মুহাজির-আনসার সাহাবাগণ বিশ্বের সর্বপ্রথম ও শ্রেষ্ঠতম মুসলিম
হাফেয কাজী আবদুল আলীম রিজভী
আল্লাহ্র নামে আরম্ভ, যিনি পরম দয়ালু, করুণাময়
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمنِ الرَّحِيْمِ
لِلْفُقَرَاءِ الْمُهَاجِرِينَ الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ وَأَمْوَالِهِمْ يَبْتَغُونَ فَضْلًا مِنَ اللهِ وَرِضْوَانًا وَيَنْصُرُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ ۚ أُولَٰئِكَ هُمُ الصَّادِقُونَ وَالَّذِينَ تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِنْ قَبْلِهِمْ يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً مِمَّا أُوتُوا وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنْفُسِهِمْ وَلَوْ كَانَ بِهِمْ خَصَاصَةٌ ۚ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
তরজমা ঃ ওই দরীদ্র হিজরতকারীদের জন্য (কাফেরদের পরিত্যক্ত এ সম্পদ) যাদেরকে আপন ঘরবাড়ী ও সম্পদ থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তারা (অর্থাৎ মুহাজিরগণ) আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি চায় এবং আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্য করে। তারাই সত্যবাদী। আর যারা (অর্থাৎ আনসারগণ) তাদের পূর্বে (অর্থাৎ মুহাজিরগণের আগমনের) মদিনায় বসবাস করেছিল এবং ঈমান আনয়ন করেছিল তারা ভালবাসে তাদেরকে যারা তাদের প্রতি হিজরত করে এসেছে এবং নিজেদের অন্তর সমূহের মধ্যে কোন প্রয়োজন খুঁজে পায় না (অর্থাৎ কোনরূপ ঈর্ষা পোষণ করে না।) ওই বস্তুর যা তাদেরকে (অর্থাৎ মুহাজিরকে) প্রদান করা হয়েছে এবং নিজেদের প্রাণের উপর তাদের কে প্রাধান্য দেয়, যদিও তাদের অভাব অত্যন্ত প্রকট হয়। এবং যাকে আপন প্রবৃত্তির লোভ থেকে রক্ষা করা হয়েছে। সুতরাং তারাই সফলকাম। এবং ওই সব লোক যারা তাদের (অর্থাৎ আনসার-মুহাজিরগণের) পরে এসেছে তারা আরজ করে হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে ক্ষমা করো এবং আমাদের ওই ভ্রাতাগণকেও ক্ষমা করো যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আমাদের অন্তরে ঈমানদারগণের দিক থেকে হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় তুমি অতি দয়াপরবস, দয়ালু। [৮,৯ ও ১০নং আয়াত, সূরা আল হাশর]
আনুষঙ্গিক আলোচনা
শানে নুযুল ঃ উদ্ধৃত নয় নম্বর আয়াতের শানে নুযুল বর্ণনায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-আলোচ্য আয়াতখানা মদীনাবাসী আনসার সাহাবীগণের ফজিলত ও শ্রেষ্ঠত্ব, বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য এবং দ্বীন প্রতিষ্ঠায় তাদের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষার বর্ণনায় অবতীর্ণ হয়েছে। একদা আল্লাহর নবীর দরবারে এক মিসকিন প্রচন্ড ক্ষুধার্ত অবস্থায় আগমন করলে আল্লাহর হাবীব সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন- من يضيف هذا অর্থাৎ কে এই ব্যক্তির আতিথ্য গ্রহণ করবে? সাহাবীয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবীর আহ্বানে সাড় দিয়ে লোকটিকে ঘরে নিয়ে আসলেন। স্ত্রীর কাছে জানতে পারলেন- ঘরে ছেলেদের জন্য সামান্য খাবার ব্যতীত আর কিছুই নেই। হযরত আবু তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বিবিকে বললেন-কোন বাহানায় ছেলেদেরকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুম পাড়িয়ে দাও। আর রাতে খাবার গ্রহণের সময় হলে কৌশলে বাতি নিভিয়ে বাসন-পেয়ালার নাড়াচাড়ার শব্দ করবে। সুতরাং তাই করা হল। অন্যদিকে নবীর মেহমানকে তৃপ্তি সহকারে আহার করিয়ে তুষ্ট করলেন। এভাবে পুরো পরিবার অভুক্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাত অতিবাহিত করলেন। তাঁদের এ ত্যাগের প্রসঙ্গে অত্র আয়াত নাযিল হল। সকাল বেলায় হযরত আবু তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবীর দরবারে এলে আল্লাহর রাসূল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন-আবু তালহা! আল্লাহপাক তোমাদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। অতঃপর আয়াতখানা তেলাওয়াত করে শুনালেন। [ছহীহ বুখারী শরীফ ও তাফসীরে নুরুল ইরফান]
পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের প্রশংসিত গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠত্ব
পবিত্র কুরআনে করীমের সূরা আল হাশর এর ৮নম্বর আয়াতে মুহাজির ও ৯নম্বর আয়াতে আনসার সাহাবায়েকেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমের বিভিন্ন প্রশংসনীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা দিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। যদ্বারা বিশ^বাসীর সম্মুখে তাঁদের অতুলনীয় মর্যাদা-মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিভাত হয়। যথা ঃ
প্রথমত ঃ মুহাজির সাহাবীগণের গুণাবলী ঃ মুহাজির সাহাবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম স্বদেশ ও সহায়সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত হয়েছেন। তাঁরা মুসলমান ও রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের সমর্থক ও সাহায্যকারী শুধু এই অপরাধে মক্কার কাফিররা তাঁদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মাতৃভুমি, ধন-সম্পদ ও বাস্তুভিটা ছেড়ে হিজরত করতে বাধ্য হন। দ্বিতীয়ত ঃ يبتغون فضلا من الله ورضوانا অর্থাৎ মুহাজির সাহাবীরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম কোন জাগতিক স্বার্থের বশবর্তী হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেননি। কেবল আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টিই তাঁদের কাম্য ছিল। মহান আল্লাহর এহেন স্বীকৃতিতে তাঁদের পূর্ণ আন্তরিকতা প্রমাণিত হয়।
তৃতীয়ত ঃ ينصرون الله و رسوله অর্থাৎ মুহাজির সাহাবীরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম আল্লাহ ও রাসূলের সাহায্য করার জন্যই উপরোক্ত ত্যাগ-তিতীক্ষাসহ সবকিছু করেছেন।
চতুর্থতঃ اولئك هم الصادقون অর্থাৎ তাঁরা নিজেদের ঈমান-আক্বিদা, আমাল-ইবাদাতে সত্যবাদী। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনের স্বীকৃতি-মুহাজির সাহাবীগণ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। এই আয়াতে সকল মুহাজির সাহাবীকে চরম সত্যবাদী বলে দৃপ্তকন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি তাঁদের কাউকে মিথ্যাবাদী বলে, সে এ আয়াতের অস্বীকারকারী হিসাবে আর মুসলমান হতে পারে না। (নাউজুবিল্লাহ) যেমন, রাফেজী ফেরকা।
আনসার সাহাবীগণের বৈশিষ্টাবলী
পবিত্র মদীনাবাসী আনসার সাহবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম প্রথমত تَبَوَّءُوا الدَّارَ وَالْإِيمَانَ مِن قَبْلِهِمْ অর্থাৎ যে শহর মহান আল্লাহর নিকট ‘দারুল হিজরত’ ও ‘দারুল ঈমান’ তথা ঈমান-ইসলামের কেন্দ্র হওয়ার ছিল তাতে তাঁদের অবস্থান ও বসতি স্থাপন মুহাজিরগণের পূর্বেই ছিল। মুহাজিরগণের এখানে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্বেই তাঁরা ঈমান কবুল করে পাকা-পোক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তাঁরা يُحِبُّونَ مَنْ هَاجَرَ إِلَيْهِمْ অর্থাৎ তাঁদেরকে ভালবেসে যারা হিজরত করে তাদের শহরে আগমন করেছেন। এটা দুনিয়ার সাধারণ মানুষের রুচীর পরিপন্থী। সাধারণত, লোকেরা এহেন ভিটা-মাটিহীন দুর্গত মানুষকে স্থান দেয়া পছন্দ করেনা। কিন্তু আনসার সাহাবীগণ কেবল তাঁদেরকে স্থানই দেয়নি, বরং নিজ নিজ গৃহে তাঁদেরকে পুর্ণবাসন করেছেন, ধন-সম্পদে অংশীদার করেছেন এবং অভাবনীয় সম্মান-সম্ভ্রমের সাথে তাঁদের কে স্বাগত জানিয়েছেন। (তাফসীরে মাযহারী শরীফ)।
তৃতীয়ত ঃ وَلَا يَجِدُونَ فِي صُدُورِهِمْ حَاجَةً অর্থাৎ নবীর পক্ষ থেকে সহায়-সম্পদের বিলি-বন্টনে মুহাজিরগণকে যা কিছু দেয়া হলো, আনসার সাহাবীগণ সানন্দে তা মেনে নিলেন। যেন তাঁদের এসব জিনিসের কোন প্রয়োজন ছিলনা।
চতুর্থত ঃ وَيُؤْثِرُونَ عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ অর্থাৎ আনসার সাহাবীগণ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম নিজেদের উপর মুহাজিরগণকে অগ্রাধিকার দিতেন। নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর আগে তাঁদের প্রয়োজন মেটাতেন। যদিও নিজেরাও অভাবগ্রস্থ ও দরিদ্র-প্রপীড়িত ছিলেন। فَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ অর্থাৎ মহান আল্লাহ স্বীকৃতি দান করলেন-এহেন গুণাবলী সম্পন্ন আনসার সাহাবীগন দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানে সফলকাম।
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ
উদ্ধৃত আয়াতের মর্মবাণীর ব্যাখ্যায় মুফাসসেরীনে কেরাম উল্লেখ করেছেন-‘সূরা হাশর’ ৮,৯ ও ১০ পরপর তিন আয়াতের মর্মবাণীর আলোকে প্রমাণিত হয়-মহান আল্লাহ কেন উম্মতে মুহাম্মদীকে তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। যথাক্রমে-মুহাজির, আনসার এবং পরবর্তী সকল মুসলমান। ৮ ও ৯ নম্বর আয়াতে মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের বিশেষ গুণাবলী ও শ্রেষ্ঠত্ব উল্লেখিত হয়েছে। উপরোক্ত ১০ নম্বর আয়াতে পরবর্তী সকল মুসলমানের গুণাবলীর মধ্য থেকে মাত্র একটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে যে- তারা সাহাবায়ে কেরামের ঈমান আনয়নে অগ্রগামীতা এবং তাদের কাছে ঈমান-ইসলাম পৌছানোর মাধ্যম হওয়ার বিষয়কে সম্যক উপলব্ধি করে তাদের জন্যও এ দোয়া করা- হে আল্লাহ! আমাদের অন্তরে কোন মুসলমানের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না।
উপরোক্ত আয়াতের মর্মার্থের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, পরবর্তী সকল মুসলমানের ঈমান-ইসলাম ও আমল-ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হযরত সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম এর মাহাত্ম ও ভালবাসা অন্তরে পোষণ করা এবং তাঁদের জন্য দোয়া করা। যার মধ্যে এ শর্ত অনুপস্থিত সে মুসলমান রূপে পরিচিত হওয়ার যোগ্য নয়। এ কারনেই হযরত মুসাব বিন সা’দ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন- উম্মতের সকল মুসলমান তিন শ্রেণিতে বিভক্ত। তাদের মধ্যে দুই শ্রেণি তথা মুহাজির ও আনসার অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এখন সাহাবায়ে কেরামের প্রতি মহব্বত পোষণকারী এক শ্রেণি বাকি আছে। তোমরা যদি উম্মতের মধ্যে কোন আসন কামনা কর তবে এই তৃতীয় শ্রেণিতে দাখিল হয়ে যাও। ইমাম কুরতবি রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন আলোচ্য আয়াতের আলোকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরামের প্রতি ভালোবাসা রাখা আমাদের জন্য ওয়াজিব।
সাইয়্যেদুনা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেছেন- মহান আল্লাহ সকল মুসলমানকে সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম-এর জন্য এস্তেগফার ও দোয়া করার নির্দেশ দিয়েছেন। অথচ আল্লাহ জানতেন যে, তাঁদের পরষ্পর যুদ্ধ-বিগ্রহ হবে। তাই তাঁদের পারষ্পরিক বাদানুবাদের কারণে তাদের মধ্য থেকে কারও প্রতি মন্দ ধারণা পোষণ কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নেই। উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন- আমি তোমাদের নবীর পবিত্র যবানে শুনেছি-এই উম্মত ততদিন ধ্বংস প্রাপ্ত হবেনা, যতদিন তাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের অভিশাপ ও ভৎর্সনা না করে। [তাফসীরে কুরতুবি শরিফ]
লেখক: অধ্যক্ষ-কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা, মুহাম্মদপুর এফ ব্লক, ঢাকা।