তা’জিমী সাজদা হারাম?

0

মুহাম্মদ জামাল উদ্দীন ভান্ডারী, সহ-সভাপতি, রিয়াদ গাউসিয়া হক্ব কমিটি =

প্রশ্ন: মে ২০০৩ সালের তরজুমানে খালেকুজ্জামানের উত্তরে লিখেছেন: নবী-রসূল, পীর-মাশায়েখ ও পিতা-মাতাকে সম্মানার্থে সিজদা করা হারাম। যদি তাই হয় তাহলে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেদিন দুনিয়ায় তাশরীফ এনেছেন সেদিন খানায়ে কাবা ও ফেরেশতারা শীর ঝুকিয়ে সিজদা করেছিল কেন? আল্লাহ্‌ তা’আলা ফেরেশতাদেরকে কেন আদম আলাইহিস্‌ সালামকে সিজদা করতে বলেছিলেন? সম্মানের জন্য না ইবাদতের জন্য?

আল্লাহর জাতে পাকের নূর থেকে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁকে কীভাবে সম্মান করা যাবে? পীর-মাশায়েখের ব্যাপারে মুফতীয়ে আজম হযরতুল আল্লামা মাওলানা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহির ফার্সি কিতাবে লিখেছেন তাজিমী সিজদা জায়েয। বেলায়তে মুত্বলাকা অছিয়ে গাউসুল আজম হযরত শাহ্‌ সূফী মাওলানা দেলোয়ার হুসাইন আল্‌-মাইজভান্ডারী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও একই কথা লিখেছেন। তাঁরা কি মিথ্যা লিখেছেন? বাতিল ফিরকা তথা ওহাবী মওদূদীদেরকে আমরা ভয় করি না ভয় করি শুধু আল্লাহ্‌কে। অনুগ্রহ পূর্বক সঠিক উত্তর দিয়ে খুশী করবেন। 

উত্তরঃ সিজদায়ে তাজিমী তথা কারো সম্মানার্থে সিজদা করা সম্পর্কে মাসিক তরজুমানে আমরা একাধিকবার আলোচনা করেছি। ইসলামী শরীয়তে সিজদায়ে তা’জিমী হারাম -এটাই অধিকাংশ ফক্বীহগণের অভিমত। কারণ, সাহাবায়ে কেরাম রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম মুহাব্বতের অতিশয্যে হুজূরে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্মানার্থে সিজদা করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন, কিন্তু হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দেন্‌ নি, বরং বারণ করেছিলেন।

পূর্বেকার নবীগণ আলাইহিমুস্‌ সালাম এর যুগে তা’জিমী সিজদা জায়েয ছিল। পরবর্তীতে আমাদের শরীয়তে অধিকাংশ ইমামগণের মতে তা ‘হারাম ও নাজায়েয’ হিসেবে সাব্যস্ত হয়।

সিজদায়ে তা’জিমী নাজায়েয ও হারাম হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলীল থাকা সত্ত্বেও খানায়ে কা’বা ইত্যাদি হুজূর পাকের শুভাগমনের মুহূর্তে সিজদা করেছে।

মূলতঃ তার অর্থ খানায়ে কা’বা নবীজিকে সম্মান প্রদর্শন করেছে। সুতরাং এ সব বলে সিজদায়ে তা’জিমী জায়েয বলা যুক্তিযুক্ত নয়। তদুপরি হুজূর পাকের শুভ পদার্পনের সময় ফেরেশতাগণ সিজদা করেছেন মর্মে কোন সুস্পষ্ট দলীল  নেই। বরং তাঁরা ওই সময় হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা’র উপর সালাত- সালামই আরজ করেছিলেন এবং তাঁর গুণকীর্তন করেছেন মর্মে বর্ণনাসমূহ বিভিন্ন কিতাবে দেখা যায়।

তবে প্রিয় নবীকে চতুষ্পদ জন্তু উট ইত্যাদিও সিজদা করেছে মর্মে বিভিন্ন বর্ণনা দেখা যায়। যার অর্থ সম্মান প্রদর্শন করা। তদুপরি চতুষ্পদ জন্তু আর মানুষের হুকুম এক নয়। ইসলামী শরীয়তে মাতা-পিতা, শিক্ষক, পীর-মুরশিদ প্রমুখকে সম্মান জানানোর সুনির্দিষ্ট রীতি রয়েছে। আর তাহল- সালাম দেয়া, কদমবুচি বা হাত ও পায়ে চুম্বন দেয়া, মুসাফাহা ও কোলাকুলি করা ইত্যাদি।

সুতরাং হুজূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবায়ে কেরাম ও আল্লাহর পূণ্যাত্মা বান্দাগণ যেভাবে আদব বা শ্রদ্ধা জানিয়েছেন আমরাও তাঁকে সেভাবে সম্মান জানাবো। যেমন, হুজূরের বেলাদত বা শুভাগমনের আলোচনান্তে দাঁড়িয়ে সালাত-সালাম আরজ করা। তাঁর প্রতি মুহাব্বত ও ভক্তি-শ্রদ্ধা প্রকাশ করা ও তাঁর সুন্নাতসমূহের পূর্ণানুসরণ করা। মূলতঃ তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামান্তর।

তবে কোন কোন ফকীহগণ আমাদের শরীয়ত তথা বর্তমানেও নবী-ওলী, গাউস-কুতুব, মাতা-পিতা, উস্তাদ-মুরশিদ ও ন্যায়-পরায়ন বাদশাহের সামনে সম্মানার্থে সিজদায়ে তাহিয়্যা বা সম্মান সূচক সিজদা পেশ করা বৈধ মর্মে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন- হযরত মুফতী আমীনুল হক ফরহাদাবাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং হযরত দেলোয়ার হুসাইন মাইজভান্ডারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় কিতাবে কোন কোন ফক্বীহগণের উক্ত উক্তি ও উদ্ধৃতি পেশ করেছেন।

কিন্তু উক্ত মত অধিকাংশ ফক্বীহগণ সমর্থন করেন্‌ নি। বরং ইসলামী শরীয়তে সম্মানসূচক সিজদাকে নাজায়েয ও হারাম বলে অধিকাংশ ফক্বীহগণ ফতওয়া প্রদান করেছেন। যা ইমাম ইবনে নুজাইম আল্‌-মিসরী আল্‌-হানাফী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কিতাবুল আশবাহ্‌ ওয়ান্‌ নাজায়ের, ১ম খণ্ডে এবং ইমাম আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলাইহি ‘ফতওয়া-ই রজভিয়া’ ও আয্‌যুবদাতুয্‌ যাকিয়্যাহ্‌’য় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

সুতরাং আমরাও মাসিক তরজুমানে একাধিকবার অধিকাংশ ইমামগণের ফতওয়া মর্মে আলোচনা করেছি মাত্র। যেহেতু ইখতিলাফী মাসআলাসমূহে অধিকাংশ ইমাম ও ফক্বীহগণের মতামতের উপরই ফতওয়া ও চূড়ান্ত ফায়সালা প্রদান করা হয়।

[সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ. ৮-৯]

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •