সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় রাসূলে করিম’র অবদান : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা-
ড. মোহাম্মদ খলিলুর রহমান
===
প্রারম্ভিকা
সর্বযুগের, সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহা মানব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সেই অসাধারণ গুণাবলীরই অধিকারী যাঁর মধ্যে সীমার মধ্যে থেকেও, অসীমের সান্নিধ্য উপলব্ধি করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। ইতিহাস-আলোকে তাই তিনি এক ক্ষণজন্মা, মহান কর্মতৎপর, দূর-দ্রষ্টা সম্পন্ন মহাপুরুষ হিসাবে নন্দিত। মানব-সমাজের জীর্ণ, ঘুণে-ধরা কাঠামোর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাই তিনি অমিত তেজ-ধারী বিরল ব্যক্তিত্বরূপে সমাদৃত। শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। হৃদয়-গভিরে বরণীয়। বিশাল মহাসাগরের ন্যায় অতলান্ত তাঁর সুবিস্তৃত মহান জীবন। সে রতœগর্ভ মহাসাগরের রোমন্থন মানুষের সাধ্যাতীত। তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অসাধারণ, প্রতিভা ছিল বহুমুখী, অভিজ্ঞতা ছিল সুবিস্তৃত ও জ্ঞান ছিল অপরিসীম। বহুবর্ণ বিভূষিত তাঁর স্বপ্নিল জীবনে বহু ঘটনারই আবর্তন ঘটেছিল। এ সমস্ত ঘটনায় তাঁর ঔদার্য ও মহত্ব, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা, মনীষা ও তেজস্বিতা প্রকাশমান। স্বভাবতই বিশ্ব মনীষায় তাঁর অবস্থান সবার ঊর্ধ্বে, শীর্ষদেশে।
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার মত নির্ভরযোগ্য প্রকাশনাও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকৃতি প্রদান করেছে যে, “He (Muhammad) is the most successful of all prophets and religious personalities..”১
অর্থাৎ “জগতের সকল ধর্মপ্রবর্তক ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে তিনিই [হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম] হচ্ছেন সর্বাপেক্ষা সফলকাম”। একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর [হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম] কোন জুড়ি নেই। মহৎ মানুষের মহিমা ও মাহাত্ম্যের রূপ-কল্প বিধৃত করতে মনীষী এমারসন একটি চমৎকার বর্ণনার আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। তাঁর ভাষায় :
“It is easy in the world to live after the world’s opinion; it is easy in solitude to live after our own; but the great man is he who, in the midst of the crowd, keeps with perfect sweetness the independence of solitude.২ অর্থাৎ “জগদ্বাসীর মত
অনুযায়ী জগতে বাস করা সহজ এবং নিজের মত অনুযায়ী নির্জনে বাস করাও সহজ। কিন্তু তিনিই মহৎ ব্যক্তি যিনি লোকালয়ের মধ্যেও নির্জনতার স্বাধিনতা অক্ষুন্ন রাখেন।”
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির স্বরূপ
ইসলাম শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। কোনরূপ সহিংসতা, বিবাদ-বিসংবাদের স্থান ইসলামে নেই। ন্যূনতম শান্তি-শৃঙ্খলা ও সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন আচরণকেও ইসলাম আদৌ প্রশ্রয় দেয় না। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন- ফিৎনা-ফাসাদ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ।৩ পৃথিবীতে শান্তি স্থাপনের পর তাতে ফাসাদ বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করো না।৪ অমুসলিমদের প্রতিও কোন অন্যায় আচরণ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুরক্ষায় ইসলামের রয়েছে শ্বাশত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতিটি আচরণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল ও প্রোজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এক অমুসলিম বৃদ্ধার ঘটনা ইতিহাসে আমরা জেনেছি। বৃদ্ধা প্রতিদিন মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর চলার পথে কাঁটা দিত। একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দেখলেন, পথে কাঁটা নেই। তখন তিনি ভাবলেন, হয়ত ওই বৃদ্ধা অসুস্থ হয়েছে বা কোন বিপদে আছে, তার খোঁজ নেয়া দরকার। এরপর দয়ার নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামই বৃদ্ধার বাড়িতে পৌঁছে দেখেন ঠিকই সে অসুস্থ। তিনি বৃদ্ধাকে বললেন, আমি আপনাকে দেখতে এসেছি। এতে বৃদ্ধা অভিভূত হয়ে গেল যে, আমি যাকে কষ্ট দেয়ার জন্য পথে কাঁটা পুঁতে রাখতাম, তিনি আজ আমার বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইনিই তো সত্যিকার অর্থে শান্তি ও মানবতার অগ্রদূত।৫ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ঘরে একবার এক ইহুদী মেহমান হয়ে আসলে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে যথাযথ মেহমানদারী করলেন এবং রাতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে সে ইহুদী মেহমান অসুস্থতাবশত বিছানায় মলমূত্র ত্যাগ করে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে কিছু বলবেন এই ভয়ে সে প্রভাতের আগেই ঘর থেকে পালিয়ে গেল। ভোরে ওই ময়লাযুক্ত বিছানা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এই মর্মে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন যে, হায়! আমি হয়তো ওই ব্যক্তিকে যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি; এতে সে কষ্ট পেয়েছে। অতঃপর বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত বিছানাটি পরিষ্কার করলেন এবং সেই ব্যক্তির কাছে গিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন এভাবে যে, “ভাই আমি আপনার যথাযথ মেহমানদারী করতে পারিনি এজন্য আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন”। তখন ইহুদি লোকটি বলল, অপরাধ করলাম আমি আর ক্ষমা চাচ্ছেন আপনি। ইসলামের আদর্শ তো সত্যিই মহৎ! অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এমন উদারতা ও আদর্শে মুগ্ধ হয়ে সে ইসলাম গ্রহণ করে।৬ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এই উদার ঐতিহাসিক চরিত্রকে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফুটিয়ে তুলেছেন এভাবে,
“তোমার ধর্মে অবিশ্বাসীরে তুমি ঘৃণা নাহি করে/আপনি তাদের করিয়াছ সেবা ঠাঁই দিয়ে নিজ ঘরে।”৭
এরূপ উৎকৃষ্টতম আদর্শের মাধ্যমেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও জাগরণ ঘটেছে।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনা হিজরত করার পর যে মদীনা সনদ প্রণয়ন করেন তা বিশ্ব ইতিহাসের সর্বপ্রথম লিখিত সংবিধান এবং শান্তি-সম্প্রীতির ঐতিহাসিক দলিল। এই সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান স¤পর্কিত উল্লেখযোগ্য ধারা সন্নিবেশিত রয়েছে। যেমন সনদে স্বাক্ষরকারী সকল গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদীনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে, সকল ধর্মসম্প্রদায়ের স্ব-স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে; কেউ কারও ওপর কোনরূপ আক্রমণ করবে না, সন্ধিভুক্ত কোন সম্প্রদায় বহিঃশত্রুকর্তৃক আক্রান্ত হলে উক্ত আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শক্রদের প্রতিহত করতে হবে, কোন নাগরিক কোন অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।”৮
এভাবে ঐতিহাসিক মদীনা সনদের মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেন। মুসলিম ও কুরাইশদের মাঝে স্বাক্ষরিত ঐতিহাসিক হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশকটি ধারা ছিল মুসলিম স্বার্থবিরোধী। এতদসত্ত্বেও সুদূরপ্রসারী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নামের সাথে রাসূলুল্লাহ লেখা যাবে না মর্মে আপত্তি জানিয়ে বলল, যদি সাক্ষ্য দিতাম যে, আপনি আল্লাহর রাসূল, তাহলে তো আমরা আপনাকে বায়তুল্লাহ যেতে বাধা দিতাম না। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সন্ধির লেখক হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে বললেন রাসূলুল্লাহ শব্দটি কেটে দিয়ে ওর ইচ্ছানুযায়ী শুধু আমার নামটি লিখ। এতে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু অপারগতা প্রকাশ করায়, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতেই তা কেটে দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও উদারতার অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করেন।৯
ইসলামের ইতিহাসে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, মক্কা বিজয়ের দিন মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিজয়ীবেশে মক্কায় প্রবেশ করলে কুরাইশদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিজিত শক্রদের প্রতি কোন ধরনের দুর্ব্যবহার তো দূরের কথা কিঞ্চিৎ পরিমাণও প্রতিশোধ¯পৃহা প্রকাশ করেননি, বরং শত্রু সম্প্রদায়ের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি কুরাইশদের বলেছেন হে কুরাইশগণ! আমি তোমাদের সাথে কেমন ব্যবহার করবো বলে তোমরা মনে করো? তারা বললো, আপনি আমাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবেন বলে আমাদের ধারণা। আপনি দয়ালু ভাই। দয়ালু ভাইয়ের পুত্র। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমি তোমাদের সাথে সেই কথাই বলছি, যে কথা হযরত ইউসুফ আলায়হিস সালাম তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন- আজ তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সকলেই মুক্ত।১০
হযরত আনাছ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, “আমরা একদিন মসজিদে নববীতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে বসা ছিলাম। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে মসজিদের ভিতরে প্রস্রাব করতে লাগল। এতে উপস্থিত সাহাবীগণ তাকে ধমক দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে প্রশ্রাব করা থেকে বাধা প্রদান করো না। তাকে সুযোগ দাও; যাতে সে প্রশ্রাবের প্রয়োজন সেরে নিতে পারে, কারণ মধ্যখানে বন্ধ করলে ক্ষতি হবে। সে বেদুঈনের প্রশ্রাব করা শেষ হলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে ডেকে বললেন যে, এটা প্রশ্রাবের স্থান নয়; বরং এটা আমাদের ইবাদতখানা, পবিত্রস্থান। এ বলে তিনি তাকে বিদায় করে দিলেন এবং এক সাহাবীকে পানি নিয়ে আসতে বললেন অতঃপর মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মসজিদ থেকে উক্ত পেশাব ধুয়ে দিলেন।”১১ প্রতিশোধের পরিবর্তে শক্রদের প্রতি মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ক্ষমা ও মহানুভবতার এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত শান্তি-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ইসলামের চিরন্তন আদর্শের জানান দেয়। পারস্পরিক সাক্ষাতে সালাম বিনিময়ের যে বিধান ইসলামে রয়েছে তাও সম্প্রীতির বন্ধন সুসংহতকরণের উজ্জ্বল প্রয়াস। সালাম অর্থ শান্তি। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে মূলত একে অপরের শান্তিই কামনা করেন। এতে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলাম এতই সোচ্চার যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেদের জানমালের পাশাপাশি সংখ্যালঘু অমুসলিম সম্প্রদায়ের জানমাল রক্ষায় সচেষ্ট থাকার জন্যও মুসলমানদের প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়; অন্য ধর্মাবলম্বী ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর আঘাত-সহিংসতাও ইসলামে জায়েজ নেই। সহিংসতা তো দূরের কথা অন্য ধর্মকে কটুক্তি থেকে বিরত থাকার জন্য কুরআন মজীদে আল্লাহপাক নির্দেশ করেছেন এভাবে : “তোমরা তাদের মন্দ বলো না, যাদের তারা আরাধনা করে আল্লাহকে ছেড়ে। কেননা তারা সীমালংঘন করে অজ্ঞানবশত আল্লাহকেও গালি দেবে।”১২
উপরোক্ত আলোচনায় সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি, শান্তি, সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান ও সদ্ব্যবহার ইসলামের অনুপম শিক্ষা। শান্তি ও মানবতার ধর্ম ইসলাম সংঘাত, সহিংসতা, বিশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িকতাকে চরমভাবে ঘৃণা করে। রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওয়ারিশ হিসেবে হক্কানী ওলামায়ে কেরাম, নিরবচ্ছিন্নভাবে শান্তি-সম্প্রীতি ও মানবতার সুমহান শিক্ষা দান করে চলেছেন দাঈ ইলাল্লাহ তথা অগণিত-অজস্র কামিল সুফীসাধকগণ। আর এ ধারা ক্বিয়ামত অবদি সুষ্ঠভাবে ও সফলতার সাথেই বহমান থাকবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকেও এসব কামিল আউলিয়ায়ি কেরামগণ তথা দাঈগণের কাতারে শামিল হওয়ার তাওফীক ইনায়াত করুন।
পরিসমাপ্তি
পরিশেষে বলা যায় ইসলামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আরো অসংখ্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। প্রবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় অধিক উদ্ধৃতি থেকে বিরত থাকা সমীচিন মনে করছি। মোদ্দাকথা কোন সংকীর্ণতা নয়, হিংসা-বিদ্বেষ নয়, উদারতা-মহানুভবতাই হচ্ছে ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য। রাহমাতুললিল আলামীন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তামাম বিশ্বে শান্তির অমোঘ বাণী নিয়েই এসেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে উঠে এক সৌহার্দ্যরে সম্প্রীতির সমাজ, রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন তিনি। বস্তুত বিশ্বমনীষায় শ্রীবৃদ্ধিও সৌকর্য সাধনে নবীজীর অবদান অনন্য, অতুলনীয় ও অনস্বীকার্য। এ বিষেয় মনীষী Alfred Lamartin-এর এ অমর উক্তি প্রণিধানেযাগ্য : Philosopher, orator, apostle, legislator, warrior, Coqueror of ideas restorer of rational dogmas of a cult without images, the founder of twenty terrestialempire and of one spiritual empire, That is Muhammad (PBUH). As regard all standards by which human greatness may be measured we may well ask, is there any greater than he?? ১৩
অর্থ্যাৎ দার্শনিক, বাগ্মী, ধর্মপ্রবর্তক, আইনপ্রণেতা, মতবাদ বিজয়, ধর্মমতের এবং প্রতিমাবিহীন উপাসনা পদ্ধতির পূন: সংস্থাপক, বিশটি পার্থিব সম্রাজ্যের এবং একটি ধর্মীয়-সম্রাজ্যের সংস্থাপককর্তা- এই দেখ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। যে সমস্ত মাপকাঠির দ্বারা মানবীয় মহত্ত্ব পরিমাপ করা হয়ে থাকে, সেগুলো প্রতিটির আলোকে তাঁকে বিবেচনা করা হলে আমরা এ কথা সহজেই জিজ্ঞাসা করতে পারি, কোন মানুষ কি তাঁর অপেক্ষা মহত্তর ছিল? কখনো না। আজ যখন ধর্মে ধর্মে হানাহানি, বর্ণে বর্ণে সংঘাত, শ্রেণিতে শ্রেণিতে দ্বন্দ্ব তখন তাঁর আদর্শের অকৃত্রিম অনুকরণ ও অনুসরণের আবশ্যকতা অনুভূত হচ্ছে তীব্র থেকে তীব্রতরভাবে। বস্তুত কেবল তাঁর আদর্শের অনুসরণের মধ্য দিয়েই এ অশান্ত পৃথিবীতে স্থাপিত হতে পারে কাক্সিক্ষত অনাবিল শান্তি, অপার সম্প্রীতি, শৃঙ্খলা, অবিশ্বাস্য নিরাপত্তা ও সার্বিক কল্যাণের বার্তা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অটুট সেতু বন্ধন।
তথ্যসূত্র:
১.Encyclopaedia Brittanica.
২. স¤পাদনা কমিটি, শাশ্বত নবী (দ.) (ঢাকা : ইফাবা, জুন, ২০০৪) পৃ. ৬০।
৩. আলকুর’আন, সূরা : ২ বাক্বারা : ১৯১।
৪. আলকুর’আন, সূরা : ৭ আরাফ : ৫৬।
৫. আবূ মুহাম্মদ আবদুল মালিক মু’আফিরি, ইবনু হিশাম (রহ.), সীরাতুন্নবী (ঢাকা : ইফাবা, ২য় সংস্করণ, ২০০৮ খৃ.), ৪খ., পৃ. ৬১।
৬. আবূ মুহাম্মদ আবদুল মালিক মু’আফিরি, ইবনু হিশাম (রহ.), প্রাগুক্ত।
৭. আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, (ঢাকা : আলকুরআন একাডেমী লণ্ডন, ২১ তম প্রকাশ, ২০০৮ খ্রি), পৃ. ৪৩৯।
৮. স¤পাদনা পরিষদ, সংক্ষিপ্ত ইসলামী বিশ্বকোষ, (ঢাকা : ইফাবা, তা.বি), ২খ, পৃ.৯৪
৯. আবূ মুহাম্মদ আবদুল মালিক মু’আফিরি, ইবনু হিশাম (রহ.), প্রাগুক্ত, ২খ, পৃ. ৩৩১
১০. আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, প্রাগুক্ত।
১১. বুখারী ও মুসলিম শরীফ।
১২. আলকুর’আন, সূরা : আন’আম : ১০৮।
১৩. Afred the Lamartine, Histore De La Turquie
লেখক : উপাধ্যক্ষ, ফয়জুলবারী ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা।