীরা যে চক্রান্ত করেছিল, এর বিরুদ্ধে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হিমালয়ের মত রুখে দাঁড়ান। তিনি ‘দেওবন্দী-ওহাবী’ ফিতনা প্রতিহত করতে সফল হন। এবং ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জাম‘আতের শিক্ষা, দর্শন ও আদর্শকে বিকৃতি হওয়া থেকে রক্ষা করেন। যদি এ উপমহাদেশে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর জন্ম না হতো, তবে এতদাঞ্চলের মুসলমানরা ‘দেওবন্দীয়াত’কে প্রকৃত ইসলাম বলে মনে করতো। আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-ই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ‘দেওবন্দীয়াত’ এবং ইসলামের মাঝে ভেদ টেনে দেন। বর্তমানেও যারা আ‘লা হযরত ও তাঁর যোগ্য উত্তর সূরি আলিম-উলামাদের লিটেরেচার অধ্যয়ন করেনি আর করলেও নিজেদের অক্ষিযুগল থেকে পক্ষপাতিত্বের চশমা সরাতে পারেনি তারা দেওবন্দীদের জুব্বা-দস্তারের ভেতরে আটকা পড়ে আছে। ফলে তারা সিরাতে মুস্তাকীম, তাকভীয়াতুল ঈমান, বারাহীনে কাতিয়া, হিফযুল ঈমান ও বেহেস্তী যেওরের ঈমান বিধ্বংসী কুফরী আকীদাগুলো দেখেনা। পবিত্র ক্বোরআন ও হাদীসের মুকাবেলায় তাদের কাছে ওই সব কিতাব অতি পবিত্র ও নির্ভুল। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মান-মর্যাদা হানি হলেও ওই কিতাবের লেখক তাদের কাছে নির্দোষ। অথচ এ ক্ষেত্রে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর শিক্ষা হলো, নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কিরাম সম্পর্কে যার থেকে সামান্যতমও অশোভন আচরণ লেখায় বা কথায় প্রকাশ পাবে, তাকে দুধের থেকে মাছি নিক্ষেপ করার মতো ছুড়ে ফেলতে হবে- সে যতো বড় আলিম, পীর, হোক না কেন। এটাই হচ্ছে প্রকৃত ঈমানের দাবী। যা আমরা সাহাবায়ে কিরামের জীবনে দেখতে পায়। এ প্রসঙ্গে পবিত্র ক্বোরআনে মহান আল্লাহ্ বলেন, ‘‘আপনি পাবেন না আল্লাহ্ ও আখিরাতে বিশ্বাসী এমনকোন সম্প্রদায়, যারা ভালোবাসে (বন্ধুত্ব রাখে) আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারীদেরকে- হোক না ওই বিরুদ্ধাদচারীরা তাদের পিতা, পুত্র, ভাই বা তাদের জাতি-গোত্র। এরা হচ্ছে ওই সব লোক, যাদের অন্তরে আল্লাহ্ ঈমান অঙ্কিত করে দিয়েছেন এবং তাঁর নিকট থেকে রূহ দ্বারা সাহায্য করেছেন।’’ [সূরা মুজাদালাহ্: ২২] তাই আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর প্রচারিত শিক্ষা ও দর্শনের মাঝেই ঈমানের প্রকৃত স্বাদ নিহিত রয়েছে। এটা শুধু কথার কথা নয়, বরং তাঁর যুগের প্রকৃত হাদীস বিশারদ, হাফিযুল হাদীস আল্লামা ওয়াছি আহমদ মুহাদ্দিস ‘সূরতি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’-এর মতো জগত বিখ্যাত আলিমের উক্তিতে এ কথার সত্যতা মিলে। যেমন, একদিন সাইয়িদ মুহাম্মদ কাছ্ওয়াছভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মুহাদ্দিস সূরতিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হুযূর! আপনিতো মাওলানা ফযলে রহমান গঞ্জেমুরাদাবাদীর মুরীদ হওয়া সত্ত্বেও আ‘লা হযরতের সাথে আপনার যে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব দেখছি তাতো অন্য কারো সাথে দেখি না। আপনার মজলিসে আ‘লা হযরতের স্মরণ ও তাঁর গুণগান করা আপনার জীবনের জন্য রূহের মর্যাদা রাখে এটা কেন? এ প্রশ্নের জবাবে মুহাদ্দিস সূরতি যে উপমাহীন জবাব দিয়েছিলেন তা স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মতো। তিনি বলেছেন- সব চেয়ে বড় সম্পদ ওই ইলম নয় যা আমি মৌলভী ইসহাক (বুখারী শরীফের ভাষ্যকার) থেকে অর্জন করেছি এবং ওই বায়আত নয়, যা গঞ্জেমুরাদাবাদী থেকে পেয়েছি। বরং ওটাই অমূল্য ঈমান- যা পরকালীন মুক্তির উপায় তা একমাত্র আমি আ‘লা হযরত থেকে পেয়েছি। আর আমার হৃদয়ে পুরোপুরিভাবে মর্যাদা সহকারে পবিত্র মদীনার ধ্যান-জ্ঞান উপস্থাপনকারী হলেন আ‘লা হযরত। এ কারণে তাঁর স্মরণ আমার অন্তরের ঈমানী দীপ্তি বৃদ্ধি করে এবং তাঁর প্রতিটি কথামালা আমার নিজের জন্য সঠিক পথের দিশা বলে জানি।’’
হাদীসে জিব্রাঈলের আলোকে ‘দ্বীন’ বলতে ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের সমষ্টিকে বুঝায়। সংক্ষেপে ‘ঈমান’ বলতে বুঝায় আকীদাকে। ‘ইসলাম’ মানে আমলকে আর ইহসান হচ্ছে তাসাওউফ বা আধ্যাত্মবাদ। দ্বীনের এ তিনটি বিষয়ের আলোকে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে আমরা তিনটি রূপে দেখতে পাই। প্রথমত তিনি মুতাকাল্লিম বা আকীদা বিশ্লেষক, দ্বিতীয়ত তিনি ফকীহ বা মুজতাহিদ এবং তৃতীয়ত তিনি সূফী। দ্বীনের এ মহান তিনটি গুণ আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর জীবন-কর্মে পূর্ণমাত্রায় বিকশিত হয়েছে। ফলে দ্বীনের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যাকারী হিসেবে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি গোটা মুসলিম মিল্লাতের আদর্শ স্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
মোটকথা আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি মুসলিম মিল্লাতের বড় অমূল্য সম্পদ। তিনি উপমহাদেশের মুসলমানদের অন্তরে ইশকে রাসূলের আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সিরাতে মুস্তাকিম প্রদর্শন করেন। তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন শুধু ক্বোরআনকে ধারণ করলে চলবে না বরং সাহেবে ক্বোরআনকেও বুকে ধারণ করতে হবে। তাওহীদের মর্যাদা রক্ষার নামে যখন রিসালতের মানহানি করা হচ্ছিলো তখন আযমতে রাসূলকে আ‘লা হযরত রাহমাতুল্লাহি আলায়হি যেভাবে উপস্থাপন করেছিলেন তাঁর যুগে এভাবে অন্য কেউ উপস্থাপিত করতে পারেনি। তাই আ‘লা হযরতের দর্শন ও শিক্ষা আমাদের ঈমানের রক্ষাকবচ। শতবর্ষ নয় কিয়ামত পর্যন্ত তাঁর দর্শন চির অম্লান ও শাশ্বত হয়ে থাকবে।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •