রক্ত স্নাত কারবালায়
শে’রে খোদার শোণিত প্রতীক সায়্যিদা বিবি যয়নব
(রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহা)
তাহিয়্যা কুলসুম >
মহান আল্লাহর বাণী, ‘‘এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো কিছু ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং কিছু ধন-সম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ঘাটতি দ্বারা এবং সুসংবাদ শুনান ঐসব ধৈর্য্যশীলদের, যারা হচ্ছে, যখন তাদের উপর কোন বিপদ এসে পড়ে তখন বলে ‘আমরাতো আল্লাহরই মালিকানাধীন এবং আমাদেরকে তাঁরই প্রতি ফিরে যেতে হবে।’’ [সূরা বাক্বারা: ১৫৫, ১৫৬] (01. Moharram সংখ্যা ডাউনলোড করুন)
আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে মানুষকে মহান আল্লাহ্ পরীক্ষার সম্মুখীন করেন। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল এরূপ পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। প্রিয়নবীর উম্মতগণও কালে কালে তেমনিই পরীক্ষার মুখোমুখি হেয়েছে। কারবালায় নবীজীর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর যে পরীক্ষা সংঘটিত হয়েছিল, সারা বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান তা আজও ভুলতে পারেনি এবং পারবেও না। ৬১ হিজরীর ১০ মুহররম সংঘটিত সপরিবারে ইমাম হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর শাহাদাতের চেয়ে নির্মম ও হৃদয়বিধারক কোন ঘটনা সম্ভবত ইসলামের ইতিহাসে আর নেই। হক-বাতিলের দ্বন্দ্ব হিসাবে কারবালার এ অসম যুদ্ধ এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব ধারণ করেছে। সত্য প্রচার ও সুষম সমাজের গোড়াপত্তন এবং জালিমের দাসত্ব থেকে আল্লাহর এ জমীনকে মুক্ত করতেই প্রতিনিয়ত নিজেদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন সত্যের এ সেনানীরা। প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এক প্রবাদ-‘ইসলাম যিন্দা হোতা হ্যায়, হার কারবালা কে বা’দ।’ শাশ্বত এই ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে নারীর দায়িত্ববোধের জায়গাও কোন যুগে কোন অংশেই কম ছিল না। কবি নজরুলের ভাষায়-
‘জগতের যত বড় বড় জয়, বড় বড় অভিযান
মাতা, ভগ্নি, বধুদের ত্যাগে হইয়াছে মহান।’
তেমনই কারবালার মহাবিপ্লবের প্রকৃত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও কারবালার ঘটনা প্রবাহে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন এক মহিয়সী নারী, যিনি তাঁদেরই শীর্ষস্থানীয়, যাঁদের কেউ হয়েছেন বিধবা, কেউ সন্তানহারা, কেউ পিতৃহীন, কেউ ভ্রাতৃহীন, অনেকে একাধিক আপনজন হারিয়েছেন। নাম তার হযরত যয়নব বিনতে আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর ছোট বোন হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা অনন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা, খোদাভীতি, জ্ঞান, ধৈর্য্য সাহস ও বাগ্মীতার জন্য জগদ্বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর সম্পর্কিত কিছু আলোচনা বিশেষতঃ কারবালা ময়দানে তাঁর অবদানের কিঞ্চিৎ পাঠক সমীপে তুলে ধরতে চেষ্টা করা হল।
আলী-তনয়া হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার জন্মক্ষণ সম্পর্কে ঐকমত্য আছে যে, তিনি প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র হায়াতে যাহেরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তবে সঠিক সনের ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী তিনি ৫ম হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জন্মের পর হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাথে কোন বিষয়ে আলোচনায় রত ছিলেন। এমতাবস্থায় হযরত জিবরাঈল আলায়হিস্ সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরমান নিয়ে এসে বলেন, মহান আল্লাহ্ খাতুনে জান্নাতের কন্যার নাম ‘যয়নব’ নির্বাচন করেছেন। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘যয়নব’ শব্দের অর্থ সুদর্শন বৃক্ষ বা সুবাতাস। সমসাময়িককালে তিনি ‘আক্বীলা’ বা বুদ্ধিমতী নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি পিতৃ-মাতৃ উভয়কুলে হাশেমী বংশধর। তাঁর বৈশিষ্ট্য সম্পৃক্ত বর্ণনা পাওয়া যায়, ‘লজ্জাশীলতায় যিনি হযরত খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, ক্ষমাধর্মে স্বীয় মাতা, প্রাঞ্জলতায় আপন পিতা, ধৈর্য্যশীলতায় ভ্রাতা হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও ত্যাগ তিতিক্ষায় হযরত হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহর সাদৃশ্যপূর্ণ।’ হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, হযরত আলী, হযরত ফাতিমা ও দুই ভাই হযরত হাসান-হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমার সান্নিধ্যে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। যাঁর শৈশব ও বেড়ে উঠা এমন মহামনীষীদের সাহচর্যে অতিক্রান্ত, তিনি তো অবশ্যই মহীয়সীই হবেন। তিনি ৬২ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার সর্বাধিক আলোচিত ও স্মরণীয় হয়ে আছেন কারবালার যুদ্ধের পর থেকে ৬১ হিজরীতে সংঘটিত উক্ত অসম যুদ্ধে তিনি যেরূপ সাহসিকতাপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তা সত্যিই অবিস্মরণীয়। মূলতঃ কারবালা ময়দানের কয়েকটি দৃশ্যপটে তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বরূপ পরিস্ফুটিত হয়ে আছে।
দৃশ্যপট-১.
কারবালা গমনে তিনি স্বীয় পুত্র সহ ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর সঙ্গী হয়েছিলেন। স্নেহের ভ্রাতার এমন দুর্দিনে ধৈর্যের প্রতীক হযরত যয়নব ভাইয়ের কাছে এসে বলতে লাগলেন, ‘‘হায়রে, আজ যদি আমার মরণ হতো। হায়রে মা জননী ফাতেমা, আব্বাজান আলী মুর্তজা, ভাই হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু চলে গেলেন। ভাইয়া আপনি গত হয়ে যাওয়া তাঁদের স্থলাভিষিক্ত, আমাদের সংরক্ষক, আর পরম আশ্রয়। জোর-জুলুম কি আপনাকেও আমাদের থেকে ছিনিয়ে নেবে।’’ বোনের অস্থিরতা এবং বিচলিতভাব দেখে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু শঙ্কিত হয়ে পড়েন, যদি না শয়তান তাঁদের ধৈর্য্য, সম্ভম আর বিবেকবুদ্ধি লোপ করে দেয়। তিনি বোনকে সান্তনা দিলেন আর বললেন, ‘‘বোন আমার! আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর কাছে ধৈর্য্য ও শক্তি কামনা কর। জেনে রেখো! যমীনবাসী সকলেই মৃত্যু বরণ করবে, আর আসমান বাসীরাও কেউ বেঁচে থাকবে না। আমার আব্বা, আম্মা, আমার ভাই এঁরা তো আমার চেয়ে উত্তম ছিল, তাঁদের জন্য এবং প্রত্যেক মুসলমানের জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আদর্শের দৃষ্টান্ত। সে দৃষ্টান্ত থেকে ধৈর্য্যরে শিক্ষা নাও। প্রিয়বোন আমার, আমি তোমাকে শপথ দিচ্ছি, আমার এ শপথ পূর্ণ কর। শোন, আমার ওফাতের পর (অধৈর্য্য হয়ে) জামা কাপড় ছেঁড়া-ছিঁড়ি করবে না, মুখে আচঁড়ও কাটবে না, হল্লা মাতম কিংবা বিলাপ করবে না। [শামে কারবালা]
ভাইয়ের নিকট সবর ও শোকের, ধৈর্য্য নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পেয়ে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যেন আরো সাহসী ও শক্তিশালী হয়ে উঠলেন, তাইতো তিনি ফুলের মত তাঁর দুই সন্তান হযরত মুহাম্মদ এবং আউনকে স্বীয় ভ্রাতার চরণে উপহারস্বরূপ উৎসর্গ করলেন। নিজ সন্তানদের কাঁটাছেড়া লাশ দেখে ধৈর্য্যশীল মা জননী নিজ বুকে হাত রেখে বললেন, ‘‘মাওলা, তোমার সন্তুষ্টিতে আমিও সন্তুষ্ট।’’
দৃশ্যপট -২.
নিজ সন্তানদের পর পালা আসলো ভ্রাতুষ্পুত্র হযরত আলী আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর। তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এসে ভাতিজার খন্ডবিখন্ড লাশ দেখে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা অধৈর্য্য হয়ে পড়লেন, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা অবশিষ্ট রইল না। ব্যথিত-হৃদয়, বিষন্নচিত্ত এ ফুফুই যে শাহযাদা ইমাম আলী আকবরকে বড় যত্নে লালন পালন করেছিলেন। তাঁর আর্তনাদের কথা ‘শামে কারবালায়’ এভাবে বর্ণিত আছে-
‘‘প্রিয় আমার দীর্ঘকেশী লুকালে কোথায়,
বিজন দেশে ময়না আমার হারালে কোথায়?
কোথায় তোমার চোট লেগেছে দেখাও সে আমায়,
দুঃখিনী এ ফুফুর বুকে প্রাণ রাখা যে দায়!
অষ্টাদশী এই জীবনেই সমন এলো হায়,
শ্যেন পড়েছে কোন সে চোখের আমার কলিজায়?’ (অনূদিত)
ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু দুঃখিনী বোনের এ দশা দেখে তাঁর হাত ধরে তাঁবুতে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, ‘হে রাসূলের প্রিয় আহলে বায়ত, আল্লাহ্ তা‘আলা আজ তোমাদের ধৈর্য্যরে শেষ দেখতে চান, ধৈর্য্য ও সংযমের পরিচয় দাও। আজ সবকিছু কুরবানি দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে নাও।’
দৃশ্যপট-৩.
ধৈর্যশীলা যয়নবের জীবনে শোকের যেন অন্ত ছিল না। সহিষ্ণুতার সর্বশেষ সীমা তাঁকে পাড়ি দিতে হয় তখন, যখন প্রিয় ভ্রাতা হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু যুদ্ধ সামগ্রী পরিহিত অবস্থায় শেষ বিদায় জানাতে মহিলাদের তাঁবুতে এলেন। দুঃখ বেদনার নিরব প্রতিচ্ছবি সে পবিত্র মহিলাদের চোখ বেয়ে বেদনার অশ্রু মুক্তো বিন্দুর মত টপকে পড়তে লাগল। ব্যথায় নিমজ্জিত আহত কণ্ঠে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা বললেন, ‘‘ভাইয়া আপনাকে ছাড়া এবং আপনার পরে আমাদের আর বেঁচে থাকার কী অর্থ আছে? আমাদেরও আপনার সাথে নিয়ে চলুন। আপনার সাথে লড়াই করতে করতে আমরাও জীবন উৎসর্গ করে দিবো।’’ ভাই আবার বোনকে ধৈর্য্য ও সংযমের অন্তিম উপদেশ শুনালেন এবং সবাইকে শেষ বিদায় জানিয়ে তাঁবু ছেড়ে আসলেন। অভিভাবকরূপ স্নেহের ভাইকে এভাবে বিদায় জানাতে বোনকে বুকে পাথর রেখে নিঃসন্দেহে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা এই পরীক্ষায়ও সম্মুখীন হলেন।
দৃশ্যপট-৪.
হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বের হয়ে দেখলেন পুরো ময়দান ফাঁকা। সহচরদের কেউই নেই। এমতাবস্থায় বোন যয়নব বের হয়ে আসলেন। দেখলেন ভাইকে সওয়ার করিয়ে দেবার মতও কেউ নেই, শোককে শক্তিতে পরিণত করে তিনি বললেন, ‘‘রসূল-কাঁধের সওয়ারী, রেকাব ধারণের সেবায় কেউ নেই বলে নিরাশ হবেন না। রাসূলের এই নাতনী যে সেই খেদমতে হাজীর।’ এরপর নিজ হাতেই নিজের ভাইকে রণ-সজ্জায় সাজিয়ে ঘোড়ায় সওয়ার করিয়ে ময়দান অভিমুখে রওয়ানা করিয়ে দিলেন। এখানেও তাঁর সাহসিকতা ও দৃঢ় মানসিকতার প্রকাশ পায়।
দৃশ্যপট-৫.
সিজদারত অবস্থায় ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এই ধরাধাম ত্যাগ করার প্রলয়ঙ্করী দৃশ্য দেখে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা রণরঙ্গিনী মূর্তি ধারণ করেন। দৌঁড়ে এসে কঠোর ধমকে ভাইয়ের পাশে যাওয়ার জন্য হুঙ্কার ছাড়েন। ‘শামে কারবালা’য় বর্ণিত আছে-
‘দিশেহারা ছুটতে গিয়ে পড়েন বুঝি এই,
অযুত সেনায় যয়নবের আজ কুচ পরোয়া নেই।’
সৈন্যরা যে রাখল ঘিরে ইমামের ওই লাশ,
চেঁচিয়ে বলেন, ‘পথ করে দাও, যাব ভাইয়ের পাশ।
ফাতিমার এ পুত্র, আমি কন্যা যাহরার,
প্রিয় ভাইকে দেখবো আমি, এই দেখা শেষবার। [অনূদিত]
দৃশ্যপট-৬
শাহাদাতের পরদিন সকালে আহলে বায়তের অবশিষ্ট কাফেলাকে ইবনে যিয়াদের সামনে আনা হলো। এখানে ইবনে যিয়াদ তাঁদের অপদস্থ করতে চাইলে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার প্রতিবাদী সরূপ উঠে আসে। ইবনে যিয়াদ যখন হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহাকে দেখল, তো সে বলে উঠল, ‘‘সে আল্লাহর শোকর, যিনি তোমাদের লাঞ্ছিত করেছেন, তোমাদের নিহত করেছেন আর তোমাদের দম্ভোক্তিকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলেন।’’ শেরে খোদার কন্যা চুপ করে থাকেননি। প্রতিবাদী স্বরে বলে উঠলেন, ‘‘আল্লাহর শোকর, তিনি আমাদেরকে প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আওলাদ হওয়ার কারণে সম্মানিত করেছেন। তিনি আমাদেরকে তাঁর ইচ্ছা মোতাবেক পূতঃ পবিত্র করেছেন। তুমি যেমন বলছ, সেরূপ নয়। নিঃসন্দেহে দুরাচার ব্যক্তিই লাঞ্চিত হয় এবং অপরাধীরাই মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়।’’ এমন দাঁতভাঙ্গা জবাব শুনে ইবনে যিয়াদ ক্রোধান্বিত হয়ে পড়ে।
দৃশ্যপট-৭.
হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা কুফায় বন্দি অবস্থায় জনসম্মুখে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তাঁর বাগ্মীতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কুফার বাজারে তিনি যখন ভাষণ শুরু করতে যান ইবনে যিয়াদের নিয়োগ করা হাজারেরও বেশি লোক হৈ চৈ করছিল, যাতে তাঁর কথা কেউ শুনতে না পায়। হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ভাষণ দেওয়ার আগে শুধু হাত দিয়ে ইশারা করেন। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বে প্রতিটি মানুষ নিশ্চুপ হয়ে যায়। তিনি হামদ ও সালাতের মাধ্যমে ভাষণ শুরু করেন। বললেন, ‘হে কুফবাসীরা, হে বেঈমান! এখন তোমরা কান্না আর মাতম করছ? খোদা তোমাদের চিরকাল কাঁদাবেন, তোমাদের এ কান্না, আর এ মাতম কখনো থামবে না। হাসির তুলনায় তোমাদের কান্না হবে অধিক।… উক্ত ভাষণে তিনি বনু উমাইয়ার কুলাঙ্গারদের মুখোশ খুলে দেন এবং সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেন।
দৃশ্যপট-৮.
ইমাম যয়নুল আবেদীন যখন শহীদদের জন্য ভীষণভাবে শোকগ্রন্থ হয়ে পড়েন, হযরত যয়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁকে সান্ত¦না দেন। বলেন, ‘তুমি যা দেখছ, তার কারণে স্থিরতা হারিও না, আল্লাহর শপথ, তোমার বাবা ও তোমার দাদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে উপদেশ লাভ করেছেন, যেন এ প্রলয়ঙ্করী দুর্যোগের তান্ডব সহ্য করেন।’ ‘ইত্যবসরে সিরিয়ার এক দুরাচার হযরত ফাতিমা বিনতে হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার দিকে ইশারা করলে, হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঐ সিরীয়কে ভৎর্সনা করে বলে উঠলেন, ‘‘বাজে বকছিস কেন, রে কম বখত? ঐ কন্যা (শরীয়ত মতে) তোর ভাগ্যে তো দূরের, স্বয়ং ইয়াযীদের ভাগ্যেও জুটবে না।’’ এভাবে এই মহিয়সী রমণী সকলকে আগলে রেখে সান্ত¦না দিয়ে স্বীয় নেতৃত্বে পুরো কাফেলা সমেত মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
যদি প্রশ্ন করা হয়, কে কারবালার ঘটনাকে অমর করেছেন? ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কারবালার মাটিতে যে নৃশংসতা চালিয়েছিল তা মানুষের কাছে সবিস্তারে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন কে? এর উত্তর হবে ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর বোন হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা। যিনি তাঁর সাথী হয়েছিলেন মদীনা থেকে মক্কায় এবং মক্কা থেকে কারবালায়। যিনি কুফা ও শামের পথে পথে জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করেছেন এবং অজ্ঞ মানুষজনকে জাগ্রত করেছেন। মহানবীর আহলে বায়তকে মানুষের সামনে পরিচিত করেছেন। আহলে বায়তের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের যে ¯্রােত বয়ে যাচ্ছিল, তা তিনি প্রতিহত করেছেন। সকলের সামনে বনু উমাইয়ার দস্যুদের মুখোশ উম্মোচিত করেছিলেন। তিনিই সকলের সামনে তুলে ধরেছেন যে, কারবালার ঘটনা কোন ক্ষমতা দখলের লড়াই ছিল না। এটি ছিল ইসলামের প্রতিরক্ষার সংগ্রাম, মানুষের স্বাধীনতা ও মর্যাদার নীতিকে সমুন্নত করার জন্য একটি বীরত্ব গাথাঁ সর্বোচ্চ আত্ম-ত্যাগের ঘটনা। তিনি প্রচার করেছেন যে, ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের আনুগত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যা মূলত খেলাফতের মুখোশ পরিধান করেছিল। এভাবে হযরত যয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহা ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর দ্বীন রক্ষার মিশনকে সার্থক করেন। হয়তো তিনি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, তবে পরোক্ষভাবে গোটা কাফেলার নেতৃত্বদান, উৎসাহ্ প্রদান, প্রেরণা দান এবং সকলকে আগলে রেখে কারবালার অসম যুদ্ধের তাৎপর্যকে সফল করে তুলেছেন। তাঁর সাহসিকতা, দৃঢ়চিত্ততা, সহিষ্ণুতা ও শক্তি কবি নজরুলের একটি পঙক্তিতে বাঙময় হয়ে অনাগত প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেয়।
‘‘কোন কালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষী নারী।’’
[‘শামে কারবালা’র নির্বাচিত অংশ অবলম্বনে]
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।