কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাম উদযাপন- মুহাম্মদ রবিউল আলম

0

কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ঈদে মিলাদুন্নবীসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামাম উদযাপন
মুহাম্মদ রবিউল আলম

===

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার আগমনের দিন কেবল মুসলমান নয়, সৃষ্টিজগতের সকলের জন্য আনন্দ ও রহমতের দিন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেন-وما أرسلناك إلا رحمة للعالمين “আমি আপনাকে জগতসমূহের রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” সারা বিশ্বের মুসলিমগণ অত্যন্ত ভক্তি ও মর্যাদার সাথে রবিউল আউয়াল মাসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করে থাকেন। কিন্তু এক দল আলেম এটিকে অবৈধ ও বিদয়াতে সাইয়্যিআহ (মন্দ বিদআত) বলে অপপ্রচার করছে। অথচ এটি একটি শরিয়ত সম্মত পুণ্যময় আমল, যা কুরআন, সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। অত্র প্রবন্ধে এটি শরিয়ত সম্মত হবার বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছি।

১. ঈদে মিলাদুন্নবী পরিচিতি
ক.শাব্দিক পরিচয়
‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ শব্দটি যৌগিক শব্দ। যা তিনটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। এক. ঈদ, দুই. মিলাদ, তিন. নবী। প্রথমত: ঈদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ উৎসব, আনন্দ, খুশি। বিশ্ববিখ্যাত অভিধান প্রণেতা ইবনুল মুনযির বলেন- العيد كل يوم فيه جمع ‘সমবেত হবার প্রত্যেকদিনকে ঈদ’ বলা হয়। মুফতি আমীমূল ইহসান আলাইহির রাহমাহ বলেন- العيد كل يوم فيه جمع او تذكار لذي فضل “কোন মর্যদাবান ব্যক্তিকে স্মরণের দিন বা সমবেত হওয়ার দিনকে ঈদের দিন বলা হয়।”
দ্বিতীয়ত: মিলাদ শব্দটি আরবি। এর শাব্দিক অর্থ: জম্মকাল, জম্মদিন। এ অর্থে ‘মাওলিদ’ শব্দের ব্যবহার আরবি ভাষায় অত্যধিক।
তৃতীয়ত: নবী, এখানে নবী বলতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।
সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ অর্থ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র আগমন উপলক্ষে আনন্দ উদযাপন।

খ. ‘ঈদে মিলাদুন্নবীর পরিচয়
এ ধরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা’র আগমন উপলক্ষে আনন্দিত হওয়া এবং এ অদ্বিতীয় নিয়ামত পাবার কারণে সৎকাজ ও ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করাকে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলা হয় ।

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা বৈধ ও উত্তম আমল, যা পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফ দ্বারা প্রমাণিত। এ বিষয়ে কুরআন-হাদিসের দলিল-প্রমাণ সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হল।

ক. কুরআন মাজিদের আলোকে
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ কুরআন মজিদে নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন-فاذكروني اذكركم واشكروا لي ولاتكفرون “সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমি তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।” এ থেকে বোঝা গেল যে, আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপন করা প্রত্যেক মানুষের ওপর অপরিহার্য। শোকরিয়া জ্ঞাপনের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। যেমন আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের বর্ণনা দেওয়া, নিয়ামতের ওপর আনন্দ উদযান করা, ঈদ উদযান করা ইত্যাদি।

ঈদ উদযাপন করা
আল্লাহর নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমেও নিয়ামতের শোকরিয়া করা যায়। যেমন হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছিলেন- ربنا أنزل علينا مائدة من السماء تكون لنا عيدا لاولنا واخرنا واية منك “হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা প্রেরণ করুন; এটি আমাদের ও আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের জন্য হবে ঈদ স্বরূপ এবং আপনার নিকটি হতে নিদর্শন হবে।”

হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার নিকট ফরিয়াদ করেছিলেন যেন তিনি তাঁদের জন্য আসমান হতে খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ করেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বলেছেন যে, খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা অবতীর্ণ হলে তাঁরা সে দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করবেন। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁদের ওপর সেই নিয়ামত রবিবারে অবতীর্ণ করেছিলেন বিধায় তাঁরা আজও রবিবারকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। কুরআন মাজিদের এ আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার স্বীকৃতি রয়েছে; কারণ তিনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের ঈদ উদযাপনের স্বীকৃতি দিয়ে তাঁর উক্তি পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করেছেন এবং কোন প্রকার নিষেধ করেননি। এটি অবৈধ হলে তিনি অবশ্যই তা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করতেন না।

ঈসা আলাইহিস সালামের উম্মতদের ওপর খাদ্যপূর্ণ খাঞ্চা রবিবারে অবতীর্ণ হবার কারণে সেদিনকে যদি ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা যায়, তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমনের দিনকে কেন ঈদের দিন হিসেবে মানা যাবে না? অথচ তিনিই হলেন সবচেয়ে বড় নিয়ামত । সুতরাং তুলনামূলক ছোট নিয়ামতের শোকরিয়া স্বরূপ সেই নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে উদযাপন করা বৈধ হলে নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত পাবার দিনকে ঈদের দিন হিসেবে মানা ও উদযাপন করা বৈধ।

খুশি উদযাপন করা
আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনের একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল নিয়ামতের ওপর খুশি উদযাপন করা। তাই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন- قل بفضل الله وبرحمته فبذلك فليفرحوا هو خير مما يجمعون “(হে রাসুল) আপনি বলুন, আল্লাহর অনুগ্রহ(ফদ্বল) ও দয়া (রহমত)কে স্মরণ করে সেটার ওপর তারা যেন খুশি প্রকাশ করে। তা তাদের সঞ্চয়কৃত সমস্ত ধন-সম্পদ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর।”

এ আয়াতে মহান রাব্বুল আলামীন খুশি উদযাপনের দুটি কারণ সাব্যস্ত করেছেন। একটি হল “ফদ্বল”(فضل) পাওয়া আর অপরটি হল “রহমত” (رحمة) অর্জন করা। এতদুভয়ের মর্ম কী- এর ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসির বিশারদ আল্লামা মাহমূদ আলুসী , ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী, ইমাম আবু হাইয়ান আনদালূসী আলাইহিমুর রাহমাহ্ স্ব-স্ব তাফসীর গ্রন্থে তাফসিরকারকদের শিরোমণি হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, এখানে “ফদ্বল” দ্বারা জ্ঞান এবং “রহমত” দ্বারা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুঝানো উদ্দেশ্য। আল্লামা ইবনু জাওযী (রহ.)বলেন- ان فضل الله العلم ورحمته محمد صلى الله عليه وسلم رواه الضحاك “নিশ্চয় আল্লাহর “ফদ্বল” হলো জ্ঞান আর “রহমত” হল হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম; যা ইমাম দ্বাহ্হাক রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেছেন।

আল্লামা তাবরীযী উল্লিখিত আয়াতের অর্থ করতে গিয়ে বলেন-
وإرسال محمد فافرحوا بفضل الله عليكم ورحمته لكم بإنزال هذا القران إليكم فانكم تحصلون بهما نعيما دائما مقيما هو خير لكم من هذه الدنيا الفانية
“তোমাদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে এবং কুরআন অবতীর্ণ করে আল্লাহ তায়ালা তোমদের ওপর যে দয়া ও করুণা করেছেন, তাতে তোমরা খুশি উদযাপন কর। কেননা উভয়ের (ফদল ও রহমত) মাধ্যমে নিশ্চয় তোমরা চিরস্থায়ী নিয়ামত অর্জন করবে, যা এ নশ্বর পৃথিবী থেকে তোমাদের জন্য অধিকতর শ্রেয়।”

ইমাম বাক্বির রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু প্রখ্যাত মুফাসসির হযরত ক্বাতাদাহ্, হযরত মুজাহিদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা প্রমুখ থেকে বর্ণনা করেন যে, “ফদ্বলুল্লাহ” (فضل الله) দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বুঝানো হয়েছে।

উল্লিখিত আয়াতে “রহমত” দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা বুঝানো হয়েছে। এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আল্লাহ তায়ালা তাঁকে উদ্দেশ করে ইরশাদ করেছেন-وما أرسلناك إلارحمة للعالمين “আমি আপনাকে বিশ্বজগতের জন্য রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি।” প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা মাহমূদ আলূসী আলাইহির রাহমাহ প্রমুখের মতে “রহমত” হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি নাম। এ ছাড়াও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন বিশ্ববাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত। এতে কারো দ্বিমত নেই। তাই আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- لقد من الله على المؤمنين إذ بعث فيهم رسولا من أنفسهم “আল্লাহ মুমিনদের ওপর বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, তিনি তাদের নিজেদের মধ্য থেকে তাদের নিকট রাসূল প্রেরণ করেছেন।”

সুতরাং প্রতীয়মান হয় যে, রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্ববাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ অনুগ্রহ ও নিয়ামত। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা এ অনুগ্রহ তথা রাসূলুল্লাহকে পাবার ওপর খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। আর রাসূলুল্লাহকে পাবার দিন হল ‘মিলাদুন্নবী’ এবং ‘মিলাদুন্নবী’ কে কেন্দ্র করে খুশি উদযাপন করাই হল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’, যা পালন করার নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহই দিয়েছেন। দেওবন্দীদের নির্ভরযোগ্য আলেম আশরাফ আলী থানভীও বলেন যে, “উল্লিখিত আয়াতে “রহমত” ও “ফদল” দ্বারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা বুঝানো হয়েছে, যাঁর জন্মের ওপর আল্লাহ তায়ালা খুশি উদযাপনের নির্দেশ দিয়েছেন। কারণ তিনি সকল নিয়ামতের মূল। তাই তাঁর আগমনে যতই খুশি উদযাপন করা হোক না কেন, তা কমই হবে।”

এ ছাড়াও উপরিউক্ত আয়াতের ‘রহমত’ শব্দ দ্বারা বিশেষভাবে রাসূলুল্লাহ এবং ‘আম’ বা ব্যাপক অর্থে অন্যসব নি’মাত ও রহমত বুঝানো হয়েছে। কারণ তিনি সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহর বড় রহমত। আল্লাহর অন্যান্য নিয়ামতের মত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা যেহেতু একটি নিয়মত, সেহেতু তাঁর আগমনের ওপর খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশ পালন মাত্র। আর রাসূলুল্লাহর জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করার নামই হল ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’।

অতএব কুরআনের আয়াত থেকে প্রমাণিত হল যে রাসূলের জন্ম উপলক্ষে খুশি উদযাপন করা আল্লাহর নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত । খুশি উদযাপনের ক্ষেত্রে সকল বৈধ পন্থা গ্রহণ করা শরিয়ত সম্মত। তাই মুসলিমগণ একত্র হয়ে মানুষের প্রতি আল্লাহর বড় কৃপার কথা তথা রাসূলের আগমনের কথা স্মরণ করে, রাসুলের জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করে, ঈসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে খানা-পিনার আয়োজন করে এবং দান-সদকা ইত্যাদির ব্যবস্থা করে। মোট কথা খুশি উদযাপনের বহিঃপ্রকাশ শরিয়ত সম্মত পন্থায় হলে তাতে কোন অসুবিধা নেই।

মহান আল্লাহ কর্তৃক মিলাদুন্নবী উদযাপন
পূর্বেই বলা হয়েছে যে মিলাদুন্নবি উদযাপন বলতে নবীর জন্মকে স্মরণ করা এবং তাঁর জীবন-বৃত্তান্ত বর্ণনা করা। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে পঁচিশজন নবী রাসূলের মধ্যে হযরত আদম, হযরত মূসা, হযরত ইয়াহইয়া, হযরত ঈসা ও হযরত মুহাম্মদ আলাইহিমুস সালামের জন্ম-বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। যেমন হযরত ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন- وسلام عليه يوم ولد“তাঁর প্রতি সালাম, যেদিন তিনি (ইহইয়া আ.) জন্মলাভ করেন ।” এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হযরত ইহইয়া আলাইহিস সালামের জন্মকালের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এটার নাম ‘মিলাদুন্নবী’ বা নবীর জন্মকাল। তিনি পবিত্র কুরআনে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে ইরশাদ করেন-
لقد جاءكم رسول من أنفسكم عزيز عليه ما عنتم حريص عليكم بالمؤمنين رؤف رحيم
“অবশ্যই তোমাদের (আরবগণ) মধ্য থেকেই (বংশ থেকে) তোমাদের নিকট এসেছেন এক রাসূল। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর জন্য কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, পরম দয়ালু।।’
এ আয়াতে মহান আল্লাহ আরবদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, তাঁদের নিকট তাঁদের বংশ থেকেই এক মহান রাসূল এসেছেন। এখানে আসার অর্থ হল জন্ম গ্রহণ করা। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম তথা ‘মিলাদুন্নবী’র কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও তিনি অসংখ্য আয়াতে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমনের কথা উল্লেখ করেছেন। এভাবে তিনি তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলের জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করেছেন। এটা ‘মিলাদুন্নবী’ উদযাপন।

খ.হাদীস শরীফের আলোকে
ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা হাদীসস শরিফ দ্বারাও প্রমাণিত। রাসূলুল্লাহ নিজেও শোকরিয়া স্বরূপ এ ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করেছেন, ছাগল জবাই করে এবং রোযা রেখে। এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলঃ

১.প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহ তায়ালা আনহুমা বলেন-
قدم النبي المدينة فرأى اليهود تصوم يوم عاشوراء فقال: ما هذا؟ قالوا: هذا يوم صالح هذا يوم نجى الله بني اسرائيل من عدوهم فصامه موسى قال فأنا أحق بموسى منكم فصامه وأمر بصيامه
“নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরিফ আগমন করলেন এবং সেখানে ইয়াহুদিদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- এটা কিসের রোযা? তারা বলল, এটা উত্তম দিন আর এ দিনেই আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাঁদের শত্র“দের থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোযা রেখেছিলেন। রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন, তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালামের আমিই অধিকতর হক্বদার। অতঃপর তিনি স্বয়ং রোযা রাখলেন এবং তাঁর উম্মতদের এ রোযা রাখার নির্দেশ দিলেন।’

২.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমা অন্য হাদিছে বর্ণনা করেন-
هذا اليوم الذي أظفر الله فيه موسى وبني اسرائيل على فرعون ونحن نصومه تعظيما له فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم : نحن اولى بموسى منكم ثم امر بصومه
“এ দিনেই আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং বনি ইসরাঈলদেরকে ফিরআউনের ওপর বিজয় দান করেছেন। আমরা এ দিনের সম্মানার্থে রোযা রাখছি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-“আমরা তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালাম’র অধিকতর হক্বদার।” তারপর তিনি (মুমিনদেরকে)এ রোযা রাখার নির্দেশ দেন।”
উপরিউক্ত হাদীস দু’টি থেকে যা বোঝা যায় –

এক. আশুরার দিনে আল্লাহ তায়ালা হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এবং বনি ইসরাঈলকে ফিরআউনের কবল থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এ কারণে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে হযরত মূসা আলাইহিস সালাম রোযা রেখেছেন। সুতরাং আমরা সৃষ্টির সবচেয়ে বড় নিয়ামত রাসূলুল্লাহকে পাবার দিনকে স্মরণ করে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করে মিলাদুন্নবি উদযাপন করি।

দুই. ইয়াহুদিরা নিয়ামত পাবার দিনকে স্মরণ করে প্রতি বছর একই দিনে রোযা রাখতেন। এ কথা রাসূলুল্লাহ জেনেও বলেননি যে, তোমরা তো অনেক বছর পূর্বে নিয়ামত পেয়েছ, তা এখন স্মরণ করে প্রতি বছর রোযা রাখার প্রয়োজন নেই; বরং নিয়ামত পাবার দিনকে স্মরণ করে উদযাপন করার প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।

তিন. মূসা আলাইহিস সালাম’র মুক্তির দিনকে স্মরণ করে রাসূলুল্লাহ স্বয়ং নিজেও রোযা রেখেছেন এবং তাঁর উম্মতদেরকে এ রোযা রাখার নির্দেশ দেন। সুতরাং নিয়ামতের দিনকে সৎকাজের মাধ্যমে উদযাপন করা এবং রাসূলুল্লাহকে পাবার দিনকে স্মরণ করে ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপন করা স্বয়ং রাসুলুল্লাহর সুন্নাত।
বিশ্বখ্যাত ইমাম জালাল উদ্দিন সুয়ূতী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
وقد سئل شيخ الإسلام حافظ العصر ابو الفضل ابن حجر عن عمل المولد فأجاب بما نصه : قال وقد ظهر لي تخريجها على أصل ثابت وهو ثبت في الصحيحين من – ان النبي صلى الله عليه وسلم قدم المدينة فوجد اليهود يصومون يوم عاشوراء فسالهم فقالوا: هو يوم أغرق الله فيه فرعون ونجى موسى فنحن نصومه شكرا لله تعالى فيستفاد منه فعل الشكر لله تعالى على ما من به في يوم معين من اسداء نعمة أو دفع نقمة ويعاد ذلك في نظير ذلك اليوم من كل سنة والشكر لله تعالى يحصل العبادات كالسجود والصيام و الصدقة والتلاوة وأي نعمة أعظم من النعمة بيروز هذا النبي صلى الله عليه وسلم الذي هو بني الرحمة في ذلك اليوم له
“(বিশ্ববিখ্যাত হাদিস বিশারদ) শাইখুল ইসলাম ইবনে হাজর আসকালানীকে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের ভিত্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনের মূল ভিত্তি আমার নিকট সুস্পষ্ট হয়েছে, যা সহীহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম শরিফে রয়েছে। সেই ভিত্তিটা হল- নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরিফে আগমন করলে, তিনি সেখানকার ইয়াহুদিদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখে তাদেরকে এ রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর তারা বলল, এ দিনে আল্লাহ তায়ালা ফিরয়াউনকে ডুবিয়ে মেরেছেন আর হযরত মূসা আলাইহিস সালাম কে মুক্তি দিয়েছেন। এ কারণে আমরা আল্লাহ তায়ালার শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে রোযা রাখছি। এ হাদিছ শরিফ থেকে প্রমাণিত হয় যে, নির্দিষ্ট দিনে আল্লাহর রহমত পাবার কারণে বা কোন বিপদ থেকে মুক্তি লাভের পর আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করা বৈধ। প্রতি বছর সেই একই দিনে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করা যাবে আর আল্লাহ তায়ালার শোকরিয়া জ্ঞাপন বিভিন্ন রকম ইবাদতের মাধ্যমে করা যায় যেমন নামায, রোযা, সদকা এবং কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি। আমাদের জন্য যেদিন নবি করিম রাহমাতুল্লিল আলামিন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করেন, সেদিনের চেয়ে বড় নিয়ামত আর কী হতে পারে?” উল্লিখিত বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী আলাইহির রাহমাহ আশুরার হাদিছকে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনের গ্রহণযোগ্য ভিত্তি বলেছেন এবং তা প্রতি বছর পালনের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। সুতরাং ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করা শরিয়ত সম্মত একটি সৎকাজ।

২. হযরত আবু ক্বাতাদাহ আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন-
إن رسول الله صلى الله عليه وسلم سئل عن صوم يوم الاثنين قال: ذاك يوم ولدت فيه ويوم بعثت او أنزل على فيه
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সোমবারে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি বলেন, সেদিন আমার জন্ম হয়েছে, আমি নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছি এবং আমার ওপর কুরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।” উল্লিখিত হাদিছ শরিফ থেকে বোঝা গেল যে, তিনি জন্মদিন উপলক্ষে রোজা রাখার মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করতেন। সুতরাং আল্লাহর নিয়ামতের শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করা রাসূলুল্লাহর সুন্নাত।
৩. হযরত আউস বিন আউস রাদ্বিয়অল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- أن من أفضل اياكم يوم الجمعة فيه خلق آدم “তোমাদের দিনসমূহের মধ্যে শুক্রবার শ্রেষ্ঠতর দিন। (কারণ) এ দিনে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” হযরত আবু হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- أن يوم الجمعة يوم عيد “নিশ্চয় শুক্রবার হল ঈদের দিন।” হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস রাদ্বিয়অল্লাহু তায়ালা আনহুমা বর্ণনা করেন,

রাসূলুল্লাহ ইরশাদ করেন-
أن هذا يوم عيد جعله الله للمسلمين فمن جاء إلى الجمعة فليغسل وإن كان طيب فليمس منه وعليكم بالسواك
“নিশ্চয় এ দিন ( শুক্রবার) ঈদের দিন, যাকে আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের জন্য নির্ধারণ করেছেন। যে ব্যক্তি জুমার নামায পড়তে আসে, সে যেন গোসল করে আসে আর তার কাছে যদি সুগন্ধি থাকে, তাহলে সে যেন তা থেকে কিছু শরীরে লাগিয়ে আসে। তোমাদের ওপর মিসওয়াক করা আবশ্যক।”
উল্লিখিত হাদিছসমূহ থেকে বোঝা গেল যে, শুক্রবার হযরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করার কারণে সেদিনকে উত্তম দিন এবং ঈদের দিন বলা হয়েছে। সুতরাং যেদিন সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী আগমন করেছেন, সেদিনকে কেন ঈদের দিন হিসেবে মানা যাবে না?

৪. হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন-
إن النبي صلى الله عليه وسلم عق عن نفسه بعد النبوة
“নবুয়ত প্রকাশের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই নিজের আক্বীক্বাহ করেছেন।” এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বিশ্ববিখ্যাত ইমাম জালাল উদ্দিন সূয়ূতী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন-
ان جده عبد المطلب عق عنه في سابع ولادته والعقيقة لاتعاد مرة ثانية فيحمل ذلك على أن الذي فعله النبي صلى الله عليه وسلم إظهارا للشكر على إيجاد الله تعالى رحمة للعالمين وتشريفا لامته كما كان يصلي على نفسه لذلك فيستحب لنا ايضا إظهار الشكر بمولده باجتماع الاخوان وإطعام الطعام ونحو ذلك من وجوه القربات وإظهار المسرات
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দাদা রাসুল্ল্লুাহ জন্মের সপ্তম দিনে রাসূলে করিমের আকিকা করেন। অথচ আক্বীক্বাহ দু’বার হয় না। সুতরাং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার যে আকীকাহ করেছেন, তা ছিল আল্লাহ তায়ালার শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে। কেননা, আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামীন’ এবং উম্মতের কাছে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপনার্থে নিজের ওপর দরুদ শরিফ পাঠ করতেন। অতএব রাসূলুল্লাহর জন্ম উপলক্ষে মুসলিম ভাইদের একত্র হবার মাধ্যমে, খানা খাওয়ানো, অন্যান্য ইবাদত পালন এবং ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে আল্লাহর শোকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্যও মুস্তাহাব।” এ বর্ণনা থেকে বোঝা গেল যে, রাসূলুল্লাহর জন্ম উপলক্ষে ‘ঈদে মিলাদুন্নবি’ উদযাপন করা স্বয়ং রাসুলুল্লাহর সুন্নাত আর আমরা এ সুন্নাতের উপরই আমল করি। এ ব্যাখ্যা বর্তমান সময়ের নয়; বরং শত শত বছর পূর্বের যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ, মুফাসসির, ফিকাহবিদ ও ইতিহাসবিদের।
৫. সহীহ বুখারী শরিফে রয়েছে-
فلما مات ابو لهب أريه بعض أهله شر حاله قال له : ماذا لقيت قال ابو لهب لم الق بعدكم غير أني سقيت في هذه بعتاقي ثوبية
“আবু লাহাবের মৃত্যুর পর তার পরিবারের কাউকে (হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু) স্বপ্ন দেখানো হল যে, সে খারাপ অবস্থায় আছে। স্বপ্নদ্রষ্টা তাকে বলল, তোমার কী অবস্থা? আবু লাহাব বলল, আমি অত্যন্ত আযাবের মধ্যে রয়েছি; তবে (রাসূলুল্লাহর জন্মের ওপর খুশি হয়ে) ছুয়াইবাহকে মুক্তি দেয়ার কারণে (সেদিন তথা সোমবার) আমাকে পান করানো হয়।’ ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী আলাইহির রাহমাহ ইমাম সুহাইলী আলাইহির রাহমাহ থেকে বর্ণনা করেন-
إن العباس : قال لما مات ابو لهب رأيته في منامي بعد حول في شر حال فقال ما لقيت بعدكم راحة إلا أن العذاب يخفف عني كل يوم اثنين قال ذلك أن النبي صلى الله عليه وسلم ولد يوم الاثنين وكانت ثويبة بشرت ابا لهب بمولده فاعتقها
“হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলেন, আবু লাহাবের মৃত্যুর এক বছর পর আমি তাকে স্বপ্নে দেখেছি যে, সে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। অতঃপর সে বলল; তোমাদের ছেড়ে আসার পর আমি কোন শান্তি পাইনি; তবে প্রতি সোমবার আমার শাস্তি কিছুটা কমানো হয়। (ইমাম সুহাইলি বলেন) কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবারে জন্ম গ্রহণ করেছেন আর আবু লাহাবের দাসী ছুয়াইবা রাসূলুল্লাহর জন্ম গ্রহণের সুসংবাদ আবু লাহাবকে দিলে সে তাকে (আনন্দিত হয়ে) দাসত্ব থেকে মুক্ত করে দেয়।’

এ হাদিছের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনুয জাযরী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
فاذا كان ابو لهب الكافر الذي نزل القرآن بذمه جوزى في النار بفرحة ليلة مولد النبي صلى الله عليه وسلم فما حال المسلم الموحد م أمة محمد صلى الله عليه وسلم بنشره مولده وبذل ما تصل اليه قدرته في محبته صلى الله عليه وسلم لعمري إنما يكون جزاء من الله الكريم أن يدخله بفضله جنات النعيم
“কাফের আবু লাহাব যার নিন্দায় কুরআনের একটি সূরা ( সূরা লাহাব) অবতীর্ন হয়েছে, সে যদি ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনের কারণে কম শাস্তি ভোগ করে, তাহলে উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে সে মুসলিম ব্যক্তির কী প্রতিদান হতে পারে, যে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করেন এবং এ উপলক্ষে রাসূলূল্লাহর প্রেমে তাঁর সামর্থ অনুযায়ী খরচ করেন। আমার জীবনের কসম করে বলছি- দয়াময় আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতিদান হল, আল্লাহ তাঁকে ‘জান্নাতুন নয়ীমে’ প্রবেশ করাবেন।”

উপরিউক্ত হাদিস সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ শাইখ আব্দুল হক মুহাদ্দিছ দেহলভী আলাইহির রাহমাহ বলেন-
“এ হাদিছ ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপনকারী এবং এর জন্য সম্পদ ব্যায়কারীদের প্রমাণ। আবু লাহাব, যার নিন্দায় কুরআনের একটি সূরা (লাহাব) অবতীর্ণ হয়েছে, সে যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্মের ওপর খুশি হয়ে তার দাসী (ছুয়াইবা) কে স্বাধীন করে দেয়ার কারণে শাস্তি কম ভোগ করে, তাহলে সে মুসলিমের কী অবস্থা হবে, যে রাসূলুল্লাহর ভালবাসা নিয়ে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ উদযাপন করে এবং ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপনে সম্পদ ব্যায় করে? তবে মন্দ বিদয়াত যেমন নাচ, গান, হারাম বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা উচিত; কেননা এগুলোর কারণে (মিলাদুন্নবী উদযাপনের) বরকত পাওয়া যাবে না।”

আল্লামা আব্দুল হাই লাকনভী বলেন-“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্মের ওপর খুশি হবার কারণে আবু লাহাবের মত কাফেরের যখন শাস্তি কমে গেল, তাহলে রাসূলূল্লাহর উম্মতের মধ্যে যে রাসূলুল্লাহর জন্মের ওপর খুশি উদযাপন করবে এবং তাঁর প্রেমে ঈদে মিলাদুন্নবি উদযাপনে সামর্থ অনুযায়ী খরচ করবে সে কেন সুউচ্চ মর্যাদা পাবে না?’ উপরে বর্ণিত হাদিছসমূহ থেকে প্রমাণিত হল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র জন্ম উপলক্ষে ‘ঈদে মিলাদুন্নবি’ উদযাপন করা শুধু বৈধ নয়; বরং অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। এটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহর সুন্নাত।

উপরিউক্ত পর্যালোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে,পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা শুধু মাত্র বৈধই নয়; বরং মহান আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি এবং দুনিয়া -আখেরাতের সার্বিক কল্যাণ হাসিলের খুবই শক্তিশালী মাধ্যম। যেমন ইবনে তাইমিয়া বলেন “মিলাদুন্নবীকে সম্মান করা এবং উৎসব হিসেবে গ্রহণ করা যেভাবে মানুষেরা করে থাকেন,এতে উদযাপনকারীর সৎ উদ্দেশ্যে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মান করার কারণে তাঁর জন্য রয়েছে মহান প্রতিদান ।”
[ইবন রজব,ইক্বতিজাউস সিরাতিল মুস্তাকিম,দারু আলামিল কুতুব, বৈরুত,৭ম সংস্করণ,১৪১৯ হি,খ.২,পৃ.১২৬।]

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা কুরআন-সুন্নাহ সম্মত হওয়া সত্ত্বেও একে অস্বীকার করা পথভ্রষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং মুমিনদের উচিত কোন প্রকার অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে বিশুদ্ধ নিয়্যত ও নিয়মে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উদযাপন করা। তাছাড়া অনেকে বলে থাকে যে, ১২ রবিউল আওয়াল রাসূলে করিমের জন্মের কারণে খুশি উদযাপনের পাশাপাশি একই দিনে ওফাতের কারণে শোক দিবস পালন করাও উচিত। আসলে তাদের এ কথাটা ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কারণ, প্রথমত, কারো ওফাতের তিনদিন পর শোক পালন করা বৈধ নয়। তাছাড়া, মীলাদুন্নবী উদযাপনের ক্ষেত্রে হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র জন্মকেই প্রাধান্য দেয়া হবে।

লেখক: প্রভাষক- আল কুরআন এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •