শানে রিসালত

0
শানে রিসালত-
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান >
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পছন্দনীয় তিনটি জিনিষ।
হুযূর রহমতে আলম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, এ দুনিয়ার তিনটি জিনিসের সাথে আমার বিশেষ ভালবাসা রয়েছেঃ খুশবু, স্ত্রীগণ এবং নামায। প্রত্যেকটার বিস্তারিত বিবরণ নিন্মরূপঃ

রবিউল আউয়াল সংখ্যা ডাউনলোড করুন- https://old.anjumantrust.org/১৪৪৮-হিজরি/

খুশবু
সর্বপ্রথম জিনিষ, যার সাথে রসূল-ই আক্রামের ভালবাসা রয়েছে তা হচ্ছে খুশবু। আল্লাহু আকবার! খোদার ক্বসম আমাদের প্রিয় রসূল-ই মাকবূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপাদমস্তক শরীফ খুশবু ছিলেন। তাঁর পবিত্র শরীর থেকে মুশ্ক ও আম্বরের চেয়েও উত্তম খুশবু প্রবাহিত হতো। যে পথ দিয়ে তিনি অতিক্রম করতেন, গলিগুলো পর্যন্ত মুহাম্মদী খুশবুতে খুশবুদার হয়ে যেতো। আর লোকেরা ওই খুশবু শুঁকে শুঁকে হুযূর-ই আক্রামকে তালাশ করতেন এবং তাঁকে পেয়ে যেতেন। এ প্রসঙ্গে আ’লা হযরত আলায়হির রাহমাহ্ বলেছেন-
كيا مهكتے هيں مهكنے والے – بو په چےتِهيں بھٹكنے والے
অর্থ: এ কেমন খুশবু! কেমন ঘ্রাণ বিতরণ করছে! ঘ্রাণ নিতে নিতে পথ হারা মানুষ পথ পেয়ে যাচ্ছে।
অন্যত্র বলেছেন-
بھينى خوشبوسےمهك جاتى هےگلياں والله
كيسےپھولوں ميں بسائے هيں تمهارےگيسو
অর্থ: প্রচন্ড খুশবুতে গলিগুলো পর্যন্ত, আল্লাহরই শপথ! খুশবুদার হয়ে যায়। এ কেমন ফুলের মধ্যে চুবিয়ে রাখা হয়েছে আপনার ঝুলফি!
প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, একদিন হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে বিশ্রাম নিতে তাশরীফ এনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আর শরীর মুবারক থেকে ঘাম ঝরছিলো। আমার মা হযরত বিবি উম্মে সুলায়ম এটা দেখে হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র ঘাম মুছে মুছে একটি শিশিতে সংগ্রহ করছিলেন। হঠাৎ রহমতে আলম তাঁর দিকে ফিরলেন এবং বললেন, ‘‘উম্মে সুলায়ম! তুমি আমার এ ঘাম নিয়ে কি করবে?’’ তদুত্তরে উম্মে সুলায়ম আরয করলেন, نَجْعَلُه فِىْ طِيْبِنَا وَهُوَ اَطْيَبُ الطِّيْبِ অর্থাৎ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমরা এটাকে আমাদের খুশবুর সাথে মিশাবো। আর এ’তো স্বয়ং সমস্ত খুশবু থেকে বেশী পবিত্র ও সর্বাপেক্ষা উত্তম খুশবু। [বোখারী ও মুস্তাত্বরাফ: ২য় খন্ড, পৃ. ২৮] এ প্রসঙ্গে আ’লা হযরত বলেছেন-
والله جو مل جاۓمرے گل كا پسينه
مانگے نه كبىে عطر نه پھرچاهےدلهن پھول
অর্থ: খোদার কসম! যখন কেউ আমার ফুলের ঘাম পেয়ে যাবে, তখন থেকে সে কখনো অন্য আতর চাইবে না, কোন দুলহান পেলে সে কখনো ফুল চাইবে না।
সুতরাং হযরত আনাস সাহাবী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ওসীয়ৎ করেছিলেন; ‘‘আমি মারা যাওয়ার পর আমার শরীর ও কাফনে যেন ওই খুশবু লাগানো হয়; যার সাথে হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ঘাম মুবারক মিশানো হয়েছে।’’
[বোখারী শরীফ: ২য় খন্ড, পৃ. ৯৭৫] মোটকথা, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং ও আপাদ মস্তক শরীফ খুশবুদার ছিলেন এবং তিনি খুশবুকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি তাই বেশী পরিমাণে খুশবু ব্যবহার করতেন, আপন উম্মতকেও খুশবু ব্যবহার করার হুকুম দিতেন। এক হাদীস শরীফে এ কথাও রয়েছে যে,
لاَ تَرُدُّوْا الطِّيْبَ فَاِنَّه طَيِِّبُ الرِّيْحِ خَفِيْفُ الْمَحْمَلِ
অর্থ: খুশবুর তোহফা কেউ দিলে তা গ্রহণ করতে অনীহা প্রকাশ করোনা, কারণ, তা পবিত্র ঘ্রাণ ছড়ায় এবং খুব হালকা জিনিষ। [মুস্তাত্বরাফ: ২য় খন্ড, পৃ. ৯২]
পবিত্র বিবিগণ
এভাবে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তিনটি পছন্দনীয় জিনিসের মধ্যে দ্বিতীয় হচ্ছে- হুযূর-ই আক্রামের পবিত্র বিবিগণ। হুযূর শাহানশাহে মদীনা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজের পবিত্র বিবিগণকে এ পরিমাণ ভালবাসতেন যে, তাঁর একসাথে নয়জন বিবি, উম্মাহাতুল মু’মিনীন (মু’মিনদের মায়েরা) ছিলেন; কিন্তু কখনো তাঁদের মধ্যে হুযূর-ই আক্রামের দিক থেকে ভালবাসা ও সুন্দর আচার-ব্যবহারের ক্ষেত্রে কারো কোনরূপ অভিযোগ ছিলোনা। আর তিনি নিজের উম্মতকেও তাদের নিজ নিজ স্ত্রীকে ভালবাসা ও তাদের সাথে ভাল ব্যবহার করার তাকিদ সহকারে নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং তিনি কখনো বলেছেন- اِسْتَوْصَوْا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا (অর্থ: তোমরা তোমাদের স্ত্রীদের সাথে ভালবাসা রাখার ব্যাপারে আমার ওসীয়ৎ (তাকীদী নির্দেশ) গ্রহণ করো)! অন্যত্র এরশাদ করেছেন- خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لِاَهْلِه (তোমাদের মধ্যে উত্তম লোক তারাই, যারা নিজের ঘরের লোকজনের নিকট উত্তম হয়)।
নামায
হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট তিনটি পছন্দনীয় জিনিষের মধ্যে তৃতীয়টি হচ্ছে-নামায। আল্লাহ্ আকবার। নামাযের প্রতি হুযূর-ই আক্রামের যেই ইশক্ব ও ভালবাসা এবং আগ্রহ ছিলো, তা মুসলমান মাত্রই জানে। হুযূর খোদ এরশাদ করেছেন- جُعِلَتْ قُرَّةُ عَيْنِىْ فِى الصَّلوة (অর্থাৎ নামাযে আমার চোখের শান্তি ও শিথিলতা রাখা হয়েছে), পাঁচ ওয়াক্বতের ফরয নামায ছাড়াও, তিনি তাহাজ্জুদের নামায এবং দিনে ও রাতে অন্যান্য নফল নামায পড়তেন। পবিত্র বিবিগণ ও সাহাবা-ই কেরাম বলেছেন, ‘‘যখনই হুযূর-ই আক্রাম কোন দুঃখ ও দুশ্চিন্তার সম্মুখীন হতেন, আর কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসতো, তখনই নামাযে রত হয়ে যেতেন।
অতএব, মুসলমানদেরও উচিৎ হুযূর-ই আকরাম যেসব কাজ ও যে স্বভাব পছন্দ করতেন তা নিজেরাও গ্রহণ করে নেয়া।
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের পছন্দনীয়
জিনিসগুলোর বিস্তারিত বিবরণ
অনুরূপ, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা বলেন, সমগ্র দুনিয়ার নি’মাতগুলো ও তৃপ্তিদায়ক জিনিষগুলোর মধ্যে তিন জিনিষের সাথে আমার ভালবাসা রয়েছে-
এক. রসূলের নুবূয়তের সৌন্দর্যের দীদার
রসূল-ই পাকের সৌন্দর্য দর্শন এমন অনুপম ফযীলত ও উত্তম ইবাদত যে, বান্দাদের অন্য কোন নেক আমল তদপেক্ষা উত্তম ও উঁচু পর্যায়ের হতে পারে না। প্রথমে একথা হৃদয়ঙ্গম করা দরকার যে, কোন মুত্তাক্বী, পরহেযগার, ওলী, গাউস, ক্বুত্বব, আবদাল, ক্বুত্ববুল আক্বত্বাবও সাহাবীর মর্যাদায় পৌঁছতে পারেন না। আর সাহাবী হলেন ওই সৌভাগ্যবান মু’মিন, যিনি কমপক্ষে একবার নবী-ই আক্রামের সৌন্দর্য স্বচক্ষে দেখেছেন। তারপর ঈমানের উপরই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সুবহা-নাল্লাহ্। যদি কোন মুসলমান একবার কলেমা পড়ার পর হুযূর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম-এর চেহারা-ই পুরনূর দেখেছেন, আর অন্য কোন নেক আমল করার পূর্বে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তাহলে তাঁর মর্যাদা গাউস, ক্বুত্বব, ওলী-আবদালের চেয়ে বেড়ে গিয়েছে।
সুতরাং ভেবে দেখুন, হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের এ মাহবূব আরজু কতোই মাহবূব! কতই পছন্দনীয়! কতই প্রিয়! সুবহানাল্লাহ! তা হবেও না কেন? তিনি তো জীবনের শুরু থেকে সব সময় হুযূর-ই আক্রামের সঙ্গে আছেন। তা তাঁর নিকট প্রিয়-পছন্দনীয় কাজও। সুতরাং এ মহা পূণ্যময় কাজটি তাঁকে অনেক ঊর্ধ্বে পৌঁছিয়ে দিয়েছে গোটা জীবন শরীফ হুযূর-ই আক্রামের সাথে থাকার পর ওফাতের পরও হুযূরের সাথে আছেন। ক্বিয়ামতেও সাথে উঠবেন, জান্নাতেও হুযূর-ই আক্রামের প্রতিবেশে থাকবেন। কবি বলেন, এর বদৌলতে তিনি নুবূয়ত ব্যতীত সব ধরনের ফযীলতের অধিকারী হয়েছেন।
مرتبہ حضرت صدیق اکبرکا یہ ہے -ہرفضیلت کےوہ جامع ہیں نبوت کےسوا
অর্থাৎ হযরত সিদ্দীক্বে আকবারের মর্যাদা এযে, তিনি নুবূয়ত ব্যতীত সবগুণের অধিকারী হয়ে গেছেন।
দুই. রসূল-ই আক্রামের ক্বদম শরীফে অর্থ সম্পদ ব্যয় করা
হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্বের দ্বিতীয় পছন্দনীয় জিনিষ ছিলো রসূলে আক্রামের কদমে নিজের ধন-দৌলত উৎসর্গ করা। সুতরাং ইসলামের ইতিহাস সাক্ষী আছে যে, যেদিন সিদ্দীক্ব-ই আকবার ইসলাম গ্রহণ করেন, সেদিন তিনি চল্লিশ হাজার দিরহামের মালিক ছিলেন। তা থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার দিরহাম মক্কা মুকাররমায় বিশ্ব রহমত সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহায্য ও সমর্থনে ব্যয় করে ফেলেছেন। অবশিষ্ট পাঁচ হাজার দিরহাম নিয়ে হিজরত করেন। এ অংকের অর্থও তিনি হুযূর-ই আক্রামের কদমে বিলিয়ে দিয়েছেন।
তিন. ¯েœহের কন্যা রসূলে পাকের বিবাহাধীন হওয়া
হযরত সিদ্দীক্ব-ই আকবারের তৃতীয় আরজু কি দেখুন। তাও কি পরিমাণ মুহাব্বতে রসূলের স্বচ্ছ দর্পণ! তিনি বলেন, আমার আরেকটি পছন্দনীয় বিষয় হচ্ছে আমার চোখের মণি কলিজার টুকরা হযরত আয়েশা যেন সব সময় (আজীবন) রসূলে পাকের বিবাহাধীন থাকে। তাছাড়া, সিদ্দীক্ব-ই আকবারের প্রতিটি কাজ দেখলেই একথা সুস্পষ্টভাবে ধারণা হবে যেন, তিনি আপাদমস্তক ইশ্ক্বে রসূল-এ নিমজ্জিত। এমন ইশক্বে রসূল প্রতিটি ঈমানদারের থাকা চাই! আল্লাহ্ তা সবাইকে দান করুন। আ-মী-ন।
হযরত ওমর ফারূক্বে আযমের তিনটি পছন্দনীয় বস্তু
এক ও দুই. সৎকাজের নির্দেশ দেওয়া ও অসৎকাজে বাধা দেওয়া। লক্ষ্য করুন! হযরত ফারূক্ব-ই আ’যমের পছন্দনীয় এ দু’টি কাজ এমনই গুরুত্ববহ যে, এ দু’টি কাজকে খোদ্ আল্লাহ্ তা‘আলা উম্মত-ই মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করেছেন। এ আখেরী উম্মতের মাথায় ‘খায়রুল উমাম’ (সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত)-এর মুকুটটি পরানো হয়েছে। আর এর পরিচিতি হচ্ছে- এ দু’টি কাজ। যেমন এরশাদ হচ্ছে-
کُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّۃٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُوْنَ
بِالْمَعْرُوْفِ وَتَنْھَوْنَ عَنِ الْمُنْکَرْ
(হে আমার হাবীবের উম্মত!) তোমরা হলে সমস্ত উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ উম্মত। আর তোমাদের পদবী হচ্ছে তোমরা আল্লাহর বান্দাদেরকে ভাল কাজের নির্দেশ দাও এবং মন্দ কার্যাদি থেকে বিরত রাখো। [সূরা আ-লে ইমরান, আয়াত-১১০]
তিন. পুরানো পোশাক পরিধান করা
হযরত ফারূক্ব-ই আ’যমের তৃতীয় পছন্দনীয় জিনিষ পুরানো কাপড়। বর্ণিত আছে যে, হযরত ফারূক্ব-ই আ’যমের লুঙ্গি মুবারকেও সাত সাতটি পর্যন্ত তালি লাগানো থাকতো। নিজেতো পুরানো কাপড় পরতেন; কিন্তু রসূলে পাকের উম্মতকে প্রতিদিন নতুন নতুন কাপড় পরাতেন। আর তিনি কোন মুসলমানকে বস্ত্রহীন কিংবা ক্ষুধার্ত দেখা পছন্দ করতেন না। খোদা ওয়ান্দে ক্বুদ্দুস এমন পরোপকারীদের প্রশংসা করে এরশাদ করেছেন- وَیُؤْثِرُوْنَ عَلٰی اَنْفُسِھِمْ وَکَانَ بِھِمْ خَصَاصَۃٌ (নুবূয়ত প্রদীপের উপর প্রাণোৎসর্গকারী পতঙ্গদের এটা অতি বড় আলামত যে, তাঁরা নিজেরা দারিদ্র ও নিঃস্বতার যিন্দেগী অতিবাহিত করতেন, অন্যদেরকে নিজের সত্তার উপর প্রাধান্য দিতেন। অর্থাৎ খোদ্ ক্ষুধার্ত থাকেন, অন্যদেরকে খাইয়ে দেন। নিজেরা ছেঁড়া-পুরানা কাপড় পরিধান করেন, অন্যদেরকে নতুন কাপড় পরিয়ে দেন!
মোটকথা, হযরত ফারূক্ব-ই আযমের এ তিনটি পছন্দনীয় বস্তুও বড় প্রশংসিত। সুতরাং যারা ফারূক্ব-ই আযমকে ভালবাসবে, তাঁরাও যেন এসব সদ্গুণ নিজের মধ্যে অর্জন করে।
হযরত ওসমান গণীর পছন্দনীয় তিন জিনিস
১. ক্ষুধার্তদের আহার করানো, ২. বস্ত্রহীনদেরকে বস্ত্র পরানো এবং ৩. ক্বোরআন-ই করীমের তিলাওয়াত করা।
এক. ক্ষুধার্তদের আহার করানো
এ কাজ অত্যন্ত সাওয়াবের। কত সাওয়াবের তা পবিত্র ক্বোরআনের আলোকে দেখুন! আল্লাহর ওইসব নৈকট্যধন্য বান্দা, যাঁদেরকে ক্বোরআন মজীদে ‘আবরার’ (নেক্কার) বলা হয়েছে, তাঁদের শানে বিশ্ব প্রতিপালক এরশাদ করেছেন- وَيُطْعِمُوْنَ الطَّعَامَ عَلى حُبِّه مِسْكِيْنًا وَيَتِيْمًا وَاَسِيْرًا অর্থাৎ লোকেরা ওই খাদ্যকে ভালবাসা সত্ত্বেও তা নিজেরা খায়না বরং মিসকীন, ইয়াতীম ও কয়েদীকে খাওয়ায়। [সূরা ইনসান: আয়াত-৮] তাঁদের জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে। এরশাদ হয়েছে- جَزَاُهُمْ بِمَا صَبَرُوْا جَنَّةٌ وَحَرِيْرًا (তাদের এ ধৈর্যের প্রতিদান হচ্ছে জান্নাত ও রেশমী কাপড়।  [সুরা ইনসান: আয়াত- ১২]
দুই. বস্ত্রহীনকে কাপড় পরানো
হযরত ওসমান গণীর দ্বিতীয় প্রিয় জিনিষ বস্ত্রহীনদের বস্ত্রদান। এটাও ক্ষুধার্তকে আহার করানোর মতো অতি বড় সাওয়াবের কাজ। মিশকাত শরীফের হাদীসে আছে, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ ফরমান-
اَيُّمَا مُسْلِمٍ كَسَا مُسْلِمًا ثَوْبًا عَلى عُرْىٍ كَسَاهُ اللهُ مِنْ خُضْرِ الْجَنَّةِ
অর্থ: যে মুসলমান কোন উলঙ্গ মুসলমানকে কাপড় পরাবে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরাবেন।
[মিশকাত শরীফ: ফদ্ব্লুস সাদক্বাহ্]
তিন. ক্বোরআনের তিলাওয়াত
হযরত ওসমান গণী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর তৃতীয় পছন্দনীয় কাজ হচ্ছে ক্বোরআন মজীদের তিলাওয়াত। ক্বোরআন-তিলাওয়াতের সাওয়াব সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
اَلْجَنَّةُ تُشْتَاقُ اِلى اَرْبَعَةِ نَفَرٍ تَالِى الْقُرْانِ وَمُطْعِمِ
الْجِيْعَانِ وَحَافِظِ اللِّسَانِ وَالصَّآئِمِ فِىْ شَهْرِ رَمَضَانَ
অর্থাৎ সব লোক তো জান্নাত পেতে আগ্রহী থাকে; কিন্তু চার ব্যক্তি এমন খোশ নসীব যে, স্বয়ং জান্নাত তাদেরকে পেতে চায়। তারা হলেন- ক্বোরআন তিলাওয়াতকারী, ক্ষুধার্তদের খাবারদাতা, নিজেদের রসনাকে হারাম খাদ্য ও অনর্থক কথাবার্তা থেকে রক্ষাকারী এবং রমযান মাসের রোযা পালনকারী। সুতরাং আমরাও যদি এসব পছন্দনীয়, কাজকে আমাদের নিকট পছন্দনীয় কাজ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তবে আমাদের সাফল্যও অনিবার্য।
মাওলা-ই কাইনাত হযরত আলীর পছন্দনীয় বস্তুগুলো
তিনি বলেন, আমার নিকটও দুনিয়ার তিনটি জিনিষ পছন্দনীয়ঃ
এক. মেহমানদের খিদমত-সমাদর করা, দুই. গ্রীষ্মকালের রোযা এবং তিন. জিহাদে তরবারি চালনা করা।
মেহমানদের সমাদর
এটা হুযূর-ই আকরামের এমন পছন্দনীয় সুন্নাত, যা সম্পর্কে হুযূর-ই আক্রাম এরশাদ করেছেন,
مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْاخِرِ فَلْيُكْرِمْ ضَيْفَه
অর্থ: যে ব্যক্তি ঈমান রাখে আল্লাহর উপর এবং শেষ দিনের উপর সে যেন তার অতিথির সমাদর করে। [মিশকাত: বাবুদ্ব দ্বিয়াফাহ্] প্রতীয়মান হয় যে, অতিথিপরায়ণতা ঈমানের বৈশিষ্ট্যাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি মু’মিন হবে, সে অবশ্যই অতিথিপরায়ণ হবে।
গ্রীষ্মকালের রোযা
এমনিতে রোযা রাখা বড় নেক কাজ, এতদ্সত্ত্বেও গ্রীষ্মকালে রোযা রাখা, গরমের চোটে সৃষ্ট পিপাসার কষ্ট সহ্য করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এমতাবস্থায় ধৈর্যধারণ করার ফযীলত কত বেশী হবে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনার অপেক্ষা রাখেনা। এজন্য রোযাদারদের জন্য ‘রাইয়্যান’ (সুশীতল, পরম আরামদায়ক) বেহেশত নির্দ্ধারিত।
জিহাদে তলোয়ার চালানো
অনুরূপ, জিহাদে খোদার দ্বীনের মর্যাদার পতাকাকে উড্ডীন করা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তলোয়ার চালানোর ফযীলত সম্পর্কে কে অনুমান করতে পারেনা? হাদীস শরীফে তো এ পর্যন্ত বর্ণিত হয়েছে যে, যে কদম জিহাদে ধূলিময় হয়েছে, ওই কদমের উপর জাহান্নামের আগুন হারাম। অপর এক হাদীসে এরশাদ হয়েছে-
اِنَّ فِى الْجَنَّةِ مِأَةُ دَرَجَةٍ اَعَدَّهَا اللهُ لِلْمُجَاهِدِيْنَ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَآءِ وَالْاَرْضِ
অর্থ: নিশ্চয় জান্নাতে একশ’টি মর্যাদার স্তর এমন রয়েছে, যেগুলোকে আল্লাহ্ তা‘আলা বিশেষ করে আল্লাহর রাহে জিহাদকারীদের জন্য তৈরী রেখেছেন। ওই একশ’ স্তরের মধ্যে প্রত্যেক দু’ স্তরের মধ্যভাগে ততটুকু ব্যবধান, যতটুকু যমীন ও আসমানের মধ্যে রয়েছে। জিহাদের অগণিত ফযীলত সর্বজন বিদিত। এ কারণে মাওলা-ই কাইনাতের তিনটি পছন্দনীয় কাজের মধ্যে একটি হলো- জিহাদে তলোয়ার চালনা করা।
হযরত জিব্রাঈলের তিনটি পছন্দনীয় বস্তু
তিনি এমন তিনটি বিষয়কে বিশেষভাবে পছন্দ করেন, যেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীমঃ ১. পথভ্রষ্টদের সৎপথে আনা কিংবা সৎপথ দেখানো, ২. আল্লাহর আনুগত্যকারী মুসাফিরদের মনোরঞ্জন এবং ৩. অর্থ সংকটগ্রস্ত পরিবার-পরিজন বিশিষ্টের সাহায্য করা বস্তুত: এ তিনটি হচ্ছে এমন ‘মালাকূতী সেফাত ও খাসাইল’ (ফেরেশতাসূলভ গুণাবলী ও চরিত্র), যেগুলো অনুসারে যদি মুসলমানগণ আমল করতে থাকে, তবে ইসলামী সমাজের শোভা-সৌন্দর্যের ওই সূর্য পুনরায় সাড়ম্বরে চমকিত হয়ে ওঠবে, যার উপর দীর্ঘ দিন যাবৎ স্বার্থপরতা, মন্দ কার্যাদি, মুনাফিক্বী, বে-দ্বীনীর মেঘমালা ছাইয়ে এসেছে; মুসলমানদের অবস্থাদির এ পরিবর্তন দেখে সারা বিশ্ব অবাক বা হতভম্ব হয়ে যাবে।
আল্লাহ্ জাল্লা শানুহুর পছন্দনীয় তিন বস্তু
এভাবে আল্লাহ জাল্লা শানুহুর নিকট বান্দাদেরকে তিনটি চরিত্র বৈশিষ্ট খুব পছন্দনীয়, সেগুলোও মু’মিনদের উভয় জগতের সাফল্য ও উভয় জগতের সৌভাগ্যের এমন পুঁজি, যার উপমা পাওয়া যায় না। ওই বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে-
এক. নিজের শক্তি-সামর্থ্য খোদার রাহে ব্যয় করা
এটা এমন চরিত্র-সৌন্দর্য, যা হাজারো পছন্দনীয় চরিত্রের ধারক। তা হচ্ছে- বান্দার মধ্যে যতটুকু শক্তি ও সামর্থ্য থাকবে, ওইসব শক্তি ও সামর্থকে আল্লাহর পথে ব্যয় করা; চাই আর্থিক সামর্থ্য হোক কিংবা দৈহিক সামর্থ্য হোক, অথবা জ্ঞানগত ও আমলগত সামর্থ্য হোক কিংবা মননগত সামর্থ্য হোক। বস্তুতঃ বান্দা খোদা প্রদত্ত অগণিত শক্তি-সামর্থ্যরে সমাবেশস্থল। তার শরীরের প্রতিটি পেশী ও লোমে রয়েছে শক্তি ও সামর্থ্যরে ভান্ডার। সুতরাং বান্দা যখন তার সমস্ত শক্তি ও সামর্থ্য খোদার রাহে ব্যয় করবে, তখন নিশ্চিতভাবে সে নানা ধরনের ইবাদত ও আনুগত্যের এক পবিত্র সুন্দর ফুলদানি হয়ে যাবে। আর তার উপর খোদার রহমত ও দানের এমন বৃষ্টি বর্ষিত হতে থাকবে, যে, ওই বান্দা দুনিয়া ও আখিরাতে খোদার বান্দা হবার সাথে সাথে খোদার মাহবূবেও পরিণত হবে।
দুই. লজ্জিত হয়ে ক্রন্দন করা
বান্দাদের দ্বিতীয় চরিত্র, যা আল্লাহর দরবারে অত্যন্ত পছন্দনীয়, তা হচ্ছে লজ্জিত হয়ে ক্রন্দন করা। অর্থাৎ বান্দা যদি কোন গুনাহ্ করে বসে, তবে ওই গুনাহর জন্য লজ্জিত হয়ে তাওবা করা, আর তাওবার সময় তার উপর লজ্জিত হবার আগ্রহ বিজয়ী হবে এবং আল্লাহর ভয় ও আতঙ্ক তার হৃদয়ের উপর এমন প্রভাব ফেলবে যে, আহাজারি ও কান্নার সাথে তার দু’চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকবে। এমন কান্নাকাটি আল্লাহর দরবারে এতই পছন্দনীয় যে, এ অশ্রুর বিনিময়ে আল্লাহর রহমতের সমুদ্র বয়ে যায় এবং মুহূর্তের মধ্যে তার গুনাহর দফতর (রেজিষ্ট্রার)কে ধুয়ে মুছে পাক-সাফ করে দেয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
مَنْ ذَكَرَ اللهُ خَالِيْقًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ
অর্থ: যে ব্যক্তি একাকীত্বে আল্লাহকে স্মরণ করে, তার চোখ থেকে পানি বের হয়, এমন সৌভাগ্যবানকে পরওয়ারদিগারে আলম ক্বিয়ামতের উত্তাপ ও প্রখর রোদে আপন আরশের ছায়ার নিচে জায়গা দান করবেন।
অনাহারে ধৈর্যধারণ
বান্দাদের তৃতীয় চরিত্র বৈশিষ্ট্য, যা মহামহিম আল্লাহর দরবারে বেশী পছন্দনীয়, তা হচ্ছে-দারিদ্র ও অনাহার-অর্দ্ধাহারের অবস্থায় ধৈর্যধারণ করা। ধৈর্যশীলদের বড়ত্ব ও মহত্বের জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কি হতে পারে।’ মহান রব ক্বোরআন-ই করীমে এরশাদ করেছেন- اِنَّ اللهَ مَعَ الصَّابِرِيْنَ (নিশ্চয় আল্লাহ্ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন)। খোদ্ আল্লাহ্ যাদের সাথে আছেন, যাদের তিনি সাহায্য-সহযোগিতা করেন, যাদের প্রতি তাঁর অবারিত রহমত ও দান থাকে, সারা দুনিয়ায় তাঁদের সমকক্ষ কিংবা মোকাবেলা কে করতে পারে? ধৈর্যধারণ করা বস্তুত: সম্মানিত নবী ও রসূলগণেরই সবিশেষ বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ্ তা‘আলা ক্বোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন-
فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرُ اُولُوْا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ
তরজমা: হে মাহবূব! আপনি ওইভাবে ধৈর্যধারণ করুন, যেভাবে উলুল ‘আযম (সুদৃঢ়-প্রতীজ্ঞ) রসূলগণ ধৈর্য ধারণ করেছেন।
পরিশেষে, এ দীর্ঘ ‘হাদীস-ই সালাস’-এর আলোকে সর্বমোট ২১টি এমন স্বভাব, কাজ বা বস্তুর সবিস্তার আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে তিনটিকে খোদ্ আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু, তিনটিকে আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম, তিনটিকে ‘নবী-রসূলগণের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ সত্তা হযরত আবূ বকর সিদ্দীক্ব, তিনটিকে ফারূক্বে আ’যম হযরত ওমর, তিনটিকে যুন্নূরাঈন হযরত ওসমান, তিনটিকে হায়দার-ই কাররার হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম এবং তিনটিকে ফেরেশতাকুল সরদার হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম সবিশেষ পছন্দ করেছেন। সুতরাং যে বান্দার মধ্যে এ ধরনের গুণাবলী বিশেষভাবে থাকবে ওই বান্দা নিঃসন্দেহে আল্লাহ্-রসূলের দরবারে প্রিয় ও মাকবূল হবেন। আল্লাহ্ আমাদেরকে তাওফীক দিন! আ-মী-ন। বিহুরমাতে সাইয়্যিদিল মুরসালীন, আলায়হি আফদ্বালুস্ সালাওয়া-তি ওয়াত্ তাসলীম।

 

লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •