জামেয়া সাচ্চা আলিম তৈরীর সবচে’ আচ্ছা প্রতিষ্ঠান

0

জামেয়া 

সাচ্চা আলিম তৈরীর সবচে’ আচ্ছা প্রতিষ্ঠান

মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম

===

এটা সবার জানা কথা যে, পৃথিবী পৃষ্ঠে মহৎ ও সচেতন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দ্বীনী কিংবা দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠান কায়েমে ব্রতী হন। এ ক্ষেত্রে এটাও পরীক্ষিত সত্য যে, ওই প্রতিষ্ঠানই সার্থক ও স্থায়ী হয়, যার প্রতিষ্ঠাতা হন নিষ্ঠাপূর্ণ, পুণ্যবান, উদ্দেশ্য হয় নিষ্কলুষ এবং প্রতিষ্ঠানও পরিচালিত হয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যের সাথে একেবারে সঙ্গতিপূর্ণ, সর্বোপরি যোগ্য লোকদের মাধ্যমে। অন্যথায় ফলশ্রুতি হয় বিপরীত কিংবা দুঃখজনক।
যেসব প্রতিষ্ঠান পুণ্যবান ব্যক্তির বরকতময় হাতে নিরেট আল্লাহর ওয়াস্তে এবং দ্বীন ও মাযহাবের স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়ে, যুগের যোগ্যতর লোকদের মাধ্যমে পরিচালিত হয় এবং প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাফল্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে সুখ্যাতির অতি উচুঁতর স্তরে উপনীত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমাদের ‘জামেয়া’ (জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া) হচ্ছে একেবারে শীর্ষস্থানীয়। ‘জামেয়া’ আজ আল্লাহর মেহেরবাণীতে এশিয়া মহাদেশের প্রসিদ্ধ শীর্ষস্থানীয় দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর কারণগুলোও সুস্পষ্ট।

প্রথমত, ‘জামেয়া’র প্রতিষ্ঠাতা হলেন এক যুগশ্রেষ্ঠ ওলী-ই কামিল শাহানশাহে সিরিকোট হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি, যাঁর নূরানী হাত পরীক্ষিত কষ্ঠিপাথর। এ জামেয়া প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যও কতই মহৎ-ইসলামের প্রকৃত আদর্শ ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’-এর প্রতিষ্ঠা ও প্রচার এবং এরই মাধ্যমে ইসলামের সব শত্রু ও নবী-ই আক্রামের দুশ্মন সব ধরনের বাতিল ফির্ক্বার দাঁতভাঙ্গা জবাব দান। জামেয়া প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট হিসেবে বাঁশখালীর শেখের খিলের ঘটনাটি সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোট সেখানে আয়োজিত ওয়াজ মাহফিলে দুরূদ শরীফ পড়ার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশকারী দুশ্মনানে রসূল (ওহাবী) সম্প্রদাযের উপস্থিতি এবং মুসলিম সমাজে তাদের কুপ্রভাব যথাযথভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন। তখনই তিনি আমাদের সমাযকে ওই কুপ্রভাব থেকে রক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আর এর কার্যকর ও সুদূর প্রসারী ব্যবস্থা হচ্ছে একটি যথার্থ সুন্নী দ্বীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা। তাও ইসলামের প্রকৃত ‘মতাদর্শ’ আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আতের বাস্তব রূপরেখা ‘মসলকে আ’লা হযরত’-এর উপর। সুতরাং তিনি নিজ বরকতময় হাতে প্রতিষ্ঠা করলেন এ ‘জামেয়া’। এরপর তিনি যে নূরানী বাণী এরশাদ করেছেন, তা থেকে জামেয়া প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য মধ্যাহ্ণ সূর্যের ন্যায় সুস্পষ্ট হয়- ‘‘কাম করো, ইসলামকো বাঁচাও, সাচ্চা আলিম তৈয়ার করো।’’ অর্থাৎ ‘‘কাজ করো, দ্বীন-ইসলামকে রক্ষা করো, সাচ্চা আলিম তৈরী করো।’’ কাজও কীভাবে করবে সেটার রূপরেখাও তিনি নিজে দিয়েছেন। ‘‘জামে‘আহ্ কী খিদমত কো আপ জুমলাহ্ ভাইয়ো! নম্বরে আউয়াল মে রাখো, বাক্বী দুনিয়াকে ধান্ধেঁ আওর কামোঁ কো দো-সেরে তে-সরে নম্বর মে রাখো। এসী হিসাব সে আপ ভাইয়োঁকে সা-থ ভী আয়সা মু‘আ-মালাহ্ হোগা।’’ আপকে তামাম নেক কামোঁ কো এসী তারতীব সে সর আন্জাম দিয়া জায়েগা। ইনশা-আল্লাহ্! অর্থাৎ জামেয়ার খিদমতকে আপনারা, সব ভাই, প্রথম নম্বরে রাখো, দুনিয়ার বাকী কাজ-কারবারকে দ্বিতীয়, তৃতীয় নম্বরে রাখো, এ-ই অনুপাতে আপনারা সব ভাইয়ের সথেও এমন আচরণ করা হবে, আপনাদের সমস্ত নেক কাজ এ অনুপাতে সম্পন্ন হবে। ইনশা-আল্লাহ্!’’ এভাবে জামেয়া সম্পর্কে হুযূর ক্বেবলার অন্যান্য তাকীদ বিশিষ্ট বাণীগুলো থেকে একথা স্পষ্ট হয় যে তিনি জামেয়াকে কত ভালবাসতেন।

এখন আলোচনা করা যাক, যে উদ্দেশ্যে জামেয়া প্রতিষ্ঠিত, ওই উদ্দেশ্য (সাচ্চা আলিম তৈরী করা) বাস্তবায়নের জন্য কী কী বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে! বস্তুত এ ব্যবস্থা গ্রহণে আন্তরিকতাও সেটার সাফল্যের অন্যতম কারণ। ‘জামেয়া’র ক্ষেত্রে এ সার্থকতা পূর্ণাঙ্গভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। কারণ, কোন কারণে এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত না হলে ওই প্রতিষ্ঠান হয়তো ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়, অথবা ওই প্রতিষ্ঠান চলে যায় ভিন্ন উদ্দেশ্যের লোকের হাতে। মাদরাসার ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটলে সাচ্চা আলিম তৈরীর স্থলে তৈরী হয় দ্বীন-ইসলামের জন্য ক্ষতিকর লোক।

‘জামেয়া’র মহান প্রতিষ্ঠাতা প্রথমে জোর দিলেন আদর্শ ও উদ্দেশ্যের নির্ভেজাল ও সুদক্ষ পরিচালক নিয়োগের উপর। সুতরাং জামেয়া সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিলেন উপমহাদেশের অপ্রতিদ্বন্ধী বুযুর্গ আলিম ও আ’লা হযরতের মসলকের একজন মহান ব্যক্তিত্ব হযরতুল আল্লামা মুফতী ওক্বার উদ্দীন রেযভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে। এরপর অধ্যক্ষ পদে নিয়োজিত হলেন একই মসলকের আরেক অতি দক্ষ আলিম-ই দ্বীন হযরতুল আল্লামা নসরুল্লাহ্ খান রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের সুযোগ্য উত্তরসূরী ও খলীফা হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ সাহেব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এরপর থেকে জামেয়ার জন্য সুযোগ্য অধ্যক্ষ ও যুগশ্রেষ্ঠ ওস্তাদমন্ডলী নিয়োগের পরম্পরা অব্যাহত রেখেছেন। ফলশ্রুতি একেবারে স্পষ্ট কারণ, তাঁরা যেমন সাচ্চা আলিম ছিলেন, তেমনি তাঁরা ছিলেন, সাচ্চা আলিম তৈরী করার সুদক্ষ কারিগরও। কোন প্রতিষ্ঠানের সাফল্য ও উত্তরোত্তর উন্নতি নির্ভর করে সুযোগ্য উত্তরসুরী পৃষ্ঠপোষক নিয়োজিত হওয়ার উপরও। অতি সৌভাগ্যের বিষয় যে, শাহানশাহে সিরিকোট তাঁর সুযোগ্য ও সুদক্ষ উত্তরসূরী ও খলীফা হিসেবে রেখে গেছেন মাদারযাদ ওলী ও যুগশ্রেষ্ঠ আলিম ও হাফেয হুযূর ক্বেবলা হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্কে তাঁরই নূরানী হাতে অর্পিত হয়েছে শরীয়ত, ত্বরীক্বত ও জামেয়ার যথাক্রমে খিলাফত ও পৃষ্ঠপোষকতা। সুতরাং হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্ এ জামেয়াকে এমন পৃষ্ঠপোষকতা ও কৃপাদৃষ্টি দ্বারা ধন্য করলেন যে, অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি সেটাকে ‘কাশ্তী-ই নূহ’ (হযরত নূহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর নৌযান) ও ‘জান্নাত-নিশান’ (বেহেশত-সদৃশ্য) ঘোষণা করেছেন। তিনি তাঁর পবিত্র হস্তে লিখিত ও প্রেরিত ২৩ রবিউল আখির, ১৪০১হি/২৯ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮১ ইংরেজি তারিখের চিঠি শরীফের এক পর্যায়ে লিখেছেন-
آپ حضرات سےمخلصانه اپيل هےكه جامعه كےبوںি كى تعليمى حالت پرخو صى توجه صركوز فرماويں تاكه وه صرف نحواور باقى فنون ميں انتى قابليت پيدا كر سكيں تاكه درس وتدريس ومناظره ميں صحيح عبارت پڑھ سكيں باطل فرقوں كى سركوبى كرسكيں صرف سنى هى نه هوں بلكه سنى گر اور مجاهد عالم يهاں سےفارغ هوں اور آپ حضرات كاپورا پورا رنگ ان سے ظاهر هو اور يه عالم ملك كے جس كونے ميں جائے بلا ججك্ مسلك كى خدمت كرسكے ملك كى صحيح خدمت حضرات كرام رحمة الله عليهم اجمعين كا عظيم مقصد هے اگر قابل علماء اپےف درسگاهوں سےپدجا نه هوں تو يه خلاكهاں سےپورا هوگا؟
অর্থাৎ ‘‘আপনাদের প্রতি আমার নিষ্ঠাপূর্ণ আপীল হচ্ছে ‘আপনারা জামেয়ার ছাত্রদের শিক্ষাগত অবস্থার প্রতি বিশেষভাবে মনোনিবেশ করুন, যাতে তারা সরফ, নাহভ ও অন্যান্য যাবতীয় বিষয়ে এত বেশি যোগ্যতা অর্জন করতে পারে যেন শিক্ষাগ্রহণ করে শিক্ষাদান করতে গিয়ে এবং মুনাযারা বা তর্কযুদ্ধে গিয়ে সহীহ্ ইবারত পাঠ ও বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। তারা যেন বাতিল ফির্ক্বাগুলোর মূলোৎপাটন করতে পারে। তারা যেন শুধু নিজেরা সুন্নী হয়ে ক্ষান্ত না হয়ে সুন্নীগর (সুন্নীতে পরিণতকারী) হতে পারে। এখান থেকে যেন বাতিল বা মিথ্যার সাথে জিহাদ করতে সক্ষম হয়ে (শেষ সনদ নিয়ে) বের হতে পারে। আপনাদেরই রং যেন তাদের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসব আলিম মাসলাকের (সুন্নী মতাদর্শ)-এর যে কোন প্রান্তে পৌঁছে যায়, নির্দ্বিধায় মসলকের খিদমত করতে পারে। মসলকের সহীহ্ খিদমতই হযরাতে কেরাম আলায়হিম আজমা‘ঈনের মহান উদ্দেশ্য। যদি আমাদের নিজেদের মাদরাসাগুলো থেকে যোগ্য আলিম তৈরী না হয়, তবে এ শূন্যতা কোত্থেকে পূরণ হবে?

চিঠিখানা হুযূর ক্বেবলা শেরে মিল্লাত আল্লামা মুহাম্মদ ওবায়দুল হক নঈমী সাহেব-এর নামে লিখেছিলেন। অবশ্য তাঁর সাথে আরো দু’জন শীর্ষস্থানীয় ওস্তাদ আলিমের নামও উল্লেখ করেছেন। তাঁদেরকে সম্বোধন করে উপরোক্ত কথাগুলো তিনি এরশাদ করেছিলেন। আরো একাধিক চিঠিতেও হুযূর ক্বেবলা এ ধরনের তাকিদ দিয়েছিলেন।

হুযূর ক্বেবলা তাঁর প্রতিটি সফরে প্রথমে এসেম্বলীতে সদয় হাযির হয়ে শিক্ষক-ছাত্রদের নসীহত ও দো‘আ করতেন, তারপর প্রত্যেক ক্লাসে গিয়ে শিক্ষকের পাঠদান ও সংশ্লিষ্ট ক্লাসের ছাত্রদের পাঠ গ্রহণের অবস্থাদি পরিদর্শন করতেন। হুযূর ক্বেবলা পাঠদান ও গ্রহণের সাথে সাথে ‘আক্বাইদের যাবতীয় বিষয়ে’ ছাত্রদের অবগতি ও প্রয়োজনে তর্ক-মুনাযারায় দক্ষতার বিষয়ের প্রতি খুব কড়াদৃষ্টি রাখতেন। কখনো কখনো শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বয়ং সদয় উপস্থিত রয়ে দু’ তার্কিক পক্ষের অবস্থা অবলোকন করতেন। কখনো সুন্নী-পক্ষের তার্কিক ছাত্রদের মধ্যে প্রতিপক্ষের মোকাবেলায় কোনরূপ দুর্বলতা দেখলে অত্যন্ত আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতেন। এমনই একটি ঘটনা সবার মধ্যে এখনো খুব প্রসিদ্ধ। এর সুফল এখন জাতি তথা দুনিয়াবাসী দেখতে পাচ্ছে। আজ জামেয়া গোটা উপমহাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আলহামদুলিল্লাহ্! হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্ তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে আমাদের প্রাণপ্রিয় বর্তমান হুযূর ক্বেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ সাহেব দামাত বারকাতুহুমুল আলিয়াকে রেখে যান। তিনি জামেয়াকে এত বেশি ভালবাসেন যে, জামেয়ার প্রতি কারো সামান্যতম অশালীনতা প্রদর্শনকেও বরদাশত করেন না। গত কিছুদিন পূর্বে কিছু হতভাগা পাপিষ্ঠ জামেয়ার ক্ষতি করার কুমৎলবে এক পর্যায়ে জামেয়ার উপর হামলা ও জামেয়ার জানালার গ্লাস ভাঙ্গার মতো জঘন্য অশালীনতা প্রদর্শন করেছিলো। এ সংবাদ শুনে তিনি এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে, তিনি অশ্রুসজন নয়নে এদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আর বলেছেন, তারা জামেয়ার উপর আঘাত করেনি বরং আমার কলিজার উপর আঘাত হেনেছে। হুযূর ক্বেবলার এ প্রতিক্রিয়া ও কষ্ট পাওয়া তাদের উপর চরম অভিশাপের রূপ নিয়েছে। তাদের ব্যাপারে এ কথা প্রসিদ্ধি আছে যে, জামেয়ার আয়নায় যে লাথি মেরেছে, তার পা কেটে ফেলার মতো রোগ হয়েছে, যে হাতে আঘাত হেনেছে ওই হাত অকেজো হয়ে গেছে। আর বাকীরা কর্ম জীবনে অভিশপ্তের মতো লাঞ্ছনা ভোগ করে বেড়াচ্ছে। মোটকথা তার দুনিয়াও বরবাদ, আখিরাতও বরবাদ হয়েছে। (خسِرَ الدُّنْيَا وَالْاخِرَةِ)

এ প্রসঙ্গে আমারও স্মরণে পড়ছে এমনি একটি ঘটনা। আমরা তখন (১৯৭৭-৭৮ইং) কামিল ক্লাসে পড়ি। তখনকার সময় একজন অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা আন্জুমানের ক্যাশিয়ার ছিলেন। জামেয়ার দালানেই আনজুমানের দপ্তর পরিচালিত হতো। ওই কারণে ওই কর্মকর্তা (ক্যাশিয়ার সাহেব)ও ওই আনজুমান-অফিসেই থাকতেন। সুতরাং আনাগোনায় জামেয়ার ছাত্রদের মুখোমুখি হওয়া স্বাভাবিক ছিলো। এক রাতে মাদরাসার বারান্দায় চলার পথে তিনি কামিল ক্লাসের এক ছাত্রকে চপোটাঘাত করে বসলেন। অমনি এটা নিয়ে ছাত্রদের মধ্যে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিলো। কারণ, ছাত্রের গায়ে চপোটাঘাত। ছাত্রও একেবারে কামিল ক্লাসের। আর যিনি এমন কান্ডটি করলেন তিনিও বয়স্ক ও সম্মানিত লোক হলেও ওস্তাদ তো নন। অন্যত্র তাঁর মুরুব্বিয়ানার কথা বিবেচনা করা গেলেও, এটাতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের যুক্তিতর্ক চলছিলো ছাত্রদের মধ্যে। সিদ্ধান্ত হলো ভোর সকালে জনাব অধ্যক্ষ মহোদয়ের দরবারে এর বিচার চাওয়া হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেলো!

ফজরের নামায মসজিদে সম্পন্ন করে আমরা আমাদের রূমে আসতেই ওই প্রহারকারী মুরুব্বী ব্যক্তিটা কাঁদতে কাঁদতে আমাদের রুমে এসে বলছিলেন, ‘‘গতরাতে আমি যেই ছাত্রটির গায়ে হাত তুলেছিলাম সে কোথায়? আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আমি ছাত্রটির নিকট ক্ষমা চাইতে এসেছি। গতরাতে আমার চোখে ঘুম আসতেই আমার মুর্শিদ ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটকে স্বপ্নে দেখেছি। দেখলাম, তিনি আমার উপর খুবই রাগান্বিত। আর আপন পাক যবানে বলছিলেন, ‘‘তোমনে মেরে বাচ্চে পর হাত উঠায়া। জো মেরে বাচ্চে পর ধুল ফেঁকতা হ্যায়, মাঁই উস পর পাথর ফেঁকতা হোঁ। জো মেরে বাচ্চে কী ত্বরফ উঙ্গলী উঠায়ে মাঁই উসকী তরফ থাপ্পর উঠাতা হোঁ।’’

(তুমি সন্তানের উপর হাত তুলেছো। আমার সন্তানের দিকে যে ধূলিবালি নিক্ষেপ করে আমি তার প্রতি পাথর নিক্ষেপ করি; যে আমার সন্তানের প্রতি আঙ্গুল তোলে আমি তাকে থাপ্পড় দেখাই।) সুবহানাল্লাহ্! সুতরাং ওই সম্মানিত ব্যক্তিটি আমাদের ওই ক্লাসমেটকে বুকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন এবং তার কাছে ক্ষমা চেয়ে, তার মুখে ‘ক্ষমা করলাম’ বাক্যটি উচ্চারণ করিয়ে বিদায় নিলেন। বহুবিধ মাহাত্ম্যভরা ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যে ছাত্র ও শিক্ষকদের দারুনভাবে রেখাপাত করলো। এরপর অধ্যক্ষ মহোদয়ের দরবারে বিচার দেওয়া তো দূরের কথা এবং পরিস্থিতিও শুধু শান্ত হয়নি; বরং জামেয়ার প্রতি ছাত্র-শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি এ মহান ওলীর সার্বক্ষণিক কৃপাদৃষ্টির বিষয়টির চর্চা বহুদিন ধরে চলতে লাগলো।

আমার পরম শ্রদ্ধেয় মুর্শিদে বরহক সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্ জামেয়ার ছাত্রদেরকে অতি মাত্রায় ভালবাসতেন। তিনি সবসময় ছাত্রদের উন্নতির জন্য দো‘আতো করতেনই, ছাত্রদের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ জোর দিতেন। যে সমস্ত ছাত্র লেখাপড়ার পাশাপাশি সিলসিলার বায়‘আত করেনি তো, তাদের প্রতি বিশেষ কৃপাদৃষ্টি দিতেন। ছাত্রদের জন্য সিলসিলার সবক হ্রাস করে প্রায় অর্দ্ধেক করে দিতেন। আর বিভিন্নভাবে উৎসাহ্ দিতেন। আর শিক্ষক ও ওলামা-ই কেরামের উদ্দেশে বলতেন, ‘‘আগর ইয়ে ওলামা আমল করতে তো একেক ওলী বন জাতে।’’ অর্থাৎ যদি এ আলিমগণ আমল করতেন, তবে একেকজন ওলী হয়ে যেতেন।’’

আমার জানা মতে, এক মাস্টার (শিক্ষক)-এর প্রতি ছাত্ররা সঙ্গত কারণে অতিমাত্রায় অসন্তুষ্টি ছিলো। এক পর্যায়ে কিছু ছাত্র উত্তেজিত হয়ে মাষ্টারদার প্রতি ক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলো। সার্বিক বিচারে মাষ্টারদার দোষের পাল্লা ভারী এবং অমার্জনীয় হলেও তদানীন্তন সময়ের বিচারকদের বিচারে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদেরকে দোষী; বরং বহিষ্কার করার প্রস্তাব দেওয়া হলো। অবশ্য, তাদের যুক্তি ছিলো আগামীতে যাতে শিক্ষকদের প্রতি অশালীনতা প্রদর্শনের পথটি রোধ করা যায়; কিন্তু মাষ্টার সাহেবকে তাঁরা একেবারে নির্দোষ সাব্যস্ত করে বসলেন, যা বিচারের নিয়ম বর্হিভূত ছিলো। ফলে, সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। ইত্যবসরে, সৌভাগ্যক্রমে, হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রহমাহ্ বাংলাদেশে তাশরীফ আনলেন। সুতরাং বিষয়টার বিচার হুযূর ক্বেবলার দরবারে উত্থাপন করা হলো। হুযূর ক্বেবলার বিচারের রায় সবাইকে শুধু চমকে দেয়নি; বরং সর্বস্তরে আনন্দের ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছিলো। তা হবেও না কেন?

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সিরিকোট শরীফ ছিলো এক প্রসিদ্ধ ও সর্বজনমান্য বিচারালয়। হুযূর ক্বেবলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ও আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বর্তমান হুযূর ক্বেবলা একান্ত ন্যায় বিচারক হিসেবে প্রসিদ্ধ। এমনকি জটিল থেকে জটিলতর বিচারও অনেকসময় কোর্ট থেকে হুযূর ক্বেবলার নিকট প্রেরণ করা হয়। আর হুযূর ক্বেবলাগণের বিচারও সবাই নির্দ্বিধায় মেনে নেন।

অতএব, উক্ত মাষ্টার ও ছাত্রদের বিচারেও হুযূর ক্বেবলা উভয় পক্ষের জবানবন্দি শুনে রায় ছাত্রদের পক্ষে দিলেন আর এরশাদ করেছিলেন, মাষ্টার সাহেবকে নিয়ম মোতাবেক বিদায় দেওয়া হোক। এতেও ছাত্রদের প্রতি হুযূর ক্বেবলার অকৃত্রিম ¯েœহ ও ভালবাসার প্রমাণ মিলে।

এখন দেখা যাক জামেয়ার পাঠদান প্রসঙ্গ। শিক্ষক দক্ষ ও আদর্শবান হলে ছাত্রও দক্ষ এবং আদর্শবান হওয়া স্বাভাবিক। জামেয়ার শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে এ নিয়ম যথাযথভাবে বিবেচনায় রাখা হয়; যার ফলশ্রুতি আজ জামেয়া থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে যেসব ছাত্র বের হচ্ছে, তাঁরা দ্বীনী ও বৈষয়িক ক্ষেত্রেগুলোতে দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালনরত আছেন। তা হবেও না কেন? বোর্ড পরীক্ষার মেধা তালিকায় জামেয়া কৃতি ছাত্রদের সংখ্যা সবসময় অবাক হওয়ার মতো। এটাও হুযূর ক্বেবলার দো‘আ ও শিক্ষকমন্ডলীর আন্তরিকতা ফসল।

পাঠ গ্রহণের বিষয়েও শিক্ষকমন্ডলী সবসময় ছাত্রদেরকে উৎসাহিত করেন। আমাদের ওস্তাদমন্ডলী প্রতি সপ্তাহে সাপ্তাহিক খতমে গাউসিয়া শরীফের পর এবং সাপ্তাহিক জলসায় বিভিন্ন মনীষীর উক্তি ও ঘটনার অবতারণা করতেন। যেমন-

علم را هر گز نيابى ناندارى شش خصال ـ حرص كوتاه فهم كامل جمع خاطر كل حال
لفظ را تحقيق خوانى هم سبق خوانى مدام ـ خدمت استاد بايد تاشوى مردكمال
অর্থ: ১. ইল্ম কখনো পাবেনা, যতক্ষণ না ছয়টা অভ্যাস ধারণ করবেঃ লোভ সংবরণ, পুরোপুরিভাবে পাঠ অনুধাবন, সর্বদা লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করা।
২. প্রতিটি শব্দ বিশ্লেষণসহকারে পড়া, সবসময় সবক শিখে নেওয়া আর ওস্তাদের খিদমত করাও জরুরী। তাহলে তুমি কামিল মানুষ হবে।
আমাদের দয়াবান শিক্ষকমন্ডলী অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছাত্রদেরকে নানাভাবে উৎসাহিত করতেন। আমার যতটুকু মনে পড়ে এমন ছাত্রের আক্ষেপের জবাবে আমাদের এ শিক্ষক তাকে তাঁর বক্তৃতা এ বলে উৎসাহিত করেছেন-

‘‘পুরাকালে এক ছাত্র শিক্ষকের পাঠদান ও পাঠ পুস্তকের বিষয়গুলো হৃদয়ঙ্গম করতে, শত চেষ্টা সত্ত্বেও অপরাগ হয়ে মনের দুঃখ ও আক্ষেপে ফেটে পড়লো। আর সিদ্ধান্ত নিলো পাহাড়ে-অরণ্যে চলে যাবে, যেন তাকে সেখানে হিং¯্র বন্য পশু খেয়ে ফেলে আর এ অসহনীয় গ্লানি থেকে যেন মুক্তি পায়। যেমন পণ, তেমন কাজ, রওনা দিলো গহিন অরণ্যের পানে। পথিমধ্যে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে বসে পড়লো এক স্থানে; কিন্তু সামনে দেখতে পেলো পাহাড় থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছিলো একটি কঠিন পাথরের উপর আর পাথরের পানির ফোঁটা পড়ছিলো সেখানে একটি গর্তের সৃষ্টি হয়ে গেলো। এটা দেখে ছাত্রটি ভাবলো, ফোঁটা ফোঁটা পানি যদি কঠিন পাথরে গর্তের সৃষ্টি করে ফেলতে পারো আমার স্মৃতিপটটি কি পাথরের চেয়েও কঠিন? দেখি আমিও অহর্নিশ অধ্যবসায় চালিয়ে যাবো!’’ সুতরাঙ সে ফিরে এলো পাঠশালায় আর হয়ে গেলো এক খ্যাতিমান জ্ঞানী!’’

সংস্কৃত ভাষার প্রবাদতো আছেই- ‘‘ছাত্রানাম অধ্যায়নং তপ:।’’ (ছাত্রত্ব হলো সাধারণত তপসীর তপস্যার মতো।) অর্থাৎ লেখাপড়া ছাড়া অন্যদিকে মনোনিবেশ করার সুযোগ একজন দৃঢ়প্রত্যয়ী ছাত্রের নেই।

বিতর্কের মাধ্যমেও ছাত্রদের মেধার বিকাশ ঘটে। জামেয়া-ই অন্যতম মাদরাসা, যেখানে নাহ্ভ-সরফ ও আক্বাইদের বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের ব্যবস্থা রয়েছে। নির্দ্ধারিত বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন এবং প্রত্যেক ছাত্রের জন্য মীলাদ ক্বিয়াম পরিবেশন, হামদ-না’ত শিক্ষা, ওয়ায, ফাত্ওয়া-ফরায়েয প্রণয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। কারণ, সাধারণত একজন দক্ষ আলিমের দায়িত্বে থাকে শিক্ষকতা, দ্বীনী কিতাবাদি রচনা/প্রণয়ন, ফাত্ওয়া প্রদান, ফরায়েয লিখন ও ওয়ায-নসীহত ইত্যাদি।

ইসলামের মূল ও প্রকৃত রূপরেখা সুন্নী মতাদর্শের পাশাপাশি ইসলামের গোড়া থেকে সমসাময়িক কালপর্যন্ত সব ধরনের বাতিল মতবাদ সম্পর্কে ছাত্রদের অবহিত করা দায়িত্বও বর্তায় প্রকৃত সুন্নী-দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের উপর। জামেয়া এ ব্যাপারে সবসময় পূণৃ সচেতন। আমরা যখন দাখিলের ছাত্র, তখন জামেয়ার কিছু জমাত-পন্থী ছাত্র ছদ্মবেশে জামেয়ায় পড়তো। তাদের টার্গেট ছিলো জামেয়ার ভাল ছাত্ররা।’ তারা কোমলমতি ছাত্রদের সাথে সখ্যতা স্থাপন করে তাদের ভ্রান্ত মওদূদীর বই পুস্তক পড়তে উৎসাহিত করতো। আর জামেয়ার পার্শ্ববর্তী একটি মসজিদে সপ্তাহে একবার জমায়েতর আয়োজন করে গোপনে ওই ছাত্রদেরকে তাতে নিয়ে যেতো। ওখানে সুযোগ বুঝে তাদের ছাত্রদের সংগঠনের সদস্য করে নেয়ার চেষ্ঠা করতো। কিন্তু যখন আমাদের তদানীন্তন অধ্যক্ষ মহোদয় ও সম্মানিত শিক্ষকমন্ডলী এ সংবাদ পেলেন, তখন তাঁরা পরামর্শ করে জামেয়া সাপ্তাহিক জলসায় (প্রতি বুধবার শেষ ঘন্টা) ছাত্রের উদ্দেশে কয়েকজন শিক্ষক পরিকল্পিতভাবে মওদূদীর বহুমুখী গোমরাহীর উপর সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। তাদের বক্তব্য থেকে ছাত্ররা বিষয়টি যথার্থভাবে বুঝতে পারে এবং স্থায়ীভাবে মওদূদী মতবাদকে বর্জন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।

মোটকথা, সাচ্চা আলিম তৈরীর সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে জামেয়ার সুনাম বিশ্বব্যাপী। তাই, জামেয়ার ছাত্রত্ব পরম সৌভাগ্যের প্রতীক।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •