ঈদুল আজহা : প্রসারিত হোক ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের পথ

0
ঈদুল আজহা : প্রসারিত হোক ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের পথ –
কাশেম শাহ >
‘ঈদুজ্জোহার চাঁদ হাসে ঐ
এল আবার দুসরা ঈদ!
কোরবানী দে, কোরবানী দে
শোন খোদার ফরমান তাগিদ…’
কাজী নজরুল ইসলামের এই কাব্যসুর আকাশ-বাতাস মুখরিত করে মনপ্রাণ উজালা করে তুলছে ঈদের আনন্দ-রোশনাইয়ে। আল্লাহপাকের প্রতি অপার আনুগত্য এবং তাঁরই রাহে সর্বোচ্চ ত্যাগের এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে মুসলিম বিশ্বে প্রতিবছর ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়ে আসছে। মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম-এর আত্মত্যাগ ও অনুপম আদর্শের প্রতীকী নিদর্শন হিসেবে কোরবানির রেওয়াজ। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম-কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এই অনন্য ঐতিহাসিক ঘটনার ধারাবাহিকতায় কোরবানি প্রচলিত হয়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের প্রতি প্রিয় বান্দা, নবী হজরত ইব্রাহিম আলায়হিস্ সালাম ও তাঁর পুত্র হজরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম -এর সীমাহীন ভক্তি, সর্বোচ্চ ত্যাগের সদিচ্ছা এবং গভীরতম আত্মসমর্পণে পরম করুণাময় সন্তুষ্ট হন এবং তিনি ইব্রাহিমকে (আলায়হিস্ সালাম) আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ পশু কোরবানি করতে নির্দেশ দান করেন। এ ঘটনার পর থেকে মুসলমানরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের প্রতীক হিসেবে পশু কোরবানি দিয়ে আসছেন। প্রতিবছর মুসলমানদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান পবিত্র হজের পরই কোরবানি দেয়া হয়। কাজী নজরুলের ভাষায়:
‘আজি আরাফাত ময়দান পাতা গায়ে গায়ে
কোলাকুলি করে বাদশাহ্-ফকিরে, ভায়ে ভায়ে’…।
ইসলামের পরিভাষায় কোরবানি হলো- নির্দিষ্ট পশুকে একমাত্র আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে নির্দিষ্ট সময়ে তারই নামে জবেহ করা। মহান আল্লাহর দরবারে জবাই করা পশুর মাংস বা রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, কেবল নিয়ত ছাড়া। ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা হচ্ছে, মনের পশু অর্থাৎ কুপ্রবৃত্তিকে পরিত্যাগ করা। নজরুল তাই লিখেন :
‘মনের পশুরে কর জবাই
পশুরাও বাঁচে, বাঁচে সবাই..’।
যুগ যুগ ধরে, বংশ পরম্পরায় আমরা এমন আনন্দ উদযাপন করে আসছি। এবারো ঈদ এলো আনন্দের বার্তা নিয়ে, তবে সবার জীবনে ঈদ আসে না। কোথাও কোথাও, কারো কারো কষ্টও সঙ্গী করে ঈদ। ক’দিন পর যখন আমরা কোটি কোটি মানুষ ঈদের আনন্দে ভাগীদার হব, তখনো কিছু মানুষ অভুক্ত দিনযাপন করবে। তাদের জীবনে আর ঈদ আসে না। ঈদ আমাদের সাম্যের শিক্ষা দেয়, সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। শুধু পশু জবেহ করলেই কোরবানি হয় না, পশু জবেহ’র মূল উদ্দেশ্যই হল মহান রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জন। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ পাক ইরশাদ করেন, ‘কোরবানি দেওয়া জীবের রক্ত-মাংস কোনটাই আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, বরং পৌঁছে তোমাদের খোদাভীতি ও আন্তরিকতা।’ অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সেবা করেই মিলবে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি।
কাম, ক্রোধ, লোভ, লালসা প্রভৃতি খোদাপ্রেম বিরোধী রিপুগুলোকে আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অনুযায়ী বশ ও দমন করার শিক্ষা রয়েছে এ কোরবানিতে। প্রতিবছর ঈদুল আযহা মুসলিম জাতির ঈমানী দুর্বলতা, চারিত্রিক কলুষতা দূর করে ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় তাদের ঈমানী শক্তিকে বলিয়ান, নিখুঁত ও মজবুত করে। মুসলমানগণ এ কোরবানির মাধ্যমে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দীক্ষা নেয়। ঈদের মধ্যে আছে সাম্যের বাণী, সহানুভূতিশীল হৃদয়ের পরিচয়। পরোপকার ও ত্যাগের মহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয় মানুষের মন। কোরবানির এ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মুসলমানরা অন্য মানুষের পাশে সাহায্যের হাত প্রসারিত করবে, সাম্য ও সম্প্রীতির অনন্য বন্ধন সৃষ্টি করবে Ñএটাই হওয়া উচিত ঈদের প্রত্যাশা।
কোরবানির মূল কথা হল ত্যাগ। সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কোরবানি দিয়ে দরিদ্র প্রতিবেশীদের মধ্যে এর মাংস বিতরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। পরিতাপের বিষয়, এদেশের অনেকের কাছে ধর্মের মতো আধ্যাত্মিক একটি বিষয়ও পরিণত হয়েছে লোক দেখানো আচারে। প্রতিযোগিতা করে মাংস খাওয়া এবং মাসের পর মাস ডিপফ্রিজে জমিয়ে রাখা ইদানিং আমাদের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আল্লাহতায়ালা প্রিয় বস্তুকে উৎসর্গ করতে বলেছেন। আমরা তাঁর আদেশ পালন করব অন্তরের তাগিদে, মানুষকে দেখানোর জন্য নয়। কোরবানির মাধ্যমে আমরা ভেতরের পশুশক্তিকে যেমন হত্যা করব, তেমনি সুদৃঢ় করব মানুষে মানুষে ভালোবাসা। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অভুক্ত শীর্ণ মানুষের জন্য একবেলা বা দু’বেলা উন্নতমানের আহারের ব্যবস্থা করা যায়। মানবতার সেবাই তো প্রকৃত ধর্ম। পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে ব্যক্তি, সমাজ তথা মানুষের ভেতরের পশুশক্তিকে দমনই হচ্ছে কোরবানির মূল কথা। ঈমানদার মুসলমানরা তা-ই করেন। এ ত্যাগ ও আত্মোৎসর্গের পথ ধরে লাভ করা যায় আল্লাহর নৈকট্য।
ঈদের আয়োজন অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানের চেয়ে খানিকটা আলাদা ও বিশাল বলে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এর সঠিক সমাধা করা অনেকটাই কঠিন। শেষ মুহূর্তে দেখা যায় কোন না কোন কিছুর সংকট থেকেই যাচ্ছে। তাই কোরবানি দেওয়ার আগে একবার যাচাই করে নিন আপনার প্রস্তুতি সব ঠিকঠাক মতো হয়েছে কি না। সকালে উঠেই প্রধান কাজ হচ্ছে ঈদের নামাজে শরীক হওয়া। ঈদ যেহেতু সবার আগে ধর্মীয় উৎসব তাই এর ওয়াজিব, ফরজ বিষয়গুলোর প্রতি নজর রাখা প্রধান কর্তব্য। এবং ঈদের নামাজ যেহেতু বছরে মাত্র দুইবার পড়তে হয় তাই এর নিয়ম কানুন ভুলে যাওয়া স্বাভাবিক। সে কারণে নামাজ পড়তে যাওয়ার আগে একবার নামাজের নিয়ম কানুন এবং যে মসজিদে নামাজ আদায় করবেন সে মসজিদে কয়টায় ঈদের জামাত শুরু হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া ভালো। ভালো হয় বাড়ির পাশে মসজিদে নামাজ পড়তে পারলে, অনেকে ঈদগাহ কিংবা দূরের বড় মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নামাজে যাওয়ার আগে কিংবা নামাজ থেকে এসে কোরবানির পশুকে গোসল করিয়ে নেওয়া সুন্নাত। বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে এটিকে উত্তম কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এরপর কোরবানি কার নামে দেওয়া হচ্ছে সেটিও জানা থাকা এবং যিনি কোরবানির পশু জবেহ করবেন তাকে জানিয়ে দেওয়া আবশ্যক।
পশু কোরবানির পর সেটির বর্জ্য পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা কিন্তু কোরবানিদাতার উপরই বর্তায়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা যারা কোরবানি দিই, তারা গরু-ছাগল জবেহ ও কাটাকাটির পর পশুর বর্জ্য রাস্তার উপরই ফেলে চলে আসি। ফলে সে বর্জ্য থেকে একদিকে যেমন দুর্গন্ধ ছড়ায় অন্যদিকে তেমন পরিবেশও বিনষ্ট হয়। প্রত্যেক কোরবানিদাতার উচিত পশু জবেহর পর কোরবানির বর্জ্য পরিস্কার করে নির্দিষ্ট একটি স্থানে জমিয়ে রেখে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা সিটি কর্পোরেশনে খবর দেওয়া।
কোরবানির শেষের দিকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোরবানি করা পশুর চামড়া। নিয়ম হচ্ছে চামড়া বা চামড়া বিক্রির টাকা গরীব মিসকিনদের মধ্যে বিতরণ করতে হয়। সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হচ্ছে কোন মাদ্রাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, যে সব প্রতিষ্ঠান সমূহে এতিমখানা আছে এবং এতিম ছেলে মেয়েদের ভরণ পোষন করে সেসব প্রতিষ্ঠানেও আপনি কোরবানির পশুর চামড়া দান করতে পারেন। একইসাথে সেসব মাদ্রাসা সঠিক ঈমান-আক্বিদার ওপর প্রতিষ্ঠিত কি-না সেটাও যাচাই করে দেখা কোরবানিদাতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, চামড়া বিক্রির টাকায় কসাই কিংবা যারা কোরবানির দিন আপনার বাসায় কাজ করবে তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া যাবে না। পশুর চামড়া ছাড়ানোর ব্যাপারেও আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। কেননা চামড়া আমাদের জাতীয় সম্পদ।
ঈদ মানে আনন্দ হলেও আল্লাহ দরিদ্রদের এ আনন্দে শরিক করার জন্য তার ধনী বান্দাদের নির্দেশ দিয়েছেন। লোক দেখানো ধর্মীয় আচার পালনে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব, মমতা ও ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে ঈদুল আজহার আদর্শকে আমরা সমুন্নত রাখতে পারি। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বিশ্বের সব মুসলমানকে সে তওফিক দান করুন।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •