সামা-কাওয়ালী

0

সামা==
আল্লাহর প্রেমমূলক সঙ্গীতকে ‘সামা’ বলে অবিহিত করা হয়। ‘হামদ’ (আল্লাহর স্তুতি), না’ত (হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রশস্তি), গযল (আল্লাহ্র প্রেমমূলক গান), মুরশিদী (পীর-মুরশিদের প্রশংসামূলক সঙ্গীত), মারিফাতী (তত্ত্বমূলক গান), আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, দেশপ্রেমমূলক সঙ্গীত প্রভৃতিকে ‘সামা’ বা বিশুদ্ধ সঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত করা হয়ে থাকে। উপরিউক্ত সামাসমূহ শুনা মুবাহ্ (বৈধ)। এ ছাড়া পৃথিবীর সর্বপ্রকার গানবাদ্য হারাম। সামা বা আধ্যাত্মিক সঙ্গীত দ্বারা সূফীগণ নিজ অন্তরে আধ্যাত্মিক অনুতূতিকে জাগিয়ে তোলে এবং আল্লাহর ধ্যানে নিবিষ্ট হন। সামা এর শ্রবণকারীকে আধ্যাত্মিক রাজ্যে টেনে নিয়ে যায় এবং মুহূর্তে সাধকের মনে আধ্যাত্মিক ভাব জাগিয়ে তোলে। ‘সামা’ প্রকৃত শ্রবণকারীকে ‘জজবার’ (ভাবন্মোদনা) পর্যায়ে নিয়ে যায়। তাই চিশতীয়া ও মৌলবীয়া তরীকার সূফীগণ কিছু শর্ত সাপেক্ষে ‘সামা’ শ্রবণকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাহতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও কিছু শর্তসাপেক্ষে ‘সামা’-এর বৈধতার উপর মত প্রদান করেছেন।

তিনি হযরত মাহবুবে ইলাহী নিযামুদ্দীন আউলিয়ার উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন যে, ‘সামা’ বৈধ হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো অপরিহার্য।
১. যিনি ‘সামা’ বলবেন, তিনি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ হতে হবে। মহিলা বা অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে হলে চলবে না।

২. ‘সামা’ আল্লাহ-রাসূলের মহব্বত বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে হতে হবে। অর্থাৎ সামা শ্রবণকারী আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল হতে পারবে না।
৩. যা ‘সামা’ হিসেবে আবৃত্তি করা হবে তা মন্দ, অযথা উপহাসমুক্ত হতে হবে।

৪. সামার অনুষ্ঠান বাদ্যযন্ত্র মুক্ত হতে হবে।

উপরিউক্ত শর্তের ভিত্তিতে ‘সামা’ হালাল বলে সাব্যস্ত হবে।’ [মাকালু-ই উরাফা, পৃ.-৩৮]

সুতরাং সূফী-ই কিরামের উদ্ভাবিত ‘সামা- মাহফিল’-এর সাথে আজকের যুগের সামা বা কাউয়ালীর দূরতমও সম্পর্ক নেই। ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাদ্যযন্ত্র সহকারে, ‘সামা’ বা কাউয়ালী করা সম্পর্কে বলেন,

শুধু কাউয়ালী করা জায়েয আছে। আর বাদ্যযন্ত্র হারাম। এ ব্যাপারে চিশ্তীয়া তরিকতপন্থীদের মধ্যে বেশী বাড়াবাড়ি দেখা যায়। অথচ হযরত সুলতানুল মাশায়েখ মাহবূবে ইলাহী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘ফাওয়ায়েদুল ফুয়াদ শরীফে’ বলেছেন, বাদ্যযন্ত্র হারাম। হযরত শরফুল মিল্লাত ওয়াদ দীন ইয়াহিয়া মুনীরী বাদ্যযন্ত্রকে ব্যাভিচারের সাথে তুলনা করেছেন।’ [আহকামে শরীয়ত (বাংলা), পৃ.১৪৮]

আমাদের দেশে ওরসের নামে আজ যেভাবে বাদ্য-বাজনা, নাচ-গান, নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা চলছে তা যেমন গর্হিত কাজ তেমনি দ্বীন-ইসলামের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপের শামিল।

এ মাসআলার বিষয়ে ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বে-আমল মিথ্যুক সূফীদের স্বরূপ উম্মোচন করতেও দ্বিধা করেন নি। তিনি লিখেছেন-

‘কোন কোন মূর্খ, মন্দ ধরনের মাতালা, আধা মোল্লা, প্রবৃত্তি পূজারী কিংবা ভণ্ড সূফী এ ব্যাপারে তৎপর যে, তারা সহীহ্, মরফূ ও মুহকাম হাদীস শরীফের মোকাবেলায় কোন কোন দুর্বল কিস্সা কিংবা সন্দেহপূর্ণ ঘটনা অথবা অস্পষ্ট অর্থবোধক বিষয়াদি পেশ করে থাকে। তাদের এতটুকু বিবেক নেই কিংবা স্বেচ্ছাই বিবেকহীন সেজে বসে। বস্তুত সহীহর সামনে দুর্বল, সন্দেহমুক্ত-এর সামনে সন্দেহযুক্ত, ‘মুহকাম’-এর সামনে ‘মুতাশাবিহ’ কে পরিহার করা ওয়াজিব। ….আহা! যদি তারা গুনাহকে গুনাহ্ বলে জানতো! স্বীকার করতো! এ হঠকারিতা আরো জঘন্য যে, উচ্চাভিলাষকেও লালন করবে, অপবাদও প্রতিহত করবে! নিজের জন্য হারামকে হালাল বানাবে। শুধু তা নয়, বরং আল্লাহর পানাহ্! এর অপবাদ আল্লাহর মাহবূব বান্দাগণ ও চিশতিয়া তরীকাত শীর্ষস্থানীয় বুযুর্গগণের উপর আরোপ করে; না আল্লাহকে ভয় করে, না বান্দাদের সামনে লজ্জাবোধ করে।…..

অথচ খোদ্ হুযূর মাহবূবে ইলাহীর খলিফা মাওলানা ফখরুদ্দীন যারাভী খোদ হুযূরের নির্দেশে সামা’র মাসআলায় একটি পুস্তক ‘কাশ্ফুল কানা আন উসূলিস্ সামা’ লিখেছেন। তাতে পরিস্কারভাবে লিখেছেন- ‘আমাদের মাশাই-ই কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম-এর সামা ওই বাদ্যযন্ত্রের অপবাদ থেকে পবিত্র। তাতো নিছক কাওয়ালের আওয়াজ মাত্র ওইসব শ্লোক সহকারে সেগুলো আল্লাহর শিল্পকর্ম সম্পর্কে খবর দেয়।’

আল্লাহর ওয়াস্তে ইনসাফ করুন! খান্দানে চিশতীয়ার ওই মহান ইমামের এ এরশাদ গ্রহণযোগ্য হবে, না আজ-কালকার ওই সবলোকের ভিত্তিহীন অপবাদ ও প্রকাশ্য ফ্যাসাদ।’ [আহকামে শরীয়ত ১মখণ্ড, পৃ.৬১]

সেমা-কাওয়ালী==
পাক ভারত উপমহাদেশে বুযর্গানে দ্বীন যেখানে তাঁদের আদর্শের মাধ্যমে ইসলামের নূর প্রসারিত করেছেন, সেখানেই তারা ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতিও প্রসার করেছেন। তখনকার চিশতীয়া তরীকার মাশাইখরা হিন্দুদের মোকাবেলায় ইসলামের তাবলীগের জন্যে ‘সেমা’র পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। যা পরবর্তীতে কাউয়ালী নামে রূপ ধারণ করে। এমনকি তা বিভিন্ন যান্ত্রিক বাদ্য বাজনার সাথে অনুষ্ঠিত হতে থাকে। অথচ সূফীয়া-ই কিরামের উদ্ভাবিত ‘সেমা-মাহফিল’র সাথে বর্তমান যুগের কাউয়ালীর দূরতমও সম্পর্ক নেই। ইসলামে যেহেতু বাদ্যযন্ত্র হারাম সেহেতু ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে গিয়ে ইসলামী সমাজকে সংস্কার করার জন্যে বাদ্যযন্ত্র সহযোগে অনুষ্ঠিত কাউয়ালীকে হারাম হিসেবে মত প্রকাশ করেন। তাঁর অমর গ্রন্থ ‘আহকামে শরীয়তে’ বাদ্য- বাজনার সাথে কাউয়ালী করা সম্পর্কে বলেন, ‘‘শুধু কাউয়ালী করা জায়েয আছে। আর বাদ্রযন্ত্র হারাম। হযরত সুলতানুল মাশাইখ মাহবুবে ইলাহী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘ফাওয়াদেুল ফুয়াদ শরীফে’র মধ্যে বলেন, (মাযামীর (বাদ্যযন্ত্র) হারাম। হযরত মাখদূম শরফুল মিল্লাত ওয়াদ দ্বীন ইয়াহইয়া মুনীরী (কুদ্দিসা সিররুহ) মাযামীরকে যিনার সাথে তুলনা করেছেন। শীর্ষ স্থানীয় ওলীগণ বলেছেন, শুধুমাত্র খ্যাতি শুনেই কারো কাছে যেওনা, যতক্ষণ না শরীয়তের নিক্তির উপর তাকে অটল দেখতে না পাও। পীর ধরার (পীরের হাতে বায়আত হওয়ার) জন্যে চারটি শর্ত অবশ্যই প্রয়োজনীয়। তন্মধ্যে একটি হলো কোন ব্যাপারে পীর সাহেব শরীয়তের বিরোধিতা করবে না। না জায়েযকে না জায়েয হিসেবে জানবে। এমন স্থানে কারো সম্পর্কে বিতর্কে যাবে না।’’

এক ব্যক্তি আ’লা হযরত রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এর কাছে প্রশ্ন করলো যে, এক জায়গায় ওরসে গিয়ে দেখতে পেলাম এমন অবস্থায় কাউয়ালী হচ্ছে যে, ঢোল, দু’টি সারঙ্গী বাজছে আর কিছু কাউয়াল গাউছে পাক এবং প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শানে কাউয়ালী পরিবেশন করছে। তাদের এহেন কাজে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং আউলিয়ায়ে কেরাম খুশী আছেন কি-না? শ্রোতারা গুনাহগার হবে কি না? এবং কাউয়ালী জায়েয আছে কি না?

ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উত্তরে বলেন, ‘‘এমন কাউয়ালী হারাম; উপস্থিত সব শ্রোতারাই গুনাহগার। আর সবার গুনাহ এমনভাবে ওরস উদ্যাপনকারী ও কাউয়ালদের উপর আবির্তত হবে এবং কাউয়ালদের গুনাহও ওরস উদ্যাপনকারীদের উপর পড়বে, কিন্তু কাউয়াল এবং শ্রোতাদের গুনাহ্ এতটুকুনও হ্রাস পাবে না। কাউয়ালদের উপর সবার সমান গুনাহ এজন্য যে, তারা যদি ঢোল-সারঙ্গী ইত্যাদির মাধ্যমে কাউয়ালী না করতো, তাহলে উপস্থিত লোকদের কিভাবে গুনাহ হতো? এজন্যে তাদের সবার গুনাহ কাউয়ালদের উপর বর্তাবে। আবার কাউয়ালদের এ গুনাহের (তার নিজের ও অপরের) কারণ হলো উদ্যাপনকারীরা। তারা যদি ওরস না করতো, কাউয়ালদের আমন্ত্রণ না জানাতো, তারা কিভাবে এবং কেন আসতো, আর বাদ্য বাজাতো? সুতরাং কাউয়ালদের গুনাহ্ও ওরসকারীদের উপরই বর্তাবে।[ইমাম আহমদ রেযাঃ আহ্কামে-ই শরীয়ত দ্রষ্টব্য]

তাহলে ভেবে দেখুন, আমাদের দেশে ওরসের নামে আজ যেভাবে বাদ্য বাজনা, নাচ-গান, নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশা চলছে, তা কতইনা গর্হিত কাজ? দ্বীন ইসলামের প্রতি কতই না ঠাট্টা-বিদ্রুপের শামিল? সময় থাকতে এগুলোর প্রতিরোধ করা আমাদের অবশ্যই কর্তব্য নয় কি? এরপর ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আলায়হি হাদীস ও ফিক্বাহর দলীলাদি এবং আউলিয়ায়ে কেরামদের মতামতের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, বাদ্যযন্ত্রের সাথে কাউয়ালী না জায়েয।

এ মাসআলার উপর গবেষণা ও আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ‘বে আমল’ এবং মিথ্যুক সূফী (?) দের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে বলেন, ‘‘কিছু মুর্খ, হারাম কাজে অভ্যস্থ, অথবা মোল্লা নামধারী, নাফস দ্বারা প্ররোচিত বা মিথ্যুক সূফীরা সিহাহ হাদীসসমূহ, ‘মারফু’ (যা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত বিশুদ্ধ সনদসহ বর্ণিত) ‘মুহকাম’ (যা স্পষ্টভাবে বর্ণিত) ইত্যাদির পরিবর্তে কিছু দুর্বল কিচ্ছা অথবা সন্দেহযুক্ত ঘটনাবলী পেশ করে থাকে। তাদের কাছে এতটুকু জ্ঞানও নেই অথচ ইচ্ছাকৃতভাবে মূর্খ সাজে (না জানার ভান করে,) অথচ সহীহ (হাদীস) এর মুকাবিলায় জয়ীফ, সুনির্দিষ্ট এর মুকাবিলায় সন্দেহযুক্ত, স্পষ্ট এর স্থানে অস্পষ্ট গ্রহণ না করাটা ওয়াজিব……….।’’[প্রাগুক্ত গ্রন্থে দ্রষ্টব্য]

তাই ইমাম আহমদ রেযা ওরস উদ্যাপন করাকে বৈধ বলে মত দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাতে যেন শরীয়ত গর্হিত কোন কাজ না হয় তার শর্তারোপও করেছেন। অন্যথায় এমন ওরসে অংশগ্রহণকে পর্যন্ত তিনি হারাম বলে জানতেন।

 

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •