মৃত ব্যক্তির সমালোচনা নয় উত্তমভাবে স্মরণ করুন –
অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি >
عَنْ عائشة رضى الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لاتسبوا الاموات فانهم قد افضوا الى ماقدموا- (رواه البخارى
عن ابن عمر رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اذكروا محاسن موتاكم وكُفّوا عن مساويهم- (رواه الترمذى
অনুবাদ: উম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, তোমরা মৃতদেরকে গালমন্দ করবে না, কারণ তারা যে কর্ম করেছিল সেগুলোর কাছে তারা পৌঁছে গেছে। [বুখারী শরীফ]
হযরত ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তিদের উত্তমভাবে স্মরণ করো। তাদের মন্দ বিষয়গুলোর আলোচনা থেকে বিরত থাকো। [মিরমিযী শরীফ]
প্রাসঙ্গিক আলোচনা
মৃত্যু সত্য ও অনিবার্য বাস্তবতা। এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। সৃষ্টিকুলের মুমীন, কাফির, নেক্কার, বদকার, ছোট-বড়, রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, সৎ-অসৎ, আস্তিক-নাস্তিক, সুস্থ-অসুস্থ, সবল-দুর্বল প্রত্যেক আত্মা মরণশীল। মহান আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ করেছেন-
كل نفس ذائقة الموت وانما توفون اجوركم يوم القيامة فمن زخزح عن النار وادخل الجنة فقد فاز وماالحيوة الدنيا الامتاع الغرور- (ال عمران- ১৭৫)
অর্থ: প্রত্যেক প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। অবশ্য তোমাদের কৃতকর্মের প্রতিদান কিয়ামত দিবসে প্রদান করা হবে। যাকে দূরে রাখা হবে জাহান্নামের অগ্নি থেকে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে সে কৃতকার্য। পার্থিব জীবন প্রতারণার সামগ্রী ছাড়া আর কিছুই নয়।
[সূরা আলে ইমরান: আয়াত ১৮৫]
মৃত্যু থেকে পালাবার কোন সুযোগ নেই
দেশে বিদেশে ঘরে বাইরে রক্ষিত অরক্ষিত পৃথিবীর দিগ-দিগন্তে যে কোন প্রান্তরে মানুষ অবস্থান করুক নির্ধারিত সময়ে মৃত্যু তার জন্য অনিবার্য। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে-
اينما تكونوا يدرككم الموت ولو كنتم فى بروج مشيده- (النساء- ৭৮)
অর্থ: তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের নাগাল পাবেই। যদিও তোমরা সুদৃঢ় কিল্লায় বাস কর।
[সূরা নিসা: আয়াত- ৭৮]
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা’আলা আরো বলেছেন-
قُل اِنَّ الذى تفرون منه فانه ملاقيكم- (الجمعة- ৮)
অর্থ: হে রাসূল আপনি বলুন! যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন করছ তা তোমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেই।
[সূরা জুমআ: আয়াত- ৮]
মৃত্যুকে অধিক পরিমাণ স্মরণ করুন
মৃত্যু কারো জন্য অপেক্ষা করে না। মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুর আগমন ঘটে। এর জন্য কোন সময়, দিন-সপ্তাহ্, মাস-বৎসর নির্ধারিত নেই। কার পূর্বে কে বা কার পরে কে মৃত্যু বরণ করবে কোন নিশ্চয়তা নেই। পুত্রের পূর্বে পিতা বিদায় নিতে পারে বা পিতার পূর্বে পুত্র বিদায় নিতে পারে এক্ষেত্রে বিদায়ের ধারাবাহিকতা নেই। মৃত্যুর জন্য অসুস্থ হতে হবে এমন নয়। সুস্থ সবল সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষও আকস্মিক মৃত্যু বরণ করে, কখন কোথায় কিভাবে কার মৃত্যু হবে কেউ জানে না। এ কারণে সর্বদা মানুষের উচিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকা। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ জন্যই আমাদেরকে মৃত্যুর কথা অধিক স্মরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اكثروا من ذكر هاذم اللذات يعنى الموت- (رواه احمد والترمذى والنسائى)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন- তোমরা আনন্দ ধ্বংসকারী (মৃত্যুর স্বাদ) মৃত্যুর কথা বেশি বেশি স্মরণ করো।
[আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ]
মালাকুল মউত দৈনিক পাঁচবার উপস্থিত হয়
সকাল-সন্ধ্যা, দিবা-রাত্রি সর্বাবস্থায় মৃত্যুর ভয় অন্তরে ধারণ করতে হবে। মৃত্যু পরবর্তী অনন্তকালীন চিরস্থায়ী জান্নাত লাভের প্রত্যাশায় আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসৃত পথে নিজেদের ঈমান ও আমলকে পরিশুদ্ধ করতে হবে। ঈমান ও আক্বিদা বিনষ্টকারী বাতিল অপশক্তির সংশ্রব থেকে বিরত থাকতে হবে। ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে আউলিয়া কেরাম, বুজুর্গানে দ্বীন ও হক্কানী ওলাময়ে আহলে সুন্নাতের সান্নিধ্য অর্জন করতে হবে। দ্বীনি স্বার্থ ও দ্বীনি কল্যাণ সুরক্ষায় তাঁদের নির্দেশিত পথে মতে নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। পার্থিব জীবনের মোহ ও আকর্ষণে দ্বীনি আদর্শ থেকে বিচ্যূত হবেন না। আমাদের পূর্ববর্তীদের ন্যায় আমাদেরকেও দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিতে হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن انس بن مالك رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم فاذا وجد الانسان فقد اكله وانقطع اجله القى عليه غمّ الموت-
অর্থ: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। দৈনিক পাঁচবার প্রত্যেক বাড়ীর দরজায় মালাকুল মাউত উপস্থিত হয়। যখন কোন মানুষকে এমতাবস্থায় পায় যে, যার রিযক শেষ হয়ে গেছে, তার হায়াত নিঃশেষ হয়ে গেছে, তখন তার প্রতি মৃত্যু শোক নিক্ষেপ করেন।
এ কথা আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, প্রত্যেক সুস্থতার সাথে অসুস্থতা আছে। প্রত্যেক অস্তিত্বের সাথে নশ্বরতা আছে। অতএব, ক্ষণস্থায়ী জীবনে উত্তম কর্ম সম্পাদনের মাধ্যমে স্থায়ী জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে।
পৃথিবীতে আমরা ক্ষণস্থায়ী মুসাফির
কোনভাবেই পরকালের কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াকে স্থায়ী সুখ শান্তির ঠিকানা মনে করা যাবে না। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য পৃথিবীতে আমাদের আগমন। পরকালই আমাদের চিরস্থায়ী ঠিকানা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن عبد الله بن عمر رضى الله عنه قال اخذ رسول الله صلى الله عليه وسلم بمنكبى فقال كن فى الدنيا كانك غريب اوعابر سبيل وكان ابن عمر وخذ من صحتك لمرضك ومن حيوتك لموتك- (رواه البخارى رقم الحديث ৬৩১৬)
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরে বললেন, দুনিয়াতে তুমি এমনভাবে বসবাস করবে, যেন তুমি মুসাফির বা পথ অতিক্রমকারী।
একথার আলোকে হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন, যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হবে সকালের আশা করবে না। আর যখন সকালে উপনীত হবে সন্ধ্যার আশা করবে না। তুমি অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতার সুযোগ গ্রহণ কর। আর তুমি জীবনের সুযোগ গ্রহণ কর মরণের পূর্বে। [বুখারী শরীফ: হাদীস নম্বর ৬৩১৬]
বিপদের সময় মৃত্যু কামনা করা নিষেধ
মানুষ অনেক সময় প্রতিকুলতা, প্রতিবন্ধকতা, শত্রুতা ও জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে অস্থির হয় পড়ে এবং মৃত্যু কামনা করে। এসব কিছু আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষা স্বরূপ। ধৈর্য একমাত্র অবলম্বন। এমতাবস্থায় মৃত্যু কামনা করা নিষেধ। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن انس رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله وسلم لا يتمنين احدكم الموت بضر نزل به فانه كان لابدّ متمنيا فليقل اللهم احيينى ماكانت الحياة خيرا لى- وتوفّنى اذا كان الوفاة خيرًا لى-
অর্থ: হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যেন কখনো তার উপর অবতীর্ণ কোন বিপদ কষ্টের কারণে মৃত্যু কামনা না করে। যদি একান্তই মৃত্যু কামনা করতে হয় তাহলে সে বলবে হে আল্লাহ্! যতক্ষণ আমার জন্য জীবন মঙ্গলময় হবে ততক্ষণ আমাকে জীবিত রাখুন। এবং আমার জন্য যখন মৃত্যু অধিকতর মঙ্গলময় হবে তখন আমাকে মৃত্যু দান করুন।
[বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
মৃত ব্যক্তির জানাযায় অংশগ্রহণ করার সওয়াব
এক মুসলমানের উপর অপর মুসলমানের ছয়টি হক রয়েছে। তন্মধ্যে মুসলমান মৃত্যু বরণ করলে তার জানাযায় শরীক হওয়া পুন্যময় কাজ। এ উত্তম আমলের প্রতিদান প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم من شهد الجنازة حتى يصلى فله قيراط- ومن شهد حتى تدفن له قيرا طان- وقيل وما القيراطان قال مثل الجبلين العطمين- (متفق عليه)
অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মৃত ব্যক্তির নিকট উপস্থিত হয়ে সালাতুল জানাযা আদায় করবে তার জন্য এক কীরাত পরিমাণ সওয়াব। কবর দেওয়া পর্যন্ত যে উপস্থিত থাকবে তার জন্য দুই কীরাত সওয়াব রয়েছে। জিজ্ঞেস করা হলো দুই কীরাত কতুটুক? নবীজি এরশাদ করেন, বিশাল দুইটি পাহাড় পরিমাণ সওয়াব।
[বুখারী ও মুসলিম শরীফ]
মৃত ব্যক্তির মাগফিরাত কামনায় কবর যিয়ারত করা সুন্নাত
হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে-
عن بريدة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله وسلم كنت نهيتكم عن زيارة القبور فزورها وفى رواية ارادان يذور القبورفليزر فانها تذكّرنا الاخرة- (رواه مسلم)
অর্থ: হযরত বুরায়দা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা কবর যিয়ারত করো। কেননা কবর যিয়ারত আমাদেরকে পরকালের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। [মুসলিম শরীফ]
হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম মৃত ব্যক্তির কবর দেয়া সমাপ্ত হলে তার পাশে দাঁড়াতেন এবং বলতেন তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য মাগফিরাত কামনা করো। এবং তার জন্য দৃঢ় থাকার তাওফিক প্রার্থনা কর। কারণ তাকে এখন প্রশ্ন করা হচ্ছে। [আবু দাঊদ শরীফ]
হে আল্লাহ্! আমাদেরকে পরকালের নাজাতের জন্য উত্তম আমল করার তাওফিক নসীব করুন। আ-মী-ন।