মানুষের ললাটে দু‘টো কালো দাগের চিহ্ন থাকবে, তারা মুনাফিক -এ কথা কতটুকু সত্য?

0

মুহাম্মদ ইকবাল হুসাইন, পূর্ব বেতাগী, রাঙ্গুনিয়া

প্রশ্নঃ কেউ কেউ বলে থাকে যে, যে সকল মানুষের ললাটে দু‘টো কালো দাগের চিহ্ন থাকবে, তারা মুনাফিক -এ কথা কতটুকু সত্য? সত্যিই কি তারা মুনাফিক?

উত্তরঃ আল্লাহ্‌ তা‘আলা সাহাবা-ই কিরামের প্রশংসা করতে গিয়ে এরশাদ করেন, سِیْمَاھُمْ فِیْ وُجُوْھِھِمْ مِنْ اَثَرِ السُّجُوْد  অর্থাৎ ‘তাঁদের চিহ্ন তাঁদের চেহারার মধ্যে রয়েছে সাজদার চিহ্ন হতে।’ সাহাবা-ই কিরাম ও তাবিঈগণ এ ‘সাজদার চিহ্ন’ এর ব্যাখ্যায় চারটি অভিমত ব্যক্ত করেছেন। যথা-

এক. হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে মাসঊদ ও ইমাম হাসান বসরী রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, -এটা ওই নূর যা কিয়ামত দিবসে তাদের চেহারায় সাজদার বরকতে দেখা যাবে।

দুই. হযরত আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস ও ইমাম মুজাহিদ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, হৃদয়ের কাকুতি-মিনতি ও নম্রতা এবং সৎগুণাবলীর চিহ্নাদি যা পুণ্যবান বান্দাদের চেহারায় স্বাভাবিভাবে ফুটে ওঠে।

তিন. ইমাম হাসান বসরী ও দাহহাক রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, ইবাদত-বন্দেগী করার জন্য রাত্রি জাগরণের ফলে চেহারায় যে হলদে বর্ণ প্রকাশ পায়, তাই ‘সাজদার চিহ্ন’।

চার. ইমাম সা’ঈদ ইবনে জুবাইর ও ইকরামাহ্‌ রদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার মতে, ওযূর পানির সিক্ততা এবং মাটির চিহ্ন যা মাটিতে সাজদা করার দ্বারা নাক ও কপালে লেগে থাকে।

উল্লিখিত চারটি অভিমতের মধ্যে প্রথম দু’টি অভিমতই অধিক শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য। কারণ, হুযূর আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র উক্তি দ্বারা প্রথম দু’টি অভিমত সমর্থনযোগ্য। যেমন- ইমাম তাবরানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর মু’জাম গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে,

وعن ابی بن کعب رضی اللہ تعالٰی عنہ قال قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم فی قولہ عزّوجلّ سیماھم فی وجوھھم من اثر السجود قال النور یوم القیامۃ (رواہ الطبرانی)

অর্থাৎ হযরত উবাই বিন কা’ব রদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলূল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বাণী سِیْمَاھُمْ فِیْ وُجُوْھِھِمْ  -এর ব্যাখ্যায় এরশাদ করেছেন যে, জ্ঞসাজদার চিহ্নঞ্চ হল ওই নূর যা কিয়ামত দিবসে প্রকাশ পাবে।

তবে অনেক তাফসীরকারক, আয়াতের প্রকাশ্য অর্থও গ্রহণ করেছেন। যেমন, তাফসীরে মাফাতিহুল গায়্‌ব-এ বর্ণিত আছে যে,

قولہ تعالٰی سیماھم فیہ وجھان احدھما ان ذالک یوم القیامۃ وثانیھما ان ذالک فی الدنیا وفیہ وجھان احدھما ان المراد مایظھر فی الجباہ بسبب کثیرۃ السجود

অর্থাৎ কপালের এ চিহ্ন দ্বারা দু’টি বিষয়কে বুঝায়, প্রথমত, তা হল কিয়ামত দিবসে প্রকাশ হবে, দ্বিতীয়ত, তা দুনিয়াতে বেশি সাজদা করার কারণে কপালে প্রকাশ পাবে।

সুতরাং কপালে বা নাকে সাজদার দরুন দাগ পড়ে থাকলে, তা বদআকীদাধারীর চিহ্ন বলা ঠিক নয়। কারণ, ইমাম জয়নুল আবিদীন ও হযরত আলী শবভণ আবদুল্লাহ্‌ ইবনে আব্বাস (রদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)’র মত প্রখ্যাত ইমামগণের অনেকের এ প্রকার সাজদার নূরানী চিহ্ন ছিল বলে বর্ণনায় দেখা যায়। তবে কপাল বা নাকে জ্ঞসাজদার দাগঞ্চ হওয়া সম্পর্কে সঠিক বিশ্লেষণ ও অভিমত হল:

১. লৌকিকতা বশত ইচ্ছে করে এ দাগ সৃষ্টি করা হারাম ও কবীরাহ গুনাহ্‌। আল্লাহ্‌ না করুক, এ দাগ জাহান্নামে প্রবেশ করার কারণ হবে, যদি বিশুদ্ধ অন্তরে তাওবাহ্‌ না করে।

২. যদি বেশি সাজদার কারণে এ দাগ এমনিই হয়ে থাকে ঠিক আছে আর যদি ওই সাজদা লোক-দেখানোর জন্য হয়, তবে এ দাগ জাহান্নামের চিহ্ন।

৩. যদি ওই সাজদা একমাত্র আল্লাহর জন্য ছিল। কিন্তু এ দাগ পড়ার কারণে মনে মনে এ ভেবে খুশি হয় যে, এ চিহ্নের কারণে লোকেরা আমাকে ইবাদতকারী ও সাজদাকারী (নামাযী) বলে জানবে, তবে সাজদার এ চিহ্ন তার জন্য অত্যন্ত মন্দ।

৪. এ চিহ্নের কারণে উপরোক্ত কোন কিছুর প্রতি যদি তার দৃষ্টিপাত না হয় তবে তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তবে শর্ত হল, আকীদা বিশুদ্ধ হতে হবে।

কারণ, বদআকীদা পোষণকারীর কোন আমল আল্লাহর দরবারে কবূল হয় না। সুতরাং বদমাযহাবী লোকের সাজদার কপালের দাগ মন্দ। সুন্নী তথা আহলে সুন্নাতের আকীদা ও আমলে বিশ্বাসী লোকদের কপালে সাজদার চিহ্ন লৌকিকতার কারণে হলে, মন্দ। অন্যথায় উত্তম ও ভাল। আর কোন সুন্নী মুসলমানের কপালে এ প্রকার সাজদার চিহ্ন দেখে রিয়া বা লৌকিকতার অপবাদ দেওয়া ও মন্দ ধারণা পোষণ করা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মন্দ ধারণা অনেক সময় মিথ্যা ও গুনাহের কারণ হয়ে যায়।

সুতরাং, ললাটে একটা বা দু’টো দাগ থাকা একমাত্র মুনাফিকের চিহ্ন এ কথা কোরআন ও সুন্নাহ্‌ দ্বারা প্রমাণিত নয়।

[ইমাম আ’লা হযরত শাহ্‌ আহমদ রেযা রহমাতুল্লাহি আলাইহি কর্তৃক লিখিত ‘ফতোয়া-ই আফ্রীকা, ও ‘ফতোয়া-ই রেজভিয়া’ এবং তাফসীরে কাবীর, কৃত ইমাম রাযী রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইত্যাদি।] [সূত্র. যুগ-জিজ্ঞাসা, পৃ.৪৩-৪৪]

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •