প্রশ্ন করেছেন সৈয়দ আহমদ রেযা, নায়েব ইমাম, মসজিদে রহমানিয়া গাউসিয়া, শীতলঝর্ণা, আবাসিক এলাকা, অক্সিজেন
চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: একটি ম্যাগাজিনে এক ব্যক্তি প্রশ্ন করেছেন, ‘কোন আশা পূরণকে সামনে রেখে কোন ওলী আল্লাহর মাযারে গমন করা জায়েয হবে কী? উত্তরে বলা হয়েছে, ‘না, আশা ও মকসুদ পূরণের উদ্দেশ্যে কোন পীর বা ওলী বুযুর্গের কবর বা মাযারে গমন করা জায়িয হবে না। একমাত্র যিয়ারতের উদ্দেশ্যে এবং আখিরাতের স্মরণের লক্ষ্যেই কবর যিয়ারত করা জায়িয। কবর বা মাযারে গিয়ে নিজের হাজত চাওয় সম্পূর্ণ হারাম ও মারাত্মক শিরক গুনাহ্। বস্তুত: মাকসূদ বা আশা পূরণে একমাত্র মহান আল্লাহর নিকট চাইতে হবে অন্য কারও কাছে নয়। সে জন্য মাযারে যাওয়ার কোনই প্রয়োজন নেই। বরং নিজের ঘরে বা মসজিদে ইবাদত-বন্দেগী করে কিংবা সালাতুল হাজত পড়ে মহান আল্লাহর নিকট নিজের হাজত পেশ করে দুআ করবে। এখন আমার প্রশ্ন এ উত্তর কতটুকু গ্রহণীয়? যদি সঠিক ন হয় তাহলে ক্বোরআন হাদীসের দলিলসহ উত্তর দিলে ধন্য হবো। উল্লেখ্য যে, এ সব কথা আমাদের দেশের বাতিল তথা ওহাবী, খারেজী, মওদুদী ও লা-মাযহাবীদের বক্তৃতায় বেশী শুনা যায়।
উত্তর: যে কোন বৈধ আশা ও মাকসূদ পূরণের উদ্দেশ্যে কোন হাক্কানী কামিল পীর-মুর্শিদ বা ওলী বুযুর্গের মাযার শরীফে গমন করা এবং আল্লাহ্ তা‘আলা প্রদত্ত বিশেষ রূহানী ক্ষমতার অধিকারী মনে করে তাঁদেরকে ওসীলা মনে করে তাদের কাছে অথবা তাঁদের মাজারে সাহায্য প্রার্থনা করা বৈধ। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে মূলত সাহায্যের মূল উৎস হচ্ছে মহান আল্লাহ জাল্লা-জালালুহু। আর সম্মানিত নবীগণ, শহীদগণ, হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও আল্লাহর পুণ্যাত্মা ওলীগণ হচ্ছেন ওই সাহায্যের বিকাশস্থল। প্রকৃত মুসলমানগণের আক্বীদা এটাই। কোন হক্কানী মুসলমান গাউস-কুতব, আবদাল ও নবী অলিগণকে আল্লাহ্ বা আল্লাহর সমতুল্য মনে করে না বরং আল্লাহর প্রিয় বন্ধু ও আল্লাহ্ প্রদত্ত ক্ষমতায় ক্ষমতাবান বলে মনে করেন। সুতরাং আল্লাহর পুণ্যাত্মা বান্দাদের নিকট বা তাঁদের মাযারে গিয়ে নিজের হাজত প্রার্থনা করাকে হারাম ও শিরক বলা মুসলমানদের উপর জঘন্যতম মিথ্যা অপবাদ এবং মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের সর্বজনমান্য মুহাদ্দিস হযরত আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর রচিত আশিআতুল লুমআত শরহে মেশকাত গ্রন্থে হযরত ইমাম গায্যালী রহমাতুল্লাহি আলায়হির উক্তি নকল করে বলেন- قَالَ الامام الغزّالى من يستمد فى حياته يستتمد بعد وفاته ইমাম মুহাম্মদ গাযালী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন, যাঁর কাছ থেকে জীবদ্দশায় সাহায্য চাওয়া যায়, তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। অর্থাৎ এটা র্শিক বা হারাম নয় বরং বৈধ ও জায়েয।
[আশিআতুল লুমআত, যিয়ারাতুল কুবুর অধ্যায়]
উপমহাদেশের অন্যতম মুহাদ্দিস ও প্রখ্যাত ফক্বিহ্ হযরত আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর রচিত তাফসীর-ই আযীযী, সূরা বাক্বারার এক আয়াতের তাফসীরে বলেন, আল্লাহর সচরাচর কার্যাবলী যেমন, সন্তানদান, রুজি, রোজগার বৃদ্ধিকরণ, রোগ হতে মুক্তি দান ও এ ধরনের অন্য সব কার্যাবলীকে মুশরিকগণ দুষ্ট ও পাপী আত্মা এবং দেব-দেবতা ও প্রতিমার সাথে সম্পর্কযুক্ত করে থাকে। ফলে তারা কাফির বলে গণ্য হয়। কারণ মুশরিকরা এগুলোকে অর্থাৎ দেব-দেবতাকে মহান আল্লাহর সমতুল্য মনে করে। আর মুসলমানগণ এসব বিষয়কে আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতায় আল্লাহর অলি, গাউস, কুতুব, আবদাল তথা আল্লাহর বন্ধুগণের শুভ দৃষ্টি ও নেক দোয়ার ফসল বলে মনে করেন কিংবা আল্লাহর এ নেকবান্দাগণ মহান রবের কাছে প্রার্থনা করে জনগণের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। এতেই এ সব মুসলমানের ঈমানের কোন ক্ষতি হয় না। [তাফসীরে আযীযী, পৃ. ৪৬০]
যেমন হযরত ঈসা নবী আলায়হিস্ সালাম এর আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতায় এবং আল্লাহর একান্ত দয়ায় মাতৃগর্ভের অন্ধ ব্যক্তিকে দৃষ্টি শক্তি দান করা, শ্বেত রোগীকে মসেহ করার সাথে সাথে মুহূর্তেই ভাল ও সুস্থ সুন্দর মানুষে পরিণত করা এবং মুর্দাকে আল্লাহর হুকুমে জীবিত করার অলৌকিক ঘটনার বিবরণ পবিত্র কোরআনে স্থান পেয়েছে, যা অস্বীকার ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে ঈমান হারা হয়ে যাবে।
হানাফী মাযহাবের বিখ্যাত ফতোয়াগ্রন্থ রদ্দুল মোহতার তথা ফতোয়া-ই শামীতে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ শীর্ষক আলোচনায় উল্লেখ আছে যে, মাযহাবের অন্যতম ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদরিচ শাফে‘ঈ রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেছেন, যখনই আমি কোন সমস্যার সম্মুখীন হতাম তখনই বাগদাদে ইমাম আযম আবু হানীফা রহমাতুল্লাহি আলায়হির মাযারে চলে যেতাম, তাঁর বরকতেই আসার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে যেত।
ওহাবী দেওবন্দীর নিকট শায়খুল হিন্দ হিসেবে খ্যাত তাদের প্রসিদ্ধ গুরু মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী স্বীয় তরজমায়ে কোরআন, সূরা ফাতেহার اِياكَ نَسْتَعِيْنَ আয়াতের টীকা তথা ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, যদি কোন আল্লাহর প্রিয়বান্দাকে রহমতে ইলাহীর ওসীলা ও মাধ্যম মনে করে তাঁকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও সত্ত্বাগতভাবে সাহায্যকারী জ্ঞান না করে তাঁর কাছে বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে সাহায্য ভিক্ষা করা হয়, তা হলে তা বৈধ। কেননা, তাঁর কাছে সাহায্য চাওয়া মূলতঃ আল্লাহ্ তা‘আলার কাছ থেকেই সাহায্য প্রার্থনার নামান্তর।
সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীরা কোন নবী বা ওলীকে আল্লøাহ কিংবা আল্লাহর সমতুল্য বা আল্লাহর পুত্র জ্ঞান করে না। (নাউযুবিল্লাহ্!) কেবল ওসীলা বা মাধ্যম বলে বিশ্বাস করে। তাই তাঁদের কাছে গিয়ে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা সম্পূর্ণ জায়েয ও বরকতময়। অবশ্য আল্লাহর নিকট ওসীলা তালাশ করার নির্দেশ স্বয়ং কুরআন পাকে আল্লাহ্ তা‘আলা প্রদান করেছেন। তদুপরি সরকারে দোআলম নুরে মুজাস্সাম রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমাদের ঘোড়া বা সাওয়ারি সফরে বা জঙ্গলে হারিয়ে হয়ে যাও, অথবা কোন বিশেষ মুসীবতের শিকায় যায় আর সাহায্য প্রার্থনা করার বাহ্যিকভাবে যদি কেউ পাওয়া না যায়, তবে তোমরা এ বলে সাহায্য প্রার্থনা কর اعينونى ياعباد الله অর্থাৎ হে আল্লাহর প্রিয়বান্দাগণ! আমাকে সাহায্য করুন। [তাবরানী শরীফ]
এ হাদীসে স্বয়ং রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সফরের কঠিন মুহূর্তে মুসীবতের শিকার হলে আল্লাহর প্রিয় বন্ধুগণ হতে সাহায্য চাওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন। যেহেতু আল্লাহর রহমত, করুণা, কৃপা ও সাহায্য লাভ করার ওসীলা ও মাধ্যম হলেন আউলিয়া-ই কেরাম তথা আল্লাহর খাস বান্দাগণ। সুতরাং তাঁদের নিকট তাঁদেরকে ওসীলা মনে করে সাহায্য প্রার্থনা করা র্শিক নয় বরং প্রিয় নবীর হাদীস শরীফের উপর বাস্তব আমল। একে শিরক ও হারাম বলা কোরআন ও হাদীস শরীফ সম্পর্কে অজ্ঞতা, মূর্খতা ও আউলিায়ায়ে কেরাম কেরামের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করার নামান্তর। সুতরাং উক্ত ম্যাগাজিনের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর ও গোমরাহী।
[তাবরানী শরীফ, তাফসীরে আযীযী কৃত. আবদুল আযিয মুহাদ্দিস দেহলভী রহ. ও আশিআতুল লুমআত, কৃত. শেখ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. ইত্যাদি]