পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপনের রহস্য
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ আবু তৈয়ব চৌধুরী
=====
গোটা পৃথিবী অজ্ঞতা, নির্মমতা, বর্বরতা, অত্যাচার, নির্যাতন, পাপাচার, পাশবিকতায় ছিল ডুবন্ত। নারী সমাজ ছিল অবহেলিত, ভোগের বস্তু এবং অধিকার বঞ্চিত। ঠিক এহেন সংকটময় মুহূর্তে অন্ধকারে আলোক বর্তিকা হয়ে পদচ্যুত মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশনা দিতে প্রায় দেড়হাজার বছর পূর্বে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ, ১২ রবিউল আউয়াল মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে তাশরীফ আনেন মানবতার মুক্তির দূত, দু’জাহানের বাদশা বিশ্ব নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম, যার আগমনে আনন্দিত হল আকাশ-বাতাস, পশু-পাখি, সাগর-নদী, মানব-দানবসহ সমগ্র সৃষ্টি। তারই ধারাবাহিকতায় আজও সে দিবসটিকে বিশ্ব মুসলমান অত্যন্ত শ্রদ্ধা-ভালবাসায় নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে উদ্যাপন করে আসছে। এ আনন্দ উৎসবটিই মুসলিম মিল্লাতের নিকট পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হিসেবে সুপরিচিত।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্যাপনের রহস্য
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপনের রহস্য অনেক। তন্মধ্যে একটি হল উদ্যাপন দ্বারা বরকত লাভ করা এবং বরকত লাভের জন্য বিদ্যমান একাধিক মাধ্যম যথা- ১. তাবাররুক বিল আছার (রেখে যাওয়া ব্যবহৃত জিনিস থেকে বরকত হাসিল করা) যেমন: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অযুর শেষে অবশিষ্ট অতিরিক্ত পানি গ্রহণের জন্য সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম প্রতিযোগিতা আরম্ভ করতেন এবং তাদের হাতে মুখে মাসেহ করতেন।
[সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নম্বর- ৩৬৯, মুসলিম শরীফ, হাদীস নম্বর- ৫০৩]
নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দাঁড়ি ও চুল মোবারক থেকেও বরকত হাসিল করতেন। তাঁরা তাঁর থুথু, লালা মোবারক ও নাকের শ্লেষা কিছুই মাটিতে পড়তে দিতেন না।
[আশ্শিফা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ৮৭, ৮৮, হাকিকতে মুহাম্মদী- পৃষ্ঠা- ২০৫,২০৬]
তাঁরা তাঁর রক্ত, প্রশ্রাবও পান করে ফেলতেন। তাঁর পরিহিত কাপড় একজন সাহাবী গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন আমি বরকত হাসিলের জন্য তা গ্রহণ করেছি, যাতে এ কাপড়ে আমাকে কাফন পরানো হয়।
[সহীহ বুখারী শরীফ, হাদীস নম্বর-৫৬৮৯]
২. তার্বারুক বিলমাকান (স্থান থেকে বরকত হাসিল করা)। যেমন-মি’রাজ রজনীতে রাসূলে আকরামকে হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম বায়তুল লাহাম (হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম-এর জন্ম স্থান)-এ দু’রাকাত নামায আদায় করতে বললে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তা আদায় করেন।
[নাসায়ী শরীফ, হাদীস নম্বর- ৪৫০, পৃষ্ঠা- ২২২]
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সকল কর্মকাণ্ডে নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পুরোপুরি অনুসরণের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। এমনকি নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হজ্বের সময় যে সকল স্থানে অবস্থান করেছেন, তিনিও পরবর্তীতে সে সকল স্থানে অবস্থানের মাধ্যমে বরকত হাসিল করেন। [সুনানে ইবনে মাজাহ্, পৃষ্ঠা-০৩]
একদা তিনি হাজরে আস্ওয়াদকে সম্বোধন করে বলেন, আমি জানি তুমি শুধুই পাথর, তোমার লাভ-ক্ষতির ক্ষমতা নেই, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তোমাকে চুমু দিতে না দেখলে আমি তোমাকে কখনো চুমু দিতাম না। [সহীহ মুসলিম শরীফ, হাদীস নম্বর-২১২৮, পৃষ্ঠা-৬৬]
অনুরূপভাবে সাফা মারওয়া সায়ী করা, আরাফা, মিনা, মুজদালিফায় অবস্থান, মিনায় কংকর নিক্ষেপ, মকামে ইব্রাহীমে নামায আদায় সবই এ ধরনের তাবাররুক লাভের অন্তর্ভূক্ত।
৩. তাবাররুক বিয্যামান (সময় থেকে বরকত হাসিল করা)। যেমন- লায়লাতুল ক্বদর। জ্ঞাতব্য বিষয় যে, প্রতি বৎসর এ রাতে পবিত্র ক্বোরআন মজিদ নাযিল হয়না, কিন্তু এ রাত কিয়ামত পর্যন্ত বরকতময়। ইয়াওমে আশুরা তথা মহররম মাসের দশ তারিখ প্রতি বৎসর ফিরআউন নীল নদে ডুবে না, আর হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম প্রতি বছর ফিরআউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি পান না। এতদসত্ত্বেও এ দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকত মণ্ডিত কিয়ামত পর্যন্ত। সেহেতু উক্ত দিবসে রোজা পালন উন্নত পানাহারের ব্যবস্থা, দান-সদকা, ইবাদত বন্দেগী অতীব গুরুত্বের সাথে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
উপরোক্ত বস্তু, স্থান ও সময় দ্বারা বরকত লাভ করার পবিত্র বৈধতা সুস্পষ্ট দলিলাদির মাধ্যমে প্রমাণিত হলো। আর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন উপরোক্ত তৃতীয় প্রকার তথা সময় থেকে বরকত হাসিল করা। কারণ মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন যে নেহায়ত তাৎপর্যপূর্ণ ও বরকতময় তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ মর্মে মহান আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘আমি আপনাকে গোটা পৃথিবীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।’’ [সূরা আম্বিয়া: আয়াত-১০৭]
এ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে বুঝা গেল তাঁর আগমনের দিনটি সৃষ্টির জন্য কল্যাণময়, গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময়। ইমাম কস্তুলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মদিন ক্বদরের রজনী থেকে উত্তম। [আল্ মাওয়াহিবুল লুদুনিয়া, মাক্তাবুত্ তাওফিকিয়্যাহ্]
কারণ লায়লাতুল ক্বদরের মর্যাদা পবিত্র ক্বোরাআন নাযিলের কারণে। আর ক্বোরআন যার উপর নাযিল হয়েছে তাঁর জন্মের রাতটি আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আর সে কারণেই তো তিনি নিজেই নিজের জন্মদিবস প্রতি সোমবার রোজা পালনের মাধ্যমে উদ্যাপন করেছেন। কাজেই প্রতি বছর ১২ই রবিউল আউয়াল ঈদ-এ মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অতি ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসার মাধ্যমে ইসলামী বিধির আলোকে উদ্যাপন করা আল্লাহ্ প্রদত্ত নেয়ামত, রহমত, বরকত, মাগফিরাত লাভের অন্যতম উসিলা।
পবিত্র মিলাদুন্নবী (দ.) উদ্যাপনের উপকারিতা
ক্বোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াস সমর্থিত পন্থায় পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী উদ্যাপন করা এটা হারাম, বিদ্আত, নাজায়েয তো নয়ই বরং তাহল সুন্নাতে ইলাহি, সুন্নাতে সাহাবা, আউলিয়া, অফুরন্ত সাওয়াব আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম উসিলা এবং দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে শান্তি ও মুক্তি অর্জনের উৎকৃষ্টতম উপায়। হাকীকতে মুহাম্মদী: পৃষ্ঠা-৪১০, শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রাহ.) মা সাবাতা মিনাস সুন্নাহ্: ৮৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্ম গ্রহণের সংবাদে খুশি হয়ে আবু লাহাব তার বাঁদী সুয়াইবিয়াকে আযাদ (দাসত্ব থেকে মুক্তি) করার কারণে প্রতি সোমবার দোজখের শাস্তি তার জন্য হালকা করা হয়। যদি কোন মুসলমান নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করে আনন্দিত হয় এবং সাধ্যানুযায়ী খরচ করে তাহলে তাঁর অবস্থা কিরূপ হবে? নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ‘দয়া’ ও ‘অনুগ্রহে’ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। প্রিয়নবীজী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অকৃত্রিম ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে সহীহ নিয়্যতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য মিলাদুন্নবী অনুষ্ঠান করলে তবে সেই ঘরে, সে মহল্লায় আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। আর দরূদ ও জিকিরের বরকতে আল্লাহর ফজল ও করমে ঐ ঘরে ও মহল্লার অধিবাসীগণের বিপদসমূহ দূরীভূত হয়।
[আবদুল হাই লাখনবী- মাজমুয়ায়ে ফতোয়ায়ে লাখনবী: খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা- ২৮, হাকিকতে মুহাম্মদী: ৪১১]
লেখক: অধ্যক্ষ মাদ্রাসা-এ তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া ফাযিল, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।