আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী!’
কাশেম শাহ
‘কে ঐ শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি, মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর। আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী। কি মধুর আজানের ধ্বনি।’ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মসজিদের মিনার থেকে যতবার এ সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসে ততবার কবি কায়কোবাদের (প্রকৃত নাম : কাজেম আলী কোরেশি) এ কবিতা অজান্তে বেজে ওঠে অন্তরের ভেতরে। আজান এমন হৃদয়কাড়া, স্নিগ্ধতায় ভরা ধ্বনি যে প্রতিদিন এতবার শোনর পরও কোনো শ্রুতি ব্যাঘাত ঘটায় না, বিরক্তির উদ্রেক করে না, পক্ষান্তরে মনকে ভরিয়ে দেয় অনাবিল এক আনন্দে, মনে পড়ে এ আহবান স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার, আজান শুনে যেতে হবে মসজিদে, পালন করতে হবে নির্ধারিত কর্তব্য কাজ। মসজিদের উঁচু মিনার থেকে মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে আজানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত হয় ভোরের আকাশ, দুপুরের রৌদ্রপ্রহর, বিকেলের শীতল পরিবেশ, সন্ধ্যার সোনালী মুহূর্ত কিংবা রাতের ¯িœগ্ধতা। আজানের আল্লাহু আকবার ধ্বনির সাথে সাথে মুসলমানদের অন্তরে বয়ে যায় অনাবিল শান্তি। বৃদ্ধি পায় আল্লাহর মহব্বত ও ভালোবাসা। এ দেশের নদীর কল্লোলে, বৃষ্টির রিমঝিমে, সূর্যের সোনালি আভায়, বাতাসের হিল্লোলে, ভোরের স্নিগ্ধতায়, চাঁদের জ্যোস্নায়, ঝরণার নূপুরে আজানের সুর শুনতে পাওয়া যায়। কবি কায়কোবাদ তার আজান কবিতায় বর্ণনা করেছেন এমনই কিছু মনমোহনী দৃশ্যের কথা। তাঁর মনের আকুলতা ও আবেগের বর্ণনা। কবি হিসেবে তাঁর প্রকাশভঙ্গি অন্যান্যের চেয়ে অসাধারণ। কায়কোবাদ আজানকে চিত্রায়িত করেছেন এক নতুন রূপে, যা তাকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে রেখেছে ভাব ও আবেগের বাহুবন্ধনে। আজানের সাথে যেন মুসলমানের হৃদয়ের সংযোগ, হৃদয়ের অনুধাবনে আজান মুসলমানের কাছে এক মধুর ঝংকারের অপার্থিব ভাবাবেগের তৈরী করে দেয়। আজান নিয়ে নিজের মনের আবেগ, ভালোবাসার কথা লিখেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও। কাজী নজরুল আজানের মধ্যে মানসিক প্রশান্তির ঠিকানা আবিষ্কার করেছেন
‘মসজিদে ঐ শোন রে আজান, চল নামাজে চল।
দুঃখে পাবি সান্ত¡না তুই বক্ষে পাবি বল।
অথবা
আমার মনের মসজিদে দেয়/আজান হাজার মোয়াজ্জিন
প্রাণের ‘লওহে’ কোরআন লেখা/রুহ পড়ে তা রাত্রিদিন।’
আজানের আবেদন শাশ্বত। প্রতিদিন সময়ের ক্রমবিবর্তনে সকাল-সন্ধ্যা পৃথিবীর সর্বত্র সব সময় মসজিদের মিনারে মিনারে বাজে আজানের সুমধুর সুর। আজান বাংলা, বাঙালির চেতনা ও অনুভূতিতে অসামান্য অভিব্যক্তির স্ফুরণরূপে অন্তরের অতলান্ত গভীরতায় স্থান করে নিয়েছে। সাহিত্যের নানা অঙ্গনে আজানের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার লক্ষণীয়। হাদিসের বিবরণে পাওয়া যায়, যত দূর আজানের শব্দ পৌঁছে, ততটুকু এলাকা ছেড়ে শয়তান দৌঁড়ে পালায়। আজানে যে গভীর সৌন্দর্য, রূপমাধুর্য রয়েছে, সে কথাগুলোর মর্ম অনুধাবন করতে পারলে আজান কানে আসামাত্রই আমরা নামাজ পড়ার জন্য একটা অন্যরকম তাগাদা অনুভব করতাম! আজানের ধ্বনি কানে নিয়ে আমাদের জন্ম, তারপর থেকে হররোজ আমরা পাঁচ ওয়াক্ত মসজিদের মিনার থেকে আজান শুনে শুনে অভ্যস্ত। প্রতিদিন সেই একই শব্দমালা ধ্বনিত হয় মুয়াজ্জিনের সুরেলা গলায়। নামাজের জন্য তিনি পরম করুণাময়ের নামে ডাকতে থাকেন ধরিত্রির মানুষগুলোকে।
প্রতিদিন শোনা হয়, তবু হৃদয় আকুল হয়ে থাকে এ ডাকে সাড়া দিতে। কোন আলস্য কিংবা বিরক্তি ছুঁতে পারে না মুমিনের ব্যাকুল তামান্নাকে। কায়কোবাদের ভাষায়,
আমি তো পাগল হয়ে, সে মধুর তানে
কি এক আকর্ষণে ছুটে যাই মুগ্ধ মনে
কি নিশীথে কি দিবসে, মসজিদের পানে।
আকাশ কিংবা ভূতল নয়, মহান ¯্রষ্টার অমর সিংহাসন প্রেমিকের হৃদয়ে। যে পেয়েছে এর সন্ধান, যে জেনেছে এর অবস্থান, সে কি আর উদাস না হয়ে পারে! অস্তিত্বের চারপাশে কেবলই যেন প্রেমাস্পদের কাছে ছুটে যাওয়ার তপ্ত আহবান। নদী ও পাখির গানে কিংবা ভ্রমরের গুণগানে, ভূধর সাগরে জলে নির্ঝরণী কল কলে- প্রেমিক হৃদয় কায়কোবাদের কর্ণকুহরে অনবরত প্রতিধ্বনি অনুভূত হয় আজানের সুরে।
নজরুল গীতি কবিতায় লিখেছেন,
‘দূর আযানের মধুর ধ্বনি/বাজে বাজে মসজিদেরও মিনারে
এ কী খুশির অধীর তরঙ্গ/উঠলো জেগে প্রাণের কিনারে…।
মনে জাগে হাজার বছর আগে/ডাকিত বেলাল এমনি অনুরাগে…।
পরম করুণাময়ের ছায়াতলে এভাবেই সকাতর সমর্পিত হওয়ার জন্য আজান ধ্বনিত হয়, প্রতিদিন পাঁচবার। ঝড়, বৃষ্টি কিংবা তুফান জলোচ্ছ্বাস- আজানের গতি নিরন্তর। কি নগর, কি গ্রাম, মাটির দেয়ালঘেরা নামাজঘর কিংবা সুউচ্চ মিনারের সুরম্য মসজিদ, আরব কিংবা আজম, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্যের যে কোন অঞ্চল, এ ধ্বনির আওতাসীমায় সমগ্র পৃথিবী। সারা পৃথিবীময় এ ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
আজানের ধ্বনির যে ঝংকার, যে শব্দমালার সমন্বয়ে তা আমাদের ডেকে যায়, এর সকাতর আহবান হয়তো আমাদের অনেকের কাছেই ধরা দেয় না। এ শুধু আহবান নয়, নয় শুধু কিছু শব্দমালার নিয়মমাফিক উচ্চারণ। এক মহান মঙ্গলময়ের কাছে হাজির হওয়ার তপ্ত আকুতি মিশে আছে এর প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি পরতে পরতে। এ আজানে দিওয়ানা হয়ে প্রভুর কাছে ছুটে চলে তার অবুঝ বান্দারা। যার রয়েছে প্রেম ও হৃদয়ের বাসনা- যে পেয়েছে অমৃতের সন্ধান, কোন শক্তি তাকে আটকে রাখে এ আজানে সাড়া দেওয়া থেকে? দিবারাত্রির বিস্ময়কর আর্বতনের ঐশ্বরিক কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িয়ে আছে আজান। আলো অন্ধকারের প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে সাথে বেজে ওঠে আজানের ধ্বনি। আজানের সাথে মিশে আছে বলেই হয়তো এ প্রকৃতির সৌন্দর্য ধরা দেয় কবিমনের ক্যানভাসে। এ অপরূপ কারিশমা দেখে তিনি উতলা হয়ে আছেন এ ধ্বনি নিজের কানে তুলে নিতে। তিনি আঁধারঘেরা অন্ধকার রাতে নিশি জেগে বসে আছেন আপন মনে, কখন আসবে ভেসে মুয়াজ্জিনের সুরেলা গলার সুমধুর আজান।
আজান এমন একটি ইবাদত যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। এটা মহান আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি প্রদানের অনন্য কর্ম। আজান ইসলামী সমাজের বাস্তবতা প্রকাশের বিশেষ দিক। আজানের বাণী দৈনিক পাঁচবার এ ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে যে, তিনি আল্লাহ তিনি লা-শারিক, তাঁর কোনো অংশীবাদী নেই, তাঁর সমতুল্য, সমকক্ষ কেউ কোথাও নেই। তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি ছাড়া কেউই প্রভু সার্বভৌমী নেই, তিনিই সার্বভৌমত্বের একমাত্র মালিক, তিনিই একমাত্র মহান, সুউচ্চ- শ্রেষ্ঠতম। আজান হলো ইসলামের অন্যতম নিদর্শন, অপূর্ব ধ্বনি, শ্রুতিমধুর বাণী, ইসলামের প্রতীক যা আমাদের আহ্বান করে ঐক্যের পথে, সত্যের দিকে, যা আমাদের সুযোগ করে দেয় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করার মাধ্যমে ঐক্যের শপথ গ্রহণ করতে।
পরম করুণাময়ের কাছে সমর্পিত হওয়ার জন্য সুমধুর ধ্বনী এ আজান আজানের মাঝে হৃদয়ের ব্যকুলতা শুনতে পাই, সুন্দরতম পবিত্র করুণাময়ের বারিধারা পেতে চাই। যান্ত্রিক জীবনেও আজান শোনায় জীবনের নতুন জয়গান, ব্যথা বেদনা ভুলে তাঁরই আশ্রয়তলে যে চায় সমর্পন হতে, আজান তো তার জন্যই।
জাতীয় কবি নজরুলের মতো আমরাও বলতে চাই
মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই
যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।