? মুহাম্মদ আফতাব হোসেন
গণপূর্ত সম্পদ উপ-বিভাগ
সিএন্ডবি কলোনি, মনছুরাবাদ চট্টগ্রাম
খাইর মোহাম্মদ, আল্লামা ইকবাল একাডেমী
বটতলী, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম।
´ প্রশ্ন: আমাদের দেশে জায়গা-জমি কট বা বন্ধক দেওয়ার নিয়মনীতি ও রেওয়াজ চালু আছে। যেমন, আমার জায়গা নির্দিষ্ট কিছু টাকা বা কর্জের বিনিময়ে বন্ধক বা কট দিলাম। এ মর্মে যতদিন বন্ধক গ্রহীতার পাওনা টাকা আমি পরিশোধ করতে পারব না, ততদিন আমার জমিন বন্ধক গ্রহীতা ভোগ করতে পারবেন। নির্দিষ্ট সময়ে যে দিন আমি বন্ধক গ্রহীতার সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিব সে দিন আমার জমিন আমাকে ফেরত দিবেন। এটাতে বন্ধক গ্রহীতার যে কোন প্রকারের দাবী রহিত হয়ে যাবে। এখন আমার প্রশ্ন-এ জায়গা-জমি ভোগ-দখলের শর্তে টাকার বিনিময়ে বন্ধক দেয়া বা নেয়া আল্লাহ্ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিধান মোতাবেক জায়েজ কিনা? যদি না জায়েজ বা হারাম হয় তাহলে নিম্নে আমার কয়েকটি প্রশ্ন পেশ করা হল-
ক. যদি এ কট বা বন্ধক না জায়েজ হয় তবে উক্ত টাকা সওয়াবের নিয়তে মসজিদ, মাদরাসায় ও কবরস্থানের দেওয়ালে খরচ করা যাবে কি না?
খ. যদি উক্ত টাকা হারাম ও না জায়েজ হয় তবে আমি উক্ত টাকাকে যদি হালাল মনে করি তা হলে আমার কি গুনাহ হবে?
গ. উক্ত বিষয়কে যদি আমার আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শী সমর্থন করে তবে তাদের বেলায় কি হুকুম?
ঘ. আবার কতগুলো লোক এমন দেখা যায় তারা উক্ত কাজকে ভালো মন্দ কিছুই বলে না, তাদের বেলায় কি হুকুম?
ঙ. হক্কানি রাব্বানি আলেমদের নিকট শুনেছি হাদিস শরীফে আছে শয়তান দুই প্রকার- ১. প্রকাশ্য শয়তান ও ২. অপ্রকাশ্য শয়তান অর্থাৎ বোবা শয়তান। এ বোবা শয়তানদের বেলায় কি হুকুম? উপরোক্ত বিষয়গুলো ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক জানানোর আবেদন রইল।
্উত্তর: একটি নির্দিষ্ট অংক বা টাকার বিনিময়ে জায়গা-জমি বা যে বস্তু কোন বস্তু ভোগ করা অথবা ফায়দা অর্জনের শর্ত আরোপ করা ছাড়া বন্ধক ও গ্রহণ করা কোরআন-সুন্নাহর বিধান অনুযায়ী জায়েজ ও ইসলামী শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত। যেমন কিতাবুল হেদায়ায় ަ অর্থাৎ বন্ধক অধ্যায়ে ইমাম বুরহান উদ্দনি আলী বিন আবু বকর ফরগানী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
অর্থাৎ(রাহান) শব্দটির আভিধানিক অর্থ যে কোন কারণে কোন বস্তুকে আটকে রাখা। শরিয়তের পরিভাষায় হক তথা কর্জের পরিবর্তে কোন বস্তুকে এমনভাবে আটকে রাখা যাতে বন্ধকী বস্তুর দ্বারা হক উসূল করা সম্ভবপর হয়। এভাবে বন্ধক রাখার বিষয়টি পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরীফের আলোকে শরিয়ত কর্তৃক সমর্থিত। যেমন পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে- অর্থাৎ বন্ধকী বস্তুসমূহ বন্ধক গ্রহীতার কব্জায় বা জিম্মায় থাকবে।
[সূরা বাক্বারা, আয়াত নম্বর ২৮৩]
তদুপরি হাদিসে পাকে বর্ণিত আছে, একদা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক ইয়াহুদি হতে কিছু খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করেছিলেন এবং এর মূল্যের বিনিময়ে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাঁর বর্মটি (যুদ্ধ পোশাক) ইয়াহুদির নিকট বন্ধক রেখেছিলেন। (সহীহ্ বোখারী ও সহীহ্ মুসলিম শরীফ, বন্ধক অধ্যায়) উল্লেখ থাকে যে, বন্ধক রাখা ও গ্রহণ করা বৈধ হওয়ার বিষয়ে ইজমা (ইমামগণের ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
[হেদায়া, কিতাবুর রাহান, ৪র্থ খণ্ড, পৃ.৫০০]
তবে বন্ধকদাতা যতদিন টাকা পরিশোধ করতে পারবে না ততদিন বন্ধকী জমিন বন্ধক গ্রহীতা ভোগ করবে ও চাষাবাদের মাধ্যমে ফায়দা অর্জন করবে এ শর্তে জায়গা-জমি বন্ধক রাখা ও গ্রহণ করা ঈমানদারের জন্য হারাম ও মারাত্মক অপরাধ; যা বর্তমানে আমাদের দেশে রেওয়াজ ও প্রচলন হয়ে গেছে। জায়গা-জমিন বন্ধক রেখে নির্দিষ্ট অংক গ্রহণ করা ঋণ ও কর্জ গ্রহণ করার নামান্তর। আর উক্ত ঋণ বা কর্জের টাকা উসূল করার জন্য ঋণ গ্রহীতা হতে জায়গা-জমি বা অন্য কোন বস্তু বন্ধক রাখা হয়। এটাই বন্ধক রাখা বা বন্ধক গ্রহণ করার মূল উদ্দেশ্য, যা কিতাবুল হেদায়ার উপরোক্ত উদ্ধৃতিসহ ইলমূল হাদিস ও ইলমূল ফিকাহ এর নির্ভরযোগ্য কিতাবসমূহের বর্ণনা দ্বারা স্পষ্ট। কর্জ বা ঋণ উসূল করার জন্য যে সব জায়গা-জমি বন্ধক গ্রহণ করা হয় তা হতে বন্ধক গ্রহীতার জন্য ফায়দা অর্জন করা নিঃসন্দেহে ইসলামী শরীয়তের বিধান মতে সুদ ও হারাম। যেমন হাদীস শরীফে রাসূলে মাকবুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- অর্থাৎ প্রত্যেক ঋণ বা কর্জ যা হতে কর্জদাতা ফায়দা অর্জন করে তা সুদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য যে, সুদী কারবার বা লেনদেন যারা করে এবং যারা এ জাতীয় লেনদেনে স্বাক্ষী হয় সকলে গুনাহের মধ্যে বরাবর।
হাদিসে পাকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুদী কারবারে বা লেনদেনের সাথে জড়িত সকলের উপর লা’নত (অভিশাপ) করেছেন। [সহীহ মুসলিম শরীফ]
ইমাম আহমদ, দারকতনীও মেশকাত শরীফে বর্ণিত হাদিসে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- সুদের মাত্র এক দিরহাম যে ব্যক্তি জেনে শুনে খাবে তা ছয়ত্রিশ বার যেনা (ব্যাভিচার) করার গুনাহের চেয়েও মারাত্মক। অপর হাদিসে হযরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- সুদের গুনাহ্ এমন সত্তর গুনাহের সমান যে সত্তর গুনাহের মধ্যে সবচেয়ে কম দরজার গুনাহ্ হল স্বীয় মায়ের সাথে ব্যভিচার করা। (নাউজুবিল্লাহ)
[সুনানে ইবনে মাযাহ্ ও বায়হাকী, সুদ অধ্যায়]
বাহারে শরীয়তে মুফতি আমজাদ আলী খাঁন রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-বন্ধকদাতা যদি বন্ধক গ্রহীতাকে বন্ধক লেনদেনের সময় বন্ধকী জায়গা-জমিন হতে ফায়দা অর্জনের অনুমতি প্রদান করে এ অর্থে যে, অনুমতি না দিলে বন্ধকগ্রহীতা বন্ধকী জমিন গ্রহণ করবে না এবং বিনিময়ে টাকাও দিবে না তখন তা শর্ত আরোপের ন্যায় হয়ে গেল যেমন বর্তমানে আমাদের দেশে করা হয় তা অবশ্যই নাজায়েজ ও সুদ। আর যদি এ রকম না হয় বরং বন্ধকী লেনদেন বা চুক্তি সংগঠিত হওয়ার পর কোন পক্ষের শর্ত আরোপ করা ছাড়া বা বাধ্যবাধকতা ছাড়া স্বেচ্ছায় বন্ধকদাতা বন্ধকগ্রহীতাকে অথবা বন্ধক গ্রহীতা বন্ধকদাতাকে যদি বন্ধকী জায়গা-জমিন থেকে ফায়দা অর্জনের অনুমতি প্রদান করে এবং একে অপরকে এ কথা বলে যে, বন্ধকী জমিনটি এভাবে পড়ে থাকলে চাষাবাদের উপযোগী থাকবে না। সুতরাং তুমি ইচ্ছা করলে তা হতে ফায়দা অর্জন করতে পারো। তখন ফায়দা অর্জন করা নাজায়েজ বা সুদ হবে না বরং জায়েজ ও বৈধ।
[দুররে মোখতার ও বাহারে শরীয়ত, রাহান অধ্যায়]
অতএব, ফিকহ-ফতোয়ার উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহের আলোকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে,
ক. যদি বন্ধকী লেনদেন বন্ধকী জমি হতে ফায়দা অর্জনের শর্তের ভিত্তিতে সংগঠিত হয় যা বর্তমানে আমাদের দেশে রেওয়াজে পরিণত হয়েছে তবে তা শরিয়ত মোতাবেক না জায়েজ হওয়ার কারণে জায়গা-জমিন বন্ধক দিয়ে নেয়া টাকা সওয়াবের নিয়তে মসজিদ, মাদরাসা ও কবরস্থান ইত্যাদিতে খরচ করা যাবে না।
খ. নাজায়েজ পন্থায় নেয়া টাকা জেনে শুনে হালাল মনে করা মারাত্মক গুনাহ্। আল্লাহর দরবারে অবশ্যই খালেস নিয়তে তাওবা করবে এবং এ ধরনের নাজায়েজ তরিকায় বন্ধকী লেনদেন হতে বিরত থাকবে।
গ. গুনাহের কাজকে সমর্থন করাও গুনাহ। সুতরাং জায়গা- জমিনের বন্ধক রাখা আমাদের দেশের প্রচলিত নাজায়েজ প্রথাকে পাড়া-পড়শী ও আত্মীয়-স্বজন যারা সঠিক মাসয়ালা না জানার কারণে সমর্থন করে তারা এ ফতোয়ার মাধ্যমে সঠিক মাসয়ালা অবগত হওয়ার দরুন উক্ত গুনাহের কাজকে আর সমর্থন করবেনা। আর যদি জানার পরও সমর্থন করে তবে মারাত্মক গুনাহগার হবে। এ জন্য তাওবা করতে হবে।
ঘ. সঠিক মাসয়ালা না জানার কারণে যদি কেউ উপরোক্ত বিষয়ে চুপ থাকে এবং কোন প্রকার মন্তব্য না করে তবে তাকে অপরাধী বা গুনাহগার বলা যাবে না।
ঙ. আর যদি সঠিক মাসয়ালা অবগত হওয়ার পরেও হক ও সত্যকে মানুষের সামনে তুলে না ধরে, সে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর হাদিস মতে বোবা শয়তান ও জঘন্যতম অপরাধী। অতএব সে খালিস নিয়তে তাওবা করবে।