একটি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা কিভাবে বসবাস করবে? কিভাবে তারা তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বসবাস করবে?

0

 মুহাম্মদ কুতুব উদ্দীন, পাইরোল, সাদা (রোকন), পটিয়া, চট্টগ্রাম। =

 প্রশ্ন: একটি ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা কিভাবে বসবাস করবে? কিভাবে তারা তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বসবাস করবে? দয়া করে জানাবেন।

উত্তর: নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শাসনামলে যে আঙ্গিকে অমুসলিম নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা হয়েছিল, মানবতার ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত বিরল, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি, চুক্তি ও বাণীর মাধ্যমে তাদের এ স্বাধিকারকে রাষ্ট্রীয় আইনভুক্ত করে নেন।
প্রিয় নবীজীর শাসন আমলে নাজরান গোত্রবাসী (খৃষ্টানদের) সাথে সম্পাদিত চুক্তি ধর্মীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাসহ অপরাপর যাবতীয় অধিকার সংরক্ষণের মনোভাবেরই পরিচয় বহন করে। এতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম লিখিতভাবে নিচের ফরমানটি জারি করেন-
ولنجران وحاشيتهاجوار الله وذمة محمد النبى رسول الله على دمائهم وانفسهم وملتهم وارضهم واموالهم وغائبهم وشاهدهم وغيرهم وبعثهم وامثالتهم لايغير ما كانوا عليه ولايغير حق من حقوقهم وأمثلتهم لايفتن أسقف من اسقفيته ولاراهب من رهبانيته ـ ولا واقفه من وقافيته على ماتحت أيديهم من قليل أو كثير وليس عليهم رَهَقٌ
অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ ও তদীয় প্রিয রসূল মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নাজরান ও এর পার্শ্ববর্তীদের জন্য তাদের রক্ত, প্রাণ, ধর্ম, ভূ-খন্ড, সম্পদ, ধর্মগুরু, পাদ্রী, তাদের উপস্থিত-অনুপস্থিত, গৃহপালিত জন্তু, সফররত জনগণ ও তাদের ধর্মশালা (ধাম) ইত্যাদির জামিন ও জিম্মাদার। তারা যে দ্বীনে রয়েছে, তা থেকে জোরপূর্বক তাদের ফেরানো হবে না। তাদের অধিকার প্রাপ্তিতে এবং উপাসনালয়ের অধিকারে কোনরূপ হেরফের করা হবে না। কোন পাদ্রী, ধর্মগুরু, সর্দার, ভোজনালয়ের সেবককে সাধারণ হোক বা উচ্চপদস্থ হোক তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে হটানো হবেনা, আর তাদের জন্য কোনরূপ ভয়-ভীতি নেই।
[ইবনে সাদ: আত্ তাবকাবুতল কুবরা, ১/২৮৮, ইমাম আবূ ইউসুফ: কিতাবুল খারাজ, ৮৭পৃ. আবূ উবাইদ কাসেম: কিতাবুল আমওয়াল, পৃ. ৪৪৯, ৪৫০, হাদীস নং ৭৩২, বালাযুরী: ফতহুল বুলদান, পৃ.৯০] ইমাম হোমাইদ বিন যানজাওয়াইহ বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ওফাতের পর হযরত আবূ বকর সিদ্দীক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাসনামলে এ চুক্তি যথারীতি কার্যকর ছিল। পরবর্তীতে হযরত ওমর ফারুক ও হযরত ওসমানগণী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার শাসনামলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাদির পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে কিছু সংযোজন করা হয়েছে কিন্তু অমুসলিমদের উক্ত অধিকার রক্ষার জিম্মাদারির সেই কার্যধারা পুরোপুরি বলবৎ ছিল। অনুরূপ খাইবার বিজয়কালেও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদের সম্পদ ও শস্যাদির ব্যাপারে অনুরূপ ঘোষণা দেন। ইমাম আহমদ, ইমাম আবূ দাঊদ, ইমাম তাবরানী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিম সহ মুহাদ্দিসগণ হাদিসটি বর্ণনা করেন-
عن خالد بن الوليد رضى الله تعالى عنه قال ـ غزونا مع رسول الله صلى الله عليه وسلم غزوة خيبر ـ فأسرع الناس فى حظائر يهود ـ وأمرنى ان انادى : الصلاة جامعة ولايدخل الجنة الا مسلم ثم قال : ايها الناس انكم قد اسرعتم فى حظائر يهود ،الا لاتحل اموال المعاهدين الا بحقها
অর্থাৎ প্রখ্যাত বীর মুজাহিদ সাহাবিয়ে রাসূল হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে খাইবার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিছু (মুজাহিদ) মুসলমান ইহুদিদের কিছু বাঁধা জন্তু আচমকা নিয়ে যায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাকে নামাযের জন্য আযান দেয়ার নির্দেশ দেন এবং বলেন, মুসলিম ছাড়া কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবেনা, নামাযের পর তিনি বলেন, হে লোক সকল! তোমরা ইহুদিদের কিছু বাঁধা জন্তুও তাড়াহুড়ায় নিয়ে এসেছ। সাবধান! অন্যায়ভাবে অমুসলিম নাগরিকদের সম্পদ গ্রহণ করা অবৈধ।
[ইমাম আহমদ ইববে হাম্বল, আল মুসনাদ, ৪/৮৯, হাদীস নং ১৬৮৬২, ইমাম আবূ দাউদ: আস্ সুনান কিতাবুল আততামাহ্, হাদীস নং-৩৮০৬] একই রেওয়ায়ত ভিন্ন শব্দেও বর্ণিত হয়েছে-الا وانى احرم عليكم اموال المعاهدين بغير حققها অর্থাৎ সাবধান! অমুসলিম সংখ্যালঘু নাগরিকদের যাদের সাথে চুক্তি করা হয়েছে, তাদের সম্পদ অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করা আমি তোমাদের জন্য হারাম ঘোষণা করেছি।
[তাবরানী, মু’জামুর কবীর, ৪/১১১, হাদীস নং ৩৮২৮] নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শাসনামলে এসব চুক্তি, লিখিত দলিল, বাণী ও ঘোষণা দ্বারা ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় যা যা করা হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা নি¤েœ প্রদত্ত হল, ১. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমরা চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের নিরাপত্তা বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট কর আদায় করবে।
২. ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক ও মুসলিম নাগরিক উভয়ের আইনী অধিকার সমান হবে, অর্থাৎ আইনের চোখে সবাই সমান হিসেবে পরিগণিত হবে। ৩. তাদের নিজস্ব ধর্ম পালনে কোন প্রকার বাধা দেওয়া যাবে না। ৪. তাদের জান-মাল ও ইজ্জত-আব্রুর রক্ষণাবেক্ষণ মুসলমানদের ন্যায় ইসলামী রাষ্ট্রের জিম্মাদারিতে থাকবে, ৫. ইসলামী রাষ্ট্র তাদের যোগ্যতা ও পারদর্শিতা অনুসারে প্রশাসনিক দায়ভার দিতে পারবে। ৬. তাদের ধর্মীয় প্রতিনিধি ও দায়িত্বশীলগণ তাদের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হিসেবে বিবেচিত হবে। তাদের উপাসনালয়গুলো পুর্ণাঙ্গ নিরাপত্তার আওতায় থাকবে।
সুতরাং বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সকল দায়িত্ববান এবং মুসলিম সমাজের সকল নাগরিককে এ বর্ণনাগুলো অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে যেহেতু ইসলাম শান্তি ও মানবতার ধর্ম। সুতরাং আমরা বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতা আমাদের দেশের সংখ্যালঘু অমুসলিমদের জান, মাল, ইজ্জত-আবরু এবং তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোকে রক্ষা করা আমাদের ধর্মীয়, রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে জানি ও মানি। তবে আমাদের প্রতিবেশী সংখ্যা গরিষ্ঠ বিধর্মী রাষ্ট্রসমূহে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জান-মাল ইজ্জ্বত-আবরু মসজিদ, মাদরাসা কতটুকু নিরাপদ? তাদের দায়িত্বশীল রাষ্ট্র পরিচালনকারীদের ভূমিকা কি ধরণের? রোহিঙ্গার লাখ লাখ মুসলিম নর-নারীদের সাথে তারা কি আচরণ করল, কাশ্মীর, গুজরাটের মুসলমানদের উপর কয়েক বছর পূর্বে ভারতের সংখ্যা গরিষ্ঠ বিধর্মীরা কিভাবে নির্যাতন করল? মানবতার প্রতি বিন্দুমাত্র সম্মানটুকুও তাদের অন্তরে নাই। বাংলাদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানদের হতে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আহ্বান রইল পার্শবর্তী রাষ্ট্রসমূহের সকল বিধর্মীদের প্রতি।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •