খতমে নুবূয়ত ও ক্বাদিয়ানী ফির্ক্বা…(ধারাবাহিক-৩)
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
হাদীস শরীফ-১১.
হযরত সাওবান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, সাইয়্যেদে ‘আলামীন হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন-اِنَّه سَيَكُوْنُ فِىْ اُمَّتِىْ كَذَّابُوْنَ ثَلٰثُوْنَ كُلُّهُمْ يَزْعَمُ اَنَّه نَبِىُّ اللهِ وَاَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ [ مشكواة : كتاب الفتن : صفحه : ৪১৫]
অর্থঃ আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদার (ভন্ডনবী) পয়দা হবে। তাদের মধ্যে প্রত্যেকের এ দাবী হবে যে, সে আল্লাহর নবী; অথচ আমি সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী নেই। [মিশকাত শরীফ: কিতাবুল ফিতান: পৃ. ৪১৫]
এ হাদীস শরীফ থেকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সুক্ষ্ম বিষয় প্রতীয়মান হয়ঃ
১. অত্যন্ত সত্য সংবাদদাতা হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রদত্ত খবর অনুযায়ী উম্মতের মধ্যে এমন এমন ব্যক্তি পয়দা হবে, যারা নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদার হয়ে বসবে; বরং এমন বলা হলেও ভুল হবে না যে, নুবূয়তের মিথ্যা দাবীদারদেরকে দেখে আমাদের মধ্যে আমাদের সত্য নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সত্যতার ইয়াক্বীন (দৃঢ় বিশ্বাস) তরুতাজা হয়ে যাবে।
২. নুবূয়তের এসব দাবীদার মিথ্যাবাদী হবে, তাদের দাবীর পক্ষে সত্যতা নেই; বরং ধোঁকা ও প্রতারণার ভিত্তিতেই হবে তাদের দাবী। এ অগ্রিম খবরের পর এখন কোন নবী বলে দাবীদার সম্পর্কে তার দাবীর সত্যতা যাচাইয়েরও কোন প্রয়োজন নেই, তা বৈধও নয়। কেননা, উম্মত প্রথম থেকেই জানে যে, এ (ভন্ডনবী) মিথ্যুক, জঘন্য মিথ্যাবাদী।
৩. কোন নতুন নুবূয়তের দাবীদারের মিথ্যাবাদিতা ফাঁশ করার জন্য এ দলীল অতিমাত্রায় যথেষ্ট যে, ‘‘হুযূর-ই পুরনূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আখেরী নবী, খাতামুন্নাবিয়্যীন, তাঁর পরে আর কো নবী নেই।’’
পর্যালোচনা
এখন এসব অকাট্য দলীলের পর না কোন আলোচনা ও দলীল উপস্থাপনের অবকাশ আছে, না এটা দেখার প্রয়োজন আছে যে, নতুন নুবূয়তের দাবীদারের নিকট তার দাবীর পক্ষে কোন প্রমাণ আছে কিনা; বরং তার নিকট তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ চাওয়াও কুফরী।
উপরে উল্লিখিত হাদীস শরীফগুলোর আলোকে একথা মধ্যাহ্ন সূর্যের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, সমস্ত নবী ও রসূলের মধ্যে সাইয়্যেদে আলম মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর একমাত্র স্বত্ত্বা রয়েছেন, যিনি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘‘আমি সমস্ত নবীর মধ্যে সর্বশেষ নবী। আমার পর কোন নবী নেই।’’ এ ঘোষণার পর এখন না কোন নতুন নবীর জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে, না কোন নতুন নবী বলে দাবীদারের আহ্বান শোনার আমাদের প্রয়োজন আছে।
এখন এ প্রসঙ্গে আলোচনার একটি সর্বশেষ অংশ অবশিষ্ট রয়ে গেছে। তাও উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। তা হচ্ছে- ওই মহান আগমনকারীর ঘোষণা তো আমরা শুনেছি যে, তিনি সর্বশেষ নবী, তিনি নবীগণের আগমনের ধারা পরিসমাপ্তকারী হিসেবে তাশরীফ এনেছেন; তদ্সঙ্গে এটাও দেখতে হচ্ছে যে, এ ধরনের কোন ঘোষণা নবী প্রেরণকারী মহামহিম আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকেও আছে কি-না! এ প্রসঙ্গে যদি নবী প্রেরণকারী (আল্লাহ্ তা‘আলা)’র পক্ষ থেকে কোন ঘোষণা এসে থাকে তবে ‘খতমে নুবূয়তের’ আক্বীদার উপর প্রেরণকারী ও প্রেরিত উভয়ের দিক থেকে চূড়ান্ত মোহর লেগে যাবে। সুতরাং নিজেদের অন্তরগুলোর দরজা খুলে নবী প্রেরণকারী (আল্লাহ্ তা‘আলা)’র ঘোষণা শুনুন- তিনি ক্বোরআন মজীদে এরশাদ করেছেন- مَاكَانَ مُحَمَّدٌ اَبَآ اَحَدٍ مِّنْ رِجَالِكُمْ وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيّيْنَ ـ
তরজমা: মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের মধ্য থেকে কোন (বয়োপ্রাপ্ত) পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রসূল এবং নবীগণের মধ্যে সর্বশেষ নবী। [সূরা আহযাব, আয়াত-৪০]
হাদীস শরীফগুলোতে উপরোক্ত আয়াত শরীফের ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ خَاتَمَ النَّبِيّيْنَ বা (সর্বশেষ নবী) শব্দ দু’টির তাফসীর বা ব্যাখ্যা খোদ্ হুযূর নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম থেকে এ শব্দগুলো দ্বারা উদ্ধৃত হয়েছে যে- اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِىْ (আমি সর্বশেষ নবী, আমার পরে কোন নবী নেই)। এতদ্ব্যতীত অন্যান্য হাদীসে اخِرُ الْاَنْبِيَآءِ (আখিরুল আম্বিয়া) দ্বারাও خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ (খাতামুন্নাবিয়্যীন)-এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ জন্য সাহাবা-ই কেরাম থেকে আরম্ভ করে উম্মতের সকল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি ও ‘সলফে সালেহীন’ (সুযোগ্য অগ্রণীগণ) পর্যন্ত সবাই একথার উপর ইজমা’ করেছেন (একমত হয়েছেন) যে, ‘খাতামুন্নাবিয়্যীন’ মানে ‘আখিরুল আম্বিয়া’ (সর্বশেষ নবী)।
এসব ‘নাস’ (نصوص) বা ক্বোরআন-সুন্নাহর দলীল ও উম্মতের ইজমা’র ভিত্তির উপর ‘খতমে নুবূয়ত’-এর এ আক্বীদা প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের উপর ছাইয়ে আছে। এতদ্ব্যতীত, এ আক্বীদা বা ধর্ম-বিশ্বাসের এক আশ্চর্যজনক কারিশ্মা (চমৎকারিত্ব) এও আছে যে, দ্বীনের অগণিত শাখার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও এ আক্বীদার উপর সবাই একমত যে, সরওয়ার-ই কাউনাঈন সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সর্বশেষ নবী। তাঁর পরে অন্য কোন নবী নেই। তাঁর পর প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ’ বছর যাবৎ কোটি কোটি মানুষের চিন্তা-ভাবনার একই ধরন কোন কাকতালীয় শুভ ঘটনা হতে পারেনা; বিশেষ করে এমন অবস্থায়, যখন হুযূর-ই আনওয়ার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর এ মহান বাণীও সামনে রাখা যায় যে, ‘আমার উম্মত গোমরাহী (পথভ্রষ্টতা)’র উপর কখনো একমত হবে না।’’
আলোচনা যদিও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি সহকারে সমাপ্ত হয়েছে, তবুও হৃদয়ের প্রশান্তির জন্য একটু এ বিষয়েও গভীরভাবে চিন্তা করা যায় যে, সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পর নবী আসার ধারাবাহিকতা (পরম্পরা) জারী থাকার কোন আলামত বা সম্ভাবনাও থাকছে কিনা। সুতরাং এ প্রসঙ্গে আমরা ‘ইলমে ইয়াক্বীন’ (নিশ্চিত বিশ্বাস সম্পর্কিত জ্ঞান)-এর সর্বোচ্চ চূড়ার উপর দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছি যে, আজ থেকে অনেক দিন আগেই এ সম্ভাবনার দরজা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে তাতে মজবুত তালা ঝুলে গেছে। আর আলামতও এমনভাবে হারিয়ে গেছে যে, উভয় জাহানের কোথাও হাতে উজ্জ্বল প্রদীপ নিয়ে তালাশ-অন্বেষণ করলেও পাওয়া যাবে না।
এরপর সেটার যদি সম্ভাবনা থাকতো, তবে মহা সত্যবাদী পরম আমানতদার পয়গাম্বর আলায়হিস্ সালাতু ওয়াস্ সালাম, যিনি হযরত ঈসা মসীহ্ আলায়হিস্ সালাম-এর নাযিল হবার খবর দিয়েছেন, তিনি কখনোই একথা বলতেন না যে, ‘আমার উপর নবী আসার পরম্পরা (ধারা) সমাপ্ত হয়ে গেছে, ‘আমি সর্বশেষ নবী, আমার পর কোন নবী নেই।’ আর আমরা চূড়ান্ত নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, নবী-রসূলের পক্ষে মিথ্যা বলা ও সত্য গোপন করা কখনোই সম্ভবপর নয়। আর ‘ক্বরীনাহ্’ বা আলামত সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলবো যে, যদি তা থাকতো, তবে তা পাওয়ার সর্বোত্তম জায়গা ছিলো ‘আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাব’ (ক্বোরআন মজীদ)। যখন ত্রিশটি পারা সম্বলিত এ বিরাটাকার গ্রন্থের একটি আয়াতও এমন নেই, যেখানে এ ‘আয়াত’ পাওয়া যায় যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পরও কোন নবী আসবে; বরং এর সম্পূর্ণ বিপরীতে নিছক আলামতই নয়, বরং এ মর্মে একেবারে সুস্পষ্ট বর্ণনাই মওজূদ আছে যে, ‘হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী।’ যেমন-এরশাদ হয়েছে, وَلكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ (কিন্তু তিনি হলেন আল্লাহর রসূল এবং সর্বশেষ নবী)। (চলবে)