মদিনা শরিফের ফযিলত-
আহমদুল ইসলাম চৌধুরী
=====
পবিত্র মদিনার শ্রেষ্ঠ ফযিলত হলÑআঠার হাজার মাখলুকাতে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সৈয়্যদানা হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামা-এর পবিত্র রওজা শরিফ এ নগরীতেই অবস্থিত। এর এমন এক ফযিলত যার সাথে অপর কোন ফযিলতের তুলনা হয় না। বরং দুনিয়া ও আখিরাতের কোন নিয়ামতই এ নিয়ামতের সমতুল্য হতে পারে না।
তাছাড়া বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব সৈয়্যদানা নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র রওযা শরীফ পবিত্র মদিনা শরীফে। শুধু তাই নয় তাঁর মহান তিন খলিফা, আহলে বায়েত, উম্মু হাতুল মোমেনিন, মহান দশ হাজারের মত সাহাবা-ই কেরামের সমাধিও এ পবিত্র মদিনা শরীফে অবস্থিত।”
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, “হে আল্লাহ, আমার অন্তরে মদিনার ভালবাসা দান কর, যেমন আমরা মক্কাকে ভালবাসি এবং তার চাইতেও বেশি।”
পবিত্র মদিনা মানুষের ময়লাকে এমনভাবে দূরিভূত করে যেভাবে কামারের ভাতি লোহার মরিচাকে দূরিভূত করে। অন্য হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে- মদিনা শরিফ পূত-পবিত্র। গোনাহসমূহকে এটা এমনভাবে বিদুরিত করে যেমনিভাবে কামারের ভাতি রূপার মরিচাকে দূরিভূত করে অর্থাৎÑফিৎনা, ফ্যাসাদ, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের এখান থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এটি মদিনা শরিফের একটি বৈশিষ্ট্য। অধিকাংশ ইমাম-একমত যে, মদিনা শরিফের এ বৈশিষ্ট্য সর্বদা বিদ্যমান।
এক বর্ণনায় বর্ণিত আছে যে, এক বেদুঈন আল্লাহ-রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হাতে এ কথার উপর বাইয়াত গ্রহণ করল যে, সে মদিনাতেই অবস্থান করবে। দ্বিতীয় দিবসে ঘটনা চক্রে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং জ্বরাক্রান্ত হয়। অতঃপর সে নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিকট এসে বাইয়াত ভঙ্গের এবং স্বদেশে চলে যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে। তখন নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে উল্লেখিত হাদিসটি বর্ণনা করেছেন।
হযরত উমর ইবনে আবদুল আজিজ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মদিনা শরিফ থেকে আসার সময় বন্ধু-বান্ধবদের সম্বোধন করে বললেনÑমদিনা শরিফ যাদেরকে দূরে নিক্ষেপ করেছে আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আশংকা করছি।
এ পবিত্র নগরির পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য ঐ দিনই পূর্ণভাবে প্রকাশ পাবে, যখন মলউন দাজ্জালের আবির্ভাব হবে এবং মদিনা শরিফে প্রবেশে সক্ষম হবে না আর সব সন্ত্রাসকারী দাজ্জালের অনুসরণে মদিনা শরিফ থেকে বাইরে চলে আসবে। সে দিন মদিনা শরিফ দুষ্ট লোক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যাবে। যেমন হাদিস শরিফে বর্ণিত আছেÑসে সময় ইসলাম বিরোধী এবং মুশরিকদের অপবিত্রতা থেকে মদিনা শরিফের পবিত্রতা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মদিনা শরিফের ফযিলতসমূহের মধ্যে এটা আরেকটি ফযিলত যে, মহান আল্লাহ পাক মদিনা শরিফের মাটি ও ফলের মধ্যে শেফা ও আঙ্গুরের গুণ রেখেছেন। অনেক হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে মদিনা শরিফের ধূলাবলিতে প্রত্যেক রোগের শেফা রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, মদিনা শরিফের মাটিতে রোগের ঔষধ রয়েছে। বিশেষ করে ওয়াদিয়ে বতন নামক স্থানে। বর্ণিত আছে যে, নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন কোন সাহাবিকে ঔষধ স্বরূপ এ মাটি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। ঔষধ হিসেবে এ মাটি নিয়ে যাওয়া সম্পর্কে অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। অনেক ইমাম এ মাটি সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেছেন। যেমন হযরত শেখ-ই মুজাদ্দেদিন ফিরোজ আবাদী বলেনÑএ মাটি সম্পর্কে আমি নিজেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার একজন গোলাম পূর্ণ এক বছর যাবৎ জ্বরাক্রান্ত ছিল, আমি নিজেই ঐ মাটি পানির সাথে মিশিয়ে সেবন করানোর ফলে সে ঐ দিনই আরোগ্য লাভ করে। হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বলেনÑআমি নিজেই এ মাটির অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। এক সময় তিনি মদিনা শরিফে অবস্থানরত অবস্থায় তাঁর পা ফুলে গিয়েছিল। চিকিৎসকগণ এটা দুরারোগ্য ব্যাধি বলে অভিমত দেন এবং তারা অক্ষমতা প্রকাশ করেন। তিনি ঐ পবিত্র মাটির ব্যবহার আরম্ভ করে দেন। এতে অল্প দিনের মধ্যে মহান আল্লাহ পাক তাকে অতি সহজে আরোগ্য দান করলেন।
যখন নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সফর থেকে ফেরার সময় মদিনা শরিফের কাছাকাছি পৌঁছে যেতেন, তখন তাড়াতাড়ি পবিত্র মদিনায় পৌঁছে যাওয়ার উৎসাহে সওয়ারিকে জোরে চালিয়ে দিতেন এবং চাদর মোবারক গর্দান থেকে নিয়ে ফরমাতেনÑহে আমার শ্বাস গ্রহণের স্নিগ্ধ পুরবী বাতাস! তোমাকে স্বাগত জানাই।
শুধু তাই নয়, মদিনা শরিফের যে সব ধূলাবালি তাঁর চেহারা মোবারকে লাগত তা তিনি পরিষ্কার করতেন না। এমন কি যদি কোন সাহাবীকে দেখতেন যে, তিনি ধূলাবালি থেকে বেঁচে থাকার জন্য মাথা ও মুখমণ্ডলকে আবৃত করছেন, তখন তিনি নিষেধ করতেন এবং এরশাদ করতেন “মদিনার মাটি শেফা।” এ কারণেই মদিনা শরিফের আরেক নাম শাফিয়া অর্থাৎ আরোগ্যকারী।
বোখারী ও মুসলিম শরিফের হাদিসে বর্ণিত আছে যে ব্যক্তি মদিনা শরিফের “আজওয়া” নামক ৭টি খেজুর দিয়ে নাস্তা করবে, কোন প্রকার বিষ ও জাদু তার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা দূরারোগ্য রোগে আজওয়া খেজুর খাবার পরামর্শ দিতেন। আজওয়া মদিনা শরিফের উৎকৃষ্ট খেজুর।
বিভিন্ন বর্ণনায় রয়েছে, এ খেজুরের মূল বৃক্ষ নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাত মোবারকে রোপণ করেছিলেন।
হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয় খেজুর ছিল আজওয়া। উল্লেখ্য, নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মোহাব্বত করার কারণেই আজওয়া অনেক গুণে গুণান্বিত রয়েছে।
বিভিন্ন গ্রন্থে মদিনা শরিফের একশত ঊনিশ প্রকারের খেজুরের কথা উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েক প্রকারের খেজুর আজওয়ার পর নানা গুণে গুণান্বিত।
নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মদিনা শরিফে বসবাস ও অবস্থানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। তথাকার দুঃখ কষ্টের উপর ছবর এবং ধৈর্য্য ধারণের উপদেশ দিয়েছেন।
বস্তুতঃ মদিনা শরিফের ফযিলত বর্ণনা করে শেষ করার মত নয়। এ পবিত্র শহরকে নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এত বেশি ভালবাসতেন, যা বর্ণনা করে শেষ হবার নয়। আশেকে রাসূলগণের আরজু থাকে মদিনা শরিফে বারে বারে যাওয়ার জন্য, যাতে রওজা পাকে সালাম পেশ করার সৌভাগ্য লাভ করা যায়।
মহান আল্লাহ পাক আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আ-মী-ন।
লেখক: বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক।