বাংলাদেশে সুন্নিয়তের পূনর্জীবনের কারণে তিনি আজও প্রাতঃস্মরণীয়-
মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার >
সমগ্র বিশ্বে তাঁর দ্বীনি সেবার জ্বলন্ত নিদর্শন ও স্বাক্ষী থাকবার পরও বলতে হয় যে, বাংলাদেশই ছিল তাঁর খেদমতের এই ধারাবাহিকতায় পূর্ণতার ঠিকানা। যে আলোর মশাল নিয়ে তিনি আফ্রিকা থেকে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে সফর করেছিলেন তা শেষ পর্যন্ত এই বাংলাদেশের চট্টগ্রামে এনে মজবুতভাবে গেঁড়ে দিয়েছেন বলে তাঁর নাতি পীর সাবির শাহ্ (মু.জি.আ.) একবার চট্টগ্রাম জামেয়ার ময়দানে প্রদত্ত তাঁর এক ভাষনে মন্তব্য করেছিলেন। মনে হয়, তিনি বাঙালিদের জন্যই জন্মেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাই ভি বাঙালি হুঁ। ১৯৫৮-এর পর যখন আর এ দেশ সফরে আসলেননা, তখন বাঙালি মুসলমানদের প্রতি তাঁর দরদ ভরা আশ্বাস ছিল ‘‘জিসিম মেরা সিরিকোট মে, আউর দিল মেরা বাঙ্গাল মে পড়া হুয়া হ্যায়’’। তিনি নাকি এমনও বলতেন যে, ‘‘বাঙালিওকা সাত মেরা হাশর হোগা’’। এটা আমাদের পরম সৌভাগ্যের খবর যে হুজুর সিরিকোটি (রাহ.) এদেশের মানুষকে ভালবাসেন, এবং নিজের করে নিয়েছেন। ১৯৪২ হতে ১৯৫৮ সনের আগ পর্যন্ত, কোন অসুস্থতাই তাঁকে বাংলা মুলুকে সফর করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। একবার প্রচন্ড জ্বর ও অন্যান্য অসুস্থতার কারণে তিনি যখন চলতে ফিরতে অক্ষম, এমন সময়ে পরিবার থেকে তাঁকে সে বার এ দেশ সফরে না আনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ কথা শুনে বলেছিলেন -‘‘নেহী, মুঝেহ্ প্লেইন মে চড়হা দো, আগর রাস্তা মে মেরি মওত আয়ি তো মেই আল্লাহকা পাছ কেহ্ চোকেঙ্গা কে এয়া আল্লাহ্, তেরে রাস্তা মে মেরে মওত হুয়ি’’ সুবহানআল্লাহ! তখন হুজুরের বয়স একশ অতিক্রম করেছিল, এরপরও শারীরিক অপারগতা কখনো তিনি প্রকাশ করেননি, আর এমন ত্যাগের কারণেই তিনি বাংলাদেশের সুন্নিয়তের জাগরণে প্রধান পথিকৃৎ হতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশে তাঁর সফরকাল ছিল জীবনের শেষ ২৩ বছর। প্রথমে রেঙ্গুনে আসা যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতিতে মাত্র কয়েকদিনের জন্য, এভাবে ১৯৩৬-৪১ পর্যন্ত। আর ১৯৪২-১৯৫৮ পর্যন্ত নিয়মিত শীতকালিন সফরে এসে থাকতেন বেশ কয়েক মাস।এই সময়ে তাঁর হাতে হাজার হাজার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, এবং শরিয়ত-ত্বরিকতের ব্যাপক উন্নতি সহ দ্বীনি শিক্ষা বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের ফলে তাঁর হাতে সুন্নিয়তের পূনর্জীবন ঘটে, যা আজ সত্যনিষ্ঠ নিরপেক্ষ মহল অকপটে স্বীকার করেন। আজো তাঁর হাতে গড়া চট্টগ্রামের জামেয়া-আন্জুমান বাংলাদেশের সুন্নিদের নির্ভরতার প্রধান ঠিকানা হিসেবে অব্যাহত আছে। আজ তাঁর আন্জুমানের হাতে পরিচালিত হয় শতাধিক মাদ্রাসা। আর, নতুন এক বিপ্লবী সুন্নি ধারার মাদ্রাসা কায়েমের প্রলয়ংকরী এই যাত্রায় ‘‘মসলকে আ’লা হযরত ভিত্তিক চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (১৯৫৪)’’ ছাড়াও , তাঁর হাতে ১৯৪২ সনে প্রতিষ্ঠিত হয় রাউজান দারুল ইসলাম মাদ্রাসা, যা বর্তমানে আনজুমান ট্রাস্ট’র হাতে পরিচালিত এবং মাস্টার্স স্তরের কামিল মাদ্রাসায় উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া, তাঁর হাতে পূনর্জীবন লাভ করেছে আরো বহু প্রতিষ্ঠান, এর মধ্যে হাটহাজারীতে -কাটিরহাট মুফিদুল ইসলাম ফাজিল মাদ্রাসা অন্যতম। ১৯৫৮ সনে এই কাটিরহাট মাদ্রাসা হাটহাজারীর বাতিলদের কবল থেকে রক্ষা পায় হযরত সিরিকোটি হুজুরের পদক্ষেপ ও সেখানে তাঁর সরেজমিন শুভাগমনের মাধ্যমে। এমন আরও অনেক মাদ্রাসা রয়েছে যেসব তাঁর প্রভাবে নতুন জীবন পায়। বিশেষত তাঁর হাতে কাদেরিয়া ত্বরিকায় যেমন নতুন জোয়ার আসে, তেমনি এ দেশবাসী পায় ‘‘মসলকে আ’লা হযরত’’ নামক সুন্নিয়তের বিশুদ্ধতম ধারার সন্ধান লাভ। বিদ্যমান পীর, সিলসিলাহ্ ও দরবারগুলোর জন্যও তিনি ছিলেন এক মহান পথ প্রদর্শক ও সংস্কারক। গাউসে পাক জিলানি (রাদ্বি.) যেভাবে তাঁর বহুমুখী সংস্কারমূলক পদক্ষেপ এবং আধ্যাত্মিক প্রভাব দিয়ে দ্বীনের পূনর্জীবন দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনিভাবে সিরিকোটি হুজুরের হাতে সুন্নিয়ত পায় নতুন জীবন। আজ বাংলাদেশের যেখানেই সুন্নিয়তের আলো দৃশ্যমান, সেখানে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে এর নেতৃত্বে, বা নেপথ্যে রয়েছে শাহানশাহে সিরিকোট, বা তাঁর মাদ্রাসাগুলোর ছাত্রদের অবদান। আর, চট্টগ্রামকে তিনি বানিয়ে গেছেন সুন্নিয়তের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে। কারণ, তাঁর জামেয়া ‘‘সুন্নিয়তের প্রধান ক্যান্টনমেন্ট’’ (উক্তি -শহীদ মৌলানা নুরুল ইসলাম ফারুকি ও স্বীকৃতি দেশের সকল মহলের) আজ ঢাকার মুহম্মদপুরে তাঁর আনজুমানের অপর কামিল-মাস্টার্স মানের সুন্নি মাদ্রাসা হল মুহম্মদপুরস্থ কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসা। যা রাজধানীর বুকে সুন্নিদের প্রধান অবলম্বন, এবং বাংলাদেশের সুন্নিয়ত রক্ষার দ্বিতীয় ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে আখ্যায়িত হয়। বর্তমানে ঢাকার বুকে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে ইনশাল্লাহ্, কারণ এখানে ১৯৫২ সনে শাহানশাহ্ এ সিরিকোটের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় কায়েৎটুলিস্থ খানকাহ্ শরিফ।