শাহানশাহ্-এ সিরিকোট বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান -৩

0

শাহানশাহ্-এ সিরিকোট বিশ্বব্যাপি সুন্নিয়তের জাগরণে তাঁর অবদান -৩

মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার >

পীরের দরবারে নজিরবিহীন খেদমতে
আফ্রিকা থেকে ফিরে তিনি তাঁর পীর খাজা চৌহরভী (রাহ.)’র দরবারেই কাটিয়ে দেন প্রায় ৭-৮ বছর। সেখানেও তিনি বিরল স্বাক্ষর রেখেছেন দরবারের সেবায়। পীরের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের ঘটনাটিও বড়ই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তাঁর মহীয়সী বিবির উপুর্যপরি পরামর্শ এবং পীড়াপীড়িতেই তিনি খাজা চৌহরভীর সাথে সাক্ষাতে কোনমতে রাজি হন, এবং সেই এলাকার হরিপুর বাজারে কাপড়ের দোকান খুলেছিলেন। হরিপুর থেকে সিরিকোটের দুরত্ব অন্তত ১৮ মাইল। দোকান খোলার কয়েকদিন পর, আসা-যাওয়ার পথেই একদিন হয়ে গেল সেই তাৎপর্যপূর্ণ মিলনপর্ব। এ সময় সিরিকোটি হুজুরের এক লোকের নুরানি সূরতের দিকে দৃষ্টি গেল, যাঁকে খুব কর্ম ব্যস্ত মনে হচ্ছিল। ভাবছিলেন, বোধহয় উনিই হবেন, তাঁর বিবির পছন্দের সেই পীর। সামনাসামনি হতেই তাঁকে সালাম দিলেন, আর পীর সাহেবের পক্ষ থেকে প্রত্যুত্তর এল অনেক লম্বা এবং বিশেষ স্বরভঙ্গিতে, যেন তাঁর সেই স্বরভঙ্গি জানান দিচ্ছিল ‘‘ও তুমিই তাহলে,এসেছ শেষতক -ঠিক আছে, আমারও যে দরকার তোমাকে’’। পীরজি সালামের তাৎপর্যপূর্ণ উত্তর শুধু দিলেন না, এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘চান্দে কেত্তে আয়ে’’, হে চাঁদপুরুষ আপনি কোত্থেকে আসছেন? সিরিকোটি হুজুর উত্তর দিলেন, গঙ্গর সে’-গঙ্গর উপত্যকা হতে। আবার জিজ্ঞেস, এখানে কেন? উত্তর দিলেন, ‘‘আমি হরিপুর বাজারের নতুন দোকানদার’’। পীরজি বল্লেন, ও তাই নাকি, বেশ ভাল কথা, আমার কাছে যারা আসে আমি তাদের বলব যে, হরিপুরে আমার একটা দোকান আছে, যেন তারা আপনার কাছ থেকে কিনে ‘‘কী আশ্চর্য, প্রথম দেখাতেই যেন শত বছরের আপনজন, পর বলে মনে হচ্ছিলনা চৌহরভী হুজুরকে। এবার সিরিকোটি হুজুর জানতে চাইলেন, হযরত আপনাকে খুব তৎপর দেখাচ্ছে, কী করছিলেন? বললেন, একটা মসজিদ নির্মানের কাজে ব্যস্ত আছি’’। সিরিকোটি সাহেব বললেন, তাই নাকি? তাহলে মেহেরবানি করে আমাকেও এমন মোবারক কাজে শরিক করুন, এই বলে, হযরত চৌহরভী’র হাতে তিনি তুলে দেন একশত টাকা, সুবহানআল্লাহ! ঘটনাটি আনুমানিক ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময়ে, আর সে সময়ে একশত টাকা তাৎক্ষনিক দানের ঘটনা কল্পনাতীত। শুধু চৌহর শরিফের উক্ত মসজিদ নয়, সিরিকোটি হুজুর নিজের টাকায় আরো বহু মসজিদ তৈরী করেন, এর মধ্যে একটি হরিপুর বাজারে রয়েছে,। তাছাড়া নিজ বাড়ি সিরিকোট দরবারের জামে মসজিদটিও তাঁর টাকায় নির্মিত হয় ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে। বিশেষ করে, ১৯০২ সনে চৌহরভী (রাহ.) হরিপুর বাজারে যে ‘দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া’ প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু করেছিলেন, তা মূলত সিরিকোটি সাহেবের হাতেই বিশাল মারকাজ হিসেবে পূর্ণতা পায়। তিনি এই মাদ্রাসার আর্থিক পৃষ্টপোষকতায় শুধু প্রধান ছিলেননা, বরং খাজা চৌহরভী (রাহ.)’র পর এর পরিচালনাটা পরিপূর্ণভাবে তাঁর উপরই নির্ভরশীল হয়। মাদ্রাসার বিশাল দ্বিতল ভবন (১৯২৭ খ্রি.) সহ পরবর্তী সকল উন্নয়ন ও প্রশংসনীয় অবস্থান ছিল তাঁর অবদান।

উল্লেখ্য, ৩১ডিসেম্বর ১৯৪৮ তৎকালিন অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী এবং গভর্নর সর্দার আবদুর রব নিশতার এ মাদ্রাসার অবস্থান সম্পর্কে বলেছিলেন। ‘‘এই দারুল উলুমের মাধ্যমে এমন কামেল ব্যক্তি তৈরী হয়েছে যে যাঁদের পদচুম্বনে রয়েছে পরকালের মুক্তি’’ (আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আ’লা হযরত গবেষক, প্রফেসর ড. মাসউদ আহমদ লিখিত ইফতিতাহিয়্যা) ২২ মার্চ ১৯৪৯ পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খাঁনও এ মাদ্রাসার অবদান স্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, দরবারের লঙ্গরখানা এবং এই রহমানিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলের রান্নাবান্নার জন্য লাকড়ির অভাব ছিল বলে, তিনি নিজ বাড়ি সিরিকোটের পাহাড় হতে সারাদিন লাকড়ি যোগাড় করতেন এবং দিন শেষে ১৮ মাইল দুরের চৌহর শরিফে নিয়ে যেতেন নিজের কাঁধে করে। এভাবে বহুবছর তিনি এমন কঠোর শারীরিক পরিশ্রম পর্যন্ত করেছিলেন দরবার ও মাদ্রাসার সেবায়। এর ফলে তাঁর হাতে -ঘাঁরে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছিল এর যন্ত্রনা এবং চিকিৎসা জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত চলেছিল। এই ক্ষত সম্পর্কে তিনি বলতেন-ইয়ে মেরে বাবাজিকা মোহর হ্যায়’’। দ্বীনি খেদমতে কঠিন পরিশ্রমী এই জবরদস্ত আলেম-হাফেজ সিরিকোটি হুজুরের মধ্যেও এক সময়ে লোকালয় ছেড়ে বনে জঙ্গলে একান্তে রেয়াজত করবার ইচ্ছা জেগেছিল এবং এ জন্য পীরের এজাজতও চেয়েছিলেন, কিন্তু পীর খাজা চৌহরভী (রাহ.) তাঁকে সাফ জানিয়ে দিলেন যে, বন জঙ্গলের কঠিন রেয়াজাত-মোশাহেদা-মোজাহেদার চেয়েও উত্তম হল মানুষের মধ্যে থেকে দ্বীনের খেদমত করা।’’ সুতরাং সংসার-লোকালয় বর্জনে তিনি ব্যর্থ হবার পর, এবার তিনি চেয়েছিলেন লাহোর বাদশাহী জামে মসজিদের ইমাম-খতিবের দায়িত্ব পেতে। দরখাস্তও করেছিলেন কিন্তু এবারও পীর সাহেব একমত হলেন না। কারণ, ঐ মর্যাদাপূর্ণ পদে ইতোপূর্বে যিনি ছিলেন তাঁর এক শাহজাদা এ পদের জন্য আবেদন করেছেন, খাজা চৌহরভী চেয়েছিলেন যে, দায়িত্বটা মরহুম ইমামের সন্তানের হাতে থাকুক। তাই, হযরত সিরিকোটি, তাঁর পীরের এক তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশে প্রেরিত হলেন রেঙ্গুনে। তাঁর কামেল পীর ছিলেন গাউসে দাঁওরান, খলিফায়ে শাহে জীলান তিনি তাঁর রুহানি দৃষ্টিতে দেখেছিলেন হযরত সিরিকোটি হুজুরের হাতে রেঙ্গুন আর চট্টগ্রামের এক যুগান্তকারী দ্বীনি খেদমত সুন্নিয়তের মহাজাগরণের সুসংবাদ। ১৯২০ সালে, তিনি পীরের নির্দেশে স্বদেশের মায়া ছেড়ে দ্বীনের মায়ায় আবারো হিজরত করলেন রেঙ্গুনে।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •