‘মাক্বাম-ই মাহমুদ’র তাৎপর্য – মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন আল্কাদেরী

0

‘মাক্বাম-ই মাহমুদ’র তাৎপর্য

মাওলানা মুহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন আল্কাদেরী

====

মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে মানুষের হেদায়তের জন্য এ পৃথিবীতে অসংখ্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানবজাতিকে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন। নবী-রাসূলগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলেন আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়ুিুহ ওয়াসাল্লাম। তিনি সকল নবী-রাসূলের সর্দার এবং আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট সৃষ্টি। সৃষ্টি জগতের মধ্যে তাঁর মত কেউ নেই। খোদার পর সৃষ্টির মধ্যে তাঁরই স্থান। তিনি আল্লাহর প্রিয় হাবীব। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে অসংখ্য মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘মকামে মাহমুদ’। মকামে মাহমুদের একাধিক ব্যাখ্যা থাকলেও অধিকাংশ মুহাদ্দিসীনের মতে ‘মকামে মাহমুদ’ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুপারিশ করার সুমহান মর্যাদা।
কিয়ামত দিবসে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সকল নবী-রাসূলের ইমাম এবং সকল আদম সন্তানের পথ নির্দেশক ও সর্দার হবেন। লিওয়ায়ে হামদ বা হামদের ঝাণ্ডা তাঁর পবিত্র হাত মোবারকে সে দিন শোভা পাবে। সৃষ্টির আদি-অন্তের সবাই কাতার বন্দী হয়ে তাঁর প্রশংসা করতে থাকবে। মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ পোশাক মোবারকে সেদিন তাঁকে অসাধারণ দেখাবে। পবিত্র আরশে তিনি উপবিষ্ট থাকবেন। আরশে আযীমের উপর তাঁর জন্য বিশেষ আসন সজ্জিত থাকবে, যাতে তিনি মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশনায় তাশরীফ রাখবেন। সকল উম্মত আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তাঁরই সুপারিশ প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা করতে থাকবে। হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘শাফায়াতে কুবরা’র (বৃহত্তম সুপারিশ) বিশেষ অনুমতি দেয়া হবে। তিনি গুনাহগার উম্মতের জন্য সুপারিশ করবেন। আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে (পরকালের) বিচার দিবসে তাঁর জন্য এক বিশেষ মর্যাদার আসন সংরক্ষিত থাকবে, যাকে বলা হয় ‘মাক্বামে মাহমুদ’ বা প্রশংসিত অবস্থান। সে দিন তাঁর যে সব অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাবে, সব কিছু ‘মাক্বামে মাহমুদ’র অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে।

পরকালীন জীবনে হুযূর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র প্রাপ্য সকল অনন্য ও অসাধারণ বৈশিষ্ট্য ‘মাক্বামে মাহমুদ’ হিসেবে নামকরণ করা হয়। মহান রাব্বুল আলামীন এরশাদ করেন-
وَمِنَ اللَّيْلِ فَتَهَجَّدْ بِهِ نَافِلَةً لَكَ عَسٰى اَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُوْدًا-
অর্থাৎ এবং রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করুন। এটা খাস আপনারই জন্য অতিরিক্ত। এ কথা নিকটে যে, আপনাকে আপনার প্রতিপালক এমন স্থানে দণ্ডায়মান করাবেন যেখানে সবাই আপনার প্রশংসা করবে।
[সূরা বনী ইসরাঈল: পারা- ১৫, আয়াত-৭৯]

বর্ণিত আয়াতের তাফসীরে আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র কিতাব الدر المنثور فى التفسير المأثور এর ৪র্থ খণ্ড ৩৬৮ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন-
أَخْرَجَ أَحْمَدُ والتِّرْمِذِىُّ وَحَسَّنَهُ وَاِبْنُ جَرِيْرٍ وَاِبْنِ أَبِىْ حَاتِمٍ وَاِبْنُ مُرْدُوْيَّةِ وَالْبَيْهَقِىْ فِى الدَّلَائِلُ عَنْ اَبِىْ هُرَيْرَةَ رَضى الله عنه عَنِ النَّبِىِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلم فِى قوله (عَسٰى اَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُوْدًا) وَسُئِلَ عَنْهُ قَالَ: هُوَ الْمَقَامُ الَّذِىْ أشفَعُ فِيْهِ لِاُمَّتِىْ-
ইমাম আহমদ ও ইমাম তিরমিযি বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটিকে হাসান বলেছেন এবং ইবনে জারির ও ইবনে আবি হাতিম ও ইবনে মারদুয়াইহ্ এবং ইমাম বায়হাকী দালায়েল এর মধ্যে বর্ণনা করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন- عَسٰى اَنْ يَبْعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَحْمُوْدًا অত্র আয়াত প্রসঙ্গে হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট প্রশ্ন করা হলে তিনি এরশাদ করেন- اَلْمَقَامُ الْمَحْمُوْدُ হল এ প্রশংসিত অবস্থান যেখানে আমার উম্মতের জন্য সুপারিশ করব- আরো বর্ণিত আছে-
وَأَخْرَجَ أَحْمَدُ وَاِبْنُ جَرِيْرٍ وَاِبْنُ أَبِىْ حَاتَمٍ وَاِبْنُ حِبَّانٍ وَالْحَاكَمُ وَصَحَّحَهُ وَاِبْنُ مَرْدُوْيّه عَنْ كَعْبِ بْنِ مَالِكِ رضى اللهُ عنهُ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى اللهُ عليهِ وسلم قَالَ يُبْعَثُ النَّاسُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأكُوْنُ أنَا وَأمَّتِىْ عَلى كُلِّ وَيِكْسُوْنِىْ رَبِّى حُلَّةِ حَضَرَاءَ ثُمَّ يُؤذَنُ لِىْ اَنْ أقُوْلَ مَاشَاء اللهُ أنْ أقُوْلَ فَذَالِكَ الْمَقَامُ الْمَحْمُوْدُ- هكذا فى المستدرك كتاب التفسير২ ⁄ ৩৯৫مجمع الزوائد⁄১৫-
এবং ইমাম আহমদ, ইবনু জারির, ইবনু আবি হাতিম, ইবনু হিব্বান ও হাকীম বর্ণনা করেছেন এবং হাদীসটি (সহীহ) বিশুদ্ধ বলেছেন এবং ইবনু মারদুয়াইহ্ হযরত কা’ব বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন- নিশ্চয় প্রিয় রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন মানুষদেরকে কবর থেকে উঠানো হবে। তখন আমার উম্মতগণ একটি উঁচু পাহাড়ে অবস্থান করবে। আমার রব আমাকে সবুজ রঙের এক সেট গৌরবময় পোশাক পরিধানের ব্যবস্থা করবেন। সেখানে আমাকে কথা বলার অনুমতি দিলে মহান আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর প্রশংসা করব। এটাই ‘মাক্বামে মাহমুদ’ হিসেবে বিবেচিত।  [সূত্র; আল্ মুসতাদরাক কিতাবুস্ তাফসীর: ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৯৫]

তাফসীরে আদ্ র্দুরুল মনসুর শরীফে রয়েছে-
وَاَخْرَجَ سَعِيْدُ بْنُ مَنْصُوْرُ الْبُخَارِىُّ وَاِبْنُ جَرِيْرٍ وَاِبْنُ مَرْدُويه عَنْ اِبْنِ عُمَرَ رضى الله عنه قال اِنَّ النَّاسَ يَصِيْرُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ جُثَاءً كُلُّ أمَّة تَتْبَعُ نَبِيَّهَا يَقُوْلُوْنَ يَافُلَانُ اِشْفَعْ لَنَا حَتَّى تَنْتَهِىَ الشِّفَاعَةُ الى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَذَالِكَ يَوْمَ يَبْعَثُهُ اللهُ الْمَقَامَ الْمَحْمُوْدَ- (هكذا فى فى صحيح البخارى كتاب التفسير- ৪৪৪১)
হযরত সাঈদ বিন মনসুর, ইমাম বুখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইবনু জারির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইবনু মারদুয়াইহ্ এই সূত্র ধরে বর্ণনা করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বর্ণনা করেন, কিয়ামতের দিন মানুষ দলে দলে নিজেদের নবীগণের পশ্চাতে চলবে এবং এ মর্মে আবেদন করবে যে, হে অমুক! আমাদের জন্য সুপারিশ করুন। এভাবে সুপারিশ প্রার্থনা ধারাবাহিকভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে শেষ হবে। এটা হচ্ছে ঐ দিন, যে দিন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে ( নবী করীম দ.) ‘মাক্বামে মাহমুদ’র উপর অধিষ্ঠিত করবেন।
[সূত্র: বুখারী শরীফ কিতাবুত্ তাফসীর, ৪র্থ খণ্ড, হাদীস নম্বর- ৪৪৪১, পৃষ্ঠা- ১৭৪৮]

লেখক: উপাধ্যক্ষ- জামিরজুরী রজবিয়া আজিজিয়া রহমানিয়া সুন্নিয়া ফাযিল মাদ্রাসা, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •