হামাস-ফাতাহ ঐক্যচুক্তি
আবসার মাহফুজ
ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংহতি চুক্তিতে পৌঁছেছে। গত ১২ অক্টোবর ফিলিস্তিনের এই দুই বিবদমান গোষ্ঠী সমঝোতা চুক্তিতে সই করেছে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী এক বছরের মধ্যে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট, সংসদ ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এই ঐক্যচুক্তির ফলে দল দুটোর মধ্যে এক দশক ধরে চলে আসা বিরোধ ও বিভক্তির অবসান হলো আপাতত।
যদিও এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল নাখোশ হয়েছে, কিন্তু শান্তি ও স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিসহ বিশ্বের সব শান্তি ও মানবতাবাদী মানুষ খুশি হয়েছে। যথাযথ বাস্তবায়ন হলে এই ঐক্যচুক্তি শুধু হামাস-ফাতাহর মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসানই ঘটাবে না, সব ফিলিস্তিনিকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে একটি ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে আসতেও উদ্বুদ্ধ করবে। বেগবান ও শক্তিশালী করবে স্বাধীনতার আন্দোলনকে। ফাতাহ ও হামাস নানা উসকানি ও ষড়যন্ত্র এড়িয়ে একসঙ্গে কাজ করতে পারলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সহসা অনিবার্য সত্য হয়ে ধরা দেবে। তবে, বাস্তবতা হচ্ছে, ইসরাইল ও তার রক্ষাকর্তারা কখনো হামাস-ফাতাহ্র ঐক্যকে মেনে নেবে না। এই ঐক্যকে নস্যাৎ করে দিতে তারা সব চেষ্টাই অব্যাহত রাখবে। কারণ হামাস-ফাতাহ্র ঐক্যের সাথে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং একটি শক্তিশালী ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রশ্নটি ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
উল্লেখ্য, ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সবশেষ নির্বাচনে জয়লাভ করে গাজাভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন হামাস। কিন্তু বিবাদমান সংগঠন দু’টি ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে সহিংসতায় জড়ালে হামাসের প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াকে বরখাস্ত করেন পশ্চিম তীরভিত্তিক ফাতাহর নেতা প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। এর জবাবে ফাতাহকে গাজা থেকে বিতাড়িত করে দেয় হামাস। সেই থেকে হামাস ও ফাতাহ পৃথক দু’টি সরকার পরিচালনা করে আসছে। ইসরাইলের অধিকৃত পশ্চিম তীরে স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সরকার পরিচালনা করে আসছিল মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ। আর ফাতাহ নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মতো সমান্তরাল সরকার হিসেবে গাজা উপত্যকা শাসন করে আসছিল হামাস। এর ফলে ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক সঙ্কট দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয় এবং আন্তর্জাতিক মহলে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সপক্ষে জনমত গঠনে নানামুখী সমস্যা সৃষ্টি হয়। দু’পক্ষের মধ্যে বারবার সমঝোতার চেষ্টা দেখা গেলেও তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখন মিসরের মধ্যস্থতায় দুই দলের মধ্যে ঐক্যচুক্তি হয়েছে। চুক্তিতে স্বাক্ষরের পর হামাস যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে তারা মাহমুদ আব্বাসকে গাজায় ঐক্য সরকার পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছে। তারা বলেছে, ফাতাহর সাথে আলোচনায় প্রস্তুত তারা। প্রসঙ্গত, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে ঐক্য সরকার গঠন করা গেলেও গাজায় সরকার পরিচালনা করতে পারেননি মাহমুদ আব্বাস। এবার সেই সুযোগ সৃষ্টি হলো। হামাসের আহ্বানের পর ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
চুক্তি অনুসারে আগামী ১ ডিসেম্বর হামাস তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন গাজা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের (পিএ) কাছে হস্তান্তর করবে। চুক্তি অনুসারে এই দুই দলের পাশাপাশি অন্য সব ক্ষুদ্র দল একটা ঐক্যের সরকার গঠন করবে। হামাস এখন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি শান্তি আলোচনায় যোগ দিতে পারবে। তবে ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ইসরায়েলের বিপক্ষে তিনবার যুদ্ধ করা হামাস তাদের সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করবে কি না সে ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি। পশ্চিমা দেশগুলো হামাস ও ফাতাহর দীর্ঘদিনের বিভেদ দূর করে ঐকমত্যে পৌঁছানোর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানালেও আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন সরকারে হামাসের যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। ফলে তারা হামাসের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক থেকে বিরত রয়েছে। ইসরাইল ও মিসরের অব্যাহত অবরোধের মুখে দুর্বল হয়ে পড়েছে ইসলামপন্থী হামাস। ইসরাইলের সাথে তিনটি যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক মহলের সাথে বিচ্ছিন্নতা হামাসকে চাপে ফেলে দিয়েছে। এ ছাড়া মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সুসম্পর্ক থাকায় হামাসের সাথে বৈরিতা চলছে মিসরের বর্তমান সামরিক সরকারের। গাজা উপত্যকায় প্রায় ২০ লাখ মানুষের বসবাস। সাম্প্রতিক সময়ে সেখানে ক্রমেই মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। নানা সমস্যার মধ্যে বিদ্যুৎ ও পানীয় জলের ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। গাজার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক এবং সেখানে বেকারত্বের হার বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। মানবিক সঙ্কট বিবেচনায় নিয়ে গাজার ওপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহারে ইসরাইলের প্রতি বহুবার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিন্তু তারা অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। আবার মার্চে গাজা উপত্যকা পরিচালনার জন্য নতুন কমিটি ঘোষণা করলে হামাসের ওপর চাপ বাড়ান মাহমুদ আব্বাস। গাজায় বিদ্যুতের জন্য অর্থ বরাদ্দ কমানো এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বেতন না দেয়ার ঘোষণা দেন তিনি। এ অবস্থায় হামাস আর শাসনভার নিতে চায় না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি হওয়ায় তারা এটাকে বোঝা মনে করছে। এসব ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়ে তারা এ থেকে মুক্তি চায়। ফাতাহও চায় সমঝোতা। ফলে স্বাক্ষরিত হলো হামাস-ফাতাহ চুক্তি। জাতিসংঘ, আরব লীগ ও পশ্চিমা দেশগুলো ঐকমত্যের চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ঐকমত্যের ফলে গাজাবাসীর দুর্ভোগ কমবে।
তবে সমঝোতার যে ঘোষণা এসেছে, তা যে অবাধে কার্যকর হবে, তার শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। ফাতাহ ও হামাস চরিত্রগতভাবে এতটাই ভিন্নপ্রকৃতির যে, তারা যে কোনো সংকট মোকাবিলায় ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করে থাকে। সে কারণে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে মিসরের মধ্যস্থতায় এমন সমঝোতা হলেও তা ভেঙে যায়। আব্বাস সরকারের অধীনে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনীকে ছেড়ে দেয়া নিয়ে বিরোধের সূত্র ধরে সমঝোতা ভুণ্ডল হয়ে যায়। এবারের সমঝোতায়ও মিসরের ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু এবারের সমঝোতাটিও স্বল্পস্থায়ী হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে নানা কারণে। সন্দেহ আছে, ইসরায়েলের বিরূপ মনোভাবের কারণে নতুন সমঝোতায় ফিলিস্তিন স্বাধীনতার লক্ষ্যে কতদূর অগ্রসর হতে পারবে, তা নিয়েও। হামাস ও ফাতাহর চুক্তির ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এতে ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তিপ্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে পড়ল। নিজের ফেসবুকে এ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তিনি অভিযোগ করেন, হামাস সন্ত্রাসাবাদে মদদ দেয়। সংগত কারণে ইসরাইল এই ঐক্যচুক্তি ভুণ্ডল করতে ষড়যন্ত্র করবে। আবার হামাসের ২৫ হাজার সদস্যের শক্তিশালী সামরিকবাহিনী ‘আল কাশেম ব্রিগেড ভেঙ্গে না দিলেও ঐক্যপ্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। ইসরাইলের সাথে আলোচনার প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া নিয়েও দুই দলের দৃষ্টিভঙ্গী দুই রকম। আরো কিছু বিষয় আছে, যেগুলোতে ভিন্ন অবস্থান দুই গোষ্ঠীর। হামাসকে ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ হলো ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে বড় অর্থ জোগানদাতা। ফলে হামাস ও ফাতাহর মধ্যে ঐক্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও, তাতে সমর্থন দিতে বেগ পাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। এসব বিবেচনায় চির বৈরী ফাতাহ ও হামাসের মীমাংসার উদ্যোগ পুনরায় ব্যর্থ হওয়ায় একটি আশঙ্কা থেকেই যায়।
কায়রোয় আগামী ২১ নভেম্বর ফিলিস্তিনের সব রাজনৈতিক আন্দোলনের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেখানেই এসব জটিল সমস্যা নিরসনের জন্য আলোচনা হবে। আমরা আশা করবো, সবকিছুর সুন্দর সমাধান হবে। প্যালেস্টাইন ন্যাশনাল ইনিশিয়েটিভ নামে একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মুস্তাফা বারঘৌতি বলেছেন, ‘যা হয়েছে এখন পর্যন্ত, তা ইতিবাচক। কিন্তু এটি সবে শুরু। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তা এখন বাস্তবায়ন করতে হবে। শুধু হামাস ও ফাতাহ নয়, ফিলিস্তিনের সব পক্ষকেই এরপর একটি ঐক্যবদ্ধ সরকার ও পরবর্তী নির্বাচনের তারিখ নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছাতে হবে।’ অনেকে আশা করছেন, এবার সমঝোতায় ৮২ বছর বয়সী আব্বাস বিরাট ভূমিকা রাখবেন। কারণ জীবনসায়াহ্নে এসে তিনি চান ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম লেখাতে। কিছু একটা করে রেখে যেতে চান তিনি, যার কারণে মানুষ তাকে মনে রাখবে। আবার হামাসও এখন চাপে আছে। উল্লেখ্য, মাহমুদ আব্বাস ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিটিকে বিরোধ নিষ্পত্তিতে ‘চূড়ান্ত চুক্তি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। ফলে সমঝোতা হওয়ার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে বলা যায়। তবে, ইসারাইলের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে উভয় পক্ষকে। যদি চুক্তিটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তাহলে হামাস এবং ফাতাহ গোষ্ঠীসহ সব ফিলিস্তিনিই এর সুফল ভোগ করবে।