প্রকাশিত হয়েছে… ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে দো‘আ ও মুনাজাত

0

প্রকাশিত হয়েছে… – ক্বোরআন-সুন্নাহর আলোকে দো‘আ ও মুনাজাত –

লেখক : মাওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল-আযহারী

সম্পাদক : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক, আনজুমান রিসার্চ সেন্টার

হাদিয়া: ৫০ /- (পঞ্চাশ) টাকা

সৃষ্টিকর্তা প্রতিপালক মহান আল্লাহ এমন এক মহান সত্তা যিনি তাঁর কাছে কোনো কিছু চাইলে অত্যন্ত খুশি হন। তিনি কারীম-পরম দয়ালু। তিনি চান মানুষ তাঁর কাছে তাদের প্রয়োজনীয় সব কিছু চেয়ে নিক। তিনি তাদের প্রার্থনা কবুল করেন। বান্দা যত বেশী চাইবে আল্লাহ তত বেশী দেন এবং তত বেশি খুশি হন। দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়।
দো‘আ শব্দের অর্থ প্রার্থনা করা, আহ্বান করা, কোন কিছু পাওয়ার জন্য আকুতি-মিনতি করা ইত্যাদি। দো‘আ আল্লাহর সঙ্গে বান্দার কথোপকথনের প্রধান মাধ্যম। ইসলামে দো‘আকে একটি স্বতন্ত্র ইবাদতের মর্যাদা দেয়া হয়েছে। দুনিয়াতে যারাই আল্লাহর প্রিয় হয়েছেন তাঁরা সকলে দো‘আকে মূল হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দো‘আর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের পার্থিব ও পরকালীন সফলতার মূল চাবিকাঠি ।
আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ওই মুহূর্তটিকে অধিক পছন্দ করেন যখন বান্দা তার নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে, তার কাছে মাগফেরাত তলব করে। ‘বান্দার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই’ স্বতঃসিদ্ধ এই কথা যখন বান্দার মুখে আকুতির মাধ্যমে উচ্চারিত হয় তখন আল্লাহর করুণার ধারা বান্দার প্রতি প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়।
বান্দা কীভাবে তার চাহিদার কথা মহান আল্লাহ তা‘আলার দরবারে উপস্থাপন করবে তার কৌশল আল্লাহ তা‘আলা নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন। নিজের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার আহ্বান করা এবং তার পদ্ধতিও বলে দেয়ার নজির একমাত্র মহান আহকামুল হাকিমীনের দরবারেই মিলে। দুনিয়ার কোনো রাজা-বাদশার দরবারে এমনটি পাওয়া যায় না। ক্বোরআনের বিভিন্ন স্থানে দো‘আ কীভাবে করতে হবে তার পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে।
যেমন দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার জন্য কীভাবে দোআ’ করবে এ প্রসঙ্গে শিক্ষা দিয়েছেন-
رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
অর্থাৎ (তোমরা এভাবে আরয করো) ‘হে আমার প্রতিপালক! তুমি আমাদেরকে দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়ের মধ্যে কল্যাণ দান কর। আমাকে জাহান্নামের কঠিন আযাব থেকে নাজাত দাও।’[সূরা বাক্বারা, আয়াত-২০১] আরেক জায়গায় তিনি দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে-
رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের ওপর অত্যাচার করেছি; এখন যদি তুমি আমাদেরকে মাফ না কর এবং আমাদের ওপর দয়া না কর; তবে নিশ্চয়ই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব।’ [সূরা আ’রাফ, আয়াত-২৩] এভাবে ক্বোরআনে আল্লাহ তাঁর বান্দার আহ্বানে সাড়া দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন-
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ ۚ
‘এবং তোমাদের রব বলেন, হে বান্দারা! তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’[ সূরা গাফির, আয়াত-৬০] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় হাবীব ও বন্ধু। তাই তিনি আল্লাহ তা‘আলার অতি নিকটে পেীঁছার জন্য অধিক হারে দো‘আ করতেন। যে কোনো বিপদে আপদে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দোআ’র মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি পূর্বক নাজাত কামনা করতেন। মক্কায় অবস্থানকালীন কঠিন মুহূর্তে, ঐতিহাসিক বদরের যুদ্ধে নিরস্ত্র অবস্থায়, হিজরতের সময় কাফেরদের আক্রমণের অতি নিকটবর্তী সময়েও, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখনই আল্লাহর দরবারে হাত উঠিয়েছেন তখনই আল্লাহর সাহায্য এসেছে। তাঁর রহমতের দরিয়ায় জোশ উঠেছে। আল্লাহ তাঁর কৃপা ও কুদরতের অদৃশ্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রিয়নবীর সাহায্যার্থে। প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ কিংবা মানবিক বিপর্যয়ের করুণ মুহূর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার ছিল দো‘আ ও মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর করুণা ও রহমতের দ্বারে আশ্রয় গ্রহণ করা। তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডারে দয়া ও করুণার প্রার্থনা করা।
গভীর রাতে সমস্ত জগত যখন ঘুমের ঘোরে নিরব, নিস্তব্ধ, নিঝুম, বিভোর, তখনও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দো‘আ ও মোনাজাতের মাধ্যমে কান্নাকাটি করতেন। প্রিয় হাবীবের সঙ্গে সেসব ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোকে মূল্যায়ন করে উম্মতে মুহাম্মদীকে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বিশেষ করুণার প্র¯্রবনে সিক্ত করেছেন। আল্লাহর একান্ত প্রিয় ও নিষ্পাপ নবী এগুলোর মাধ্যমে আপন-প্রিয় উম্মতকেও শিক্ষা দিয়েছেন।
দো‘আর আদব হলো, বান্দা তার সমস্ত দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব আল্লাহর কাছে পেশ করবে অত্যন্ত বিন¤্র ভাষায়। নিজের সত্তাকে বিলীন করে দেবে আল্লাহর দরবারে। নিজেকে সম্পূর্ণ আল্লাহর দরবারে সোপর্দ করে নিজের চাহিদার কথা, নিজের অভাব-অনটনের কথা মহান রবকে জানাবে। প্রকৃত ও যথার্থ দো‘আর ফল অবশ্যম্ভাবী। সঠিক নিয়মে দো‘আ করলে তা কখনও বিফলে যাবে না। দো‘আর ফল প্রকাশে বিলম্ব হলেও তাতে নৈরাশ হওয়ার কারণ নেই। কোনো দো‘আর ফল যদি দুনিয়াতে নাও পাওয়া যায় তবে তা আখেরাতে অবশ্যই পাওয়া যাবে-এ বিশ্বাস রাখতে হবে সবাইকে। সর্বোপরি অন্তরকে স্বচ্ছ, কলুষমুক্ত করে আল্লাহর দরবারে হাজিরা দিতে পারলেই দো‘আ কবুলের গ্যারান্টি দেয়া যায়।
ফরয নামাযের পর হাত তুলে দো‘আ করা কোরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে এটি একটি সুন্নাত আমল। এটিকে বিদ‘আত বলার কোনো অবকাশ নেই। ফরয নামাযের পর দো‘আ করা হাদিসের ছয়টি নির্ভরযোগ্য কিতাব অর্থাৎ সিহাহ সিত্তার মাধ্যমে প্রমাণিত। অন্যদিকে দো‘আর সময় হাত তোলার কথাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই, যাতে ফরয নামাযের পর হাত তুলে দো‘আ করাকে হারাম কিংবা নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জমানা থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে ফরয নামাযের পর হাত তুলে দো‘আ করার নিয়ম চলে আসছে। এতে কেউ আপত্তি করেনি।
ইমাম আবূ হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম মালেক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শাফে‘ঈ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মতো ফকিহ মুজতাহিদগণ ও অগণিত মুহাদ্দিস চলে গেছেন ঠিক, কিন্তু কোনো একজন ইমামও এ বিষয়ে আপত্তি করেননি। পক্ষান্তরে, ইবনে তাইমিয়া ও ইবনে ক্বাইয়্যিম এ বিষয় নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন। তথাকথিত আহলে হাদিসের আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানীর অনুকরণে বর্তমানে কিছু ওহাবী, লা-মাযহাবী ফরয নামাযের পর হাত তুলে মোনাজাতের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেছেন অথচ তা শরিয়তের আলোকে কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আহলে সুন্নাত এ কাজকে ফরয কিংবা ওয়াজিব মনে করেন না; বরং সুন্নাত হিসেবে হাত তুলে দো‘আ-মুনাজাত করে থাকেন।
আরব রাষ্ট্রগুলোতে ওয়াহাবী মতবাদের প্রবর্তক মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহ্হাব নাজদির আত্মপ্রকাশ এবং পেট্রো ডলার পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ফরয নামাযের পর হাত তুলে মোনাজাতের আমল জারি ছিল। এমনকি লা-মাযহাবীদের গুরুজনরাও তা সমর্থন করেছেন। যেমন সাইয়্যিদ নাযির হোসাইন, নাওয়াব সিদ্দিক হাসান ভূপালি, সানাউল্লাহ, হাফেয আব্দুল্লাহ মুবারকপুরী প্রমুখ। তারা নামাযের পর হাত তুলে দো‘আ করাকে বিদ’আত বলেননি। কয়েকজন লোকের অহেতুক বিরোধিতার কারণে উম্মতের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আমলকে বিদ’আত বলা কখনো যুক্তিসংগত হতে পারে না।
হাদিসের কিতাবাদি অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, দো‘আর জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা সময়ের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বিশেষ বিশেষ জায়গায় দো‘আ করার হাদিস রয়েছে। এর মধ্যে ফরয নামাযের পর অন্যতম। এ মাসআলাটি সমাজের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন। আমরা এ নিবন্ধে কোরআন, হাদিস, সলফে সালেহিনের আমল ও তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
নিবন্ধটি তিনটি অধ্যায় ও কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করা হয়েছেঃ প্রথম অধ্যায়ে দো‘আ ও মুনাজাতের গুরুত্ব ও ফযীলত, দ্বিতীয় অধ্যায়ে ফরয নামাযের পর হাত তুলে দো‘আ ও মুনাজাত এবং তৃতীয় অধ্যায়ে এ বিষয়ে পর্যালোচনা করা হয়েছে।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •