দরবারে সিরিকোটের উৎসর্গিত সফল ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব ওয়াজের আলী আলকাদেরী (রহ.)

0

দরবারে সিরিকোটের উৎসর্গিত সফল ব্যক্তিত্ব 
আলহাজ্ব ওয়াজের আলী আলকাদেরী (রহ.)-

মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার>

দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফ, এক অফুন্ত ভান্ডার। ‘সের’ মানে মাথা আর ‘কোহ’্ মানে পাহাড়। পাহাড়ের মাথা বা অগ্রভাগ বুঝাতে ‘সেরকোহ’ শব্দটি শতশত বছর ধরে মানুয়ের মুখে স্বাভাবিক পরিবর্তনের ধারায় আজ সিরিকোট হিসেবে উচ্ছারিত হচ্ছে। সুলতান মাহমুদ গজনভীর (৯৯৭-১০৩০) সময়ে আফগানিস্তানের কোহে সোলায়মানীকে কেন্দ্র করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, এমনকি মুলতান পর্যন্ত ব্যাপক ভাবে ইসলাম প্রচার করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ১২তম বংশধারার হোসাইনী বীর মুজাহিদ সৈয়্যদ মুহাম্মদ হোসাইনী গীসুদারাজ (রাঃ)-তাঁরই বংশধর সৈয়্যদ গফুর শাহ্ ওরফে কাপুর শাহ্ (রাঃ)‘র হাতে শিখ-হিন্দু শাসিত পার্বত্য অঞ্চল উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশস্থ ‘কোহে গঙ্গর’ অর্থাৎ গঙ্গর পাহাড় ইসলামের অধীনে বিজিত হয়। তাই গফুর শাহ্ কে বলা হয় ফাতেহ্ সিরিকোট বা সিরিকোট বিজয়ী। এ আহ্লেবাইত বা বংশেরই উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হলেন শাহেনশাহে সিরিকোট আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি পেশোয়ারী (রহ) এবং তাঁর সাজ্জাদানশীন সাহেবজাদা, গাউসে জামান আল্লামা হাফেজ সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাঃ)।
আল্লাহ পাক তাঁর অফুরন্ত ধন-ভান্ডারের যে মালিকানা তাঁর প্রিয় হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করেছেন তারই উত্তরাধিকারি হবেন তাঁর বংশধারার যোগ্য প্রতিনিধিরা এটাই স্বাভাবিক। তাছাড়া এটাতো সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার নেয়ামত বণ্টনকেন্দ্রও বটে। বর্তমানে কাদেরিয়া ত্বরিকা ও গাউসিয়াতের পতাকা এই পাহাড় শীর্ষেই পত পত করে উড়ছে।
‘আনাল জীলী মুহীউদ্দিন ইসমি
ওয়া আ‘লামী আলা রাসিল জেবালী।’
খলিফায়ে শাহে জীলান, গাউসে দাওরান, খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাঃ) তাঁর এই প্রিয় মুরীদ ও প্রধান খলিফা সিরিকোটি হুজুরকে জামানার গাউস নির্বাচনের বিষয়ে কাদেরিয়া ত্বরিকা এবং আহলে বাইত‘র অগ্রাধিকারের যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন এর তাৎপর্য আজ দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফ‘র রওনক ও অবদান দেখে দিনদিন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। ইমামে আহলে সুন্নাত, আল্লামা গাজী শেরে বাংলা (রহ) তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন-
“দরজমানশ্ নবীনম মিসলে ও পীরে মগাঁ”
অর্থাৎ, সেই জামানায় এতো উচুদরের পীর আর কাউকে পাওয়া যায়নি (দেওয়ান-ই-আজিজ)।
এমন বিরল পীরে মগাঁ‘র হাতে যারা বায়াত গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের উৎসর্গ করতে পেরেছেন তারা যে কতই না ভাগ্যবান তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আবার এদের মধ্যে রয়েছেন এমন কিছু সচেতন ভাগ্যবান ব্যক্তিত্ব যারা সুযোগের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে অফুরন্ত এ ধন-ভান্ডারের সাথে অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ স্থাপন করে, দুনিয়া আখেরাতের সুসংবাদ নিশ্চিত করে নিয়েছেন। বক্ষ্যমান নিবন্ধের আলোচিত ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব ওয়াজের আলী আলকাদেরী সে সব সৌভাগ্যবানদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল এক তারকা। আল্হাজ্ব নূর মুহাম্মদ সওদাগর আল কাদেরী, আলহাজ্ব আমিনুর রহমান সওদাগর আল কাদেরী, আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মাষ্টার আবদুল জলিল, ডাঃ মুজাফ্ফরুল ইসলাম, ডাঃ টি. হোসেন, মাওলানা ফয়েজ আহমদ, মাওলানা এজাহার আহমদ, ডাঃ আবু বকর সিদ্দিকি, মাওলানা আবু বকর, সূফী আবদুল গফুর, সূফী আবদুল লতিফ, ফজলুর রহমান সরকার (রাহমাতুল্লাহি আলাইহিম) দের পাশে আজ ওয়াজের আলী আল কাদেরী নামটি ও শোভা পাচ্ছে সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়া এবং এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষা কেন্দ্র চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসার সফল খাদেমদের নামের পাশে। তিনি এ ইহজীবনে একজন সফল সৎ ব্যবসায়ী এবং সমাজ ও মুসলমানদের নিরলস সেবক হিসেবে ৬৫ বছরের হায়াতে তাইয়্যেবা পাড়ি দিয়ে অবশেষে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্ (রহ)‘র খেলাফত‘র সনদ নিয়ে কবর জীবনে প্রবেশ করেন বিধায় তাঁর আখেরাতের তথা হাশর-নশরের জীবনটি ও যে সুন্দরে কেটে চিরসুখের জান্নাতে কাটবে তা ইনশাল্লাহ্ আশা করা যায়। কারণ,
যে যাকে ভালবাসে তার সাথেই তার হাশর হবে- (আল হাদিস)।
তাছাড়া, তিনি তো তাদের মধ্যেই গণ্য হবেন যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-
“লাহুমূল বুশরা ফিল হায়াতিদ্ দুনিয়া, ওয়া ফিল আখিরা”
– তাদের জন্য সুসংবাদ দুনিয়ার জীবনে এবং আখিরাতে ও -( আল ক্বোরআন)।
রাব্বানা আতিনা ফিদ দুনিয়া হাসানাতাও, ওয়াফিল আখেরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান নার”
– যাঁর জীবনে এই দোয়া কবুল হয়েছে তিনি তো সফল মানুষ নিঃসন্দেহে।
এই সফল মানুষটির সাড়ে ছয় দশকের সুন্দর ইহজীবনের সংক্ষিপ্ত খন্ডচিত্র নিম্মরূপঃ
১. জন্ম তাঁর ২০ ডিসেম্বর ১৯১৫, মরহুম আশরাফ আলী মিয়া ও মরহুম আবু জান বিবির ঘরে, নোয়াখালীর বেগম গঞ্জের তালুয়া চানপুর গ্রামে।
২. ১৯৩০ এ, মাত্র পনের বছর বয়সে কাজের সন্ধানে চট্টগ্রাম আসেন এবং প্রথমে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চাকুরি এবং পরে নিজেই ব্যবসা শুরু করে সফলতা অর্জন করেন। চট্টগ্রামের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে স্থান করে নেন এবং চট্টগ্রামেই স্বপরিবারে স্থায়ী হয়ে যান।
৩. ১৯৫০ হলো সেই শুভক্ষন- যে বছর তিনি হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ)‘র হাতে বায়াত গ্রহণ করে ধন্য হন এবং অফুরন্ত ধনভান্ডারের সাথে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এ সম্পর্ক দিনদিন আরো গভীর ও ঘনীভূত হতে থাকেন।
৪. তীব্র আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও পীরে কামেলের তাওয়াজ্জুহ্ তাকে আল্লাহ্ ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমে এমন মাতোয়ারা করে দেয় যে, এক পর্যায়ে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে, সংসারের ঝামেলা মুক্ত হয়ে, সমগ্র জীবন ঐশী প্রেমে নিমজ্জিত থাকতে মনে মনে দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ হন। এমন এক চিন্তায় বিভোর ওয়াজের আলী সওদাগর যখন আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের আন্দরকিল্লা কোহিনুর ভবনে জোহর কি আছরের নামাজের উদ্দেশ্যে গিয়ে পৌছলেন দেখলেন হযরত সিরিকোটি (রহ) দু‘তলায় সিঁড়ির উপরেই দাঁড়ানো আছেন। দেখা মাত্রই ওয়াজের আলী সওদাগর কে অত্যন্ত কঠিনভাবে বললেন- “ ওয়াজের আলী তুম একিলা জান্নাত মে জায়েগা
তো মাখলুককা কেয়া ফায়দা হোগা ?”
আশ্চর্য হয়ে গেলেন তিনি, কারণ এই সংকল্প তো তাঁর মনেই ছিল- বাইরের কেউ জানবার কথা নয়। অথচ, জামানার গাউস, সৈয়্যদুল আউলিয়ার কাছে তা অজানা ছিল না। তিনি নিজের মুরীদকে সন্ন্যাস জীবনের কঠিন পথ থেকে তওবা করে সুন্নতি জিন্দেগী সংসারধর্মে ফিরে এসে ব্যবসা- বাণিজ্য করে সেই ধন সম্পদ আর কায়িক শ্রম ও মেধা দিয়ে দ্বীনি খিদমতের মাধ্যমে মঞ্জিলে মাকসুদে পৌঁছবার তাগিদ দিলেন। আর সেই ইঙ্গিতের তাৎপর্য ওয়াজের আলী হারে হারে বুঝলেন। সচেতন ওয়াজের আলী ফিরে এলেন ‘কাম করো দ্বীন কো বাঁচাও- সাচ্ছা আলেম তৈয়ার করো’ অভিযানে। ধন-মন দিয়ে একাগ্রচিত্তে নিরলসভাবে লেগে পড়েন সিলসিলাহ্ ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়ার খিদমতে। এই সময়েই তো জামেয়া প্রতিষ্ঠার যাবতীয় প্রস্তুতি চলছিল এবং এরপর চলে একে একে শাহেনশাহে সিরিকোটী‘র ইচ্ছানুসারে সাচ্চা আলেম তৈরীর আদর্শিক জিহাদ। এই জিহাদে তিনি ছিলেন এক অকুতোভয় সেনানী।
৫. তিনি জীবনে মোট ৮ বার হজ্জ করেন এবং হাজীদের সেবা ও তাঁর নসীব হয় বহুবার। আঞ্জুমানে খাদেমুল হজ্জ কমিটির পক্ষে হাজী সাহেবানদের সেবায় ও নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্রথম হজ্জ পালন করেন ১৯৫২ সালে। আর প্রধান হজ্জ বা আসল হজ্জ হলো ১৯৫৮ তে হযরত সিরিকোটি (রহ) ও তার বড় নাতি রাহনুমায়ে শরিয়ত ও ত্বরিকত, আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুল আলী এর সাথে। সিরিকোটি (রহ) ১৯৪৫ সনে হজ্জের সময়ে রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াআল্লাম কর্তৃক নির্দেশিত হয়েছিলেন। পরবর্তি হজ্জে যেন- বড় নাতি তাহের শাহ্ কে সাথে আনা হয়। এ জন্য তার ঘুম যেন হারাম হয়ে যায় নির্দেশ পালনের জন্য। কিন্তু হযরত তাহের শাহ‘র বয়স তখন মাত্র চার। এরপর চেষ্টা তদবির কম চলেনি। কিন্তু সম্ভব হয়ে ওঠছিলনা এ দুঃসাধ্য সাধন। অবশেষে, ১৯৫৮ তেই সেই দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ ছিল সিরিকোটি (রহ) হুজুরের বাংলাদেশে শেষ সফর। শাহজাদা তৈয়্যব শাহ্ কে খেলাফত দেন এ বছরেই এই চট্টগ্রামে। এই গুরুদায়িত্ব পালন করে তারপর তাহের শাহ্ হুজুরকে সাথে করে চট্টগ্রাম থেকে হজ্বে নিয়ে মদীনা ওয়ালার পাক দরাবারে সোপর্দ করেন। বিশাল বহর নিয়ে পানির জাহাজে চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে হজ্বে যান তিনি। হযরত তাহের শাহ্কে বায়াত করিয়ে নেন আরাফাতের ময়দানে। হুজুরের হাতে এ সময় বায়াত গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের আরো এক খ্যাতনামা পীর সাহেব সহ অনেকেই। রত্তজা মুবারকে জেয়ারতের সময় এতোগুলো মুরীদ ভক্ত ও জেয়ারতকারীদের সাক্ষাতেই সিরিকোটি হুজুর ডাঃ টি. হোসেন কে মদীনা ওয়ালা সরকারে দো- আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রকৃত জেয়ারত- শারীরিক সাক্ষাত দান করেন এবং বলেন, “ডাঃ টি. হোসেন আপ খোশনসীব হ্যায়। ইসওয়াক্ত আপকি সাথ সরকারে দো আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি দিদার চল রাহা- অওর আপ কি উপর সিলসিলাকি গেয়ারা সবককি হুকুম হো গিয়া”। আর দেরী না করেই আলহাজ্ব ওয়াজের আলী সওদাগর কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন দিদারে মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য। একের পর এক আবেদন-নিবেদনে ব্যতিব্যস্ত করে তুললেন হুজুর কেবলাকে। হুজুর কেবলা বলেন- সবর করো ওয়াজের আলী- কোশিশ করো ইনশাল্লাহ্ মিল যায়ে গা। কিন্তু ওয়াজের আলী কোন প্রকারেই যেন সবর করতে পারছিলেন না-পাগল হয়ে ওঠলেন দিদারের জন্য। “চায়’তে জানলে রয়না কাঙাল অফুরন্ত ভান্ডারে”- শেষ পর্যন্ত তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তির সংযোগটি ঘটেছিল হুজুর পাকের দিদারের মাধ্যমে যা তরিক্বতে আসার প্রধান উদ্দেশ্য নিজেকে মুর্শিদের মাধ্যমে নবী পাক পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার মতো বিরল সৌভাগ্য অর্জন বটে। দিদারের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠা ওয়াজের আলী হঠাৎ করেই যেন শান্ত চুপচাপ হয়ে গেলেন দিদার নসীব হবার সাথে সাথে। আর হাজার গুণ, উৎসাহ ও শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ‘কাম করো দ্বীন কো বাচাও’ আন্দোলনে।
৬. সিরিকোটি হুজুরের ওফাত বরণ ১৯৬১ সালের ২৭ এপ্রিল, ১৩৮০ হিজরীর ১১জিলক্বদ, বিষ্যুদবার এরপর ওয়াজের আলী আল কাদেরী কোন এক সময়ে হাজির হন দরবারে আলীয়া কাদেরীয়া সিরিকোট শরীফে। হঠাৎ করেই বায়না ধরলেন আম্মা হুজুরের সাক্ষাতের জন্য যা এই দরবারে অসম্ভব একটি আবদার বটে। কারণ, এখানে মহিলাদের সাথে সাক্ষাৎ জীবনেও ঘটেনি এমনকি অন্দর মহলের কোন চিহ্ন বা সাড়া শব্দটিও অন্যদের জন্য অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু, ওয়াজের আলী তো নাছোড়বান্দা। অমনিই কান্না জুড়ে দিলেন না বোধক উত্তর পেতে না পেতেই। শাহজাদা হাফেজ আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ উপায়ান্তর না দেখে আম্মা হুজুরের কাছে গিয়ে বললেন এবং অবস্থার প্রেক্ষিতে সম্মত হলেন মায়ী সাহেবা। ওয়াজের আলী অনুমতি পেলেন সালাম করবার। আপাদমস্তক আবৃত আম্মা হুজুর যেই সালাম নেবার জন্য বসলেন অমনিই হুমড়ি খেয়ে কদমের উপর পড়লেন ওয়াজের আলী আর বুক ফাটা আর্তনাদ মাখা কান্নায় পরিবেশ ভারী করে তুললেন। মায়ী সাহেবা ও কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লেন এবং এই কান্নার হেতু কি জানতে চাইলেন। উত্তরে ওয়াজের আলী সাহেব বললেন-‘ মায়ী সাহেবা যেন তাকে তৈয়্যব শাহ্ হুজুরের মতো নিজের ছেলে হিসেবে কবুল করেন’। শুনে চমকে উঠলেন আম্মা হুজুর। এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু ওয়াজের আলীও ছাড়বার পাত্র নয়। তাই, শেষ পর্যন্ত এই অসম্ভবটিও সম্ভব হয়ে গেল। ছেলে হিসেবে কবুল করে নেওয়ার স্বীকৃতি পাবার পরেই কদম ছাড়লেন ওয়াজের অলী নামক এই হুশিয়ার পাগলটি।
একদিন ওয়াজের আলী সওদাগর পেশোয়ারের কোন এক বাড়িতে গুরুতর অস্স্থু হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিল। অথচ, চট্টগ্রামের পরিবার বন্ধু-বান্ধব বা অন্য কেউ কোথাও এ খবর জানেনা। তাই, বড় অসহায় ভাবেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময়ে সন্তানের এই অসহায়ত্ব কোন মা‘ই তো মেনে নেবেনা। সুতরাং তাঁর এই ধর্মের মা কেন মানবেন? হঠাৎ এমন সময়েই মায়ী সাহেবা তাঁর শাহজাদা তৈয়্যব শাহ্ কে বলেন-‘ তুমি এখনি পেশোয়ারে যাও এবং আমার ছেলে ওয়াজের আলীকে খুঁজে বের করো, সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে নিরাশ্রয়- অসহায়ভাবে পড়ে আছে। তাকে এখানে নিয়ে এসো’। তৈয়্যব শাহ্ হুজুর বলেন- আম্মা, পেশায়ার তো অনেক বড় শহর, ঠিক কোথায় আছে না জানলে তাকে কীভাবে তালাশ করবো? উত্তরে আম্মা বলেছিলেন – কোশিশ করো- ইনশাল্লাহ্, মিল যায়েগি’। কী আশ্চর্য! তিনি কথা মতো, পেশোয়ারে গিয়ে অতি সহজেই সেই অজানা ঠিকানায় গিয়ে পৌঁছলেন এবং ওয়াজের আলী সাহেব কে দরবারে নিয়ে এসে মাতৃস্নেহে সেবা গ্রহণের ব্যবস্থা করলেন। আহা! এ কেমন বিরল মা তিনি। যিনি একজন ‘সাহেবে কাশ্ফ’ বা অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন আধ্যাত্মিক শক্তিধর মহীয়শী নারী এবং হোসাইনী ধারার আহলে বাইত ছিলেন। সিরিকোটি (রহ.) কে তিনিই গাউসে দাঁওরান খাজা চৌহরভী (রহ)‘র সন্ধান দিয়েছিলেন এবং অনেকটা জোর করেই তাঁর দরবারে ঠেলে দিয়েছিলেন অফুরন্ত ভান্ডারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে। যাই হোক, ওয়াজের আলী উপযুক্ত পীর মুর্শিদ, উপযুক্ত মা লাভ করার পর তাঁদের করুনা কামনায় সর্বশক্তি নিয়োগ করে বিরল নিয়ামত অর্জন করতে পেরেছিলেন। শেষ পর্যন্ত, নিজেকে গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ্র খিদমতে এমনভাবে উৎসর্গ করে দিলেন যে যার স্বীকৃতি স্বরূপ সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার খেলাফত ও নসীব হয়ে যায় মৃত্যুর আগে। লাভ করলেন ‘কাদেরী সনদ’। যা তাঁর কবরে-হাশরে পারাপারের টিকেট হিসেবে কাজে আসবে। স্বয়ং আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী (রহ) ফরিয়াদ করতেন-
‘কাদেরী কর-কাদেরী রাখ, কাদেরী ও মে ওঠা কদরে আবদুল কাদেরে কুদরত নূমা কে ওয়াস্তে’্
৭. মৃত্যুপথের যাত্রী ওয়াজের আলী আল কাদেরী। কিন্তু এখনো তাঁর চাওয়া-পাওয়ার হুশিয়ারি বরাবর বহাল রয়েছে। তাঁর শেষ ইচ্ছে হলো মৃত্যুর পর জানাজাটা পড়াতে হবে হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ কেই। অথবা জানাজাটা হবে দরবারে সিরিকোটে। ভাগ্যটা যেন তাঁর পক্ষেই ছিল এবারও। ১৯৮০ সনের জানুয়ারিতে শেষ সপ্তাহে ছিল জশনে জুলুছ। তাই হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ্ (রহ) ও ছিলেন চট্টগ্রামে। ওয়াজের আলী সাহেব অসুস্থ জেনে তাঁকে দেখতে যান ১৫ মার্চ তাঁর বাসভবনে। হুজুর কেবলাকে দেখেই আবেগ আপ্লুত হাজী সাহেব শেষ সুযোগটুকুর সদ্ব্যবহার করতে ছাড়লেন না। অমনিই হুজুর কেবলার হাত ধরে কাঁদতে লাগলেন এবং বললেন,‘ হুজুর আপনি হয়তো আমাকে আপনার সাথে দরবারে (সিরিকোটে) নিয়ে যান, নতুবা আমার জানাজা পড়িয়ে যান’। ওয়াজের আলী সাহেবের অবস্থা হুজুর কেবলার অজানা নয়। হাত তুললেন মুনাজাত করলেন হুজুর কেবলা। তারপর চলে এলেন চট্টগ্রামের ঠিকানায় বলুয়ার দিঘী পাড়স্থ খানকাহ্ শরীফে। হুজরা শরীফে প্রবেশের পূর্বে খাদেম রশীদুল হককে বললেন- রাত যতক্ষণ হোক ওয়াজের আলী সওদাগরের কোন খবর এলে আমাকে জানাবে। আর শেষ রাতে খবর এলো ওয়াজের আলী সওদাগর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। হুজুর কেবলার ইমামতিতেই তাঁর নামাজের জানাজা সম্পন্ন হলো ;
‘চাইতে জানলে রয়না কাঙাল অফুরন্ত ভান্ডারে’।
দাফনের সময়ও উপস্থিত ছিলেন হুজুর কেবরা (রহ)। কবরে শুইয়ে দেয়ার পর মুখ খুলে দিতে বললেন হুজুর কেবলা এবং তারপর বললেন-
‘হাজি সাব সবকো মেরা সালাম কেহনা’।
এরপর কী ঘটেছিল? আজ আর নয়। আলহাজ্ব ওয়াজের আলী আল কাদেরী (১৯১৫-১৯৮০) ছিলেন একজন ভাগ্যবান মানুষ। একজন সফল মানুষ। আর তার সফলতা এসেছে আত্মবিশ্বাস থেকে। যোগ্য পীর আর সঠিক সিলসিলাহ্ পাবার পর সময় নষ্ট না করে যত বেশি আদায় করা যায়- তাই বুদ্ধিমানের কাজ। তিনি সত্যিকার অর্থেই বুদ্ধিমান ছিলেন বলে সময়কে অপচয় না করে কাজে লাগিয়ে ছিলেন।
‘তামান্না দরদে দিলকি হো- তু কর খিদমত ফকির কি নেহী মিলতে ইয়ে গওহর বাদশাহ্ কি খজিনে মে’।
আর তাঁর পীর মুর্শিদ মামুলি কোন ফকির দরবেশ তো নন, রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধর- যার ফকিরিতে ছিল মাওলা আলী শেরে খোদা (রাঃ)‘র বেলায়াতের সুগন্ধিতে ভরপুর। তাইতো কবি বলেছেন-
‘দারা ও সিকান্দার সে উয়হ্ মর্দে ফকির আওলা হো জিসকি ফকিরি মে বুয়ে আসাদুল্লাহি’ আল্লাহ্ আমাদের সকলকে সফল মানুষদের পদাংক অনুসরণ করে এমন মহান দরবারের খিদমতে উৎসর্গিত হবার তৌফিক দান করুন। আমিন! বেহুরমাতি সৈয়্যদিল মুরসালিনÑসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •