বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক আমাদের প্রিয়নবী

0
বিশ্ব মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক আমাদের প্রিয়নবী-
সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী >
জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান-সাধনা মানুষের প্রবৃত্তি। অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা এবং অজয়কে জয় করা মানুষের সহজাত গুণ। জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান অর্জন করতে হলে শিক্ষা অপরিহার্য। শিক্ষক এবং শিক্ষা শব্দ দুটি পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার প্রচার ও প্রসার ঘটে থাকে। শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। মেরুদন্ডহীন মানুষ যেমন দাঁড়াতে পারে না, ঠিক তেমনি শিক্ষাবিহীন কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। মানুষের মধ্যে আল্লাহ প্রদত্ত যেসব গুণাবলি ও প্রতিভা সুপ্ত রয়েছে, তার বিকাশ ঘটে শিক্ষার মাধ্যমে।
আর শিক্ষকতাও একটি মহান পেশা। শিক্ষার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষকের। একজন ছাত্রকে কেবল শিক্ষিতই নয়, বরং ভালো মানুষ করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্বটাও থাকে শিক্ষকের ওপরই। তাই একটি সভ্য ও সুন্দর পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে মানব জাতির শিক্ষকরূপে সম্মানিত নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেন। প্রথম নবী হযরত আদম আলাইহিসর্ সালাম থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সব নবীই ছিলেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত এবং সু-শিক্ষার ধারক ও বাহক। আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সে ধারার সর্বশেষ ও সর্বোত্তম প্রেরিত পুরুষ। আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞানদক্ষতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতই পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন যে, শিক্ষা সম্প্রসারণে বিশ্বমানবতার মহান শিক্ষকরূপে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। যুদ্ধ, রাজনীতি, সমাজ সংস্কার এবং নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার কাজে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও তিনি একটা উল্লেখযোগ্য সময় শিক্ষকতায় ব্যয় করতেন। সে জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও এ পৃথিবীতে রাষ্ট্র প্রধান বা সেনাপতি কোন নামেই নিজের পরিচয় তুলে ধরেননি। বরং তিনি নিজেকে শিক্ষক হিসেবে পরিচয় দিতে এভাবে গর্ববোধ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন: إنّما بُعِثت معلّماً ‘আমি মানবতার জন্য শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’( )
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন:
كَمَآ أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِّنكُمْ يَتْلُواْ عَلَيْكُمْ أٰيٰتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ ٱلْكِتٰبَ وَٱلْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُم مَّا لَمْ تَكُونُواْ تَعْلَمُونَ
‘হে মানুষেরা! আমি তোমাদের কাছে তোমাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসুল পাঠিয়েছি। যে তোমাদের কাছে আমার আয়াত (কোরআন) পাঠ করে শোনায়, তোমাদের জীবন পরিশুদ্ধ করে,তোমাদের কিতাব ও হিকমত (কোরআন ও বিজ্ঞান) শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যে বিষয়ে কিছুই জানতে না, সেটা শিক্ষা দেয়। [বাক্বারা : ১৫১] তাঁর মাধ্যমে ঐশী শিক্ষা পূর্ণতা লাভ করে। তিনি তাঁর কার্যকর ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি ও পদ্ধতির মাধ্যমে আরবের মূর্খ ও বর্বর একটি জাতিকে পৃথিবীর নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করান এবং ইসলামের মহান বার্তা ছড়িয়ে দেন পৃথিবীর আনাচে কানাচে।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হলেন একজন পরিপূর্ণ আদর্শ শিক্ষক। যার প্রতিটি কথা, কাজকর্ম ইত্যাদিতে ছিল কেবলই শিক্ষা। তাই তো তিনি হলেন উভয় জগতের আদর্শ শিক্ষক। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ জ্ঞানের ভান্ডার আল কুরআনের ধারক-বাহক। অজ্ঞতা-অশান্তির চরম সময়ে শিক্ষার মশাল নিয়ে এসেছিলেন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর জ্ঞানের মশাল জ্বলে উঠেছিল শত দীপশিখায়, ছড়িয়ে পড়েছিল দিগন্তে। তাঁর আবির্ভাবে এবং কুরআনের চির নির্ভুল সত্যবাণী অবতীর্ণ হওয়ার ফলে অজ্ঞতার গাঢ় অন্ধকার কেটে গেল। বিশ্বমানবতা লাভ করল জ্ঞান-বিজ্ঞানের এক পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন।
আর কেনোই বা তিনি শ্রেষ্ঠতম শিক্ষক হবেন না, যখন স্বয়ং আল্লাহতায়ালা তাঁকে সর্বোত্তম শিক্ষা ও শিষ্টাচার শিখিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আমাকে আমার প্রভু শিক্ষা দিয়েছেন, সুতরাং আমাকে তিনি সর্বোত্তম শিক্ষা দিয়েছেন। আমার প্রভু আমাকে শিষ্টাচার শিখিয়েছেন সুতরাং তিনি সর্বোত্তম শিষ্টাচার শিখিয়েছেন। ( )
আল্লাহ্পাক রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পরিচয় করিয়ে দিয়ে কোরআনুল কারিমে বলেন,
هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولًا مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِن كَانُوا مِن قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُّبِينٍ
‘তিনিই সেই পবিত্র সত্ত্বা। যিনি উম্মী লোকদের মধ্য থেকে তাদের একজনকে রাসূল করে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদেরকে তার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনাবেন, তাদেরকে পবিত্র করবেন, তাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও প্রজ্ঞা। যদিও ইতোপূর্বে তারা ভ্রান্তিতে (অজ্ঞতায়) মগ্ন ছিলো। ’ [সূরা জুমা : ০২] মূলত তাঁর শিক্ষা ছিল নিখুঁত। তাঁর ব্যবহার ছিল নমনীয় এবং আচরণ ছিল উদার ও ভালোবাসাপূর্ণ। মহান আল্লাহই তাঁকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বানিয়েছেন, তাঁর শিক্ষাকে মানুষ অতি সহজেই গ্রহণ করতে বাধ্য হতো এবং তাঁর পদতলে এসে আনুগত্য স্বীকার করে ইসলামে দীক্ষিত হতো। তাঁর শিক্ষা পেয়ে আরবের অসভ্য সমাজে যে বিপ্লব ঘটেছিলো, এর আগে বা পরের কোনো শিক্ষক বা আন্দোলনের নেতা দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। সামাজিকতা, শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি, যুদ্ধনীতিসহ সব দিক থেকে তাঁর ছাত্ররা ছিলো অগ্রসর।
মহান রাব্বুল আলামিন তাঁর প্রিয় বান্দা ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জন্মগতভাবেই শিক্ষকসুলভ আচরণ দান করেছিলেন। তাঁর অনুপম শিক্ষানীতি ও পদ্ধতিতে মুগ্ধ ছিলেন তাঁর পুণ্যাত্মা সাহাবি ও শিষ্যগণ। হযরত মুয়াবিয়া রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
فَبِأَبِي هو وأُمِّي، ما رَأَيْتُ مُعَلِّمًا قَبْلَهُ ولَا بَعْدَهُ أحْسَنَ تَعْلِيمًا منه، فَوَاللهِ، ما كَهَرَنِي ولَا ضَرَبَنِي ولَا شَتَمَنِي،
‘তাঁর জন্য আমার বাবা ও মা উৎসর্গিত হোক। আমি তাঁর পূর্বে ও পরে তাঁর চেয়ে উত্তম কোনো শিক্ষক দেখিনি। আল্লাহর শপথ! তিনি কখনো কঠোরতা করেননি, কখনো প্রহার করেননি, কখনো গালমন্দ করেননি।( )
তাই শিক্ষা ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাফল্যের জন্য সর্বোত্তম শিক্ষকের শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। নিম্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসৃত কয়েকটি শিক্ষাপদ্ধতি তুলে ধরা হলো।
তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের প্রতি পিতার ন্যায় স্নেহশীল
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শিক্ষকতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ছাত্রদের প্রতি ছিলেন পিতার ন্যায় ¯েœহশীল। এ জন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
إِنَّمَا أَنَا لَكُمْ بِمَنْزِلَةِ الْوَالِدِ أُعَلِّمُكُمْ
আমি হচ্ছি তোমাদের সামনে পুত্রের জন্য পিতার ন্যায়। তাই আমি তোমাদেরকে শিক্ষা দিই।( )

তিনি ছাত্রের আকল ও বিবেকের প্রতি খেয়াল রাখতেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের বুঝ ও আকলের প্রতি খুব খেয়াল রাখতেন এবং সে অনুযায়ী তিনি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা দিতেন। তিনি ছোট-বড় সকলের মন-মেজাজের প্রতি সদা সতর্ক থাকতেন।
প্রত্যেক মানুষকে তার আক্বল ও বিবেকানুযায়ী সম্বোধন করতেন।

তিনি ছাত্রদের মেধাশক্তি বিকাশের জন্য বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন
তিনি ছাত্রদের মধ্যে জানার কৌতূহল জাগাতেন, তাই তাদের সামনে নানা বিষয়ে প্রশ্ন ওঠাতেন এবং তাদের থেকে উত্তর জানতে চাইতেন। যেনো তারা প্রশ্ন করতে এবং তার উত্তর খুঁজতে অভ্যস্ত হয়। কেননা নিত্যনতুন প্রশ্ন শিক্ষার্থীকে নিত্যনতুন জ্ঞান অনুসন্ধানে উৎসাহী করে। যেমন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন,
عَنِ عَبْد اللَّهِ بْنَ عُمَرَ يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ مِنْ الشَّجَرِ شَجَرَةً لَا يَسْقُطُ وَرَقُهَا وَإِنَّهَا مَثَلُ الْمُسْلِمِ فَحَدِّثُونِي مَا هِيَ فَوَقَعَ النَّاسُ فِي شَجَرِ الْبَوَادِي قَالَ عَبْدُ اللهِ وَوَقَعَ فِي نَفْسِي أَنَّهَا النَّخْلَةُ فَاسْتَحْيَيْتُ ثُمَّ قَالُوا حَدِّثْنَا مَا هِيَ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ فَقَالَ هِيَ النَّخْلَةُ قَالَ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لِعُمَرَ قَالَ لَأَنْ تَكُونَ قُلْتَ هِيَ النَّخْلَةُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ كَذَا وَكَذَا( )
একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার সামনে প্রশ্ন করলেন, একটা গাছ আছে, যার বরকত মুসলমানের ন্যায়। যে গাছের পাতা কখনো শুকায় না এবং ঝরেও পড়ে না। সর্বদা ফল দেয়। তোমরা বলো তো ওই গাছ কোনটি? তখন প্রত্যেকে বিভিন্ন উত্তর দেয়া শুরু করলো। ইবনে ওমর বলেন, আমার মনে হচ্ছিলো ওই গাছ হচ্ছে খেজুর গাছ। তাই আমি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু সেখানে অনেক বয়স্ক লোকও ছিলো। আর আমি ছিলাম বাচ্চা’। সর্বশেষ ইবনে ওমরের ধারণাই সঠিক হলো। কেউ বলতে না পারায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলে দিলেন সেটা হচ্ছে খেজুর গাছ’।( )
হযরত মুয়ায ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
كنتُ رِدفَ النَّبيِّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ على حِمارٍ، فقال: يا مُعاذُ، فقُلتُ: لَبَّيكَ يا رسولَ اللهِ، قال: أتَدري ما حَقُّ اللهِ على العِبادِ؟ قال: قُلتُ: اللهُ ورسولُه أعلمُ، قال: فإنَّ حَقَّ اللهِ على العِبادِ أنْ يَعبُدوه ولا يُشرِكوا به شيئًا، فهل تَدري ما حَقُّ العِبادِ على اللهِ إذا فَعَلوا ذلك؟ قال: قُلتُ: اللهُ ورسولُه أعلمُ، قال: فإنَّ حَقَّ العِبادِ على اللهِ إذا فَعَلوا ذلك ألَّا يُعذِّبَهم. ( )
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন, হে মুয়ায! তুমি কী জানো বান্দার নিকট আল্লাহর অধিকার কী? তিনি বলেন, আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তার ইবাদত করা এবং তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক না করা। ’ ( )
তিনি শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দিতেন
শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকের আলোচনা শুনে শিক্ষার্থীর মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। এসব প্রশ্নের সমাধান না পেলে অনেক সময় পুরো বিষয়টিই শিক্ষার্থীর নিকট অস্পষ্ট থেকে যায়। সে পাঠের পাঠোদ্ধার করতে পারে না। আর প্রশ্নের উত্তর দিলে বিষয়টি যেমন স্পষ্ট হয়, তেমনি শিক্ষার্থী জ্ঞানার্জনে আরো আগ্রহী হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষাদানের সময় শিক্ষার্থীর প্রশ্ন গ্রহণ করতেন এবং প্রশ্ন করার জন্য কখনো কখনো প্রশ্নকারীর প্রসংশাও করতেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত।
أنَّ أعْرابِيًّا عَرَضَ لِرَسولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ وهو في سَفَرٍ، فأخَذَ بخِطامِ ناقَتِهِ، أوْ بزِمامِها، ثُمَّ قالَ: يا رَسولَ اللهِ -أَوْ يا مُحَمَّدُ- أخْبِرْنِي بما يُقَرِّبُنِي مِنَ الجَنَّةِ، وما يُباعِدُنِي مِنَ النَّارِ، قالَ: فَكَفَّ النبيُّ صَلَّى اللَّهُ عليه وسلَّمَ، ثُمَّ نَظَرَ في أصْحابِهِ، ثُمَّ قالَ: لقَدْ وُفِّقَ، أوْ لقَدْ هُدِيَ
‘এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রশ্ন করে, আমাকে বলুন! কোন জিনিস আমাকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে দিবে এবং কোন জিনিস জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে নিবে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থামলেন এবং তাঁর সাহাবাদের দিকে তাকালেন। অতপর বললেন, তাকে তওফিক দেওয়া হয়েছে বা তাকে হেদায়েত দেওয়া হয়েছে। ( )
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রশ্নটি শুনেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেননি। বরং তিনি চুপ থাকেন এবং সাহাবিদের দিকে তাকিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং প্রশ্নকারীর প্রশংসা করেন। যাতে প্রশ্নটির ব্যাপারে সকলের মনোযোগ সৃষ্টি হয় এবং সকলেই উপকৃত হতে পারে।
তিনি কিছু প্রশ্নের জবাব শিক্ষার্জনকারীদের ওপর ছেড়ে দিতেন
তিনি নিজে সব ক’টির উত্তর দিতেন না। কোনো কোনোটির উত্তর দেয়ার দায়িত্ব ছাত্রদের ওপর ছেড়ে দিতেন। যাতে তাদেরকে দিয়ে বিষয়টির অনুশীলন করানো যায়। যেমন এক সাহাবি এসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেন। সেখানে হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু উপস্থিত ছিলেন।
হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু উত্তর দেয়ার জন্য অনুমতি চাইলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। ব্যাখ্যা দেয়ার পর আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাখ্যা ঠিক হয়েছে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘কিছু ঠিক হয়েছে আর কিছু ভুল’।( )
তিনি সফলদের প্রশংসা করতেন
তিনি সাহাবাদের মেধা ও জ্ঞান যাচাই করার জন্য কোনো একটি বিষয়ে প্রশ্ন করে পরীক্ষা নিতেন। সঠিক উত্তরদাতার সম্মাননা স্বরূপ তিনি প্রশংসা করতেন, বুকে হাত মেরে ‘শাবাশ!’ বলতেন। যেমন
يا أبا المُنْذِرِ، أتَدْرِي أيُّ آيَةٍ مِن كِتابِ اللهِ معكَ أعْظَمُ؟ قالَ: قُلتُ: اللَّهُ ورَسولُهُ أعْلَمُ. قالَ: يا أبا المُنْذِرِ أتَدْرِي أيُّ آيَةٍ مِن كِتابِ اللهِ معكَ أعْظَمُ؟ قالَ: قُلتُ اللَّهُ لا إلَهَ إلَّا هو الحَيُّ القَيُّومُ} [البقرة:২৫৫] قالَ: فَضَرَبَ في صَدْرِي، وقالَ: واللَّهِ لِيَهْنِكَ العِلْمُ أبا المُنْذِرِ.
হযরত উবাই ইবনে কা’বকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন, আল কোরআনে কোন আয়াতটি সবচেয়ে ফজিলতপূর্ণ? প্রথমে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুনরায় তাকে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন ‘আয়াতুল কুরসি’। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বুকে হাত রেখে বলেন, ‘শাবাশ!’। আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য ইলম অর্জন সহজ করুন।’( )
তিনি কখনো কখনো রাগ করতেন
তিনি যেমন স্নেহশীল ও দয়ালু ছিলেন তেমনি তিনি প্রয়োজনে মৃদ প্রতি রাগও দেখাতেন। যেমন,
একবার তিনি বের হয়ে দেখেন সাহাবারা তাকদির নিয়ে তর্ক করছেন। তখন তিনি খুব রাগান্বিত হয়ে বলেন, তোমাদেরকে এজন্য দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছে? ( )
একজন আদর্শ শিক্ষকের দায়িত্ব হল, ছাত্রদের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসার পাশাপাশি তাদেরকে আদব শিখানোর জন্য কখনও কখনও রাগ করা।
তিনি উপযুক্ত পরিবেশ নির্বাচন করতেন
শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অপরিহার্য। কোলাহলপূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিবেশ শিক্ষার বিষয় ও শিক্ষক উভয়ের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষাদানের জন্য উপযুক্ত পরিবেশের অপেক্ষা করতেন। অর্থাৎ শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে স্থির হওয়ার এবং মনোসংযোগ স্থাপনের সুযোগ দিতেন। অতপর উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হলে শিক্ষাদান শুরু করতেন। হযরত জারির ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত।
قالَ لي رَسولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ في حَجَّةِ الوَدَاعِ: اسْتَنْصِتِ النَّاسَ ثُمَّ قالَ: لا تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ.
‘নিশ্চয় বিদায় হজের সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, মানুষকে চুপ করতে বল। অতপর তিনি বলেন, আমার পর তোমরা কুফরিতে ফিরে যেয়ো না…। ’ ( )
তিনি থেমে থেমে পাঠদান করতেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠদানের সময় থেমে থেমে কথা বলতেন। যেনো তা গ্রহণ করা শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ হয়। খুব দ্রুত কথা বলতেন না যেনো শিক্ষার্থীরা ঠিক বুঝে উঠতে না পারে আবার এতো ধীরেও বলতেন না যাতে কথার ছন্দ হারিয়ে যায়। বরং তিনি মধ্যম গতিতে থেমে থেমে পাঠ দান করতেন। হযরত আবু বাকরাহ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
خَطَبَنَا النبيُّ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ يَومَ النَّحْرِ، قالَ: أتَدْرُونَ أيُّ يَومٍ هذا؟، قُلْنَا: اللَّهُ ورَسولُهُ أعْلَمُ، فَسَكَتَ حتَّى ظَنَنَّا أنَّه سَيُسَمِّيهِ بغيرِ اسْمِهِ، قالَ: أليسَ يَومَ النَّحْرِ؟ قُلْنَا: بَلَى، قالَ: أيُّ شَهْرٍ هذا؟، قُلْنَا: اللَّهُ ورَسولُهُ أعْلَمُ، فَسَكَتَ حتَّى ظَنَنَّا أنَّه سَيُسَمِّيهِ بغيرِ اسْمِهِ، فَقالَ أليسَ ذُو الحَجَّةِ؟، قُلْنَا: بَلَى، قالَ أيُّ بَلَدٍ هذا؟ قُلْنَا: اللَّهُ ورَسولُهُ أعْلَمُ، فَسَكَتَ حتَّى ظَنَنَّا أنَّه سَيُسَمِّيهِ بغيرِ اسْمِهِ، قالَ أليسَتْ بالبَلْدَةِ الحَرَامِ؟ قُلْنَا: بَلَى، قالَ: فإنَّ دِمَاءَكُمْ وأَمْوَالَكُمْ علَيْكُم حَرَامٌ، كَحُرْمَةِ يَومِكُمْ هذا، في شَهْرِكُمْ هذا، في بَلَدِكُمْ هذا، إلى يَومِ تَلْقَوْنَ رَبَّكُمْ، ألَا هلْ بَلَّغْتُ؟، قالوا: نَعَمْ، قالَ: اللَّهُمَّ اشْهَدْ، فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الغَائِبَ، فَرُبَّ مُبَلَّغٍ أوْعَى مِن سَامِعٍ، فلا تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا، يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ. ( )
‘তোমরা কী জানো- আজ কোন দিন? …এটি কোন মাস? …এটি কী জিলহজ নয়? …এটি কোন শহর?’( ) –
প্রতিটি প্রশ্নের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চুপ থাকেন এবং সাহাবারা উত্তর দেন আল্লাহ ও তার রাসূল ভালো জানেন।
তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন
তিনি কোনো বিষয়ে আলোচনা করলে, তাঁর দেহাবয়বেও তার প্রভাব প্রতিফলিত হতো। তিনি দেহ-মনের সমন্বিত ভাষায় পাঠ দান করতেন। কারণ,এতে বিষয়ের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য ও প্রকৃতি সম্পর্কে শ্রোতা শিক্ষার্থীগণ সঠিক ধারণা লাভে সক্ষম হয় এবং বিষয়টি তার অন্তরে গেঁথে যায়। যেমন, তিনি যখন জান্নাতের কথা বলতেন, তখন তাঁর দেহ মুবারকে আনন্দের স্ফূরণ দেখা যেতো। জাহান্নামের কথা বললে ভয়ে চেহারা মুবারকের রঙ বদলে যেতো। যখন কোনো অন্যায় ও অবিচার সম্পর্কে বলতেন, তাঁর চেহারায় ক্রোধ প্রকাশ পেতো এবং কণ্ঠস্বর উঁচু হয়ে যেতো।
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا خَطَبَ احْمَرَّتْ عَيْنَاهُ وَعَلاَ صَوْتُهُ وَاشْتَدَّ غَضَبُهُ حَتَّى كَأَنَّهُ مُنْذِرُ جَيْشٍ يَقُولُ ‏”‏ صَبَّحَكُمْ وَمَسَّاكُمْ ‏”( )
হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন বক্তব্য দিতেন- তাঁর চোখ মুবারক লাল হয়ে যেতো, আওয়াজ উঁচু হতো এবং ক্রোধ বৃদ্ধি পেতো। যেনো তিনি (শত্রু) সেনা সম্পর্কে সতর্ককারী। ’ ( )
তিনি গল্প বলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের 
জ্ঞানের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতেন
শিক্ষার প্রয়োজনে শিক্ষককে অনেক সময় গল্প-ইতিহাস বলতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও পাঠদানের সময় গল্প বলতেন। তিনি গল্প বলতেন অত্যন্ত মিষ্টি করে। এমন মিষ্টি ভঙ্গি গল্প-ইতিহাস স্বপ্রাণ হয়ে উঠতো। জীবন্ত হয়ে উঠতো শ্রোতা-শিক্ষার্থীর সামনে। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘দোলনায় কথা বলেছে তিনজন। হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.) …। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন, আমি (মুগ্ধ হয়ে) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তিনি আমাকে শিশুদের কাজ সম্পর্কে বলছিলেন। তিনি তার মুখে আঙুল রাখলেন। এবং তাতে চুমু খেলেন।’( ) অর্থাৎ তিনি শিশুদের মতো ঠোঁট গোল করে তাতে আঙুল ঠেকালেন।
তিনি আলোচ্য বিষয়ের গুরুত্ব সম্পর্কে
শিক্ষার্থীদের সজাগ করতেন
বিষয়বস্তুর গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা থাকলে শিক্ষার্থী শ্রেণী কক্ষে অনেক বেশি মনোযোগী হয়। একাগ্র হয়ে শিক্ষকের আলোচনা শোনে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঠদানের সময় বিষয়বস্তুর গুরুত্ব ফুটিয়ে তুলতেন।
عن أبي سعيد رافع بن المعلى -رضي الله عنه- قال: قال لي رسول الله -صلى الله عليه وسلم-: أَلاَ أُعَلِّمُكَ أَعْظَمَ سُورَةٍ في القُرْآن قَبْلَ أنْ تَخْرُجَ مِنَ الْمَسْجِد؟গ্ধ فَأخَذَ بِيَدِي، فَلَمَّا أرَدْنَا أنْ نَخْرُجَ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، إنَّكَ قُلْتَ: لأُعَلِّمَنَّكَ أعْظَمَ سُورَةٍ في القُرْآنِ؟ قالَ: ্রالحَمْدُ للهِ رَبِّ العَالَمِينَ، هِيَ السَّبْعُ المَثَانِي وَالقُرْآنُ العَظِيمُ الَّذِي أُوتِيتُهُ
হযরত সাঈদ ইবনে মুয়াল্লা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেন, ‘মসজিদ থেকে বের হওয়ার পূর্বে আমি তোমাদেরকে কোরআনের সবচেয়ে মহান সূরাটি শিক্ষা দেবো। তিনি বলেন, আমি যখন বের হওয়ার ইচ্ছে করলাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার হাত ধরে বললেন, তোমাকে বলিনি! মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগে তোমাকে কোরআনে সবচেয়ে মহান সূরা শিক্ষা দেবো। অতপর তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। ’ ( )
অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে সূরা ফাতেহা শিক্ষা দেন।
তিনি শিক্ষার্থী চয়ন করে নিতেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ বিশেষ শিক্ষাদানের জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থী নির্বাচন করতেন। যেনো শেখানো বিষয়টি দ্রুত ও ভালোভাবে বাস্তবায়িত হয়।
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আমার উম্মতের মধ্য থেকে কে পাঁচটি গুণ ধারণ করবে এবং তার ওপর আমল করবে? তিনি বলেন, আমি বলি, আমি হে আল্লাহর রাসূল! তখন তিনি আমার হাত ধরলেন এবং হাতে পাঁচটি বিষয় গণনা করলেন। ( )
তিনি উদহারণ ও উপমা পেশ করতেন
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক সময় কোনো বিষয় স্পষ্ট করার জন্য উপমা ও উদাহরণ পেশ করতেন। কেননা উপমা ও উদাহরণ দিলে যে কোনো বিষয় বোঝা সহজ হয়ে যায়।
عَنْ سَهْلِ بْنِ سَعْدٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَا وَكَافِلُ الْيَتِيمِ فِي الْجَنَّةِ كَهَاتَيْنِ وَأَشَارَ بِأُصْبُعَيْهِ يَعْنِي السَّبَّابَةَ وَالْوُسْطَى قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ( )
হযরত সাহাল ইবনে সাদ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘আমি ও এতিমের দায়িত্ব গ্রহণকারী জান্নাতে এমনভাবে অবস্থান করবো। হযরত সাহাল রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর শাহাদত ও মধ্যমা আঙুল মুবারকের প্রতি ইঙ্গিত করেন।’( )
তিনি প্রাক্টিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষার
মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন
শিক্ষার সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো প্রাক্টিক্যাল বা প্রয়োগিক শিক্ষা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ বিষয় নিজে আমল করে সাহাবিদের শেখাতেন। শেখাতেন হাতে-কলমে। এজন্য হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহা বলেন, তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো কোরআন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي( )
‘তোমরা নামায আদায় কর, যেমন আমাকে আদায় করতে দেখো। ’ ( )
তিনি বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন
মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি সহজ উপায় হলো- মানুষের বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিবেক ও মনুষ্যত্ব জাগিয়ে তোলার মাধ্যমেও মানুষকে শিক্ষাদান করতেন। যেমন-
এক যুবক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার খেদমতে আরয করলো। হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ব্যভিচারের অনুমতি দিন। তার কথা শুনে উপস্থিত লোকেরা মারমুখি হয়ে উঠলো এবং তিরস্কার করলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কাছে ডেকে নিলেন এবং বললেন, তুমি কী তোমার মায়ের ব্যাপারে এমনটি পছন্দ কর? সে বললো, আল্লাহর শপথ না। আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গিত করুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেউ তার মায়ের ব্যাপারে এমন পছন্দ করে না। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একে একে তার সব নিকট নারী আত্মীয়ের কথা উল্লেখ করেন এবং সে না উত্তর দেয়। এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার বিবেক জাগ্রত করে তোলেন।( )
তিনি চিত্র অংকনের সাহায্যে শিক্ষা দিতেন
কখনো কখনো কোনো বিষয়কে স্পষ্ট করার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রেখা ও চিত্র অঙ্কনের সাহায্য নিতেন। যেনো শ্রোতা ও শিক্ষার্থীর স্মৃতিতে তা রেখাপাত করে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি চারকোণা দাগ দিলেন। তার মাঝ বরাবর দাগ দিলেন। যা তা থেকে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে যাওয়া দাগটির পাশে এবং চতুষ্কোণের ভেতরে ছোট ছোট কিছু দাগ দিলেন। তিনি বললেন, এটি মানুষ। চতুষ্কোণের ভেতরের অংশ তার জীবন এবং দাগের যে অংশ বের হয়ে গেছে সেটি তার আশা। ’ ( )
এভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রেখাচিত্রের সাহায্যে মানুষের জীবন ও জীবনের সীমাবদ্ধতার বিষয় স্পষ্ট করে তুললেন।
বার বার পাঠ করে কঠিন বিষয়কে
সহজ করে উপস্থাপন করতেন
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষার্থীদের মেধা ও স্মৃতিশক্তির ওপর নির্ভর না করে বার বার পাঠ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন; বরং বার বার পাঠ করে কঠিন বিষয়কে আয়ত্ব করতে বলতেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন,
اسْتَذْكِرُوا الْقُرْآنَ فَلَهُوَ أَشَدُّ تَفَصِّيًا مِنْ صُدُورِ الرِّجَالِ ، مِنَ النَّعَمِ بِعُقُلِهَا( )
‘তোমরা কোরআনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হও। সেই সত্ত্বার শপথ যার হাতে আমার জীবন তা উটের চেয়ে দ্রুত স্মৃতি থেকে পলায়ন করে। ( )
তিনি আশা ও ভীতি জাগানোর
মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করতেন
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের অনাগত জীবন সম্পর্কে যেমন আশাবাদী করে তুলতেন, তেমনি তার চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করে তুলতেন। যেমন, হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ভাষণ দিলেন। আমি এমন ভাষণ আর শুনিনি। তিনি এরশাদ করেন,
لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلبَكَيْتُمْ كَثِيرًا
আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে অল্প হাসতে এবং বেশি কাঁদতে। ’( )
হযরত আবু যর গিফারি রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বললো এবং তার ওপর মৃত্যুবরণ করলো, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমি বললাম, যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, হ্যাঁ। যদি সে ব্যভিচার করে এবং চুরি করে। ’ ( )
তিনি জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয় সহজ করে তুলতেন মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে
মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে বহু জটিল ও দুর্বোধ্য বিষয় সহজ হয়ে যায় এবং উত্তম সমাধান পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও বহু বিষয় মুক্ত আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে শিক্ষাদান করতেন। সমাধান বের করতেন। যেমন, হুনায়নের যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বণ্টন নিয়ে আনসার সাহাবায়ে কেরামের মাঝে অসন্তোষ দেখা দিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সঙ্গে মুক্ত আলোচনা করেন। একইভাবে বদর যুদ্ধের বন্দিদের ব্যাপারে সাহাবিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ( )
গুরুত্বপূর্ণ কথার পুনরাবৃত্তি করতেন
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পাঠদানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিন বার পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন। হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يُعِيدُ الْكَلِمَةَ ثَلاثًا لِتُعْقَلَ عَنْهُ
‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কথাকে তিনবার পুনরাবৃত্তি করতেন যেনো তা ভালোভাবে বোঝা যায়। ’( )
ভুল সংশোধন করে দিতেন
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভুল সংশোধনের মাধ্যমে শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতেন।
হযরত আবু মাসউদ আনসারি রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট অভিযোগ করে যে, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নামাযে অংশগ্রহণ করতে পারি না। কারণ অমুক ব্যক্তি নামায দীর্ঘায়িত করে ফেলে। আমি উপদেশ বক্তৃতায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে সেদিনের তুলনায় আর কোনোদিন বেশি রাগ হতে দেখিনি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘হে লোক সকল! নিশ্চয় তোমরা অনীহা সৃষ্টিকারী। সুতরাং যে মানুষ নিয়ে (জামাতে) নামায আদায় করবে, সে তা যেনো হাল্কা করে (দীর্ঘ না করে)। কেননা তাদের মধ্যে অসুস্থ্য, দুর্বল ও যুল-হাজাহ (ব্যস্ত) মানুষ রয়েছে।( )
তিনি শাস্তিদানের মাধ্যমে সংশোধন করতেন
গুরুতর অপরাধের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো তাঁর শিষ্য ও শিক্ষার্থীদের শাস্তি প্রদান করে সংশোধন করতেন। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধিকাংশ সময় শারীরিক শাস্তি এড়িয়ে যেতেন। ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করতেন। যেমন উপযুক্ত কারণ ব্যতীত তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করায় হযরত কাব ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুসহ কয়েকজনের সঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কথা বলা বন্ধ করে দেন। যা শারীরিক শাস্তির তুলনায় অনেক বেশি ফলপ্রসূ ছিলো।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষাদান পদ্ধতির সামান্য কিছু দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা হলো। সুতরাং মুসলিম উম্মাহকে যদি তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হয় এবং উভয় জগতের সাফল্য অর্জন করতে হয়, তবে অবশ্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •