ইসলামের মূলধারা রক্ষায় হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি ’র অসামান্য অবদান –
আল্লামা কাযী মুহাম্মদ মুঈন উদ্দীন আশরাফী
সুন্নীয়াত রক্ষায় জামেয়া-আনজুমান এর সকল কর্মযজ্ঞের কেন্দ্রবিন্দু কুতবুল আউলিয়া, হযরত হাফেজ সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি। তিনি পাকিস্তানের সিমান্ত প্রদেশের অধিবাসী। এটা তাঁর ভৌগলিক অবস্থানগত পরিচয়। কিন্তু তাঁর ইসলামের বিশাল খেদমত আঞ্জামের ক্ষেত্র অনেক বড়। যার বিস্তৃতি এশিয়া মহাদেশ পার হয়ে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত। পবিত্র হাদিসে বর্ণিত, ‘‘আল্লাহ্ তা’আলা যাকে যে কাজের জন্য সৃষ্টি করেন, তা তার জন্য সহজ করে দেন।’’ যোগাযোগ ব্যবস্থার কঠিন সময়ে এতো দীর্ঘ সফর এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামের অসাধারণ খেদমত আঞ্জাম দেয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত যে, মহান আল্লাহ্ তাঁকে ইসলামের বিশাল খেদমত আঞ্জাম দেয়ার লক্ষ্যে সৃষ্টি করেছেন। ফলে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ তাঁর জন্য সহজ এবং সম্ভব হয়েছে। এভাবেই আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর একমাত্র মনোনীত দ্বীন ইসলামকে এ যাবৎ রক্ষা করেছেন। আফ্রিকার ‘কেপটাউন’ এবং এশিয়ার ইয়াঙ্গুন (রেঙ্গুন), পাকিস্তান ও বাংলাদেশ তাঁর যাবতীয় খেদমত এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
বাংলাদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসার পীর-আউলিয়া, সুফী-সাধকদেরই অবদান এটা অলী বিদ্বেষীরাও অস্বীকার করে না। কারণ বিষয়টি দিন-দুপরে সূর্যের মত স্পষ্ট। এটাকে কেবলমাত্র মানুষরূপী পেঁচারাই অস্বীকার করবে। বাংলাদেশে বাতিল পন্থীগণ বিষয়টিকে সাধারণ মুসলমানদের থেকে আড়াল করার কুমতলবে প্রকাশ্যে না বললেও লিখতে গেলে অস্বীকার করতে পারে না। প্রকৃত সত্যকে এড়িয়ে চলা অত সহজ নয়। এদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পীর-বুযর্গদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার-প্রসার লাভ করলেও সর্বত্র তাঁদের অনুগত মুসলমানদের অস্তিত্ব নেই বর্তমানে। বরং অলী বিরোধীদের সংখ্যাও কম নয়। বর্তমানের এ অবস্থার জন্য সহজভাবে অলীভক্তদের দায়ী করা যায়। কারণ, তাঁরা পীর-আউলিয়া কেরামের আদর্শ রক্ষায় সময় উপযোগী কর্মসূচি নেয়নি। অলী ভক্ত বা তাঁদের উত্তরসুরীদের এ উদাসীন্যের সুযোগ নিয়েছে বাতিল পন্থীরা। তারা স্বয়ং পীর-আউলিয়াদের আস্তানাগুলোতে পর্যন্ত দৃঢ় অবস্থান গেড়ে বসেছে অনেক জায়গায়। বিষয়টি প্রায় সবারই জানার কথা।
কোন দর্শনকে টিকিয়ে রাখতে হলে তাকে শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যেমনটি বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মহান স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানানোর লক্ষ্যে ‘‘মহান মুক্তি যুদ্ধের’’ ইতিহাসকে শিক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ঠিক তেমনিভাবে দেশের শিক্ষাক্রমে এ দেশে ইসলাম প্রচারের পরিপূর্ণ ইতিহাসকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সুতরাং কোন আদর্শ বা দর্শনকে টিকিয়ে রাখার সফল মাধ্যম হলো শিক্ষা ব্যবস্থা ও উর্বর ক্ষেত্র হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ কারণেই হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি প্রাধান্য দিয়েছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে। আর প্রতিষ্ঠা করেছেন- বাংলাদেশে সুন্নী মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে সর্ববৃহৎ মাদ্রাসা চট্টগ্রাম জামেয়া আহমদীয়া সুন্নীয়া আলিয়া। এদেশের সুন্নী মুসলমানদের এটি শেষ ভরসা। এক বিশ্বখ্যাত সুফী দরবেশের পবিত্র হাতে ভিত্তি রাখা এ দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে এক পরিচিত নাম। এটিকে পুঁজি করে রাজধানী ঢাকার বুকে মুহাম্মদপুর কাদেরীয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। একইভাবে চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলায়ও আরো অনেক মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে এবং ভবিষ্যতেও গড়ে উঠবে ইনশাআল্লাহ্ তা’আলা। এ বাস্তব সত্যটিকে প্রত্যেক সুন্নী মুসলমানকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। গায়ের জোরে যা ইচ্ছা বলা যায়, কিন্তু বাস্তবে প্রমাণ করা বেশ কঠিন।
হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি এর পরে তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীকত মুর্শিদে বরহক হযরতুলহাজ্ব আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ কেবলা রাহমাতুল্লাহি তা’আলা আলায়হি খোদাপ্রদত্ত বহুমুখী প্রতিভা দিয়ে তিনি এ ধারাকে আরো অনেক বেশী সমৃদ্ধ করে গেছেন। অতঃপর বর্তমানে তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসুরী হযরতুলহাজ্ব সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ (মু.জি.আ.) শরীয়ত-তরীকতের মহান দায়িত্ব পালনে রত আছেন।
ইসলামের মূলধারা সুন্নী মতাদর্শকে মুসলমানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার শক্তিশালী মাধ্যম হলো সুন্নী মাদ্রাসা। আর সুন্নী মাদ্রাসা বলতে কিছু অবকাঠামো বা পরিচালনা সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যক্তিবর্গের নাম নয়। বরং যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা প্রদর্শিত, সাহাবা কেরাম, তাবেয়ীন, তা’বে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহেদীন, আউলিয়া কামেলীন অনুসৃত ও ইসলামের একমাত্র রূপ রেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বীদা-আদর্শের আলোকে- ক্বোরআন-সুন্নাহর নির্ভুল শিক্ষা দেয়া হবে সেটিই সুন্নী মাদ্রাসা। অতএব, যুগোপযোগী যথার্থ পাঠ্যক্রম, সুন্নী আক্বীদায় বিশ্বাসী পরিচালনা কমিটি, সর্বোপরি দক্ষ-অভিজ্ঞ সুন্নী শিক্ষকমন্ডলী। ইতিপূর্বে এ পথেই মোটামুটি সুন্নীয়াতের আহ্বানকে ধরে রাখা হয়েছে এদেশে। কিন্তু, বর্তমানে এ পথটিও ধীরে ধীরে রূদ্ধ হতে চলেছে।
ভবিষ্যতে হয়তো ওই মাদ্রাসাটি পরিপূর্ণ সুন্নী মাদ্রাসা এটা বলার সুযোগই থাকবে না। কারণ ইতিপূর্বে দেশে হাতেগনা কিছু মাদ্রাসা সুন্নী আক্বীদার বিষয়টিকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে- মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি, সুপার/অধ্যক্ষ ও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বদা সচেতনতার কাজ করেছে। যাতে বাতিল কেউ কোনভাবে ঢুকে পরিবেশ নষ্ট করতে না পারে। কিন্তু, বর্তমানে এ সুযোগ আর নেই। কেননা- বর্তমানে নিয়োগ ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটির কোন হাত নেই। শূন্য পদে শিক্ষক নিয়োগের আবেদন করবে প্রতিষ্ঠান আর শিক্ষক নিয়োগ দেবে সরকার। কোন সুন্নী মাদ্রাসার শূন্য পদে নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকের আক্বীদা-আদর্শ যাচাইয়ের কোন সুযোগ নেই, ধীরে ধীরে একটি সুন্নী মাদ্রাসার সকল শিক্ষক ও অধ্যক্ষ বা সুপার সকলেই অসুন্নী হয়ে যাবে না, তা তো হলফ করে বলার সুযোগ নেই। তখন ঐ মাদ্রাসাকে সুন্নী মাদ্রাসা কিভাবে বলা যাবে। আর ঐ মাদ্রাসা থেকে সুন্নী মতাদর্শে বিশ্বাসী আলেমই বা কিভাবে তৈরী হবে। শোনা যাচ্ছে- সামনে মাদ্রাসা শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও ‘বদলী’ এর বিধান আসছে। তখনও একটি অস্বস্তিকর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। বদলীর ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের আক্বীদাগত অবস্থান বিবেচ্য হবার কোন সুযোগ নেই। মনে রাখা উচিত আক্বীদাগত বিরোধ- রাজনৈতিক বিরোধের চেয়েও অনেক শক্তিশালী। সেক্ষেত্রে নানা জটিলতার সৃষ্টি হবে। আর এমতাবস্থায় সবচেয়ে অসুবিধার মুখোমুখী হবে সুন্নী আক্বীদা বিশ্বাসী আলেমরাই। কারণ, বাতিল পন্থীগণ যেখানে যেমন, সেখানে তেমনভাবে নিজেকে মানিয়ে নেয় এবং অবস্থান দৃঢ় করার অপেক্ষায় থাকে। তারপর তার বিষক্রিয়া ছড়াতে তৎপর হয়। কিন্তু সুন্নী আলেমগণের পক্ষে তা সম্ভব হবে না। তাঁরা যদি মোকাবেলার পরিবেশ না পায়, তাহলে অনেকে চাকরিই ছেড়ে দেবেন। এতেও সুন্নীয়াতের কোন লাভ হবে না। এ ধরণের হাজারো জটিলতার স্বল্পমেয়াদী- সমাধান হলো ‘দরসে নেযামী’ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে এক ঝাঁক দক্ষ আলেম তৈরি করা। এ সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সুন্নী শিক্ষকের সংখ্যাও আপনা-আপনি বৃদ্ধি পাবে। একজন দক্ষ আলেম আত্মরক্ষায় সতর্ক অবস্থানে থেকেও বাতিলকে ধরাশায়ী করতে পারেন। একজন দক্ষ আলেমের মোকাবেলায় অধিক সংখ্যক বাতিলপন্থী পরাজিত হবার অনেক প্রমাণ বিদ্ধমান। বর্তমান মাদ্রাসা ‘‘সিলেবাসে’’ দক্ষ আলেম তৈরি হাবার সুযোগ একেবারেই সংকুচিত। এমতাবস্থায় আমাদের সামনে রাখতে হবে হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ঐতিহাসিক বাণী- ‘কাম করো, দ্বীনকো বাঁচাও, সাচ্ছা আলেম তৈয়ার করো।’ আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের তৌফিক দান করুন- আ-মী-ন।