ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরতুল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্

0
যাঁর বেলায়তী দুরদর্শিতা ও আন্তরিকতায় সুন্নী সমাজ ধন্য
ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরতুল
আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্
[আলায়হির রাহমাহ্] –
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান >
‘আহলে সুন্নাত’ বা সুন্নী সমাজের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্য সর্বজন বিদিত। হাবীব-ই খোদা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন নুবূয়তী যবানে পাকে আপন উম্মতের ৭৩ ফির্ক্বার মধ্যে একটি মাত্র জমা‘আত বা দলকে বেহেশতী ঘোষণার পর সাহাবা-ই কেরাম জানতে চাইলেন তারা কারা? হুযূর-ই আক্রাম এর জবাবে তাঁর খোদাপ্রদত্ত অদৃশ্য জ্ঞানের বিশ্ব আলোকিতকারী জ্যোতি বিচ্ছুরিত করলেন। এরশাদ করলেন- ‘‘মা-আনা আলায়হি ওয়া আসহাবী।’’ আমি ও আমার সাহাবীরা যে আদর্শ তথা মত ও পথে আছি সেটার অকৃত্রিম অনুসারীরাই সুন্নী জমা‘আত, কিতাবের ভাষায় ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’। এটাই ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা। আলহামদু লিল্লাহ্, ক্বিয়ামত পর্যন্ত এ পূতঃপবিত্র মতাদর্শ পৃথিবীর বুকে স্থায়ী হবে। সুতরাং সাহাবা-ই কেরামের পর থেকে এ মতাদর্শের সংরক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার জন্য গোটা বিশ্বে, আল্লাহ্ তা‘আলা অগণিত ইমাম, আউলিয়া-ই কেরাম, হক্বক্বানী-রব্বানী ওলামা-ই ‘ইযাম এবং নিষ্ঠাবান ব্যক্তিবর্গও সৃষ্টি করেছেন। বলাবাহুল্য, এ পর্যন্ত ওই ধারাবাহিকতায় এ উপমহাদেশে যেসব আউলিয়া-ই কেরামের বেলায়তপূর্ণ দুরদর্শিতা ও আন্তরিকতায় সুন্নি মতাদর্শের গৌরব-রবি অম্লাণভাবে আলোময় রয়েছে, তাঁদের মধ্যে আমাদের প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ ওয়ার রিদ্বওয়ানের মক্বাম শীর্ষে। তাঁর অসাধারণ বেলায়তপূর্ণ ও আন্তরিক পদক্ষেপ এবং অবদানগুলো দ্বারা আজ সুন্নী সমাজ অবর্ণনীয়ভাবে ধন্য। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর মধ্যে অগণিত বৈশিষ্ট্য গচ্ছিত রেখেছেন। ওইগুলোর সুফল বিশেষত মুসলিম সমাজ চিরদিন ভোগ করবেন। এ নিবন্ধে এ মহান ওলী ও অব্যর্থ পথপ্রদর্শকের অগণিত গুণ ও বৈশিষ্ট্য থেকে কিছুটা মাত্র আলোচনা করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
হযরতুল আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ মাদারযাদ ওলী
আল্লাহ্ তা‘আলা এ মহান ওলী থেকে দ্বীন-মাযহাবের অসাধারণ খিদমত নেবেন বিধায় শুভ জন্ম থেকেই তাঁকে এক মহান ওলীর আসনে আসীন করেছেন। তিনি আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ৩৯তম বংশধর। তাঁর বংশীয় ধারা সাইয়্যেদুশ শোহাদা হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হয়ে যুগ পরম্পরার এক শুভ সোপানে যুগশ্রেষ্ঠ হোসাঈনী বুযুর্গ হযরত গেসূ দরায আলায়হির রাহমাহ্ পর্যন্ত পৌঁছে। তারপর এ নূরানী ধারা ফাতিহে সিরিকোট হযরত সৈয়্যদ গফূর শাহর বংশধর হযরত খান-ই যমান শাহ্ এবং তাঁর সুযোগ্য সাহেবযাদা সৈয়্যদ সদর শাহ্ এবং তাঁরই সুযোগ্য সাহেবযাদা যুগশ্রেষ্ঠ ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আরায়হি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তাঁরই সুযোগ্য সাহেবযাদা ও খলীফা হলেন হুযূর ক্বেবলা হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্।
গাউসে যমান মুর্শিদে বরহক্ব হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ ১৩৩৬ হিজরী মোতাবেক ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের এক শুভ দিনে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জিলার সিরিকোট-শেতালু শরীফে যুগশ্রেষ্ঠ ওলী হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির ঔরশে এবং এক রতœগর্ভা আবেদাহ্-যাহেদাহ্ মহীয়সীর পবিত্র গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উলূমে লাদুন্নিয়াহ্ ও মা‘আরিফি ইলা-হিয়্যাহর ধারক, ত্রিশপারা বিশিষ্ট মজমু‘আহ্-ই সালাওয়াত-ই রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রণেতা হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্র নূরানী ভাষায় ‘তৈয়্যব’ (পাক-পবিত্র) এবং যুগশ্রেষ্ঠ ওলী, তাঁর পিতা মহোদয়ের পবিত্র ভাষায় ‘মাদারযাদ ওলী’ (মাতৃগর্ভের ওলী) হিসেবে ভূষিত। এর প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতাও সর্বজন বিদিত।
হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হির শুভজন্মের পূর্বাভাস হিসেবে হযরত চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্র একটি ঘটনা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ হুযূর ক্বেবলার জন্মের পূর্বে একদিন হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী আলায়হির রাহমাহ্ তাঁর খলীফা-ই আ’যম হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর শাহাদত আঙ্গুল ধরে স্বীয় পিঠ মুবারকের মেরুদন্ডের মাঝামাঝি স্থানে ঘষতে ঘষতে বললেন, ‘ইয়ে পাক চীয, তোম লে লো।’ (এ পবিত্র জিনিষ তুমি নিয়ে নাও।) ‘পাক’ উর্দু শব্দ। আরবীতে এর প্রতিশব্দ ‘তৈয়্যব’ (طيب)। এরপর হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহর ঘরে হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্র জন্ম হয়। অতঃপর তাঁর নাম রাখা হয়, ‘তৈয়্যব’ (হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্)।
দ্বিতীয়ত, বিগত ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রামের কোন এক ভাই হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্র জন্য (তখন তিনি পাকিস্তানে অবস্থানরত) এক জোড়া জুতা তৈরী করানোর আরজু প্রকাশ করলেন এবং হযরত শাহানশাহে সিরিকোটের সমীপে জুতার জন্য মাপ চাইলেন। হুযূর ক্বেবলা হযরত সিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নিজের পায়ের মাপ দিলেন আর বললেন, ‘আমাদের দু’জনেরই পায়ের মাপ সমান।’
৭/৮ দিন পর লোকটি এক জোড়া অতি সুন্দর ও নরম জুতা তৈরী করিয়ে নিয়ে আসলেন এবং মাপ সঠিক হয়েছে কিনা দেখার জন্য শাহানশাহে সিরিকোটকে পায়ে পরার জন্য অনুরোধ জানালেন। লোকটি পরপর দু’বার অনুরোধ করে তৃতীয়বার এ কথা বলতেই হুযূর ক্বেবলা দীপ্তকণ্ঠে এরশাদ করলেন, ‘‘তৈয়্যব মাদারযাদ ওলী হ্যায়। জায়সে হ্যাঁয় ওয়ায়সে দে দো!’’ (অর্থাৎ তৈয়্যব শাহ্ মাতৃগর্ভের ওলী। জুতোগুলো যেমন আছে তেমনি দিয়ে দাও!)
বলা বাহুল্য, শৈশব থেকেই হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ-এর অনেক ওলী সুলভ কারামত প্রকাশ পেতে থাকে। মাত্র ছয়/সাত মাসের শিশু তৈয়্যবকে হযরত চৌহরভী শিরনী খাওয়াতে সিরিকোট শরীফ এসেছিলেন। গরম শিরনী হাযির করা হলে হযরত চৌহরভী বললেন, ‘‘তৈয়্যব তোম না খাওগে তো হামভী না খায়েঙ্গে।’’ (তৈয়্যব, তুমি না খেলে আমরাও খাবো না)। একথা শুনতেই হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ গরম শিরনীতে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে শিরনী খাচ্ছিলেন। হাতগুলো ছিলো তুলতুলে নরম আর শিরনী ছিলো গরম; কিন্তু হুযূর ক্বেবলার কোন ক্ষতি হয়নি। তাঁর এ আনুগত্য ও শিশুসুলভ অবস্থা দেখে হযরত চৌহরভী হেসে ফেললেন আর হযরত সিরিকোটীও তাঁর শিশু সন্তানের বুদ্ধিমত্তা ও অলৌকিকত্ব দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলেন এবং আল্লাহ্ পাকের শোকরিয়া আদায় করলেন।
হুযূর ক্বেবলা হযরত তৈয়্যব শাহ্র বয়স যখন মাত্র ৫/৬ বছর, তিনি আপন পিতা হযরত সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহকে বললেন, ‘‘নামায মে আপ আল্লাহ্ কো দেখতে হ্যাঁয়। মুঝে ভী দেখনা হ্যায়।’’ (নামাযে আপনি আল্লাহকে দেখেন। আমিও দেখতে চাই।) ছোট্ট শিশুর মুখে একথা শুনে, খোদার সান্নিধ্য প্রাপ্তির এমন আগ্রহ দেখে খুশী হয়ে পিতা হযরত সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহ্ আপন পরম ¯েœহের পুত্রের মনোবাসনা পূরণের জন্য দো‘আ করলেন। আল্লাহ্ তা‘আলা যে তাঁর দো‘আ কবূল করেছেন তার বাস্তবতা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে।
তিনি সাত কিংবা আট বছর বয়সে আপন পিতার সাথে ভারতের আজমীর শরীফ সফরে গেলে সেখানে হযরত খাজা গরীব নাওয়াযের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তিনি তাঁকে পাশে বসিয়ে আদর করেন এবং দো‘আ করেছেন। ১১ বছর বয়সে তিনি তাজভীদ সহকারে পবিত্র ক্বোরআন মজীদ হেফয করে হাফেয হন। তাঁর কণ্ঠস্বর ছিলো অতি শ্রুতিমধুর। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা আপন পিতা মহোদয়ের নিকট অর্জন করেন এবং কৈশোরে তাঁরই তত্বাবধানে, হযরত খাজা চৌহরভীর হরিপুর রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদরাসায় দীর্ঘ ষোল বছর যাবৎ ক্বোরআন, তাফসীর, হাদীস, ফিক্বহ্, নাহ্ভ, সরফ, মানত্বিক, আক্বাইদ, দর্শন, বলাগত এবং আরবী সাহিত্যসহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তাছাড়া, তৎকালীন যুগশ্রেষ্ঠ আলিমে দ্বীন, ফক্বীহ্ ও মুফাস্সির হযরতুল আল্লামা সরদার আহমদ লায়লপুরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির সান্নিধ্যে রয়ে, ২৭ বছর বয়সে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে জাহেরী জ্ঞানের শেষ বর্ষ সনদ লাভ করেন।
বাকী রইলো আধ্যাত্মিক জ্ঞান। বেলায়ত অর্জনের প্রসিদ্ধ পন্থা তিনটি-১. মাতৃগর্ভের ওলী হওয়া, ২. আল্লাহর কামিল বান্দার কৃপাদৃষ্টি এবং ৩. রিয়াযত (আধ্যাত্মিক সাধনা)। আমাদের হুযূর ক্বেবলা যে মাদারযাদ ওলী, তাতো ইতোপূর্বে প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রতি হাবীবে খোদা আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম, শাহে বেলায়ত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুল করীম, বিশেষতঃ শাহানশাহে বাগদাদ গাউসুল আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত চৌহরভী ও শাহানশাহে সিরিকোটের বেলায়তী দৃষ্টি নিবদ্ধই ছিলো। বাকী রইলো তাঁর রিয়াযত-মুজাহাদাহ্। তাঁর ক্ষেত্রে একথাই যথাযথভাবে প্রযোজ্য, ‘জিনকী হার হার আদা সুন্নাতে মোস্তফা, আয়সে পীরে ত্বরীক্বত পেহ্ লাখোঁ সালাম।’ (যাঁর প্রতিটি কাজ সুন্নাতে মোস্তফার অনুসরণ। ত্বরীক্বতের এমন পীর-মুর্শিদের দরবারে লাখো সালাম নিবেদিত)।
আরো লক্ষণীয় যে, বেলায়ত যেই খনি বা উৎস অর্থাৎ আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবার থেকে, ওই নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এরই তিনি (হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্) ৩৯তম বংশধর। ওই মহান উৎস থেকে বেলায়তের ফাল্গুধারা হযরত ফাতিমা যাহরা ও হযরত সাইয়্যেদুশ্ শোহাদা হয়ে আরো আটত্রিশ জন বুযুর্গ সৈয়্যদের মাধ্যমে বেলায়তের ৩৯তম আধার সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। তরীক্বতের সিলসিলাও ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি ও তাঁর পীর-মুরশিদ মা‘আরিফে লাদুন্নিয়ার প্র¯্রবণ হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী হয়ে অব্যাহত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে শাহে বেলায়ত হযরত আলী কাররামাল্লাহু তা‘আলা ওয়াজহাহু হয়ে সরকার-ই দু‘আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
এ বেলায়তী শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতার ক্ষেত্রে এ নূরানী বংশীয় ধারার গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী আলায়হির রাহমাহ্ হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সম্পর্কে বলেছেন-
অর্থাৎ ১. হে বেলায়ত ও ক্বুত্ববিয়াত বন্টনকারী। আপনি সাইয়্যেদুনা সাইয়্যেদুল কাউনাঈন আবুল ক্বাসেম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বংশধর। সুতরাং আপনার গুণ ‘ক্বাসেম’ (বন্টনকারী) হবে না কেন? আপনার ঊর্ধ্বতন মহান প্রপিতা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে তো আল্লাহ্ তা‘আলা ইখতিয়ার ও ক্ষমতা দিয়েছেন। আপনি যেহেতু তাঁরই প্রিয় বংশধর, সেহেতু আপনি যথাযথ বন্টনকারী (ক্বাসেম) না হবার কারণ নেই! তাই, বেলায়ত বন্টনের ভার হুযূর গাউসে পাকের পবিত্র হাতে, খোদ্ হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র দরবার থেকে প্রদান করা হয়েছে। (বলাবাহুল্য), আমাদের প্রাণপ্রিয় মুরশিদগণের বেলায়তের প্রকৃষ্ট প্রমাণ এও যে, বায়‘আত করার পর তাঁদের প্রত্যেকেই একথা বলেন, ‘‘তোমাদের এ বায়‘আতের পরম্পরা হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ হয়ে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।’’)
২. ওহে গাউসুস্ সাক্বালাঈন! আপনি হলেন নবী-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দান, দয়া ও বদান্যতার বারিধারা, হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বসন্ত ঋতু, হযরত ফাতিমা বতূল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার ফুল-বাগান, হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফুল আর হযরত হোসাঈন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ফুল থেকে প্রবাহিত খুশবু। সুতরাং আপনি একাধারে অনেক গুণের অধিকারী।
বলাবাহুল্য, হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্, হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বংশধর এবং তরীক্বা-ই ক্বাদেরিয়ার সুযোগ্য খলীফা। সুতরাং তাঁর বেলায়তরূপী আলো পেয়ে সংশ্লিষ্ট সবার যাহির ও বাত্বিন আলোকিত হওয়া নিশ্চিতই।
তদুপরি, পীরে কামিল ও মুরশিদ-ই বরহক্ব হবার জন্য যেসব পূর্বশর্ত অনিবার্য ও অপরিহার্য ওইসব ক’টিই হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্র মধ্যে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। আ’লা হযরত ওইসব পূর্র্বশর্তের নির্যাস হিসেবে মোট চারটি পূর্বশর্তের কথা বলেছেন- ১. সহীহ্ আক্বীদা (আহলে সুন্নাতের আক্বীদা) থাকা, ২. মুত্তাক্বী-পরহেযগার হওয়া, (ফাসিক্ব বা প্রকাশ্য মহাপাপী না হওয়া), ৩. আলিম হওয়া (প্রয়োজনীয় ইল্ম থাকা, যাতে নিজে নিজে দ্বীনী প্রসিদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য কিতাবাদি থেকে সমাধান বের করতে পারেন) এবং ৪. সহীহ্ সিলসিলা, যা সংশ্লিষ্ট মুরশিদ থেকে আরম্ভ করে যোগ্য ও পরহেযগার বুযুর্গদের মাধ্যমে হুযূর-ই আক্রাম পর্যন্ত পৌঁছে, মাঝখানে যেন কোন অযোগ্য ও বাতিল আক্বীদার লোক পড়ে ওই সিলসিলা কর্তিত না হয়ে যায়। [ইরশাদাত-ই আ’লা হযরত]
আলহামদুলিল্লাহ্! হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহর মধ্যে উক্ত পূর্বশর্তগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে রয়েছে। শাহানশাহে সিরিকোটের সিলসিলাহর মাশাইখ সুন্নিয়াতের প্রবাদে পরিণত হয়েছে। এ ত্বরীক্বার মাশাইখ হযরাত নিজেরা শুধু সুন্নী নন; বরং তাঁরা সুন্নীগরও, তাঁদের প্রত্যেকে আহলে সুন্নাতের পেশোয়াও। হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলিমে দ্বীন, ক্বারী ও হাফেযে ক্বোরআন। হুযূর ক্বেবলার তাক্বরীরগুলো এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। [‘নুরানী তাকরীর’ শীর্ষক পুস্তক দ্রষ্টব্য]
শাহানশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রতিষ্ঠিত জামেয়া তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য হয়ে তাঁরই নূরানী ভাষায় আজ ‘জান্নাত নিশান’ ও ‘কিস্তিয়ে নূহ’ (যথাক্রমে, জান্নাত সদৃশ ও হযরত নূহ আলায়হিস্ সালাম-এর নৌযানসম)। ইসলামের মূলধারা ‘আহলে সুন্নাত’-এর সমাদৃত মুখপত্র ‘মাসিক তরজুমানে আহলে সুন্নাত ওয়াল জমা‘আত’ তাঁরই প্রতিষ্ঠিত। তাঁরই স্পর্শধন্য ‘আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’ আজ জামেয়াসহ সারা দেশে শতাধিক সুন্নী মাদরাসা ও অগণিত খানক্বাহ্ সুচারুরূপে পরিচালনা করছে। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ‘গাউসিয়া কমিটি’ আজ সুন্নিয়াতের শীর্ষস্থানীয় আধ্যাত্মিক সংস্থা। ইতোপূর্বে তিনি সুন্নিয়াতের বৃহত্তম অবস্থান ও ঐক্যের প্রতীক ‘জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’-এর প্রবর্তন করেছেন। উলূমে লাদুন্নিয়ার উজ্জ্বল স্বাক্ষর মাজমু‘আহ-ই সালাওয়াত-ই রসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরবর্তী সংস্করণগুলো অতি সুন্দরভাবে নিয়মিতভাবে মুদ্রিত ও প্রচারিত হবার ব্যবস্থা তিনিই করে গেছেন। নবী-ই আকরামের দুরূদ শরীফ ও প্রশংসার এ বিরল ও অনন্য গ্রন্থখানির উর্দু অনুবাদের তিনি ব্যবস্থা করে যান।
বলাবাহুল্য তাঁর বরকতময় জীবদ্দশায় উক্ত গ্রন্থের ২২ পারার উর্দু অনুবাদ সমাপ্ত হয় এবং বর্তমান হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ ও পীরে বাঙ্গাল হযরতুল আল্লামা সাবির শাহ্ দামাত বরকাতুহুমাল আলিয়ার তত্ত্বাবধানে উক্ত কিতাবের উর্দু অনুবাদ পূর্ণতা পায়। আরো সুখের বিষয় যে, হুযূর ক্বেবলা হযরতুল আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহরই বরকতময় দিক নির্দেশনা অনুসারে ওই উর্দু অনুবাদকে সামনে রেখে উক্ত কিতাবের উচ্চারণসহ বঙ্গানুবাদের কঠিন কাজটির সূচনা হয়ে বর্তমানে অনুবাদকর্ম প্রায় সমাপ্তির পথে আর আমি অধম গুনাহ্গারের সম্পাদনা ও নিরীক্ষণে উক্ত ত্রিশপারা সম্বলিত কিতাবের চতুর্দশ পারা পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে বর্তমানে পঞ্চদশ পারা এখন যন্ত্রস্থ। আশাকরি, হুযূর ক্বেবলার দো‘আ ও কৃপাদৃষ্টির বরকতে অবশিষ্ট অনূদিত পারাগুলোও যথানিয়মে মুদ্রিত হয়ে যথাসময়ে সম্মানিত পাঠক সমাজের হাতে পৌঁছে যাবে। বিশ্বের এ বিরল গ্রন্থটি একদিকে হুযূর-ই আক্রাম বিশ্বকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রশংসাপূর্ণ অতি উন্নত মানের দুরূদ শরীফ, অন্যদিকে একটি অতি উচ্চাঙ্গের আরবী সাহিত্য, পবিত্র ক্বোরআনের নির্ভুল তাফসীর, হাদীস-ই রসূলের অতি বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা, ইসলামের শীর্ষস্থানীয় ইমাম ও মনীষীগণের নির্ভুল অভিমত সম্বলিত আর ইসলামের একেবারে সঠিক ইতিহাস ইত্যাদি। আদর্শের বহুল ও অব্যাহত প্রচারের জন্য বিশুদ্ধ প্রকাশনার বিকল্প পথ নেই। তাই হুযূর ক্বেবলা সুন্নী প্রকাশনার প্রতি অত্যন্ত জোর দিতেন। আমি অধম গত শতাব্দির ৯০-এর দশকে ‘কানযুল ঈমান ও খাযাইনুল ইরফান’র ১ম পারার অনুবাদ শেষ করে হুযূর ক্বেবলা আলায়হির রাহমাহর খিদমতে দো‘আর জন্য পেশ করলে হুযূর সেটার অনুবাদ এবং প্রকাশনাও সম্পূর্ণ করার সদয় নসীহত করে দো‘আ করেন। এ দু’টি কিতাব হুযূর ক্বেবলার দো‘আর বরকতে আজ প্রায় পঁচিশ বছর যাবৎ সম্মনিত পাঠক সমাজের হাতে পৌঁছে সমাদৃত হয়ে আছে। বর্তমান হুযূর ক্বেবলার দো‘আর বরকতে ‘মিরআত শরহে মিশকাত’ও অনূদিত এবং সর্বমোট (১০ খন্ডে) প্রকাশিত হয়ে আসছে। আলহামদুলিল্লাহ্! তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী ও খলীফা বর্তমান হুযূর ক্বেবলা ও পীরে বাঙ্গাল দামাত বরকাতুমুহুল আলিয়ার নূরানী বির্দেশে প্রতিষ্ঠিত ‘আনজুমান রিসার্চ সেন্টার’-এর মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত আদর্শের গবেষণালব্ধ কিতাবাদি (গ্রন্থ-পুস্তকাদি) অব্যাহত গতিতে প্রকাশিত হয়ে আসছে।
আদর্শের স্থায়িত্ব ও নির্মল অবস্থানের গতিশীলতার জন্য উপযুক্ত বংশধর ও উত্তরসূরী তৈরীর বিকল্প নেই বললেও অত্যুক্ত হবে না। হুযূর ক্বেবলার বেলায়তী দুরদর্শিতার স্বচ্ছ দর্পণে এটা যথাযথভাবে উদ্ভাসিত ছিলো। তাই তিনি আপন মুরীদান ও ভক্তদের ছোট বড় সবাইকে সিলসিলা-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার সাথে সম্পৃক্ত থাকতে উৎসাহিত করতেন। তিনি প্রত্যেকের পরিবারের সকল সদস্যকে, এমনকি ছোট্ট শিশুদেরকেও সিলসিলার বায়‘আতে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহ্ দিতেন। তিনি এরশাদ করতেন, এতে শিশুকাল থেকেই তাদের অন্তর আলোকিত হবার সুযোগ হয়। এর ফলে ভবিষ্যতে তারা সঠিক পথে ও মতে স্থির থেকে জীবনে উন্নতির সোপানগুলো অতিক্রম করতে সুযোগ পাবে। মহামহিম আল্লাহ্, রসূল-ই আক্রাম এবং মাশাইখে কেরামের কৃপাদৃষ্টি তাদের প্রতি নিবদ্ধ থাকবে। তিনি একই কারণে, জামেয়াসহ সকল মাদরাসার ছাত্রদের দক্ষ ও সাচ্চা আলিম-ই দ্বীন হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সদয় নির্দেশ দিতেন। শাহানশাহে সিরিকোট মসলকে আ’লা হযরতের উপর জামেয়ার বুনিয়াদ স্থাপন করেছেন। এটা সুন্নীয়তের আসল রূপরেখা। হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহও এ মসলককে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাংলাদেশে সফরকালে সশরীরে মাদরাসার ক্লাস এবং শিক্ষাদান ও গ্রহণের পদ্ধতি পরিদর্শন করতেন এবং প্রয়োজনীয় ও উপকারী দিক-নিদের্শনা দিতেন। দেশের ছাত্র ও যুবকদের সুন্নী পরিবেশে রেখে সব ধরনের বাতিলের সফল মোকাবেলা করার জন্য উপযুক্ত করে তোলার প্রতি জোর তাকিদ দিতেন। সুন্নী ওলামা ও আপামর জনসাধারণকে সত্য ও ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অসত্যের অপসারণ এবং সৎ কাজের নির্দেশ ও অসৎ কাজে বাধাদান (আমর বিল মা’রূফ নাহি ‘আনিল মুনকার)-এর শিক্ষা ও দীক্ষা দিতেন। এর পরম্পরায় বর্তমান হুযূর ক্বেবলা ও পীরে বাঙ্গাল দামাত বরকাতুহুমাল আলিয়া ‘গাউসিয়া কমিটি’কে ‘দাওয়াত-ই খায়র’-এর কর্মসূচী জোরেশোরে চালু করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যা দ্রুত বাস্তবায়িত হতে চলেছে।
শরীয়ত মানুষের যাহিরকে এবং ত্বরীক্বত মানুষের বাতিনকে পরিশুদ্ধ করে। শাহানশাহে বাগদাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর অব্যর্থ শিক্ষা ও দীক্ষায় এ দু’য়ের অকল্পনীয় ফলপ্রসূ সমন্বয় সর্বজন বিদিত। শাহানশাহে বাগদাদ যেমন যুগশ্রেষ্ঠ আলিম ছিলেন, তেমনি ছিলেন ওলীকুল শিরমণি, গাউসুল আ’যম। তিনি নিজে এরশাদ করেন, ‘দারাসতুল ইলমা হাত্তা সিরতু ক্বুতবান।’ (আমি ইলমের চর্চা করতে করতে বেলায়তের অতি উচ্চাসন ক্বুত্ববিয়াতের মর্যাদায় পৌঁছে গেছি।) তিনি হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী হলেও হানাফী, শাফে‘ঈ ও মালেকী মাযহাবেরও সুদক্ষ আলিম এবং মুফতী (শরীয়তের সমাধানদাতা) ছিলেন। তাঁর সান্নিধ্য ও ওয়ায-নসীহতের প্রভাবে মানুষের হৃদয়মন শরীয়ত ও তরীক্বতের নিষ্ঠাপূর্ণ অনুসরণ ও অনুকরণের অনুপ্রেরণায় একেবারে উদগ্রীব হয়ে যেতো। তাই, তাঁরই প্রবর্বিত ‘কাদেরিয়া ত্বরীক্বা’ সারা বিশ্বে দ্রুত গ্রহণযোগ্য ও অনুকরণীয় হয়ে আসছে। আলহামদু লিল্লাহ্! শাহানশাহে সিরিকোটও এ ক্বাদেরিয়া ত্বরীক্বারই মহান মুর্শিদ। হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ হলেন তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরী। এ কারণে স্বয়ং তাঁর এবং তাঁর সুযোগ্য খলীফা ও উত্তরসূরীদের সান্নিধ্যে এসেও একজন মানুষ প্রথমে সাচ্চা মু’মিন-মুসলমান, তারপর শরীয়তের নিষ্ঠাপূর্ণ অনুসারী এবং পাকাপোক্ত সুন্নী হয়ে যান।
এ কারণে, এ যুগে যখন একশ্রেণীর শরীয়তপন্থীর তরীক্বত বিমুখতা এবং আরেক শ্রেণীর তরীক্বতপন্থীর শরয়ীত পালনে অনীহার কুফল ও নানা ক্ষতির চিত্র দেখে এবং ভুক্তভোগী হয়ে শরীয়ত ও তরীক্বতের সুন্দর সমন্বয়ের ক্বাদেরিয়া তরীকার অনিবার্য সুফল ও সাফল্যের দিকে অগণিত বিবেকবান মানুষ দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। এ একান্ত কাক্সিক্ষত বৈশিষ্ট্যাদির কারণে ‘ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়া’র সুখ্যাতি আজ বিশ্বব্যাপী। আক্বীদার বিশুদ্ধতা এবং নিষ্কলূষ আমলের শিক্ষা ও দীক্ষার জন্য, সাচ্চা দ্বীনী ইলমের আলো বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করার জন্য বিশ্বের সর্ব সাধারণ পর্যন্ত আজ শাহানশাহে সিরিকোট এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসূরী হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ ও তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী এবং খলীফা বর্তমান হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ ও তাঁরই সুযোগ্য অনুজ হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ্ তথা এ আদর্শ খান্দানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাঁদের মাধ্যমে সহীহ্ সিলসিলা ও সহীহ্ মুর্শিদ পেয়ে আজ মুসলিম উম্মাহ্ ধন্য।
শরীয়তসম্মত ‘কারামাত’ বা অলৌকিক ঘটনাবলী কারো মাধ্যমে প্রকাশ পেলে তা তাঁর বেলায়তের প্রমাণ বহন করে; যদিও তা প্রকাশ করা বা প্রকাশ পাওয়া জরুরী নয়। হুযূর সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহর বহু কারামত আজ সর্বজন বিদিত। নি¤েœ তাঁর কতিপয় কারামত উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছিঃ
এক. হুযূর ক্বেবলা স্বপ্নযোগে হজ্বের সুসংবাদ দিলেন
হাজী হাবীবুর রহমান কাদেরী পেশোয়ারী বিগত ১৯৯৪ইংরেজীর এক ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, তদানীন্তনকালীন মুখ্যমন্ত্রী হযরতুল আল্লামা পীর সাবের শাহ্ মুদ্দাযিল্লুহুল আলী হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ হুযূরের খলীফা পীরযাদা সাঈদুর রহমান সাহেবকে হজ্ব পালনের জন্য ৫০,০০০/-(পঞ্চাশ হাজার) রূপী প্রদান করলেন। তিনি তাঁর একান্ত বন্ধু হিসেবে হাজী হাবীবুর রহমান ক্বাদেরীকে হযরত পীরযাদা সাবির শাহ্ হুযূরের নিকট গিয়ে তাঁর জন্য হজের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানাতে পরামর্শ দিলেন। তিনি তা করলেন কিন্তু হযরত সাবির শাহ্ দামাত বরকাতুহুমুল আলিয়া তাঁকে বললেন, ‘এ বছরের হজ্বের সরকারী কোটা শেষ হয়ে গেছে, এ বছর আপনার হজ্জে যাওয়া সম্ভবপর হবে না।’ সুতরাং ওই বছর পীরযাদা সাঈদুর রহমান সাহেব হজ্বে গেলেও জনাব হাবীবুর রহমানের হজ্বে যাওয়া হলো না। তাই তিনি ভারাক্রান্ত মনে ঘরে ফিরে গেলেন কিন্তু এ দিকে, হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্র এক বছর পূর্বে (১৯৯৩ইং সালে) ইনতিক্বাল করলেও ওই রাতেই হাজী হাবীবুর রহমানকে স্বপ্নযোগে শান্ত¦না দিয়ে এরশাদ করলেন, ‘‘দুঃখের কোন কারণ নেই, সাঈদুর রহমান সাহেব এ বছর (১৯৯৪) হজ্বে গেছেন, আগামী বছর (১৯৯৫ইং) তোমার পালা আসছে।’’
কি আশ্চর্য! আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে, আমার আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও ওই বছর আমার হজ্বের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এটা হুযূর ক্বেবলার কারামত বৈ-আর কি? আলহামদুলিল্লাহ্!
দুই. কামিল ওলী ও পীর-মুর্শিদ গণ মানুষ ও আপন মুরীদের অন্তরের খবর জানেন
এটাও হাজী হাবীবুর রহমান পেশোয়ারী ক্বাদেরীর ঘটনা। তিনি বলেন যে, ১৯৭৯ইং সালের জুলাই মাসে তাঁর শাদী হয়। হুযূর ক্বেবলা আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ হুযূরকে উক্ত বিবাহে দাওয়াত করা হলো। হুযূর ক্বেবলা তাঁর শাহযাদা সৈয়্যদ মুহাম্মদ ক্বাসেম শাহ্ সাহেবকে সাথে নিয়ে উক্ত বিবাহ্ অনুষ্ঠানে সদয় তাশরীফ নিয়ে গেলেন। হুযূর ক্বেবলা আক্বদ পড়ালেন; দো‘আ করলেন।
কিন্তু ওদিকে তাঁদের (হাবীবুর রহমান পেশোয়ারী) মহল্লার তখনকার ইমাম সাহেব মাওলানা আবদুল হক দুঃখ ভরা অন্তরে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন। কারণ তিনি আক্বদটি পড়ালে অন্তত বিশ রুপিয়া (টাকা) পেতেন। তা থেকে তিনি বঞ্চিত হলেন। ওই সময় আক্বদ পড়ানোর হাদিয়া ওই এলাকায় বিশ রুপিয়া ছিলো। ইমাম সাহেব তখনও হুযূর ক্বেবলার বেশী পরিচিত ও ঘনিষ্ট ছিলেন না; কিন্তু হুযূর ক্বেবলা ইমাম সাহেবের অন্তরের কথা জেনে ফেলেন। তিনি আক্বদ পড়ানোর পর ইমাম সাহেবকে দু’শ রুপী দিলেন। তাকে দশগুণ বেশী হাদিয়া দিলেন। এরপর থেকে ইমাম সাহেব হুযূর ক্বেবলার ভক্ত হয়ে গেলেন এবং মাঝে মধ্যে সিরিকোট শরীফ গমন করতেন ও হুযূর ক্বেবলার সান্নিধ্য লাভ করে ধন্য হতেন। হুযূর ক্বেবলা তাকে কিছু হাদিয়া- তোহফাও প্রদান করতেন।
আরো সুখের বিষয় যে, হাজী হাবীবুর রহমানের বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেয়ার সময় বিয়ে উপলক্ষে হুযূর ক্বেবলা তার কোন কর্জ হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন। হাজী হাবীব লজ্জায় না বললেও হুযূর ক্বেবলা তাঁকে ১৪০০/- চৌদ্দশ রূপী হাদিয়া স্বরূপ দিলেন। বস্তুতঃ হাজী হাবীবের বিয়েতে তার কর্জও হয়েছিলো ১৪০০ রূপী। হুযূরকে হাজী হাবীব এক জোড়া কাপড় হাদিয়া স্বরূপ দিয়েছিলেন; কিন্তু হুযূর ক্বেবলা তার আক্বদের ফি এবং কর্জও পরিশোধ করে দিলেন। সুবহা-নাল্লাহ্! এ ধরনের আরো হাজারো কারামত প্রকাশ পেয়েছিলো হুযূর ক্বেবলার।
তিন. হক্বক্বানী পীর-মুর্শিদ আপন মুরীদের বিপদে সাহায্য করেন
বর্ণনাকারী হাজী হাবীবুর রহমান ক্বাদেরী। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, আমি ১৯৮৯ সালের একদিনের শেষ প্রান্তে ঘর থেকে আমার মুর্শিদের দরবার সিরিকোট শরীফের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে রাত ৯/১০টা হয়ে গেলো। সিরিকোট দরবার শরীফ আরো ৯/১০ কিলোমিটার দূরত্বে। চতুর্দিক অন্ধকারে ছাইয়ে রইলো। গোটা পথ জন-মানব শূন্য। মনে ভয়-ভীতি অনুভূত হওয়া স্বাভাবিক। এমতাবস্থায় একটু অগ্রসর হয়ে গুদ্ওয়ালী নামক স্থানে পৌঁছলে হঠাৎ দু’টি কুকুর আমার সাথী হয়ে গেলো। কুকুর দু’টিকে সাথে পেয়ে আমি সম্পূর্ণ ভয়ভীতি শূন্য হয়ে গেলাম; কিন্তু কি আশ্চর্য! সিরিকোট শরীফ পৌঁছা মাত্রই কুকুর দু’টি অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি আমার আগমনের কথা হুযূর ক্বেবলাকে আগে জানাইনি; কিন্তু হুযূর ক্বেবলা আমাকে দেখার সাথে সাথে বললেন, ‘‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষায় আছি।’’ আমার কুশলাদি জানতে চাইলে আমি হুযূর ক্বেবলাকে পথের অবস্থা ও কুকুর দু’টির কথা বললাম। হুযূর ক্বেবলা নিজের কারামতকে গোপন করে বললেন, ‘‘হযরাতে কেরাম আপনার হেফাযতের জন্য দু’টি কুকুর প্রেরণ করেছেন।’’ সুবহা-নাল্লাহ! এ যে হুযূর ক্বেবলার যিন্দা কারামত আর নিজের কারামতকে গোপন করার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত!
চার. হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ স্বচক্ষে প্রিয়নবীর দর্শন লাভ করেন
শাহানশাহে সিরিকোট হুযূর ক্বেবলা আলায়হির রাহমাহ্ তাশরীফ রাখছিলেন চট্টগ্রামে আলহাজ্ব ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক সাহেবের কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেস সংলগ্ন বাসায়। আর হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ ছিলেন পাকিস্তানে সিরিকোট দরবার শরীফে। একদিন হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ সিরিকোট শরীফে আপন পিতা শাহানশাহে সিরিকোটের হুজুরার দরজা খোলা দেখে ভিতরে প্রবেশ করলেন। কি দেখলেন? কী সৌভাগ্য! ওই হুজুরা শরীফে খোদ্ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সদয় হাযির। রাহমাতুল্লিল আলামীন আলায়হি আফদ্বালুস সালাওয়াতি ওয়াত্ তাসলীম হুযূর ক্বেবলাকে শুধু আপন দীদার দান করেননি; বরং তাঁকে দু’টি নির্দিষ্ট সূরা দিয়ে ‘দু’ রাক্‘আত নামায পড়তে বললেন। তিনি এ বরকতময় নির্দেশ পালন করলেন। তাঁর নামায শেষে হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ ফরমালেন, ‘‘এ দফতরে আল্লাহর ওলীগণের দায়িত্ব বন্টন করা হয়। এ গুরু দায়িত্ব এখন হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটির উপর ন্যস্ত।’’ হুযূর-ই আক্রাম এ সুসংবাদ চট্টগ্রামে অবস্থানরত হযরত সিরিকোটী আলায়হির রাহমাহকে জানিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশও দান করেছিলেন।
হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ সাহেব পুরো ঘটনা জানিয়ে চিঠি চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিলেন আলহাজ্ব আবদুল খালেক্ব ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ঠিকানায়। এ দিকে যথাসময়ে চিঠি আসলো। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব দুপুরের খানা শেষে পত্রটি হুযূর ক্বেবলা শাহানশাহে সিরিকোটের বরকতময় হাতে দিলেন। সবাই সিরিকোট শরীফের কুশলাদি জানার জন্য হুযূর ক্বেবলার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন; কিন্তু হুযূর ক্বেবলা যেন চিঠিতে উল্লিখিত বিষয়ে অবগত আছেন। তাই তিনি পত্রটি না খুলে ও না পড়ে তখন বালিশের নিচে রেখে দিলেন।
ওইদিন আসরের নামাযের পর হুযূর ক্বেবলার সাক্ষাৎ প্রার্থীদের দ্বারা দরবার শরীফ ভরপুর হলো। তখনই তিনি বালিশের নিচে থেকে পত্রটি নিতে বললেন। অতঃপর মাস্টার বদিউল আলম সাহেবকে পত্রটি খুলে পাঠ করার সদয় নির্দেশ দিলেন। পাঠান্তে যাবতীয় কুশলাদি, বিশেষতঃ উক্ত সৌভাগ্যের ঘটনা সম্পর্কে জানা গেলো। সবাই আনন্দে আত্মহারা। হুযূর ক্বেবলা হযরত সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ বললেন, ‘‘ইয়ে মুঝে মা’লূম হ্যায়’, খত্ব আপ লোগোঁকে লিয়ে হ্যায়, কেহ্ মেরে বা’দ কৌন্ আনে ওয়ালা হ্যায়, ইয়ে সমঝানে কে লিয়ে।’’ (অর্থাৎ এ সব ঘটনা আমার জানা আছে। এ চিঠি আপনাদের জন্য এসেছে, আমার পরে কে আসছে তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।’’
এ জন্যই শাহানশাহে সিরিকোট রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রায়শঃ বলতেন, ‘‘তৈয়্যব কা মাক্বাম বহুত উঁচা হ্যায়। তৈয়্যব মাদারযাদ ওলী হ্যায়। মুস্তাক্ববিল মে সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া কা কাম তৈয়্যব সাম্ভা-লেগা। তোমারে লিয়ে এক নওজাওয়ান মজবুত পাবন্দে সুন্নাত পীর কী যুরূরত হ্যায়। আওর উয়হ্ তৈয়্যব শাহ্ হ্যায়।’’ (অর্থাৎ তৈয়্যব শাহর মাক্বাম (মর্যাদাপূর্ণ স্থান) অনেক ঊর্ধ্বে। তৈয়্যব মাতৃগর্ভের ওলী। অদূর ভবিষ্যতে সিলসিলাহ-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়ার সার্বিক কার্যক্রম তৈয়্যবই পরিচালনা করবেন। তোমাদের জন্য সুন্নাতের অনুসারী একজন মজবুত (দৃঢ়চিত্ত) নওজোয়ান পীরের প্রয়োজন। আর ওই পীর হলেন তৈয়্যব শাহ্।)
হুযূর ক্বেবলা সিরিকোটি আলায়হির রাহমাহ্ আরো বলেছেন, ‘‘মাইঁ দুনিয়া কা কোণা কোণা ছান মারা। তৈয়্যব কে ‘আলাওয়াহ্ আওর কেসী কো নেহীঁ মিলা।’’ (আমি দুনিয়ার আনাচে কানাচে তালাশ করেছি; কিন্তু তৈয়্যব শাহ্ ছাড়া আর কাউকে পাইনি)।
সুতরাং একথা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হলো যে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কৃপাদৃষ্টি, হযরাতে কেরামের রূহানী ফুয়ূযাত এবং কঠোর রিয়াযত বা আধ্যাত্মিক সাধনা হুযূর ক্বেবলা হযরত তৈয়্যব শাহ্ আলায়হ্ িরাহমাহ্কে বেলায়তের বহু উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করেছে। একজন ওলী-ই কামিল এবং সাচ্ছা, কামিল ও মুকাম্মিল পীরের পক্ষে এগুলোই হচ্ছে প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
বলাবাহুল্য, ওলী-ই কামিল ও মুকাম্মিল হযরত শাহানশাহে সিরিকোটের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়িত হয়েছে। হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ শুধু সিলসিলাহর জন্য নন বরং গোটা সুন্নী তথা মুসলিম জাতির কল্যাণে অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। তাঁর বেলায়তী শক্তি, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতায় আজ গোটা সুন্নী সমাজ ও মুসলিম উম্মাহ্ ধন্য। আল্লাহ্ তাঁর দরজাতকে আরো বুলন্দ করুন।
পাঁচ. ওলী-ই কামিলের বেলায়তী শক্তির সামনে বাতিলের শক্তি পরাস্ত হতে বাধ্য
শাহানশাহে সিরিকোটের পর হুযূর ক্বেবলা তাঁর খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণের পরক্ষণ থেকে তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রতি বছর তিনি বাংলাদেশে তাশরীফ আনতে লাগলেন। দেশ-বিদেশে দলে দলে অগণিত সৌভাগ্যবান বান্দা হুযূর ক্বেবলার পবিত্র হাতে বায়‘আত গ্রহণ করে তাঁদের যাহির ও বাত্বিনকে ইসলাম, সুন্নিয়াত ও ত্বরীক্বতের আলোকে আলোকিত করে উভয় জাহানের কামিয়াবী (সাফল্য) লাভ করে ধন্য হতে থাকে। অন্য দিকে তাঁর বেলায়তী শক্তি ও দূরদর্শিতাপূর্ণ বিভিন্ন অবদানের ফলে নানাভাবে বিশেষতঃ সুন্নিয়াতের অকল্পনীয় উন্নতি সাধিত হতে থাকে। কারণ, তিনি সুন্নীয়াতের প্রশ্নে ছিলেন একেবারে ইস্পাত-কঠিন, তাই সুন্নিয়াতের অগ্রযাত্রাই ছিলো তাঁর একান্ত কাম্য। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিলো তাঁর অকৃত্রিম ও অসাধারণ খোদা ও নবী-প্রেম। আর অকৃত্রিম ভালবাসার দাবীও এটাই যে, আপন মা’শূক্ব-ই হাক্বীক্বীর শানে কারো পক্ষ থেকে বিন্দুমাত্র অশালীনতাকে বরদাশ্ত না করা। কোথাও ব্যতিক্রম দেখা দিলে সেটার প্রতিকারের স্থায়ী ব্যবস্থা করা। বাঁশখালীর শেখের খিলের মাহফিলে শাহানশাহে সিরিকোট দুশমনে রসূল (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম)-এর উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে ‘জামেয়া’ প্রতিষ্ঠা ও সিলসিলার দ্রুত প্রসারের যুগান্তকারী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরই সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে হুযূর ক্বেবলা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ ও উপমহাদেশে সুন্নিয়াত তথা ইসলামের প্রকৃত রূপরেখা ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য যুগোপযোগী যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এতে একদিকে সুন্নী মুসলমানদের গৌরব, সাহস ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাচ্ছিলো অন্যদিকে বাতিলপন্থীরা (ওহাবী, জামাতী, ক্বাদিয়ানী ও শিয়াপন্থীগং) ফুঁসে উঠছিলো।
এসব কারণে হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহ্ তখন নির্দিষ্ট কোন সিলসিলার পীর-মুর্শিদ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন না বরং তিনি তখন আপামর সুন্নী মুসলমানদের নিকট এক অবিসংবাদিত ‘পেশোয়ার’ সম্মানিত আসনে আসীন ছিলেন।
সুতরাং সকল অসুন্নী সম্প্রদায় ক্রমশঃ হুযূর ক্বেবলার বিরুদ্ধে ভিতরে ভিতরে সংঘবদ্ধ হতে হচ্ছিলো। বিগত ১৯৮৪ ইং সালে তাদের এ বিরোধিতা ও গোপন ষড়যন্ত্র এক চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। তারা অতি গোপনে বাংলাদেশের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে হুযূর ক্বেবলার এ দেশে আগমনের পথ বন্ধ করতে সম্মত করে ওই বছর যথাসময়ে হুযূর-ই ক্বেবলার এদেশে আসতে না পারার তথাকল্পিত আনন্দ উদ্যাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো; কিন্তু তাদের বিধি হলো বাম। এ দিকে আল্লাহ্ তা‘আলার গোষণা বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছিলো। মহামহিম আল্লাহ্ ঘোষণা করেছেন- মান ‘আ-দা-লী- ওয়ালিয়্যান ফাক্বাদ ‘আ-যানতুহু বিল হারব।’ অর্থাৎ (যে হতভাগা ‘আমার ওলীর সাথে দুশমনী করলো, আমি (আল্লাহ্) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম)।
বলাবাহুল্য, আল্লাহর সাথে ওইসব বাতিলের সম্মিলিত শক্তি আল্লাহর সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকাতো দূরের কথা, দুনিয়া ও আখিরাতে তাদের লাঞ্ছনাই অবধারিত হয়। হুযূর ক্বেবলা কিন্তু অনেক আগেই বলে রেখেছিলেন ওই বছর দেশের প্রেসিডেন্টের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য।
যথাসময়ে হুযূর ক্বেবলার ভিসার জন্য আবেদন করা হলে বাতিলদের ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ পায়। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তাদের ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত ছিলো। তারা জানিয়ে দিলো, এ বছর হুযূর ক্বেবলার ভিসা দেওয়া যাবে না। অর্থাৎ হুযূর ক্বেবলা তাশরীফ আনবেন না; কিন্তু আল্লাহর ওলীর তাসাররুফ বা বেলায়তী ক্ষমতার প্রয়োগ ও সাফল্য যথাসময়ে প্রকাশ পেয়েছিলো। তখন ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে পারতেন দেশের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী তদানীন্তনকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ। সুতরাং আনজুমান কর্মকর্তাগণ প্রেসিডেন্ট এরশাদ সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে হুযূর ক্বেবলার কথা বলতেই তিনি তদানীন্তনকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন যেন যথাসময়ে হুযূর ক্বেবলা এ দেশে তাশরীফ আনার ব্যবস্থা করে দেন। সুতরাং তাই হলো। সাথে সাথে হুযূর ক্বেবলার কারামতের কথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো। ওই বছর হুযূর ক্বেবলার সদারতে অনুষ্ঠিত ‘জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’-এ অংশগ্রহণকারী আশেক্বানে রসূলের সংখ্যা কল্পানাতীতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ওই বছরের জুলূস ছিলো স্মরণকালের বৃহত্তম জুলূস।
আরো সুখের বিষয় যে, পরদিন জুলূস পর্যালোচনা বৈঠকে প্রত্যেকে আপন আপন দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার কথা ব্যক্ত করলেও হুযূর ক্বেবলা বলেছিলেন, ‘‘আমি কিন্তু ‘মুত্বমাইন’ বা নিশ্চিন্ত ছিলাম।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘এ বছর নিজে না এসে হযরত তাহের শাহকে পাঠানোর কথা চিন্তা করছিলাম; কিন্তু যখনই শুনলাম যে, বাতিলপন্থীরা সম্মিলিতভাবে আমার যাবার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, তখন আমি প্রতিজ্ঞা করলাম যে, এ বছর আমাকে বাংলাদেশে যেতেই হবে।’’ সুতরাং আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীবের কৃপাদৃষ্টিতে তাই বাস্তবায়িত হলো। তা হবেও না কেন? হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে- ‘…লাউ আক্বসামা আলাল্লা-হি লা আবাররা।’ (আল্লাহ্র খাস বান্দা যখন আল্লাহর দরবারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন, তখন তিনি তা অবশ্যই পূরণ করেন)। খোদ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ ফরমান- ‘ওয়াল্লাযী-না জা-হাদূ- ফী-না- লানাহদিয়াল্লাহুম সুবুলানা-, ওয়া ইন্নাল্লা-হা লামা‘আল মুহসিনী-ন।’ (অর্থাৎ যারা আমার পথে চেষ্টা করে আমি তাদেরকে সঠিক রাস্তাগুলো বাত্লিয়ে দিই। নিশ্চয় আল্লাহ্ সৎ কর্মপরায়ণদের সাথে আছেন। সূরা আনকাবূত: আয়াত-৬৯) সুবহা-নাল্লাহ্ হুযূর ক্বেবলার প্রতিটি পদক্ষেপ যে, আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের পথে গৃহীত, আল্লাহ্ তা‘আলা যে, সর্বক্ষেত্রে তাঁকে সাফল্য দিয়েছেন, তাতে সন্দেহ কিসের?
এভাবে হুযূর ক্বেবলা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ আলায়হির রাহমাহর দরবারে এসে, তাঁর দো‘আয় অনেক নিঃসন্তান লোক ছেলে সন্তান লাভ করেছে। হুযূর ক্বেবলার বলুয়ারদীঘিপাড়স্থ খানক্বাহ্ শরীফে সদয় তাশরীফ রাখছিলেন। ওদিকে আলহাজ্ব নুর মুহাম্মদ আলকাদেরী (আলায়হির রাহমাহ)’র এক ছেলে ওই দালানোর ছাদ থেকে অসাবধানতা বশত পড়ে যাচ্ছিলো। তখন হুযূর ক্বেবলা স্বহস্তে তাকে রক্ষা করেছিলেন। এ ঘটনা কেউ কেউ স্বচক্ষে দেখেও ফেলেছিলো। হুযূর ক্বেবলা নিজেকে গোপন রেখে সওদাগর সাহেবকে বলছিলেন, ‘ঘাবরাইয়্যে মত, বাচ্ছা গির গায়া সাছ, মগর হযরাতনে পকড় লিয়া।’ (ভয় করবেন না, শিশুটি পড়ে গিয়েছিলো ঠিকই;কিন্তু হযরতগণ ধরে ফেলেছেন)।
আল্লাহর ওলীগণ কঠিন পরীক্ষারও সম্মুখীন হন; কিন্তু সব পরীক্ষায় তাঁরা অকল্পনীয়ভাবে কামিয়াব (সফল) হন। শেষ বয়সে হুযূর ক্বেবলার একটি কঠিন রোগ হয়েছিলো। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় রোগের নাম ‘লিমফোমা’ যা ক্যান্সার হতেও হাজারগুণ বেশী ভয়াবহ। বিগত ১৯৮০ ইংরেজী সালে যাহেরী চিকিৎসার সুন্নাত পালনের জন্য হুযূর ক্বেবলা লন্ডনে তাশরীফ নিয়ে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকগণ এ রোগের কারণে হুযূর ক্বেবলা আর বেশীদিন জীবদ্দশায় না থাকার কথা বললেও তিনি আরো দীর্ঘ ১৩ বছর যাহেরী হায়াত মুবারকে ছিলেন অনেকটা স্বাভাবিকভাবেই। লন্ডনে এ খবর পেয়ে চিকিৎসকগণ খোদ আশ্চর্যবোধ করেন। আর চিকিৎসাকালেই তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘তিনি একজন মহান সাধক পুরুষ।’’ এক অভিজ্ঞ নার্স তো নিঃসকোচে বলেছিলো, ‘‘আমি আমার জীবনে তাঁর মতো সাধকপুরুষ কখনো দেখিনি।’’
তরীক্বতপন্থীদের চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং এর অন্যতম প্রমাণ আল্লাহর রসূলের সাথে সাক্ষাৎ। হুযূর ক্বেবলার মুরীদানের মধ্যে একাধিক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হুযূর ক্বেবলার সাথে হজ্জে গিয়ে এবং অন্যত্র সরকারে দু’ আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দর্শন লাভ করে ধন্য হয়েছেন। এভাবে, হুযূর ক্বেবলার অনেক কারামত রয়েছে। কলেবর বৃদ্ধি এড়ানোর জন্য এ নিবন্ধে এ পর্যন্ত লিখলাম। আল্লাহ্ পাকের দরবারে অসংখ্য শোকর, তিনি আমাদেরকে এমন কামিল-মুকাম্মিল মুরশিদ দান করেছেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর দিকনির্দেশনা অনুসারে চলার এবং সবসময় তাঁর দো‘আয় ধন্য থাকার তৌফিক দিন। আ-মী-ন।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •