মাহবুব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস সালাম-এর প্রত্যেক কাজই প্রিয়

0

শানে রিসালত : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান

মাহবুব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস সালাম-এর প্রত্যেক কাজই প্রিয়
ক্বোরআন-ই করীমে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-يَااَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ قُمِ اللَّيْلَ اِلَّاقَلِىْلًا
তরজমা: হে বস্ত্রাবৃত! রাত্রিজাগরণ করুন, রাতের কিছু অংশ ব্যতীত। [সূরা মুয্যাম্মিল: আয়াত-১-২, কান্যুল ঈমান] এ আয়াতে শরীফ হুযূর-ই আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর না’ত শরীফ। এ’তে মাহ্বূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম এবং তাঁর মাধ্যমে সমস্ত উম্মতকে তাহাজ্জুদের নামায ও ক্বোরআন-ই করীমের তারতীল সহকারে তিলাওয়াত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ সম্বোধন অতিমাত্রায় মজার। এতে বলা হয়েছে- ‘‘হে বস্ত্রাবৃত মাহবুব (আলায়কাস্ সালাম)! এ’তে বুঝা যায় যে, মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর প্রতিটি কাজ অতি প্রিয়।
এ আয়াত শরীফের ‘শানে নুযূল’ প্রসঙ্গে তাফসীরকারদের কতিপয় অভিমত রয়েছে
এক. ওহী নাযলি হবার প্রাথমিক যুগে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম আল্লাহ্ তা‘আলার কালাম (বাণী শরীফ)-এর ভক্তিপ্রযুক্ত ভয়ে নিজের কাপড় শরীফে আবৃত হয়ে যেতেন। এমতাবস্থায় তাঁকে এ আহ্বান করা হয়েছিলো।
দুই. হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম একদিন কাপড় শরীফে আবৃত হয়ে আরাম করছিলেন। এমতাবস্থায় এ সম্বোধন করা হয়েছে।
তিন. কেউ কেউ একথাও বলেছেন যে, এ আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে- ‘হে নুবূয়তের চাদরে আবৃত মাহবূব!’
তাফসীরে ‘রূহুল বয়ানে’ এ আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া হয়েছে যে, রাতে মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম চাদর শরীফ গায়ে দিয়ে আরাম করছিলেন। তখন আল্লাহ্ তা‘আলার আগ্রহ হলো- এ সময়ে আমার মাহবূব আমার দরবারে মুনাজাত করুন! (একান্তে কথা বলুন) এবং গোপন রহস্যের কথাবার্তা বলুন। সুতরাং এভাবে সম্বোধন করে তাঁকে জাগ্রত করলেন! আর বললেন- হে বিশ্রামরত মাহবূব! এ মুহূর্তে আমার সাথে কথা বলুন! মোটকথা, এ বাণী শরীফের ব্যাখ্যা যেভাবেই দেওয়া হোক না কেন, প্রতিটি ব্যাখ্যায় মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর শানই প্রকাশ পায়।

মাসআলা: তাহাজ্জুদের নামায ইসলামের প্রাথমিক যুগে ওয়াজিব ছিলো। কারো কারো মতে ফরয ছিলো। পরবর্তীতে সেটার ওয়াজিব কিংবা ফরয হওয়া মান্সূখ (রহিত) হয়ে গেছে। আর ওই আয়াত দ্বারা এটা মান্সূখ হয়েছে, যা এ সূরায়, সামনে (পরবর্তীতে) উল্লেখ করা হয়েছে। তা হচ্ছে- فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنْهُ (তোমরা তিলাওয়াত করো যা তা থেকে সহজ হয়)।
[তাফসীর-ই খাযাইনুল ইরফান ও তাফসীরাত-ই আহমদী] এখন তাহাজ্জুদের নামায ‘সুন্নাতে মুআক্কাদাহ্ ‘আলাল কিফায়াহ’। সুতরাং একটি বস্তিতে (লোকালয়) একজনও যদি পড়ে নেয়, তবে সবাই দায়মুক্ত হয়ে যাবে। আর যদি কেউ না পড়ে, তবে সবাই সুন্নাত বর্জনকারী হলো।
মাসআলা: তাহাজ্জুদের নামাযের ওয়াক্বত তখনই আরম্ভ হয় যখন মুসলমান এশার নামায পড়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে তারপর জাগ্রত হয়। তার জন্য সেটাই তাহাজ্জুদের সময়। সুতরাং যদি কেউ শীতের মৌসুমে রাত আট টার সময় এশার নামায পড়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আর নয়টার সময় জাগ্রত হলো। তাহলে এটাই তার জন্য তাহাজ্জুদের সময়। আর যদি কেউ সমগ্র রাত ঘুমায়নি, তবে তার জন্য তাহাজ্জুদের সময় আসেনি। কেননা, তাহাজ্জুদে ঘুমিয়ে জাগ্রত হওয়া জরুরী। আর তাহাজ্জুদের মুস্তাহাব সময় হচ্ছে- রাতের শেষ ষষ্ঠাংশ। তাহাজ্জুদের নামাযের রাক‘আত-সংখ্যা কমপক্ষে দু’রাক্‘আত। আর বেশী থেকে বেশী বার রাক‘আত। যদি প্রত্যেক রাক‘আতে তিনবার করে ‘ক্বুল হুয়াল্লাহু আহাদ’ পড়ে, তবে প্রত্যেক রাক্ব‘আতে এক খতম করে ক্বোরআন পড়ার সাওয়াব দেওয়া হবে।
হুযূর আসালায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম আপন উম্মতের অবস্থাদি সম্পর্কে অবগত।
আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান- اِنَّا اَرْسَلْنَآ اِلَيْكُمُ رَسُوْلًا شَاهِدًا عَلَيْكُمْ كَمَآ اَرْسَلْنَا اِلى فِرْعَوْنَ رَسُوْلًاঙ
তরজমা: নিশ্চয় আমি তোমাদের প্রতি একজন রসূল প্রেরণ করেছি, যিনি তোমাদের উপর হাযির (উপস্থিত-পর্যবেক্ষণকারী), যেভাবে আমি ফির‘আউনের প্রতি রসূল প্রেরণ করেছি। [সূরা মুয্যাম্মিল: আয়াত- ১৫, কান্যুল ঈমান]

এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর প্রশংসা (না’ত)। এ’তে কাফিরগণ ও মুসলমানদেরকে সম্বোধন করা হচ্ছে। এরশাদ হচ্ছে- ‘হে লোকেরা! এ পয়গাম্বর, যিনি তোমাদের মধ্যে তাশরীফ এনেছেন, তিনি তোমাদের ও তোমাদের অবস্থাদি সম্পর্কে বে-খবর নন, বরং তোমাদের এবং তোমাদের ঈমান কিংবা কুফর সম্পর্কে জানেন। এমনকি তিনি ক্বিয়ামত পর্যন্তের সমস্ত মানুষের প্রতিটি অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। এজন্যই তোমাদের সবার পক্ষে কিংবা বিপক্ষে মহান রবের দরবারে সাক্ষ্য দেবেন। অর্থাৎ মু’মিনের ঈমান এবং কাফিরের কুফরকে প্রকাশ করে দেবেন। এ থেকে যেখানে হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর ইল্মে গায়ব (অদৃশ্যের জ্ঞান) প্রমাণিত হলো, সেখানেই তাঁর প্রত্যেক লোকের নিকট হাযির-নাযির হওয়াও প্রমাণিত হয়ে গেলো। কেননা, সাক্ষ্য তো স্বচক্ষে দেখেই দিতে হয়। এ কারণে যখন ক্বিয়ামতে হুযূর মোস্তাফা আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর উম্মত পূর্ববর্তী নবীগণের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে তখন হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম ওই উম্মতের পক্ষে সাক্ষ্য দেবেন। ‘হাযির-নাযির’ বিষয়ের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা ‘জা‘আল হক্বক্বু ওয়া যাহাক্বাল বাত্বিল’ নামক কিতাবে করা হয়েছে।
অনেক সাহাবী ও আলিম এক রাক‘আত নামাযে পবিত্র ক্বোরআন খতম করেছেন
আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ করেছেন-
اِنَّ رَبَّكَ يَعْلَمُ اَنَّكَ تَقُوْمُ اَدْنى مِنْ ثُلُثَىِ اللَّيْلِ وَنِصْفَه وَثُلُثَه وَطَائِفَةٌ مِنَ الَّذِيْنَ مَعَكَ – وَاللهُ يُقَدِّرُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَط عَلِمَ اَنْ لَّنْ تُحْصُوْهُ فَتَابَ عَلَيْكُمْ فَاقْرَءُوْا مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْانِঙ
তরজমা: নিশ্চয় আপনার প্রতিপালক জানেন যে, আপনি রাতে জাগ্রত থাকেন- কখনো রাতে দু’তৃতীয়াংশের কাছাকাছি, কখনো অর্দ্ধরাত্রি, কখনো এক তৃতীয়াংশ; এবং আপনার সাথের একটি দলও। আর আল্লাহ্ রাত ও দিনের পরিমাণ নির্ণয় করেন। তিনি জানেন হে মুসলমানগণ! তোমাদের দ্বারা রাতের সঠিক হিসাব রাখা সম্ভবপর হবে না। সুতরাং তিনি আপন করুণা সহকারে তোমাদের প্রতি কৃপাদৃষ্টি ফিরিয়েছেন। এখন ক্বোরআনের মধ্য থেকে যতটুকু তোমাদের নিকট সহজ হয়, ততটুকু পাঠ করো।
[সূরা মুয্যাম্মিল: আয়াত-২০, কান্যুল ঈমান] এ আয়াত শরীফও হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর শানের প্রকাশ্য বর্ণনা দিচ্ছে। এর শানে নুযূল এ’যে, যখন মুসলমানদের উপর তাহাজ্জুদের নামায ফরয ছিলো, তখনকার সময় হুযূর সাইয়্যেদে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা-ই কেরাম খুব বেশী পরিমাণে দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন, এ পর্যন্ত যে, ওই সব হযরতের পায়ে পানি এসে যেতো (ফুলে যেতো), এমনকি ফেটে রক্ত প্রবাহিত হতো, এ আশংকায় যেন যতটুকু পড়া ওয়াজিব (অপরিহার্য) ততটুকু থেকে কম পড়া না হয়, বরং বেশী হলে তো ক্ষতি নেই। যেহেতু ওই যুগে ঘড়ি ছিলো না, সেহেতু মুসলমানগণ রাতের সঠিক অনুমান করতে পারতেন না। সুতরাং কখনো কখনো ভোর হয়ে যেতো। এক বছর যাবৎ ফরয হবার এ বিধান বলবৎ ছিলো। দীর্ঘ এক বছর পর এ আয়াত শরীফ নাযিল হয়েছে আর সেটা তাহাজ্জুদ ফরয হবার বিধান রহিত করে দিয়েছে। এ তাহাজ্জুদ ফরয হওয়ার বিধান রহিত হবার কারণ কি ছিলো? হুযূর আলায়হিস্ সালাম ও সাহাবা-ই কেরামের কষ্ট ও পরিশ্রমই।

এ থেকে বুঝা গেলো যে, মাহবূব আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালামকে সন্তুষ্ট করা এ পরিমাণ বিবেচ্য যে, তাঁর জন্য বিধানাবলীতে বিশেষ বিবেচনা করা হয়েছে। তাহাজ্জুদের মূল নামায হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর উপর সর্বদা ফরয রয়ে গেছে। কিন্তু রাতে জাগ্রত থাকার পূর্বশর্ত বলবৎ থাকেনি। অর্দ্ধরাত কিংবা রাতের এক তৃতীয়াংশ জাগ্রত থাকলেই যথেষ্ট ছিলো; বরং যতটুকু তাঁর মন চায়, ততটুকুই জাগ্রত থাকলেই যথেষ্ট ছিলো। অবশ্য উম্মতের জন্য তা আর ওয়াজিব থাকেনি।
মাসআলা: ‘শবীনাহ্’ পড়া অর্থাৎ- তাহাজ্জুদ অথবা তারাবীহতে এক রাতে সমগ্র ক্বোরআন খতম করা জায়েয, যদি পাঠকের জন্য কষ্টকর না হয়।
‘তাফসীর-ই রূহুল বয়ানে’ এ আয়াত- وَرَتِّلِ الْقُرْانَ تَرْتِيْلًا -এর ব্যাখ্যায় বর্ণিত হয় যে, তিন জন সাহাবী ও একজন তাবে‘ঈ এক রাক‘আতে গোটা ক্বোরআন খতম করেছেন-১. হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান, ২. হযরত তামীম-ই দারী, ৩. হযরত সা‘ঈদ ইবনে জুবায়র, এবং ৪. ইমাম আ‘যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম আজমা‘ঈন।

আর হযরত হামযাহ্ ইবনে মিনহাল এক মাসে নয় খতম করতেন। হযরত আবুল হাসান আলী ইবনে আবদুল্লাহ্ একদিনে চার খতম করেছেন। তাহাভী শরীফ: প্রথম খন্ড: বাবু জম‘ইস সুভারি ফী রাক‘আতিন-এ বর্ণিত হয়- হযরত তামীম-ই দারী, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে যুবায়র এবং হযরত সা‘ইদ ইবনে জুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা এক রাক‘আতে পূর্ণ ক্বোরআন খতম করেছেন। খুব সম্ভব রাদ্দুুল মুহতার (শামী)-এর মুক্বাদ্দামাহ্ (ভূমিকা)য় আছে- ইমাম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রমযান মাসে ৬১ খতম ক্বোরআন তিলাওয়াত করতেন। ইমাম নাওয়াভী তাঁর কিতাব ‘আল আয্কার: কিতাবু তিলাওয়াতিল ক্বোরআন’-এ লিখেছেন- অগণিত হযরত এক রাক‘আত নামাযে পূর্ণ ক্বোরআন খতম করেছেন। তাঁদের মধ্যে হযরত ওসমান ইবনে ‘আফ্ফান, হযরত তামীম-ই দারী এবং হযরত সা‘ঈদ ইবনে জুবায়রও রয়েছেন।

এ সবক’টি দলীল প্রমাণ থেকে ‘শবীনাহ্’র বৈধতা সাব্যস্ত হলো। তবে শবীনার মধ্যে দু’টি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে-১. তিলাওয়াতকারী বিশুদ্ধভাবে তিলাওয়াত করবেন, পরিষ্কারভাবে পড়বেন, হরফ বা বর্ণগুলো বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করবেন, শুধু ‘ইয়া’লামূন, তা’লামূন’ পাঠক হবে না এবং ২. শ্রোতাগণও আগ্রহ সহকারে শুনবেন। এমন যেন না হয় যে, লোকেরা বসে বসে ঘুমাবে (তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকবে), আর রুকূ’র সময় হলে তাড়াতাড়ি তাকবীর বলে নামাযে শরীক হয়ে যাবে। এ দু’টি কাজ নিষিদ্ধ।
উল্লেখ্য, যেসব হাদীসে ক্বোরআন তাড়াতাড়ি খতম করার নিষেধ এসেছে, তা দ্বারা এটাই বুঝানো উদ্দেশ্য। যেসব হযরত এক রাক‘আতে পূর্ণ ক্বোরআন খতম করেছেন, তা এতটুকু দ্রুত পড়া সত্ত্বেও তাঁদের তিলাওয়াতে শব্দগুলো স্পষ্টভাবে বুঝা যেতো। [সূত্র: শানে হাবীবুর রহমান ইত্যাদি]

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •