রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর শরীয়ত প্রণয়নের ক্ষমতা

0
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর
শরীয়ত প্রণয়নের ক্ষমতা-
মাওলানা আহমদুল্লাহ ফোরকান খান কাদেরী >
আল্লাহ পাক আপন হাবীব রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে শরীয়তের বিধান প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করেছেন। কোন সর্বজনীন আইনকে ব্যক্তি বিশেষের জন্য পরিবর্তন করার অধিকারও দিয়েছেন।
ইসলামের এই স্বতঃসিদ্ধ ও মৌলিক আকীদাকে অস্বীকারকারী কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ মুসলিম সমাজে দেখা যায়। বাতিলপন্থি আলেম, বক্তা ও লেখকদেরকে এ কথাটি সবসময় বলতে শোনা যায় : ‘‘নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দায়িত্ব কেবলমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়তের বিধানাবলী উম্মতের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এছাড়া কোন বিষয়কে হালাল, হারাম, ফরজ, ওয়াজিব এমনকি সুন্নাহ সাব্যস্ত করার এখতিয়ার নবীজিকে দেওয়া হয়নি ।’’
এমনটি বলা তাফরীত তথা নবীজির মর্যাদার সংকোচন হওয়ায় নিঃসন্দেহে কুফরী আক্বীদা। এ ভ্রান্ত আক্বীদার সপক্ষে তারা কিছু মনগড়া দলীল পেশ করে । এ সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে উপস্থাপন করা হলো।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللهُ وَرَسُولُهُ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّىٰ يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَن يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ.
অনুবাদঃ ‘‘যুদ্ধ করো তাদের সাথে, যারা ঈমান আনে না আল্লাহ্র উপর ও ক্বিয়ামত দিবসের উপর এবং হারাম বলে মানে না ওই বস্তুকে, যাকে হারাম করেছেন আল্লাহ্ ও তার রাসূল, এবং সত্যদ্বীনের অনুসারী হয় না; অর্থাৎ ওই সব লোক, যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, যে পর্যন্ত নিজ হাতে জিযিয়া দেবে না লাঞ্ছিত হয়ে।”১
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ ۗ وَمَن يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُّبِينًا
অনুবাদঃ ‘‘এবং কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর জন্য শোভা পায় না যে, যখন আল্লাহ্ ও রাসূল কোন নির্দেশ দেন তখন তাদের স্বীয় ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকবে। এবং যে কেউ নির্দেশ অমান্য করে- আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের, সে নিশ্চয় সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পথভ্রষ্ট হয়েছে।”২
উপরোক্ত দুটি আয়াতের দুটি অংশের দিকে লক্ষ করুন। প্রথমটিতে বলা হলো “আল্লাহ ও রাসূল হারাম করেছেন।”
দ্বিতীয় আয়াতে বলা হচ্ছে “যখন আল্লাহ ও রাসূল কোন নির্দেশ দেন”। এ দুটি কথা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় কোন কিছুকে হারাম করার এবং কোন বিধান পালনের নির্দেশ দেওয়ার অধিকার রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ পাক নিজেই দিয়েছেন । শেষোক্ত আয়াতের শানে নুযূল দেখলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বীয় পালকপুত্র হযরত যায়দ বিন হারিসার জন্য যায়নাব বিনতে জাহশ রাদ্বিয়াল্লাহু এর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাঠালেন। যায়নাব রাদিয়াল্লাহু আনহার মা উমায়মা বিনতে আবদুল মুত্তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন নবীজির ফুফু। প্রথমে যায়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ভাবলেন নবীজি নিজের জন্যই প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তাই রাজী হলেন। পরে যখন শুনলেন যায়দের জন্য; তখন অস্বীকৃতি জানালেন। তখনি নাযিল হলো সূরা আহযাবের ৩৬ নং আয়াত। ইসলাম যে কোন বালেগা মহিলাকে স্বাধীনতা দিয়েছে কারো বিবাহের প্রস্তাব গ্রহণ করার বা না করার। তাই যায়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যায়দ বিন হারিসার বিবাহের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ প্রদত্ত এই অধিকার সর্বযুগের সকল মহিলার জন্য কিন্তু যায়নাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা-এর জন্য সে আইন রহিত করা হলো। এর একটাই কারণ এ বিবাহের প্রস্তাবক হচ্ছেন নবী-ই মুখতার সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাই এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার অধিকার ওনার নেই।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর নির্দেশ উম্মতের জন্য শরীয়ত। সেই নির্দেশ সার্বজনীন হোক কিংবা কারো একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এজন্যই উক্ত আয়াতে মৃদু ভর্ৎসনা করে বলা হলো, “কোন ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারীর জন্য শোভা পায় না যে, যখন আল্লাহ্ ও রসূল কোন নির্দেশ দেন তখন তাদের স্বীয় ব্যাপারে কোন ইখতিয়ার থাকবে।”
হাদীস শরীফেও এ বিষয়ে অসংখ্য দলীল রয়েছে
এক. হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবায় ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের উপর হজ্বকে ফরয করেছেন । অতএব তোমরা হজ্ব পালন করো।” তখন এক সাহাবী প্রশ্ন করলেন, “হজ্ব কি প্রতি বছর ফরজ?” প্রশ্নকারী কথাটি তিনবার বলার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, لو قلت : نعم ، لوجبت ولم تستطيعوا “আমি যদি হ্যাঁ বলি তবে তোমাদের উপর প্রতি বছর হজ্ব করা ফরজ হয়ে যাবে – যা করতে তোমরা সক্ষম হবে না ।”৩ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উম্মতের কষ্টের কথা চিন্তা করে প্রত্যেক বছর হজ্ব করা ফরজ করেন নি । এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হলো, নবীজির হ্যাঁ বলা এবং না বলার মাধ্যমে শরীয়তের বিধান পরিবর্তিত হতো ।
দুই. আল্লাহ তায়ালা মক্কা মুকাররমা শহরকে হারাম তথা সম্মানিত ও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে নির্ধারিত করেছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। এ দুটি শহরে সুনির্দিষ্ট কিছু কাজ করা হারাম। যা মক্কা ও মদীনা মুনাওয়ারার হেরমের সীমা ব্যতীত অন্য স্থানে বৈধ। সে বিষয়টি বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলে কারীম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করলেন, “সেখানকার ঘাস কাটা যাবে না, শিকারকে তাড়া করা যাবে না , সেখানে পড়ে থাকা কোন বস্তু উঠানো যাবে না” ইত্যাদি।
তখন হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইযখির ঘাস আমাদের স্বর্ণকারদের ও কবরগুলোর কাজে প্রয়োজন হয়। তাই ইযখির ঘাসের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা যাবে কি? তৎক্ষণাৎ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন,إلا الإذخر “ইযখির ব্যতীত।”৪ অর্থাৎ হেরমের সীমার মধ্যেও ইযখির ঘাস কাটা বৈধ করা হলো। সাহাবীর অনুরোধ ও সর্বসাধারণের প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নির্দিষ্ট প্রকার ঘাস কাটা বৈধ করলেন।
তিন. হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, لو لا ضعف الضعيف وسقم السقيم لأخرت صلاة العتمة “যদি দুর্বলদের দুর্বলতা ও অসুস্থদের অসুস্থতা না হতো (অর্থাৎ এদের কষ্টের কথা না ভাবতাম) তাহলে ইশার নামাযকে বিলম্বিত করতাম । অন্য বর্ণনায় এসেছে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্ব করে ইশার নামায আদায় করতাম ।”৫
চার. হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন,
لَوْلَا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي أَوْ عَلَى النَّاسِ لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ كُلِّ صَلاَةٍ
“যদি আমার উম্মতের জন্য কঠিন বা কষ্টকর মনে না করতাম, তাহলে প্রত্যেক নামাযের সাথে তাদেরকে মিসওয়াক করার আদেশ করতাম।”৬
অন্য বর্ণনায় এসেছে যেভাবে নামাযের জন্য উযু করা ফরয করেছি তেমনিভাবে প্রতি ওয়াক্ত নামাযের জন্য মিসওয়াক করা ফরয করতাম।
পাঁচ. হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদিন আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামার দরবারে উপবিষ্ট ছিলাম। এক ব্যক্তি এসে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি ধ্বংস হয়ে গেলাম। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার কি হয়েছে? সে বললো, আমি রোযাদার অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করে ফেলেছি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি (এর কাফফারা স্বরুপ) একটি ক্রীতদাসকে মুক্ত করে দিতে পারবে? সে বললো, না (আমার গোলাম কিনে আযাদ করার সামর্থ নেই)। নবীজি বললেন, তাহলে কি দু মাস লাগাতার রোযা রাখতে পারবে? সে বললো, না (আমার তেমন শারীরিক সক্ষমতা নেই)। নবীজি বললেন, ষাটজন মিসকিনকে (একদিনের) খাবার দিতে পারবে? সে বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! না (এতটুকু আর্থিক স্বচ্ছলতা আমার নেই)।
হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এরপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেমে গেলেন, আমরাও এ অবস্থায় ছিলাম। এ সময় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর কাছে একটি ঝুড়ি পেশ করা হল যাতে খেজুর ছিল। নবীজি বললেনঃ প্রশ্নকারী কোথায়? সে বলল, আমি। নবীজি বললেন, এগুলো নিয়ে কাউকে সাদকা করে দাও। তখন লোকটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার চাইতেও বেশি অভাবগ্রস্থকে সাদকা করব? আল্লাহ্র শপথ, মদীনার দুই সীমান্তের মধ্যে আমার পরিবারের চেয়ে অধিক অভাবগ্রস্থ কোন পরিবার নেই।
فضحك النبي صلى الله عليه وسلم حتى بدت أنيابه، ثم قال: أطعمه أهلك ” লোকটির কথা শুনে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে উঠলেন । এতে তাঁর দাঁত মুবারক দেখা গেল। এরপর তিনি বললেন, এ খেজুরগুলো তোমার পরিবারকে খাওয়াও ।”৭
ছয়. হযরত আবূ নুমান আযদী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিল এক মহিলার কাছে । রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তুমি স্ত্রীকে মোহরানা দাও। অর্থাৎ তার মোহরানা কত দিতে পারবে তা নির্ধারণ করো । সে বললো, ‘আমার কাছে কিছুই নেই’ । নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, أما تحسن سورة من القرآن فاصدقها السورة، ولا يكون لأحد بعدك مهرا ” তুমি কি কুরআন কারীমের কোন সূরা সুন্দরভাবে পড়তে পারো (বা মুখস্ত করেছো)? যদি তা পারো তাহলে সে সূরাটি বিবাহের মোহরানা হিসেবে তোমার স্ত্রীকে শিক্ষা দাও। তোমার পর আর কারো জন্য কুরআন কারীমকে মোহরানা হিসেবে নির্ধারণ করা বৈধ হবে না ।”৮
সাত. তাবেয়ী হযরত নাসর বিন আসিম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জনৈক সাহাবী থেকে বর্ণনা করেন,
أَنَّهُ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم- فَأَسْلَمَ عَلَى أَنَّهُ لاَ يُصَلِّى إِلاَّ صَلاَتَيْنِ فَقَبِلَ ذَلِكَ مِنْهُ
“জনৈক ব্যক্তি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে এই শর্তের উপর ঈমান আনলেন যে, তিনি কেবলমাত্র দুই ওয়াক্ত নামায (ফজর ও আসর) আদায় করবেন। নবীজি তার এই শর্তটি মেনে নিলেন।”৯
দেখুন কোন মানুষকে এ ধরণের শর্তসাপেক্ষে মুসলমান বানানো বা কারো জন্য কয়েক ওয়াক্ত নামাযকে শিথিল করা বৈধ নয়। কিন্তু আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা বলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম একজন ব্যক্তির জন্য এ ধরণের শর্ত মেনে নিয়েছেন।
আট. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষের জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করা হারাম ঘোষণা করেছেন। পরবর্তীতে হযরত যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও আবদুর রহমান বিন আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর জন্য রেশমী কাপড় পরিধান করার অনুমতি প্রদান করেছেন । হাদীসে পাকে এসেছে,
عَنْ أَنَسٍ قَالَ رَخَّصَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِلزُّبَيْرِ وَعَبْدِ الرَّحْمَنِ فِي لُبْسِ الْحَرِيرِ لِحِكَّةٍ بِهِمَا.
‘‘আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুবায়র রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও আবদুর রহমান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে তাদের চর্মরোগের কারণে রেশমী কাপড় পরিধান করার অনুমতি প্রদান করেছেন।”১০
নয়. কোন মুসাফির পবিত্র অবস্থায় চামড়ার তৈরী মোজা পরিধান করলে পরবর্তীতে অযু করার সময় মোজা না খুলে তিনদিন পর্যন্ত মোজার উপর মাসেহ করতে পারবে। সাহাবীর বিশ্বাস ছিল, যদি কেউ এ মেয়াদ আরো বাড়ানোর জন্য আবেদন করতেন তাহলে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাড়িয়ে দিতেন। সেই অধিকার নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আছে । এ সম্পর্কে হাদীসে পাকে এসেছে,
عَنْ خُزَيْمَةَ بْنِ ثَابِتٍ، قَالَ جَعَلَ رَسُولُ اللهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ لِلْمُسَافِرِ ثَلاَثًا وَلَوْ مَضَى السَّائِلُ عَلَى مَسْأَلَتِهِ لَجَعَلَهَا خَمْسًا ‏.‏
“খুযায়মা বিন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসাফিরের জন্য (মোজার উপর) তিন দিন মাসেহ করার মেয়াদ নির্ধারণ করেছেন। যদি প্রশ্নকারী আবেদন করতে থাকতো তাহলে তিনি হয়তো পাঁচ দিন নির্ধারণ করতেন।”১১
উক্ত হাদীস শরীফগুলো শরীয়ত প্রণয়নে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইখতিয়ার তথা ক্ষমতার দলীল। সে সাথে উম্মতের প্রতি অসীম দয়া, ইসলামের জীবন ঘনিষ্ঠতা, বাস্তবধর্মী ও মানব কল্যাণমুখী হওয়ার সুস্পষ্ট প্রমাণ।
এছাড়া আরো কয়েকটি হাদীসে পাক উল্লেখ করা হলো।
দশ. হযরত নু’মান বিন বাশীর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক বেদুঈনের কাছে থেকে একটি ঘোড়া কিনলেন। পরে ঐ বেদুঈন ঘোড়াটি বিক্রি করার কথা অস্বীকার করলো এবং প্রমাণ চাইলো । তখন সেখানে মুসলমানদের মধ্য থেকে যে আসলো এবং কথাটি শুনলো সেই তাকে ভর্ৎসনা করে বলতে লাগল,’ ধিক্কার তোমাকে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো অসত্য কথা বলতে পারেন না।’ কিন্তু কোন সাহাবী নবীজির পক্ষে সাক্ষ্য দিতে পারছিলেন না। কারণ তাঁরা কেউ বেচাকেনা করার বিষয়টি প্রত্যক্ষ করেন নি ।
এমতাবস্থায় হযরত খুযায়মা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু আসলেন। ঘটনার আদ্যোপান্ত শোনার পর বললেন, ” আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি তার কাছ থেকে ঘোড়াটি কিনেছেন।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি করে সাক্ষ্য দিচ্ছ, তুমি তো সেসময় উপস্থিত ছিলে না? (অর্থাৎ ঘোড়াটি বেদুঈনের কাছ থেকে কেনার সময় তুমি উপস্থিত না থাকার কারণে আইনানুযায়ী তোমার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়)। খুযায়মা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন সবকিছুর প্রতি আমি বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমি জানি আপনি কখনো সত্য ব্যতীত অন্য কিছুই বলতে পারেন না।” রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুশী হয়ে বললেন, مَنْ شَهِدَ لَهُ خُزَيْمَةُ أَوْ شَهِدَ عَلَيْهِ فَحَسْبُهُ ” (এখন থেকে) খুযায়মা যার পক্ষে বা বিপক্ষে সাক্ষ্য দিবে সে সাক্ষ্য যথেষ্ট হবে (অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে, আজ থেকে সব সময়ের জন্য খুযায়মার সাক্ষ্যকে দুজনের সাক্ষ্য হিসেবে গণ্য করা হবে)।”১২
এগারো. ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক পুরুষের জন্য স্বর্ণের আংটি পরিধান করা হারাম। কিন্তু রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার সাহাবী হযরত বারা বিন আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু জন্য স্বর্ণের আংটি পরিধান করা বৈধ করেছেন। হাদীসে পাকে এসেছে, “তাবেয়ী হযরত মুহাম্মদ বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত বারা বিন আযিব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাতে স্বর্ণের তৈরী আংটি দেখলাম। লোকেরা তাঁকে প্রশ্ন করলো, আপনি স্বর্ণের আংটি কেন পরিধান করছেন – অথচ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বর্ণের আংটি পুরুষের জন্য হারাম করেছেন?
বারা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু উত্তর দিলেন, একদিন আমরা নবীজির কাছে ছিলাম। তখন ওনার সামনে কিছু গনীমত রাখা ছিল। তিনি সেগুলো বন্টন করার পর একটি আংটি রয়ে গেলো। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কয়েকবার সাহাবীদের দিকে তাকালেন এবং চোখ নামিয়ে নিলেন। অবশেষে আমাকে ডাকলেন। আমি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে বসলাম। তিনি আংটিখানা নিয়ে আমাকে দিলেন। এরপর বললেন,
خذ، البس ما كساك الله ورسوله ” ধরো ,এটি তোমার আঙ্গুলে পরে নাও – যা তোমাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পরিয়ে দিলেন ।” ১৩
বারো. স্বর্ণের অলংকার সম্পর্কিত আরেকটি বর্ণনা এসেছে হযরত সুরাক্বা বিন মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সম্পর্কে একদা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুরাক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে বললেন, كيف بك إذا لبست سواري كسرى “তোমার কতই না সৌভাগ্য হবে যেদিন পারস্য সম্রাট কিসরার হাতের দুটি বাহুবন্ধনী তুমি পরিধান করবে!” ১৩
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামার ভবিষ্যদ্বানী অনুযায়ী মুসলমানরা পারস্য বিজয় করলো। পারস্য বিজয়ের পর হযরত উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কাছে কিসরার হাতের দুটি স্বর্ণের তৈরী বাহুবন্ধনী, কোমরের বেল্ট ও মুকুট উপস্থিত করা হলো।
স্বর্ণের তৈরী দেখার পরও উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটুও দ্বিধা করলেন না । তিনি অনুধাবন করলেন যদিও স্বর্ণ ব্যবহার করা পুরুষদের জন্য হারাম কিন্তু ভবিষ্যদ্বানীর মাধ্যমে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা বিশেষভাবে সুরাক্বার জন্য বৈধ করেছেন । এরপর উমার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সুরাক্বা বিন মালিক বিন জু’শুম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ডেকে বাহুবন্ধনী দুটি তাঁর হাতে পরিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার দুটি হাত উঁচু করো। এরপর বলো, الحمد لله الذي سلبهما كسرى بن هرمز وألبسهما سراقة الأعرابي ” সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি এ দুটি কিসরা বিন হুরমুযের হাত থেকে খুলে বেদুঈন সুরাক্বাকে পরিয়ে দিয়েছেন।”১৪
উপরোল্লেখিত হাদীস শরীফগুলো নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শরীয়ত প্রণেতা হওয়ার দলীল।
সে সাথে এটিও স্মর্তব্য,যে হারাম বিষয়গুলো শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তির জন্য হালাল করা হয়েছে তা সর্বসাধারণের জন্য দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা বৈধ নয়। সর্বজনীন হারামকে ব্যক্তি বিশেষের জন্য হালাল করার মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেবলমাত্র আল্লাহ পাকের বিধানাবলীর সংবাদবাহক ছিলেন না। তিনি আল্লাহ পাকের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ইসলামী শরীয়তের প্রবর্তক।
তথ্যসূত্র
১, সূরা তাওবা, আয়াতঃ ২৯
২, সূরা আহযাব, আয়াতঃ ৩৭
৩, সহীহ মুসলিম শরীফ, কিতাবুল হজ্ব, হাদীস নং ৩৩২১
৪, সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল জানাইয, হাদীস নং ১৩৪৯
৫, আল মুজামুল কাবীর, ইমাম তাবরানী রহঃ, হাদীস নং ১১৯৯৩, ৫ম খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৪৪২, প্রকাশনায়ঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, লেবানন
৬, সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল জুমুআহ, হাদীস নং ৮৮৭
৭, সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুস সাওম, হাদীস নং ১৯৩৬
৮, আল ইসাবাহ , ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী, ৪র্থ খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৬০, প্রকাশনায়ঃ মাকতাবাতু মিসর
৯, মুসনাদুল ইমাম আহমদ রহঃ, হাদীস নং ২০১৬৫, খন্ডঃ ১১শ, পৃষ্ঠাঃ ৫৪৫, প্রকাশনায়ঃ দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর
১০, সহীহ বুখারী শরীফ, কিতাবুল লিবাস, হাদীস নং ৫৮৩৯
১১, সুনানে ইবনে মাজাহ , কিতাবুত্ তাহারাতি ওয়া সুনানিহা, হাদীস নং ৫৯৬
১২, আল মুজামুল কাবীর, ইমাম তাবরানী রহঃ, হাদীস নং ৩৬৪২, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৪৫৮, প্রকাশনায়ঃ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরূত, লেবানন
১৩, মুসনাদুল ইমাম আহমদ রহঃ, হাদীস নং ১৮৫০৯, ১১শ খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ১০২, প্রকাশনায়ঃ দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর ।
১৪, দালাইলুন্ নুবুওয়াত, ইমাম বায়হাক্বী রহঃ, ৬ষ্ঠ খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৮০, প্রকাশনায়ঃ দারুল হাদীস, কায়রো, মিশর / আল ইসাবাহ, ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী (রহঃ), ২য় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ২৬ , প্রকাশনায়ঃ মাকতাবাতু মিসর ।
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাউজান দারুল ইসলাম কামিল মাদরাসা, রাউজান, চট্টগ্রাম।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •