ছবি তোলা ও ভাষ্কর্য নির্মাণ সম্পর্কে শরীয়তের ফয়সালা

0
ছবি তোলা ও ভাষ্কর্য নির্মাণ সম্পর্কে শরীয়তের ফয়সালা –
মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ অছিয়র রহমান >
[ভাষ্কর্য নির্মাণ, ছবি তোলা বৈধ না হারাম, বর্তমানে এ বিষয়ে মিডিয়া ও প্রচার মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা চলছে। ইসলামী শরিয়ত তথা ক্বোরআন-সুন্নাহর দৃষ্টিকোণে ও ফিক্বহ্ ফতোয়ার আলোকে উপরোক্ত বিষয়ে শরয়ী ফয়সালা প্রদত্ত হলো। যাতে বিভ্রান্তি নিরসন হয়। মুসলিম মিল্লাত ফিতনা-ফ্যাসাদ হতে মুক্তি পায়।]
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-
لاَ تَدْخُلُ الْمَلآَئِكَةُ بُيُتًا فِيْهِ كَلْبٌ وَلاَ صُوْرَةٌ
অর্থাৎ রহমতের ফেরেশতা ওইসব ঘরে প্রবেশ করেননা, যাতে কুকুর ও ছবি থাকে। [ছহি বুখারী-হাদিস নং-৫৩২২] এ হাদীস ছাড়াও ছবি সম্পর্কিত অপরাপর হাদীসের আলোকে ছবি অঙ্কন করা বা ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তোলা সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রাণীর ছবি অঙ্কন বা তোলাকে সাধারণভাবে নিষেধ করেছেন। কিন্তু কতেক ওলামা যেসব ছবির শরীর ও ছায়া নেই সেসব ছবিকে বৈধ বলেছেন। তারা নি¤েœাক্ত হাদীসকে তাঁদের সমর্থনে পেশ করেন। যেমন-
عَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ عَنْ اَبِىْ طَلَحَةَ صَاحِبِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَنَّهٗ قَالَ اَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اِنَّ الْمَلآَئِكَةَ لاَتَدْخُلُ بُيُتًا فِيْهِ صُوْرَةٌ قَالَ بُسَرٌ ثُمَّ اشْتَكى زَيْدٌ فَعدنَاهُ فَاِذَا عَلى بَابِهِ سَتَرٌ فِيْهِ صُوْرَةٌ قَالَ فَقُلْتُ لِعُبَيْدِ اللهِ الْخَوْلاَنِىْ ربيب ميمونة زوج النَّبِىُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اَلَمْ يَخْبَرْنَا زَيْدٌ عَنِ الصُّوْرِ يَوْمَِ الْاَوَّلُ فَقَالَ عُبَيْدُ اللهِ اَلَمْ تَسْمَعَه حِيْنَ قَالَ اِلَّا رَقَمَا فِىْ ثَوْبٍ [بخارى جلد ৪৮৫ ـ ج ـ ২, ৮৮১ص] অর্থাৎ যায়েদ ইবনে খালেদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন যে, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের সাহাবী হযরত আবূ তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন- রসূলূল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে, যে ঘরে ছবি থাকে তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করে না। (বর্ণনাকারী বলেন) বুসর বলেছিলেন, হযরত যায়েদ অসুস্থ হলে আমরা তাঁকে দেখতে গেলাম, তখন তাঁর ঘরের দরজায় ছবি ওয়ালা পর্দা দেখতে পাই। আমি ওবায়দুল্লাহ্ খাওলানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, যায়েদ আমাদেরকে কি পূর্বে ছবি থেকে নিষেধ করতেন না? হযরত ওবায়দুল্লাহ্ বললো, তুমি কি শুননি যে, তিনি কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবিকে পূর্বের হুকুম থেকে পৃথক করে থাকেন। অর্থাৎ কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবিকে তিনি অসুবিধা মনে করেন না। [বুখারী, ১ম খন্ড-পৃ. ৪৮৫, ২য় খন্ড, পৃ.-৮৮১] আল্লামা নববী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এ হাদীসের ব্যাখ্যায়ে লিখেছেন যে-
هذَا يَحْتَجُ بِه مَنْ يَقُوْلُ باباحة مَا كَانَ رَقَمُا مُطْلَقًا
যারা মুতলাক বা সাধারণভাবে কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবির বৈধতা বলে থাকেন তারা এ হাদীসকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। [ইমাম নববী, শরহে মুসলিম, ২য় খন্ড, পৃ. ৬০০] ইমাম ইবনে হাজর আসকালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-
اِنَّ مَذْهَبَ الْحَنَابَلَةِ جَوَازُ الصُّوْرَةِ فِى الثَّوْبِ وَلَوْ كَانَ مُعَلَّقًا عَلى مَافِىْ خَبَرَ اَبِىْ طَلْحَةَ لَكِنْ اِنْ ستَرَ بِهِ الْجِدَار مَنَعَ عِنْدُهْمُ قَالَ النَّوَوِىْ وَذَهَبَ بَعْضُ السَّلْفِ اِلى اَنَّ الْمَمْنُوْعَ مَا كَانَ لَه ظِلٌّ لَه وَمَالاَظِلَّ لَه فَلاَ بَأْسَ بِاتِّخَاذَه مُطْلَقًا
অর্থাৎ হাম্বলী মাযহাব মতে সাধারণভাবে কাপড়ের উপর অঙ্কিত ছবি বৈধ। যা আবু তালহার হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। অবশ্য যদি ওই ছবি দিয়ে দেয়ালে পর্দা দেয়া হয় তবে তা তাঁরা নিষেধ করেন। আল্লামা নববী বলেন- পূর্ববর্তী কতেকের মাযহাব এ ছিলো যে, যেসব ছবির ছায়া নেই তা বানানো সাধারণভাবে বৈধ। আর যেসব ছবির ছায়া আছে তা নিষিদ্ধ। [ফতহুল বারী, শরহে ছহি বোখারী, ১০ম খন্ড, পৃ. ৯২] হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম শুরুর দিকে ছবি তৈরী করা ও সংরক্ষণ করাকে নিষেধ করেছিলেন; কিন্তু পরবর্তীতে নকশাকৃত বা অঙ্কিত ছবির ব্যাপারে অনুমতি দেয়ার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেছেন-
وَاِنَّمَا نَهَى الشَّارِعَ اَوَّ لاً عَنِ الصُّوْرِ كُلِّهَا وَاِنْ كَانَتْ رَقَمًا لِاَنَّهُمْ كَانُوْا حَدِيْثِىْ عَهْدِ بِعبَادَةِ الصُّوْرِ فَنَهَى عَنْ ذلِكَ جُمْلَةً ثُمَّ لِمَا تَقررنهيه عَنْ ذلِكَ اباح مَا كَانَ رَقَمًا فِى الثَّوَبِ لِلضُّرُوْرَةِ ـ
অর্থাৎ শারে’ আলাইহিস্ সালাম প্রথম দিকে প্রত্যেক ধরনের ছবি তৈরীকে নিষেধ করেছেন, যদিও তা কাপড়ের উপর নকশাকৃত হোক না কেন। কেননা ওই সময় লোকেরা ছবির ইবাদত করতে অভ্যস্থ ছিল। এ জন্য সাধারণভাবে নিষেধ করেছেন। আর যখন ওই নিষেধাজ্ঞার কারণ উঠে যায় তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রয়োজন বশতঃ কাপড়ের উপর নকশাকৃত বা অঙ্কিত ছবির অনুমতি দেন। [আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী, ওমদাতুল ক্বারী, খন্ড-২১, পৃ. ৭৪] হাদীসের মধ্যে এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেখা যায়, যেমন, হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আপন উম্মত কবর পূজার প্রতি ধাবিত হওয়ার আশঙ্কায় প্রথম দিকে কবর জিয়ারতকে নিষেধ করেছিলেন। যখন মুসলমানদের অন্তরে তাওহীদের বা আল্লাহর একত্ববাদ সুদৃঢ় হয়ে যায় তখন আবার কবর জিয়ারতের অনুমতি দেন। তেমনি ইসলামের প্রাথমিক যুগে লোকদের মধ্যপানের অভ্যস্থতার কারণে ওইসব পাত্রের ব্যবহারও নিষেধ করে দেন; যা দ্বারা মধ্যপান করা হতো। পরে মুসলমানরা যখন মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করলো তখন ওইসব পাত্র ব্যবহারও বৈধ হয়ে যায়।
অতএব, উপরোক্ত বিশ্লেষণ দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হলো যে, পূর্ববর্তীদের কেউ কেউ এবং হাম্বলীরা মুতলাক বা সাধারণভাবে শরীর বিহীন (গায়রে মুজাস্সাম) ছবি অঙ্কন করা বৈধ বলে মত পোষণ করেন। আর মালিকীদের মধ্যে বিশেষতঃ আল্লামা কুরতবী, শাফেয়ীদের মধ্যে আল্লামা ইবনে হাজার আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি শরীর বিহীন ছবির ব্যাপারে বৈধতার পক্ষে রায় দেন। আর আমাদের হানাফীদের মধ্যে বিশেষতঃ আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী রহমাতুল্লাহি আলায়হিও শরীর বিহীন ছবিকে প্রয়োজন বশত! বৈধ বলে মত পোষণ করেন। অবশ্যই ফক্বীহ্গণ শরীর সমেত (মুজাস্সাম) ছবিকে হারাম বলেছেন। (যেমন-কারো মূর্তি/ভাস্কর্য তৈরী করা) আর যেসব ফক্বীহ্ বিশেষ প্রয়োজনে শরীর বিহীন (গায়রে মুজাসসাম) ছবির বৈধতার পক্ষে মত দিয়েছেন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসাযোগ্য- এ জন্য যে, তাঁরা ছবি হারাম হওয়ার সঠিক কারণ অনুসন্ধান করেছেন আর প্রয়োজনে শরীরবিহীন ছবির অনুমতি দিয়েছেন। কারণ, আজকের যুগে হজ্ব, উমরা, বিদেশ ভ্রমণ, চাকুরী, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ইত্যাদিতে রেকর্ড ও চ্যালেঞ্জের জন্য ছবির প্রয়োজন হচ্ছে। তাই এসব ক্ষেত্রে ছবি তোলা, সংরক্ষণ করা অবৈধ হতে পারে না। কারণ, এসব প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ছবি তোলা ও সংক্ষরণ করা যদি হারাম বা মাকরূহে তাহরীমী বলা হয় তবে দ্বীনের সঙ্কীর্ণতা ও কঠোরতা অবধারিত হয়। অথচ আল্লাহ্ ও তাঁর হাবীব সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের ব্যাপারে কোন সঙ্কীর্ণতা ও কঠোরতা রাখেনি। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন-وَ مَا جَعَلَ عَلَیْكُمْ فِی الدِّیْنِ مِنْ حَرَجٍؕ-অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের উপর দ্বীনের সঙ্কীর্ণতা বা কঠিনতা রাখেননি। [সূরা হজ্ব, আয়াত-৭৮]
আরো বলা হয়েছে-یُرِیْدُ اللّٰهُ بِكُمُ الْیُسْرَ وَ لَا یُرِیْدُ بِكُمُ الْعُسْرَ-
অর্থাৎ আল্লাহ্ তোমাদের সাথে সহজতর ইচ্ছা পোষণ করেন আর কঠিনতর ইচ্ছা করেন না। [বাক্বারা, আয়াত-১৮৫] হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে,اَحَبُّ الدِّيْنِ اِلَى اللهِ الْحَنِيْفِيَّةُ السمحة
অর্থাৎ আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় দ্বীন হলো তা, যা সত্য ও সহজ। [বুখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ১০] আরো এরশাদ হচ্ছে-
وَعَنْ اَنَسِ بْنِ مَالِكٍ يَقُوْلُ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَسِّرُوْا وَلَاتُعَسِّرُوْا [صحيح مسلم ـ جلد ـ ৩ـ صفحه৮ ৩] অর্থাৎ হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, হুযুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, লোকের জন্য সহজ কর আর তাদের উপর কঠোর করো না। তাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের কারণে বিশেষ প্রয়োজন বশতঃ ছবি তোলা ও সংরক্ষণ করা ইত্যাদি বৈধ। যা যুগের চাহিদাও। তাই প্রত্যেক যুগের ফক্বীহ্, মুফতি, কাজী ও আলিমগণ যুগের চাহিদার প্রেক্ষিতে শরয়ী মাসআলার সমাধান দিয়েছেন। তাই আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি লিখেছেন-
فَلَا بُدَّ لِلْمُفْتِىْ وَالْقَاضِىْ بَلْ وَالْمُجْتَهِدِيْنَ مَعْرِفَةُ اَحْوَالِ النَّاسِ وَقَدْ قَالُوْا وَمَنْ جَهَلِ باهل زَمَانِه فَهُوَ جَاهِلٌ
অর্থাৎ মুফতি, কাজী এবং মুজতাহিদগণের জন্য স্বীয় যুগের হাল ও অবস্থা জানা জরুরী। কারণ ফক্বীহগণ বলেছেন যে, যে স্বীয় যুগের চাহিদা ও অবস্থা জানা থেকে অজ্ঞ সে নিরেট মূর্খ। [রাসায়েলে ইবনে আবেদীন, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৬, লাহোর হতে প্রকাশিত] অবশ্য সম্মানার্থে বা মুহাব্বতের প্রেক্ষিতে কোন পীর-বুযুর্গ বা যে কোন ব্যক্তির ছবি তোলা ও প্রদর্শন করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কারণ ছবি হারাম হওয়ার মূলে হলো গায়রুল্লাহর সম্মান ও ইবাদত। যদি লোকেরা প্রাণীর ফটোকে সম্মান ও ইবাদত শুরু করে দেয় তবে এটা অবশ্য হারাম।
আরো উল্লেখ্য যে, ইমাম আবু জাফর তাহাবী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ছবির মুখ্য অংশ মাথার অংশ। যে ছবির মাথার অংশ নাই, তা ছবি হিসেবে গণ্য নয়। সুতরাং মাথা ও মুখমন্ডল ছাড়া ছবি রাখতে অসুবিধা নেই। ফক্বীহ্গণ আরো বলেছেন, যদি কোন প্রাণীর বা মানুষের ছবি ঘরের দেয়ালে সামনে বা ডানে-বামে লটকানো হয় বা শোভা প্রদর্শনের জন্য আলমিরা ইত্যাদিতে সাজিয়ে রাখা হয় যা বর্তমানে অনেক ঘরে দেখা যায় তা অবশ্যই মাকরূহে তাহরীমা বা গুনাহ্। আর উক্ত কামরায় সাজানো ছবিসমূহকে সামনে বা ডানে-বামে রেখে নামায আদায় করাও মাকরূহ ও গুনাহ্। [রদ্দুল মুহতার ও হিন্দিয়া]
ছহীহ্ বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে প্রিয়নবী রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন যে,
اُؤْلئِكَ اِذَا مَاتَ فِيْهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلى قَبْرِه مَسَجِدَا ثُمَّ صُوَّروا فِيْهِ تِلْكَ الصُّورِ شرار خلق اللهِ ـ صحيح البخارى وسلم অর্থাৎ পূর্ববর্তী নবীগণের উম্মতের মধ্যে কোন নেক্কার বুযুর্গ ব্যক্তি ইন্তিকাল করলে তখন তাঁদের ভক্ত-অনুরক্তরা তাঁর কবরের উপর মসজিদ বানিয়ে উক্ত মসজিদে ওই বুযুর্গ ব্যক্তিগণের ছবি নির্মাণ করত। তারা আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে নিকৃষ্ট। [ছহীহ্ বুখারী ও মুসলিম]
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী ক্বারী হানাফী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন-اى صور الصلحآء تذكيرابهم ترغيبا فى العبادة لاجلهم ثم جآء من بعدهم فزين لهم الشيطان اعمالهم وقال لهم سلفكم يعبدون هذه الصور فوقعوا فى عبادة الاصنام [مرقاة] অর্থাৎ পূর্ববর্তী বুযুর্গ ব্যক্তিবর্গের ইন্তিকালের পর তাদের স্মরণার্থে তাঁদের ছবিসমূহ ইবাদতে উৎসাহ্ সৃষ্টির জন্য মসজিদে টাঙ্গিয়ে রাখতো। অতঃপর তাদের পরবর্তী প্রজন্মদের শয়তান প্রতারণা করে বলতো, তোমাদের পূর্ববর্তীগণ এসব বুযুর্গ ব্যক্তিদের ছবিসমূহকে ইবাদত করত, তাই তোমরাও কর। এভাবে তারা মূর্তি পূজোয় লেগে যায়। [মিরকাত শরহে মিশকাত]
বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, মক্কার কাফিরগণ হযরত ইব্রাহীম আলায়হিস্ সালাম, হযরত ইসমাঈল আলায়হিস্ সালাম ও হযরত মারয়াম আলায়হাস্ সালামের ছবিসমূহ পবিত্র কা’বা ঘরের দেয়ালে নকশা করে রেখেছিল। মক্কা বিজয়ের দিন হুযুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হযরত ওমর ফারুক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে উক্ত ছবিসমূহ অপসারণ করার নির্দেশ দেন। আর প্রিয়নবী মক্কা শরীফের ভেতরে ছবির কিছু নমুনা ও নিশানা দেখলে তাও পানি দ্বারা মুছে দেন এবং যারা এ কাজ করেছে তাঁদের উদ্দেশ্যে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেন, আল্লাহ্ তাদের ধ্বংস করুক। [তাহাবী ও সুনানি আবু দাউদ]
শরহে মায়ানিউল আছার এ হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর অন্য বর্ণনায় দেখা যায়, একদা হযরত জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম প্রিয়নবীর দরবারে হাজির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমি গত রাতে এসেছিলাম; কিন্তু ঘরের পর্দায় কিছু প্রাণীর ছবি থাকায় আমি প্রবেশ করিনি। আপনি ছবির মাথা বা উপরিভাগ কেটে ফেলার জন্য নির্দেশ করুন। যেন তা বৃক্ষের মত হয়ে যায়। অতঃপর রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাই করলেন। [শরহে মায়ানিউল আছার, কৃত. ইমাম তাহাবী রহ., ইমাম কাছানী হানাফী রহ. এর বাদাঈয়ুস সানাঈ, ১ম খন্ড, পৃ. ৪১৫]
হুযুর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে ছবির উপরিভাগ ধ্বংস করে উম্মতকে প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষা দিয়েছেন। বিশ্ববিখ্যাত হানাফী ফক্বীহ্ ইমাম মরগিনানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি ছবি সংক্রান্ত মাসআলার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেন-
ولوكانت الصورة صغيرة بحيث لاتبد والناظر لايكره لان الصفار جدا لاتعبد واذا كانت التمثال مقطوع الراس اى ممحوا الراس فليس بتمثال لانه لايعبد بدون الراس كما اذا صلى الى شمع اوسراج على ماقالوا ولو كانت الصورة على وسادة ملقاة او على بساط مفروش لايكره لانها تدالس وتوطا بخلاف اذا كانت منصوبة او كانت على سترة لانه تعظيم لها ..الخ ـ الهداية اولين ـ صفحه ১২২ অর্থাৎ ছবি যদি এমন ছোট হয়, তা পরিষ্কারভাবে দেখা যায় না, তবে এমন ছবি মাকরূহ নয়। নেহায়ত ছোট ছবির উপাসনা করা যায়না। আর যদি ছবির মাথা কর্তিত হয় তাও ছবি হিসেবে গণ্য হয় না, কারণ মাথা বিহীন ছবির ইবাদত করা হয় না। তা বাতি বা চেরাগ (সামনে নিয়ে) নামায পড়ার মত। অর্থাৎ যেভাবে বাতি বা চেরাগকে সামনে নিয়ে নামায পড়তে অসুবিধা নাই তদ্রুপ মাথাবিহীন ছবিকে সামনে নিয়ে নামায পড়তে অসুবিধা নেই।
তেমনিভাবে ফাতহুল বারীতে ইমাম ইবনে হাজর আসক্বালানী রহমাতুল্লাহি আলায়হি (১০ম খন্ডের ৩৯১ পৃষ্ঠায়) লিখেছেন-
فاما لوكانت ممتهنة وغير ممتهنة لكنها غيرت من هيئتها اما قطعها من نصفها او بقطع رأسها فلا امتناع ـ فتح البارى ـ جلد ১০ـ صفحه ـ ৩৯১ অর্থাৎ যদি ছবিকে অসম্মানের সাথে রাখা হয় এবং তার আকৃতি পরিবর্তন করে দেয়া হয় বা ছবির অর্ধেক কেটে দেয়া হয় বা মাথা কেটে ফেলা হয় তাহলে এ ছবি রাখাতে কোন বাঁধা নেই। অর্থাৎ তা হারাম পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত নয়। [ফাতহুল বারী, ১০ম খন্ড, পৃ. ৩৯১]
অতএব, উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনা, ফক্বীহ্ ও মুহাদ্দিসীনে কেরামের বর্ণনা ও উদ্ধৃতি দ্বারা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, উপাসনা, সম্মান প্রদর্শন ঘর বা আলমিরার শোভা বর্ধনের উদ্দেশ্যে মানুষ ও প্রাণীসমূহের ছবি ঘরে বা দেয়ালে টাঙ্গানো এবং ভাস্কর্য নির্মাণ অবশ্যই ইসলামী শরীয়তের বিধানমত নিষিদ্ধ ও গুনাহ। কিন্তু বিশেষ প্রয়োজনে চাকুরী, পাসপোর্ট, ভিসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ছবির ব্যবহার বিভিন্ন প্রয়োজনীয় রেকর্ডের জন্য ফাইল বন্দী ছবিসমূহ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের নিকট জ্ঞান ও ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য জানার নিমিত্তে সরকারী-বেসরকারী যাদুঘর বা বিশেষ প্রতিষ্ঠানসমূহে পূর্বের নানা মনীষীগণের ছবি সংরক্ষণ বা ধারণ করে রাখা বিশেষ প্রয়োজনে হারাম বা মাকরূহ পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হবে না।
এসব জরুরী বিষয় ও ইমামগণের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ পর্যালোচনা না করে ঢালাওভাবে প্রাণীর ছবির বিষয়ে সাধারণভাবে হারাম ও গুনাহে কবীরা ইত্যাদি ফতোয়া প্রদান করা সীমালঙ্ঘন ও মূর্খতা ছাড়া আর কিছু নয়। উল্লেখ্য যে, অন্যান্য মানুষের ভাষ্কর্যের বিষয়ে চুপচাপ কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের ভাষ্কর্যের বিষয়ে তুমুল হৈ-চৈ এবং আন্দোলনের ডাক দেয়া কখনো হক্কানী ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামের আদর্শ হতে পারে না বরং তা দেশে ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির নামান্তর। আর ফিতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টি খুন হত্যার চেয়েও জঘন্যতম অপচেষ্টা। উপরোক্ত বিষয়ে এটাই ইসলামী শরিয়তের ফতোয়া/ফয়সালা। এ বিষয়ে তরজুমান প্রশ্নোত্তর বিভাগে পূর্বে প্রামাণ্য আলোচনা করা হয়েছে।
লেখক : অধ্যক্ষ-জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসা, চট্টগ্রাম।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •