শানে রিসালত : হুযূর-ই আকরাম দুনিয়া, আখিরাত, জিন ও ইনসান এবং আরব ও অনারবীয়দের সরদার

0
শানে রিসালত : হুযূর-ই আকরাম দুনিয়া, আখিরাত,
জিন ও ইনসান এবং আরব ও অনারবীয়দের সরদার –
মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান >

 

হুযূর-ই আকরাম দুনিয়া, আখিরাত, জিন ও ইনসান এবং আরব ও অনারবীয়দের সরদার
আল্লামা বূ-সীরী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর বিশ্ববিখ্যাত কাব্য গ্রন্থ ‘ক্বসীদা-ই বোর্দাহ্’ শরীফে লিখেছেন-
مُحَمَّدٌ سَيِّدُ الْكَوْنَيْنَ وَالثَّقَلَيْنِ – وَالْفَرِيْقِيْنِ مِنْ عُرْبٍ وَّمِنْ عَجَمِ
উচ্চারণঃ
মুহাম্মাদুন সাইয়্যেদুল কাউনাঈনি ওয়াস্ সাক্বালাঈন
ওয়াল ফারীক্বাঈনি মিন ‘উরবিওঁ ওয়া মিন আজামী।
অর্থঃ হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সরদার ও আশ্রয়স্থল দুনিয়া ও আখিরাতের সব অবস্থানকারীর, জিন ও ইনসানের এবং আরব ও অনারব উভয় দলের।
হযরত ক্বাযী আয়ায রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর বিশ্বখ্যাত কিতাব শেফা শরীফে লিখেছেন, ‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) নামটি একমাত্র হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এরই মহান নাম। হুযূর-ই আক্রামের পূর্বে আরবে অন্য কেউ এ নামে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ হয়নি; অনারবীয় কোন দেশেও হুযূর-ই আক্রামের শুভ আবির্ভাবের পূর্বে কারো এ নাম রাখা হয়নি। এমনকি, হুযূর-ই আক্রামের বেলাদত শরীফের পূর্বেই একথা প্রসিদ্ধ হয়েছিলো যে, اَنَّ نَبِيِّنَا يُبْعَثُ اِسْمُه مُحَمَّدٌ অর্থাৎ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হবেন এবং তাঁর নাম-ই পাক হবে ‘মুহাম্মদ’ (আলায়হি আফদ্বালুস্ সালাওয়াতি ওয়াত্ তাসলীম)।
অবশ্য এ কথা প্রসিদ্ধ হয়ে যাবার পর কোন কোন গোত্রের লোকেরা তাদের সন্তানদের নাম ‘মুহাম্মদ’ রাখছিলো, এ আশায় যে, যেই প্রসিদ্ধ নবী প্রেরিত হবেন, তিনি যেন তাদের ‘আওলাদ’ (সন্তানগণ) থেকেই হন; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা পবিত্র ক্বোরআন ঘোষণা দিয়েছেন, اَللهُ اَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَه (আল্লাহ্ ভাল জানেন তিনি তাঁর রিসালতকে কার মধ্যে স্থাপন করবেন। সূরা আন্‘আম: আয়াত-১২৪) অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা জানেন যে-ই মর্যাদায় তিনি আপন রসূলকে বানাবেন।
হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনেক নাম রয়েছে। ‘ইরশাদুস সারী শরহে বোখারী’ হুযূর-ই আক্রামের নাম মুবারকের সংখ্যা এক হাজার বর্ণনা করা হয়েছে। এক অভিমতানুসারে তিন শত, আরেক অভিমত অনুসারে নিরানব্বই নাম এসেছে; কিন্তু তন্মধ্যে ‘মুহাম্মদ’ নামের পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।) এ নাম সর্বাপেক্ষা উত্তম, সবচে প্রসিদ্ধ। তাছাড়া, এটা ‘মাহমূদিয়াত’ বা ‘প্রশংসিত হওয়া’র অর্থ সর্বাপেক্ষা বেশী প্রকাশ করে। এ জন্য ‘না’ত’ বা প্রশংসার ক্ষেত্রে এ নামটি বেশী প্রযোজ্য। ইমাম বূসীরী আলায়হি রাহমাহও হুযূর-ই আক্রামের এ প্রশংসাগাঁথা কবিতার পংক্তিতে এ নাম-ই পাককেই বেছে নিয়েছেন।
বাকী রইলো ‘সাইয়্যেদ’ শব্দটি ‘সাইয়্যেদ’ হওয়া উচ্চ মর্যাদার অর্থ প্রকাশেই ব্যবহৃত হয় অথবা ‘সাইয়্যেদ’ বলা হয় ওই মহান ব্যক্তিকে, يَلْجَأْ اِلَيْهِ النَّاسُ فِىْ حَوَائِجِهِمْ যাঁর নিকট লোকেরা তাদের চাহিদা বা প্রয়োজন পূরণের জন্য আশ্রয় নেয়। বস্তুতঃ হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম অপেক্ষা সৃষ্টিকুলের বড় আশ্রয়স্থল আর কে হতে পারে? আর কেউ নেই। সুতরাং হুযূর-ই আক্রাম অপেক্ষা উত্তম ‘সাইয়্যেদ’ও আর কেউ নেই।
আমাদের আক্বা ও মাওলা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ‘সাইয়্যেদুল কাউনাঈন’। ‘কাউনাঈন’ মানে দুনিয়া ও আখিরাত অথবা আলম-ই শাহাদাত ও আলম-ই গায়ব (দৃশ্য ও অদৃশ্যজগত)। দুনিয়ায় হুযূর-ই আক্রাম যে সাইয়্যেদুল কুল (সবার সরদার), তা’তো স্পষ্টই। কারণ, তিনি ‘খাতামুল আম্বিয়া’ (সর্বশেষ নবী), ‘সাইয্যেদুল মুরসালীন’ (সমস্ত রসূলের সরদার), মি’রাজ শরীফের মর্যাদা হুযূর-ই আক্রাম ছাড়া নবীগণের মধ্যে অন্য কেউ পাননি। তিনি وَمَآ اَرْسَلْنكَ اِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ (তিনি সমস্ত মানুষের প্রতি প্রেরিত)-এর মহা মর্যাদাপূর্ণ মসনদ বা আসনে সমাসীন হয়েছেন। হুযূর-ই আক্রামকেই আল্লাহ্ তা‘আলা সমস্ত নবী, রসূল, জিন ও ইনসানের সরদার করে এবং وَمَآ اَرْسَلْنكَ اِلاَّ رَحْمَةً لِّلْعلَمِيْنَ (আপনাকেই সমস্ত জগতের জন্য রহমত করে প্রেরণ করা হয়েছে)-এর তাজ (মুকুট) পরিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি সমগ্র বিশ্বের জন্য ‘রহমত’ হওয়ার কারণে কাফির-মুশরিকগণও তাৎক্ষণিকভাবে আযাব দ্বারা আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হচ্ছেনা; তাদের শাস্তিÍকে পেছানো হয়েছে। হুযূর-ই আক্রামের শহর মুবারক সমস্ত শহরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, হুযূর-ই আক্রামের মসজিদ মুবারক ‘আফযালুল মসজিদ’ (সর্বাধিক শ্রেষ্ঠ মসজিদ)। সর্বোপরি, পৃথিবীর যেই অংশটিতে হুযূর-ই আক্রাম নূর-ই মুজাস্সাম আরাম ফরমাচ্ছেন, তা কা’বা শরীফ এবং আরশ-ই মু‘আল্লা থেকেও উত্তম। হুযূর-ই আন্ওয়ারের রূহ মুবারকরূপী নূরই সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সেরা; বরং ওই সুক্ষ্ম নূরই সমস্ত নবী ও রসূলের নূর রাশির মূল ও উৎসস্থল।
হযরত আলী ও হযরত ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেন-
مَابَعَثَ اللهُ نَبِيًّا مِّنَ الْاَنْبِيَاءِ اِلاَّ اَخَذَ عَلَيْهِ الْمِيْثَاقَ لَئِنْ بُعِثَ
مُحَمَّدٌ عَلَيْهِ الصَّلوةُ وَالسَّلاَمُ وَهُوَ حَيٌّ لَيُؤْمِنَنَّ بِه وَلَيَنْصُرَنَّه
অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা কোন নবী পাঠাননি; কিন্তু তাঁর নিকট থেকে অঙ্গিকার নিয়েছেন যে, যদি তাঁর জীবদ্দশায় হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রেরিত হন, তাহলে তিনি যেন তাঁর উপর ঈমান আনে এবং তাঁকে সাহায্য করে। একথা এ আয়াত শরীফেও এরশাদ হয়েছে-
وَإِذْ أَخَذَ ٱللهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّنَ لَمَآ أَتَيْتُكُم مِّنْ كِتَابٍ وَّحِكْمَةٍ ثُمَّ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِه وَلَتَنصُرُنَّه
তরজমাঃ এবং স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্ নবীগণের নিকট থেকে তাদের অঙ্গিকার নিয়েছেন, ‘আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট ওই রসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলোর সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা নিশ্চয় তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাঁকে সাহায্য করবে।…আল-আয়াত। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত-৮১, কানযুল ঈমান।] আর পরকালেও হুযূর-ই আক্রাম সরর্দার। ক্বিয়ামতের ময়দানে ‘শাফা‘আত-ই ক্বোবরা (সর্বোত্তম সুপারিশ) তিনিই করবেন। ক্বিয়ামতবাসী পঞ্চাশ হাজার বছর দাঁড়িয়ে থেকে যখন অসহনীয় কষ্ট ভোগ করবে এবং হিসাব-নিকাশ শুরু করানোর জন্য হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আরম্ভ করে একের পর এক করে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, তখন প্রত্যেকে বলবেন, ‘আজ এখন এ মহান কাজটি আমার দ্বারা সম্ভব হবে না।’ সব শেষে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম বলবেন, ‘তোমরা শেষ যামানায় যিনি সর্বশেষ নবী ছিলেন এবং যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, তোমরা তাঁর নিকট যাও! এ কাজটি আজ এ মুহূর্তে তাঁর দ্বারাই সম্ভব হবে।’ সুতরাং হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সুপারিশ করে হাশরবাসীদেরকে ওই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। [হাদীস-ই শাফা‘আত দ্রষ্টব্য] ক্বিয়ামতের ময়দানে হুযূর-ই আক্রাম ‘মাক্বাম-ই মাহমূদ’-এ সমাসীন হবেন আর সমস্ত ক্বিয়ামতবাসী তাঁর প্রশংসা করবে। হুযূর-ই আক্রাম সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করবেন। হুযূর-ই আক্রামের উম্মতই সমস্ত নবীর উম্মতের আগে বেহেশতে প্রবেশ করবেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো হুযূর-ই আক্রাম যে, পরকালেও সরদার তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। সুতরাং আমরাই সর্বাধিক সৌভাগ্যবান যে, আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রসূলের সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হবার তাওফীক্ব দিয়েছেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে আজীবন এ মর্যাদা রক্ষা করার তাওফীক্ব দিন। আ-মী-ন।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •