মায্হাব অনুসরণ ও বিভ্রান্তি নিরসন

0
মায্হাব অনুসরণ ও বিভ্রান্তি নিরসন
মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি
অধ্যক্ষ, মাদরাসা -এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল
মধ্য হালিশহর, বন্দর, চট্টগ্রাম।
খতিব- কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ, মোমিন রোড চট্টগ্রাম।

সম্পাদনায় : মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার

প্রথম প্রকাশ : ১১ জমাদিউল উলা ১৪৪২ হিজরি
১১ পৌষ, ১২২৭ বাংলা
২৬ ডিসেম্বর, ২০২০ ইংরেজি
সর্বস্বত্ত্ব প্রকাশকের :
বর্ণসাজ : মুহাম্মদ ইকবাল উদ্দীন
হাদিয়া : ২০/- (বিশ) টাকা মাত্র।
প্রকাশনায়
আন্জুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট [প্রচার ও প্রকাশনা বিভাগ] ৩২১, দিদার মার্কেট (৩য় তলা দেওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম-৪০০০, বাংলাদেশ। ফোন : ০৩১-২৮৫৫৯৭৬,

 

সূচীপত্র
 বিষয় পৃষ্ঠা
 লেখকের কথা ০০০
 মুজতাহিদ ও মুকাল্লিদ এর সংজ্ঞ
 তাকলীদের প্রকারভেদ
 আল কুরআনের আলোকে মাযহাব অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল
 আল্ হাদীসের আলোকে মাযহাব অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার দলিল
 মনীষীদের দৃষ্টিতে তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণ
 ইমাম আযমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
 ইমাম আযম সম্পর্কে মুজতাহিদ ইমাম ও মনীষীদের অভিমত
 ইমাম শাফেয়ী (জন্ম ১৫০হি./৭৬৭ খ্রি., ওফাত ২৪০হি./৮১৯ খ্রি.) এর অভিমত
 হানাফীদের নামায প্রসঙ্গ
 রুকুতে যাওয়া ও রুকু হতে উঠার সময় দু’হাত না তোলার যৌক্তিকতা
 قِرْاءَةُ خَلْفِ الْاِمَامِ বা ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরআত পড়া নিষেধ
 قِرْأَةُ خَلْفِ الْاِمَامِ ইমামের পিছনে কিরআত
প্রসঙ্গে ফোকাহায়ে কেরামের অভিমত
 لَاصَلَوةَ اِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ হাদীসের ব্যাখ্যা
 أَمِيْنُ بِالسِّرِّ আমীন নীরবে বলা প্রসঙ্গে
 পবিত্র ক্বোরআনের আলোকে প্রমাণ
 হাদীসের আলোকে প্রমাণ
 গায়রে মুকাল্লি লা মাযহাবীদের অভিযোগ ও জবাব
লেখকের কথা
ইসলামী জীবন বিধানের দলীল চতুষ্টয় কুরআন, সুন্নাহ্, ইজমা, কিয়াসের আলোকে মযহাবের মহান ইমামগণ নামায, রোজা, হজ্ব যাকাত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও যুগ জিজ্ঞাসার সমাধান দিয়েছেন, যুগে যুগে পৃথিবীর মুসলমানগণ ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন মাসয়ালা মাসাইল সম্পর্কে মুজতাহিদ ইমামগণের প্রদত্ত ফাত্ওয়া ও সিদ্ধান্তের আলোকে ধর্মের বিধি বিধান পালন করে আসছেন। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী আলিমগণ কুরআন হাদীসের আলোকে মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণ করাকে ওয়াজিব বলেছেন। বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমানগণ প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাব তথা হানাফী, শাফিঈ, মালিকী ও হাম্বলী চারটির যে কোন একটির অনুসারী, তবে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে হযরত ইমাম আবু হানীফা নামানুসারে প্রবর্তিত হানাফী মাযহাবই সর্বাধিক সমাদৃত। তিনি হানাফী মাযহাবের প্রবক্তা ও মুজতাহিদ কুল শিরোমণি। তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী ফিকহশাস্ত্র প্রণয়ন ও সংকলন করেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এ পর্যন্ত মাযহাব বিষয়ক শত সহ¯্র গ্রন্থাবলী রচিত হয়েছে। মুসলিম জনসাধারণ দৈনন্দিন জীবনে আবহমানকাল থেকে মাযহাব অনুসরণ করে চলছেন, দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামের নামে এক শ্রেণির উগ্রপন্থিরা সম্মানিত মুজতাহিদ ইমামগণের প্রতি বিষোদগার ও তাঁদের প্রতি জনমনে প্রতিনিয়ত বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কুরআন, সুন্নাহর অনুসরণের নামে মাযহাব বিরোধীতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। সাধারণ মুসলমান তো বটেই এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে শিক্ষিত সমাজও বিভ্রান্ত হচ্ছে। দৈনন্দিন সালাত আদায়ের ক্ষেত্রে, মাযহাব বিরোধীতার প্রবণতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আনজুমান ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত দেশ-বিদেশে প্রচার বহুল জনপ্রিয় মাসিক মুখপত্র তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত-এ আমার লিখিত ‘তাকলীদ ও মাযহাব’ শিরোনামে ২০১৩ সালে ধারাবাহিক প্রকাশিত লেখাটি আনজুমান ট্রাস্ট কর্তৃক ‘মাযহাব অনুসরণ ও বিভ্রান্তি নিরসন’ নামে পুস্তিকাকারে প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করায় কর্তৃপক্ষের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক মুহতারাম আলহাজ্ব আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান সাহেব ব্যস্ততার মাঝেও বইটির মুখবন্ধ লিখে আমাদের কৃতার্থ করেছেন।
মুদ্রণ কাজে যারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন, সকলের প্রতি রইলো আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। বইটি ত্রুটিমুক্ত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও কোথাও মুদ্রণপ্রমাদ পরিদৃষ্ট হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টি একান্তভাবে কাম্য। পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনে সহায়তা করলে কৃতার্থ হতো।
আল্লাহ্ ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এ ক্ষুদ্র প্রয়াস কবুল করুন। আমীন।
মুখবন্ধ
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
নাহমাদুহু ওয়া নুসাল্লী ওয়া নুসাল্লিমু আলা হাবীবিহিল কারীম
ওয়া আলা আলিহী ওয়া সাহবিহী আজমা‘ঈন।
প্রত্যেক মানুষের উপর সর্ব প্রথম ফরয হচ্ছে ঈমান আনা। ঈমান আনার পর প্রত্যেক মু’মিনের উপর বর্তায় নামায, রোযা, হজ্ব ও যাকাত ইত্যাদির বিধানাবলী। এ বিধানাবলীর উৎস হচ্ছে ক্বোরআন (কিতাবুল্লাহ্), সুন্নাহ্, ইজমা’ ও ক্বিয়াস।
এ চতুষ্টয় দলীলে মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান রয়েছে। যাবতীয় বিধান এ চতুর্দলীল থেকে অনুমিত হয়। বলাবাহুল্য, এসব উৎসমূল থেকে মাসয়ালা-মাসাইল অনুমান করে সঠিকভাবে তারাই উপস্থাপন করতে পারে, যাদের মধ্যে ওই জ্ঞানগত যোগ্যতা রয়েছে। সুতরাং পবিত্র ক্বোরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দেশ দিয়েছেন, ‘‘ফাসআলূ……আহ্লায যিক্রি ইনকুন্তুম লা-তা’লামূন।’’ অর্থাৎ তোমরা, যারা জানো না, তারা যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো। কাজেই, যারা এমন জ্ঞান রাখেন, তারা হলেন মুজতাহিদ আর যারা ওই পর্যায়ের নয় তারা হলো মুক্বাল্লিদ। আল্লাহ্ তা‘আলা মুক্বাল্লিদ পর্যায়ের মুসলমানদেরকে মুজতাহিদদের শরণাপন্ন হবার নির্দেশ দিয়েছেন। এ’তে মুজতাহিদ ইমামদের অনুসরণ ওয়াজিব বা অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হয়।
সুতরাং সমস্ত মুসলমান দু’ভাগে বিভক্ত-মুজতাহিদ ও মুক্বাল্লিদ। উসূলে ফিক্হ্, শাস্ত্রে ‘মুজতাহিদ’-এর যোগ্যতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং যাঁরা ওই যোগ্যতার অধিকারী তাদের উপর একদিকে মাসআলা অনুমান করা (ইজতিহাদ করা) ওয়াজিব, অন্যদিকে যারা ওই পর্যায়ের নয়, অর্থাৎ ‘মুক্বাল্লিদ’ তাদের উপর কোন না কোন মুজতাহিদের অনুসরণ করা ওয়াজিব। উল্লেখ্য, মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হলেন ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তথা তাঁর মাযহাবের অনুসারীরা হলেন হানাফী।
ইসলামী শরীয়তের বিধানানুসারে মুক্বাল্লিদ মুসলমানদের উপর কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ করা ওয়াজিব। মাযহাবের অনুসরণ শুধু ওয়াজিব তা নয়; বরং এটাই প্রতিটি মুক্বাল্লিদের জন্য নিরাপদও। কারণ, কোন মুক্বাল্লিদ যদি কোন মাযহাবের অনুসরণ না করে সরাসরি কিতাব ও সুন্নাহ্ ইত্যাদি থেকে মাসআলা অনুমানের দুঃসাহস দেখায়, সে যে তাতে ভুল করবে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। উদাহরণস্বরূপ কেউ যদি চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করে পাশ করা ডাক্তার না হয়ে নিজে নিজে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বই-পুস্তক থেকে ঔষধ সেবন করে কিংবা কোন রোগীকে সেবন করায়, তবে তার ও ওই রোগীর মৃত্যু অনিবার্য। তেমনি, ইসলামের দলীল চতুষ্টয়কে সহজ মনে করে, দক্ষ আলিম, ইমাম, মুজতাহিদ ইত্যাদি না হয়ে সরাসরি (নিজে নিজে) মাসআলা অনুমান করতে চায় তার ঈমান ও আমল উভয়ই হুমকির সম্মুখীন হওয়াও অনিবার্য।
মাযহাবের অনুসরণের অপরিহার্যতার পক্ষে ক্বোরআন (কিতাব), সুন্নাহ্ ইত্যাদিতে অকাট্য প্রমাণাদিও রয়েছে। ওইগুলো পাঠ পর্যালোচনা করলে এ সত্য বিষয়টি অনুধাবন করা যাবে, এবং কেউ মাযহাবের অনুসরণের অপরিহার্যকে অস্বীকার করার দুঃসাহস দেখাবে না। তদুপরি, মাযহাবের মুজতাহিদ ইমামগণের যোগ্যতা ও এ ক্ষেত্রে পরিশ্রম যে উম্মতকে তাঁদের নিকট চিরঋণী করেছেন তাও সহজে অনুমান করা যাবে।
কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, ইসলামের নামে এমন কিছু ভ্রান্ত লোক দেখা যায়, যারা শুধু মাযহাবকে অস্বীকার করে না; বরং ইমাম-ই আ’যমসহ মাযহাবের ইমামদের শানে বেয়াদবী করে বেড়ায়। তারা বলে ক্বোরআন-হাদীস তাদের সামনে আছে। সুতরাং কোন মাযহাব মানার প্রয়োজন নেই। এটাও মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করার এবং ইসলামী ঐক্যে ফাটল ধরানোর একটি সুক্ষ্ম ষড়যন্ত্র।
এসব বিষয় অতি প্রমাণ্যভাবে আলোকপাত করে পুস্তকটি রচনা করা এবং ওইগুলো বহুলভাবে প্রচার করার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। সুখের বিষয় যে, অধ্যক্ষ আল্লামা বদিউল আলম রিজভী সাহেব এ প্রসঙ্গে একটি প্রামাণ্য পুস্তক বাংলা ভাষায় প্রণয়ণ করেছেন যা প্রথমে মাসিক তরজুমান-এ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছেন। লেখাটি মুসলিম সমাজে সঙ্গতকারণে সমাদৃত হয়েছে। এখন স্বতন্ত্র একটি পুস্তকাকারে সেটা ছাপানোর জন্য আনজুমান ট্রাস্ট উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। আলোচ্য বিষয়ে উপস্থাপিত দলীল প্রমাণসহ বর্ণনাদি একটি পুস্তকে সন্নিবিষ্ট হওয়ায় পাঠক সমাজের বিশেষ উপকার সাধন করবে তাতে সন্দেহ নেই।
আমি এজন্য লেখক ও প্রকাশককে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি এবং পুস্তকটির বহুল প্রচার ও সমাদর কামনা করছি।
ইতি-
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার
পশ্চিম ষোলশহর, চট্টগ্রাম।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

মাযহাব ও তাকলিদ

মাযহাব ও তাকলিদ শব্দ দু’টি আরবি। মাযহাব শব্দের অর্থ পথ চলা। শরিয়তের পরিভাষায় মাযহাব হলো দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে মুজতাহিদ কর্তৃক শরয়ী হুকুম সম্পর্কে প্রদত্ত সঠিক ব্যাখ্যা।
তাকলিদ تقليد শব্দের আভিধানিক অর্থ গলায় হার পরিয়ে দেওয়া। ব্যবহারিক অর্থে অনুসরণ করা। শরিয়তের পরিভাষায় তাকলিদের সংজ্ঞা বর্ণনায় বিভিন্ন মতামত পরিলক্ষিত হয়। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা নি¤েœ বর্ণিত হলো।
তাকলিদ প্রসঙ্গে তাফসীরে কাশ্শাফে উল্লেখ হয়েছেÑ
১. اَلتَّقْلِيْدُ اِتِّبَاعُ الْاِنْسَانِ غَيْرَهُ فِيْمَا يَقُوْلُ اَوْ يَفْعَلُ مُعْتَقِدًا لِلْحَقِيَّةِ مِنْ غَيْرِ نَظْرِ اِلَى الدَّلِيْلِ كَاَنَّ هَذَا الْمُتَّبِعُ جَعَلَ قَوْلُ الْغَيْرِ اَوْ فِعْلِهِ قَلَادَةً فِىْ عُنُقِهِ مِنْ غَيْرِ مُطَالَبَةُ دَلِيْلٍ
তাকলিদ হচ্ছে কোন মানুষের অন্য কাউকে (মুজতাহিদ) তিনি যা বলেন বা করেন তা সত্য জেনে অনুসরণ করা। এক্ষেত্রে কোন দলিলের প্রতি দৃষ্টিপাত না করা যেন অনুসরণকারী ব্যক্তি অন্যজনের (মুজতাহিদের) কথা বা কর্মকে কোন প্রকার দলিল প্রমাণ ছাড়াই নিজের গলার হার স্বরূপ গ্রহণ করে নিলো।
২. ইমাম গাজ্জালীর অভিমত-
اَلتَّقْلِيْدُ هُوَ قُبُوْلِ قَوْلٍ بِلْاِحْجَةٍ
অর্থাৎ তাকলীদ বলা হয় কারো উক্তি দলিল প্রমাণ ছাড়াই গ্রহণ করা।
৩. ইসলামী আইনজ্ঞ ফোকাহায়ে কেরামের মতে
اَلتَّقْلِيْدُ هُوَ الْعَمَلُ مَقُوْلُ اِمَامٍ مُجْتَهِدٍ مِنْ غَيْرِ مُطَالَبَةِ دَلِيْلٍ
অর্থাৎ প্রমাণ অন্বেষণ ছাড়াই কোন মুজতাহিদ ইমামের কথা অনুসারে আমল করাকে তাকলিদ বলে।
৪. আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ্ বিহারী মুসাল্লামুস সবুত কিতাবে তাকলিদ প্রসঙ্গে বলেন-
اَلتَّقْلِيْدُ الْعَمَلُ بِقَوْلِ الْغَيْرِ مِنْ غَيْرِحُجَّةٍ
অর্থাৎ তাকলিদ হচ্ছে কোন দলিল প্রমাণ ছাড়াই অন্যের মতানুযায়ী আমল করা।
দলীল প্রমাণ অšে¦ষণ না করার অর্থ এই নয় যে, মুজতাহিদের কাছে কোন দলিল নেই অথবা মুজতাহিদের মনগড়া কথার উপর আমল করা হচ্ছে তা নয় প্রকৃত কথা হলো, মুজতাহিদের কাছে কোন না কোন প্রমাণ অবশ্যই আছে কিন্তু মুকাল্লিদের জন্য (অনুসরণকারীর) তা অšে¦ষণ করা অপরিহার্য নয়। তবে তাকলিদকারী এ ক্ষেত্রে যদি কোন দলিল জ্ঞাত হয় বা কোন বিধানের দলিল জানতে সচেষ্ট হয় তা তাকলিদের পরিপন্থি হবে না।
মুজতাহিদ ও মুকাল্লিদ এর সংজ্ঞা
প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ জ্ঞান সম্পন্ন মুসলমান দুই প্রকার ঃ
১. মুজতাহিদ ও
২. গায়রে মুজতাহিদ বা মুকাল্লিদ।
যিনি কুরআন মজীদ, হাদীস শরীফের ইঙ্গিত, রহস্য, আল্লাহ্ ও রসূলের বাণীর প্রকৃত উদ্দেশ্য নিজ জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও যোগ্যতায় বুঝতে সক্ষম, কুরআন হাদীস থেকে সরাসরি শরয়ী মাসআলা বের করতে সমর্থ রাখেন, নাসিখ-মানসুখ সম্পর্কিত জ্ঞানে পারদর্শী আরবি ব্যাকরণশাস্ত্র, নাহভ, অলংকারশাস্ত্র বালাগাত ইত্যাদি বিষয়ে পূর্ণমাত্রায় সুদক্ষ, শরীয়তের আহকাম তথা বিধিসংক্রান্ত আয়াতসমূহ ও হাদীস সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান রাখেন তিনিই মুজতাহিদ।
যিনি ঐ স্তরে পৌঁছতে পারেনি বা উপর্যুক্ত যোগ্যতার অধিকারী নন তাকে বলা হয় গায়রে মুজতাহিদ বা মুকাল্লিদ। যিনি গায়রে মুজতাহিদ বা মুজতাহিদ নন তার জন্য মুজতাহিদের তাকলিদ বা অনুসরণ করা অপরিহার্য। আর যিনি মুজতাহিদ তার জন্য অন্যের তাকলিদ বা অনুসরণ নিষিদ্ধ।
তাকলীদের প্রকারভেদ
তাকলিদ দুই প্রকারÑ
১. তাকলিদে মুতলাক (সাধারণ অনুসরণ) ও
২. তাকলিদে শাখসী (নির্দিষ্ট ইমামের অনুসরণ)।
ব্যাখ্যা
১. নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের অনুসরণ না করে নানা বিষয়ে বিভিন্ন জনের মতামত অনুসরণ করাকে তাকলিদে মুতলাক বলা হয়।
২. শরিয়তের সামগ্রিক বিষয়ে একজন ইমামের অনুসরণ করাকে তাকলিদে শাখসী বলা হয়।
হিজরী প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মুসলমানদের যুগ রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের যুগের কাছাকাছি হওয়ার কারণে তাঁদের মধ্যে প্রবৃত্তির অনুসরণ ছিলনা বললেই চলে, যখন যে বিষয়ে যার ফায়সালা সঠিক মনে করতেন, সে ফায়সালা মেনে নিতেন, তখন তাঁদের মধ্যে সুবিধা লাভের মনোভাব না থাকার কারণে তাকলিদে মুতলাক তথা সাধারণ অনুসরণে আপত্তি ছিল না। পরবর্তীতে ক্রমাগতভাবে মানব সমাজে কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী একই সময়ে একই সাথে বিভিন্ন মুজতাহিদের ফায়সালা গ্রহণের প্রবণতা দেখা দিলে শরীয়তের বিধি বিধান নিয়ে হাসি তামাশার আশঙ্কা দেখা দেয়। যেমন ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মতে, শরীর থেকে রক্ত প্রবাহিত হলে অযু ভঙ্গ হয় না, ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলায়হির মতে, এতে অযু ভঙ্গ হয়। ইমাম শাফেয়ী রহমাতুল্লাহি আলায়হির মতে, কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে অযু ভঙ্গ হয়। ইমাম আবু হানিফার মতে, এতে অযু ভঙ্গ হয় না। কোন ব্যক্তি যদি এ মত পার্থক্যের সুযোগ নিয়ে রক্ত প্রবাহিত হওয়ার ব্যাপারে ইমাম শাফেয়ীর মত অনুসরণ করেন। মহিলাদের স্পর্শ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানিফার অনুসরণ করেন, তা হবে সুবিধাবাদী মনোভাবের পরিচায়ক। এ কারণে তা বৈধ হবে না। উপরোক্ত কারণেই হিজরি চতুর্থ শতাব্দীতে তাকলিদে মুতলাকের অনুমতি রহিত হয়ে যায়। তাকলিদে শখসী তথা নির্দিষ্টভাবে চার মাযহাবের যে কোন এক মাযহাবের ইমামের তাকলিদ বা অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হয়।
—০—
আল কুরআনের আলোকে মাযহাব
অনুসরণ ওয়াজিব হওয়ার দলিল
মহাগ্রন্থ আল কুরআনুল করীমের অসংখ্য আয়াত দ্বারা মাযহাব অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার ব্যাপারে প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে কয়েকটি আয়াতে করীমা পেশ করা হলোÑ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ،
Ñহে ঈমানদারগণ নির্দেশ মান্য করো আল্লাহর এবং নির্দেশ মান্য করো রসূলের আর তাদেরই যারা তোমাদের মধ্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত।
উল্লিখিত আয়াতে أُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ (উলীল আমরে মিনকুম) দ্বারা শরিয়তের হক্কানী আলেমেদ্বীন মুর্শিদে কামিল, মুজতাহিদ ইমাম, ইসলামী সুলতান (রাষ্ট্রপ্রধান) এবং ইসলামী বিচারকগণ এর আনুগত্য করা ওয়াজিব। এ আয়াত থেকে তাকলিদ তথা মাযহাবের ইমামের অনুসরণ অপরিহার্য।
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ، صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ.
Ñআমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত করো, তাদেরই পথে যাঁদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছো।
আয়াতে বর্ণিত সিরাতাল মুস্তাকিম দ্বারা ইসলাম কুরআন মজীদ, প্রিয়নবী হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জীবনাদর্শ, আহলে বায়তে রসূল, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তবে তাবেঈ, সালেহীন, আউলিয়ায়ে কামেলীন, মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত পথ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের বৃহত্তম জামাআতকে বুঝানো হয়েছে। সোজা পথ বলতে সকল মুফাস্সির, মুহাদ্দিস, ফকীহ্, গাউস কুতুব, আবদাল ও অলী আল্লাহর অনুসৃত পথকে বুঝানো হয়েছে। তাঁরা সকলেই ছিলেন, মুকাল্লিদ তথা মাযহাবের অনুসারী, মাযহাব মান্য করা এ আয়াতের নির্দেশ মান্য করার নামান্তর।
কুরআনুল করীমের নিম্নোক্ত আয়াতেও মুজতাহিদ ইমামগণের তাকলিদ তথা অনুসরণের ইঙ্গিত রয়েছে। সমস্যা সমাধানে তাঁদের পথ নির্দেশ (এঁরফব ষরহব) উম্মতের জন্য দিশারীর ভূমিকা পালন করবে। এরশাদ হয়েছেÑ
وَإِذَا جَاءَهُمْ أَمْرٌ مِنَ الْأَمْنِ أَوِ الْخَوْفِ أَذَاعُوا بِهِ وَلَوْ رَدُّوهُ إِلَى الرَّسُولِ وَإِلَى أُولِي الْأَمْرِ مِنْهُمْ لَعَلِمَهُ الَّذِينَ يَسْتَنْبِطُونَهُ مِنْهُمْ،
অর্থ যখন তাঁদের কাছে আসে কোন নিরাপত্তার বিষয় অথবা কোন ভয়ভীতির বিষয় তখন তাঁরা তা প্রচার করে। যদি তাঁরা তা রাসূল ও তাঁদের মধ্যকার নেতৃস্থানীয় আলিম (ওলীল আমর) দের নিকট উপস্থিত করত তবে নিশ্চয় তাঁদের নিকট থেকে সেটার বাস্তবতা জানতে পারতো।
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
فَثَبَتَ أَنَّ الِاسْتِنْبَاطَ حُجَّةٌ، وَالْقِيَاسُ إِمَّا اسْتِنْبَاطٌ أَوْ دَاخِلٌ فِيهِ، فَوَجَبَ أَنْ يَكُونَ حُجَّةً. إِذَا ثَبَتَ هَذَا فَنَقُولُ: الْآيَةُ دَالَّةٌ عَلَى أُمُورٍ: أَحَدُهَا: أَنَّ فِي أَحْكَامِ الْحَوَادِثِ مَا لَا يُعْرَفُ بِالنَّصِّ بَلْ بِالِاسْتِنْبَاطِ. وَثَانِيهَا: أَنَّ الِاسْتِنْبَاطَ حُجَّةٌ. وَثَالِثُهَا: أَنَّ الْعَامِّيَّ يَجِبُ عَلَيْهِ تَقْلِيدُ الْعُلَمَاءِ فِي أَحْكَامِ الْحَوَادِثِ.
অর্থ প্রমাণিত হলো যে, মুজতাহিদ কর্তৃক ফিকহী হুকুম উদ্ঘাটন ও উদ্ভাবিত হুকুম শরীয়তের স্বীকৃত দলিল। আর কিয়াসের বিষয়টি ইজতিহাদের সমার্থক কিংবা অন্তর্ভুক্ত বিধায় কিয়াস ও শরিয়তের দলিল।
বর্ণিত আয়াতে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত। প্রথমত- কুরআন হাদীসের দলিলের প্রত্যক্ষভাবে কোন বিষয় জানা না গেলে ইজতিহাদের দ্বারস্থ হওয়া। দ্বিতীয়ত: ইজতিহাদ তথা মুজতাহিদ ইমামগণের উদ্ঘাটিত সমাধান শরিয়তের দলিল, তৃতীয়ত উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে মুজতাহিদ, ইমাম ব্যক্তিগণ মুজতাহিদ, ইমামগণের তাকলিদ করা অপরিহার্য। সূরা তাওবার নিম্নোক্ত আয়াত তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে। এরশাদ হয়েছে-
فَلَوْلَا نَفَرَ مِنْ كُلِّ فِرْقَةٍ مِنْهُمْ طَائِفَةٌ لِيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنْذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ،
অর্থ অতঃপর কেন বের হয় না প্রত্যেক বড় দল থেকে একটি ছোট দল (طائفة) যেন তারা দ্বীনের আহকাম সম্বন্ধে গভীর প্রজ্ঞা অর্জন করতে পারে যখন তারা নিজ সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসে যে তখন তাঁদেরকে সতর্ক করতে পারে এ আশায় যে তারা সতর্ক হবে।
আয়াতে বর্ণিত طَائِفَةٌ (ছোট দল) হচ্ছে اُوْلِىْ الْاَبْصَارِ বা চিন্তাশীল ব্যক্তিরা, যাঁদের উপর আল্লাহ্ আহকাম উদ্ভাবনের দায়িত্ব ন্যস্ত করেছেন। ইসলামী শরিয়তের মুজতাহিদ ইমাম কর্তৃক শরয়ী মাসআলা তথা আহকাম উদ্ঘাটন ও বের করার ব্যবস্থা এজন্য করা হয়েছে যে, যেন ইসলামী শরীয়ত সর্বযুগে সর্বকালে সর্বাবস্থায় পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত থাকে যেন মুসলমানদের সমস্যা সমাধানে পৃথিবীর অন্য কোন মতবাদের দ্বারস্থ বা মুখাপেক্ষী হতে না হয়।
মুজতাহিদ ইমামগণ মুহাজির, আনসার সাহাবীদের অনুসারী। মাযহাবের ইমামগণের তাকলিদ তথা অনুসরণে সাহাবীদের অনুসরণ নিহিত। এরশাদ হয়েছে-
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ،
Ñএবং সবার মধ্যে অনুগামী প্রথম মুহাজির ও আনসার আর যারা সৎকর্মের সাথে তাদের অনুসারী হয়েছে আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।
আয়াত থেকে প্রমাণিত হলো আল্লাহ্ তা‘আলা তিন শ্রেণির বান্দার উপর সন্তুষ্ট। যথাÑ ১. মুহাজির; ২. আনসার ও ৩. মুহাজির আনসার সাহাবীদের অনুসরণকারী মুসলমানগণ।
মুজতাহিদ ইমাম তথা তাকলিদ বা মাযহাব মান্যকারী মুসলমানগণ এ আয়াতের অন্তর্গত। যারা তাকলীদে তথা মাযহাবে বিশ্বাস করে না, মাযহাবের সম্মানিত মুজতাহিদ ইমামগণের প্রতি কটূক্তি ও সমালোচনায় লিপ্ত, মাযহাব অনুসরণ করাকে গুনাহ্ ও শিরক বলে আক্বিদা পোষণ করে তারা এ আয়াতের বাইরে। তারা অভিশপ্ত, ঘৃণিত। আয়াত থেকে আরো প্রমাণ হলো যারা মুহাজির ও আনসার সাহাবাদের তাকলীদ করেন, (অনুসরণ) তাঁদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি রয়েছে। এ কারণে পৃথিবীতে দিন দিন মাযহাব অনুসারীগণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আলিমগণ হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী চারটি প্রসিদ্ধ মাযহাবের যে কোন একটি মাযহাবের অনুসরণ করাকে অপরিহার্য মনে করে থাকেন।
শরয়ী জ্ঞানে অভিজ্ঞ আলিমদের শরণাপন্ন হয়ে অজানা বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা, অস্পষ্ট বিষয়ে সঠিক ধারণা লাভের ব্যাপারে আল্লাহ্ পাকের নির্দেশ রয়েছে। এরশাদ হয়েছেÑ
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ،
Ñজ্ঞানবানদের কে জিজ্ঞাসা করো, যদি তোমাদের জ্ঞান না থাকে। এ আয়াত দ্বারা মাযহাবের ইমামের তাকলিদ করা ওয়াজিব করা হয়েছে।
—০—
আল্ হাদীসের আলোকে মাযহাব
অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার দলিল
তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণের সমর্থনে অসংখ্য সহীহ হাদীস রয়েছে। কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় মাত্র কয়েকটি হাদীস প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করছি। বিশ্বাসীদের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট, পথভ্রষ্ঠ লা মাযহাবী আহলে হাদীস নামধারী অভিশপ্তদের জন্য দলিল প্রমাণের বিশাল স্তুপ কোন কাজে আসবেনা।
প্রথম হাদীস
عَنْ حُذَيْفَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ كُنَّا جُلُوسًا عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ إِنِّي لَا أَدْرِي مَا بَقَائِي فِيكُمْ فَاقْتَدُوا بِاللَّذَيْنِ مِنْ بَعْدِي وَأَشَارَ إِلَى أَبِي بَكْرٍ وَعُمَرَ(رواه الترمذى وابن ماجة واحمد).
Ñহযরত হুজায়ফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলাল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন। আমি জানিনা আর কতদিন তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকবো, তবে আমার পর তোমরা আবু বকর ও ওমর এর অনুসরণ করে যাবে।
তাকলিদের বৈধতার সপক্ষে বর্ণিত হাদীস নির্ভরযোগ্য প্রামাণ্য দলিল।
দ্বিতীয় হাদীস
عَنْ أَبِىْ سَعِيْدِنِ اْلخُدْرِىِّ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ [إِنَّ النَّاسَ لَكُمْ تَبَعٌ وَسَيَأْتِيكُمْ أَقْوَامٌ مِنْ أَقْطَارِ الْأَرْضِ يَتَفَقَّهُونَ فِي الدِّينِ، فَإِذَا أَتَوْكُمْ فَاسْتَوْصُوا بِهِمْ خَيْرًا]. (رواه الترمذى
অর্থ: হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন হুযুর পূরনুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের লক্ষ্য করে এরশাদ করেন, মানুষ তোমাদের অনুগামী হবে। তারা ভূপৃষ্ঠের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তোমাদের নিকট দ্বীনি ফিকহ অর্জন করতে আসবে। যখন তারা তোমাদের কাছে আসবে তোমরা তাদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে।
তাকলিদ বিরোধী মাযহাব অমান্যকারীরা বর্তমানে ফিকাহ শাস্ত্র ও মাযহাবের প্রবর্তক সম্মানিত মুজতাহিদ ইমামগণের প্রতি প্রতিনিয়ত বিষোদগার ছড়াচ্ছে। মিডিয়ার মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে মুসলিম সমাজকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করছে। বর্ণিত হাদীসের আলোকে অবশ্যই তারা পথভ্রষ্ট ও অভিশপ্ত।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবায়ে কেরামের যুগে ব্যাপকভাবে তাকলিদের প্রচলন ছিলো, জটিল কঠিন সমস্যার সমাধানে তাঁরা মুজতাহিদ সাহাবীদের শরণাপন্ন হতেন। তাঁদের প্রদত্ত সমাধানের আলোকে আমল করতেন, সাহাবা কেরামের জীবনাদর্শের অসংখ্য ঘটনাবলীতে এর প্রমাণ রয়েছে। নিম্ন বর্ণিত হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে।
তৃতীয় হাদীস
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: خَطَبَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ النَّاسَ بِالْجَابِيَةِ، فَقَالَ: ্রيَا أَيُّهَا النَّاسُ، مَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْقُرْآنِ، فَلْيَأْتِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ ، وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفَرَائِضِ فَلْيَأْتِ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ ، وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْفِقْهِ فَلْيَأْتِ مُعَاذَ بْنَ جَبَلٍ، وَمَنْ أَرَادَ أَنْ يَسْأَلَ عَنِ الْمَالِ فَلَيَأْتِنِي، فَإِنَّ اللهَ جَعَلَنِي لَهُ وَالِيًا وَقَاسِمًا،
প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একদা জবরিয়া নামক স্থানে ভাষণ দেন, তিনি বলেন হে মানব জাতি! যে কুরআন সম্পর্কে জানতে চায় সে যেন ওবাই ইবনে কা‘ব’র শরণাপন্ন হয়। যে ফরায়েজ (তথা সম্পত্তি বন্টন বিধি) সম্পর্কে জানতে চায়, সে যেন যায়দ বিন সাবিত এর শরণাপন্ন হয়, যে ফিকহ সম্পর্কে জানতে চায় সে যেন মুআয ইবনে জাবালের কাছে যায়। কারো যদি ধন সম্পদের প্রয়োজন হয় সে যেন আমার নিকট আসে। কারণ আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে সম্পদের অভিভাবক ও বন্টনকারী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন। এ হাদীস তাকলিদে শাখসীর উৎকৃষ্ট দলিল।
সাহাবীদের যুগেও অনেক ঘটনা ও সমস্যার সমাধানে কুরআন সুন্নাহর সুস্পষ্ট বর্ণনা না পাওয়ার কারণে সমস্যা সমাধানে মুজতাহিদ সাহাবাদের উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। নিম্ন বর্ণিত হাদীসে সাহাবায়ে কেরামের কর্ম পদ্ধতি ও ইজতিহাদের প্রতি হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি ও সমর্থন পাওয়া যায় এরশাদ হয়েছে।
চতুর্থ হাদীস
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا بَعَثَ مُعَاذًا إِلَى الْيَمَنِ قَالَ لَهُ: كَيْفَ تَقْضِي إِنْ عَرَضَ لَكَ قَضَاءٌ؟ قَالَ: أَقْضِي بِكِتَابِ اللهِ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي كِتَابِ اللهِ؟ قَالَ: أَقْضِي بِسُنَّةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: فَإِنْ لَمْ تَجِدْهُ فِي سُنَّةِ رَسُولِ اللهِ؟ قَالَ: أَجْتَهِدُ رَأْيِي لاَ آلُو، قَالَ: فَضَرَبَ بِيَدِهِ فِي صَدْرِي، وَقَالَ: الْحَمْدُ للهِ الَّذِي وَفَّقَ رَسُولَ رَسُولِ اللهِ لِمَا يُرْضِي رَسُولَ اللهِ.
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যখন হযরত মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে কাযী হিসেবে (বিচারক) ইয়ামনে পাঠান তখন মুআযকে লক্ষ্য করে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে মুআয! তুমি কিসের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করবে? হযরত মুআয বললেন কিতাবুল্লাহ্র (আল কুরআন) মাধ্যমে, হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসল্লাম বললেন, যদি কিতাবুল্লাহ্র মাধ্যমে সমাধান খুঁজে না পাও? তার উত্তরে মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, সুন্নাহর মাধ্যমে (আলহাদীস)। এর পর হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি এতেও না পাও? তখন হযরত মুআয রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি এ ব্যাপারে ইজতিহাদ করব। এতে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, সকল প্রশংসা ঐ আল্লাহর যিনি তাঁর রাসূলের দূতকে এমন বিষয়ের (ইজতিহাদের) তাওফিক দিয়েছেন, যার উপর তাঁর রাসূল সন্তুষ্ট আছেন।
পঞ্চম দলিল
বাতিল পন্থিদের অপব্যাখ্যার খন্ডনে ভ্রান্তনীতিমালার স্বরূপ উম্মোচন হবে, দ্বীনি শিক্ষার সঠিক মর্ম ও বিশ্লেষণে অভিজ্ঞ পারদর্শী মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসরণের অপরিহার্যতা নিম্ন বর্ণিত হাদীসে আলোকপাত হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَحْمِلُ هَذَا الْعِلْمَ مِنْ كُلِّ خَلَفٍ عُدُولُهُ، يَنْفُونَ عَنْهُ تَحْرِيفَ الْغَالِينَ، وَانْتِحَالَ الْمُبْطِلِينَ، وَتَأْوِيلَ الْجَاهِلِينَ،
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, এই ইলম পরবর্তী যুগের ন্যায়পরায়ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করেন, যারা এ ইলম (দ্বীনিজ্ঞান) থেকে চরমপন্থা অপব্যাখ্যাকারীদের বিকৃতিকরণ বাতিলপন্থীদের ষড়যন্ত্র ও অন্ধমূর্খদের ব্যাখা বিশ্লেষণ দূরীভূত করেন।
বস্তুত, মাযহাবের ইমামগণ ইসলামকে তাদের চেষ্টা সাধনার বদৌলতে বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করেন। সকল প্রকার অপব্যাখ্যা-অপপ্রচার প্রতিরোধে তাঁরা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইসলাম বিকৃতিকারীদের ষড়যন্ত্রের কালো থাবা থেকে ইসলামের স্বকীয়তা ও শ্রেষ্ঠত্বকে অক্ষুণœ রাখেন। মুসলিম উম্মাহর বিভ্রান্তির এ নাজুক সন্ধিক্ষণে ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে ইসলাম নামধারীদের বিভ্রান্তির এ নাজুক সন্ধিক্ষণে ঈমান আক্বিদা সংরক্ষণে ইসলাম নামধারী কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যাকারী মুনাফিক চক্রের বহুমুখী ষড়যন্ত্র থেকে ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অম্লান রাখার প্রয়াসে আজো তাঁদের অনুসরণ তথা তাকলিদ করা অপরিহার্য। মুজতাহিদ ইমামগণ ইসলাম নামধারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বাতিল আক্বিদার করাল গ্রাস থেকে ইসলামকে রক্ষার প্রত্যয়ে বাতিলপন্থিদের ভ্রান্তি নির্ধারণ ও তাঁেদর দাঁতভাঙ্গা জবাব দানের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা বিশ্বাসকে প্রণয়নের প্রয়াস পান। ইসলামের মৌলিক আকাইদ বিষয়ে যারা কুরআন-হাদীস ও সাহাবায়ে কেরামের যথাযথ অনুসারী তাঁরাই প্রকৃত পক্ষে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত এর অনুসারী। এই আকাইদ সুবিন্যস্ত করণে দ’ুজন মনীষীর অবদান অবিস্মরণীয়। ১. ইমাম আবুল মনসুর মুহাম্মদ ইবন মুহাম্মদ ইবন মাহমুদ আল মাতুরিদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (ইন্তেকাল ৩৩৩হি.) তিনি হানাফী মাযহাবের অনুসারী। ২. ইমামূল মুতাকাল্লীমিন আবুল হাসান আলী ইসমাইল আল আশআরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। (ইন্তেকাল ৩৩০হি.) তিনি শাফেয়ী মাযহাবভুক্ত ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু মুসা আশআরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু-এর অধস্তন বংশধর ছিলেন।
উল্লেখ্য যে, বর্ণিত ইমামদ্বয় হানাফী ও শাফেয়ী মাযহাব মতাবলম্বী হলেও প্রকৃত পক্ষে চারটি মাযহাবের প্রত্যেক ইমামগণ, চার মাযহাবের সকল মুজতাহিদ এবং মুকাল্লিদগণ আক্বিদাগতভাবে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত।
—০—
মনীষীদের দৃষ্টিতে তাকলিদ
তথা মাযহাব অনুসরণ
এক. প্রখ্যাত ফিকাহবিদ আল্লামা শেখ আহমদ প্রকাশ মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর তাফসীরাতে আহমদীয়াতে লিখেনÑ
قَدْ وَقَعَ الْاِجْمَاعَ عَلَى اَنَّ الْاِتِّبَاعَ اِنَّمَا يَجُوْزُ لِلْاَرْبَعَ اِلَى قَوْلِهِ وَكَذَا لَايَجُوْزُ الْاِتِّبَاعَ لِمَنْ حَدَّثَ مُجْتَهِدًا اِنْ مُخَالِفَا لهمْ،
এ ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ‘ইজমা’ হচ্ছে, যে চারজন ইমামেরই তাকলিদ (অনুসরণ) জায়িজ। কোন নতুন মুজতাহিদের আবির্ভাব হলে তার কথাবার্তা যদি চার মহান ইমামের পরিপন্থি হয়, তবে তার অনুসরণ জায়িজ হবে না।
দুই. প্রখ্যাত ফকিহ আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (ওফাত-৯৭০হি.) ইমাম চতুষ্টয়ের বিরোধিতাকে ইজমা পরিপন্থি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেনÑ
وَمَا خَالَفَ الْاَئِمَّةَ الْاَرْبَعَةَ فَهُوَ مُخَالِفُ لِلْاِجْمَاعِ،
কোন ব্যক্তির ভূমিকা ইমাম চতুষ্টয়ের বিরোধী প্রতীয়মান হলে সে মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ‘ইজমা’ বিরোধী হিসেবে বিবেচিত হবে।
তিন. হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ এর অভিমতÑ
اِنَّ هَذِهِ المَذْاهِبَ الْاَرْبَعَةَ الَمدُوْنَةَ المَحْرُرَةَ قَدِ اجْتَمَعْتَ الْاَئِمَّةَ اَوْ مَنْ يَّعْتَدَّ بِهَا مِنْهَا عَلَى جَوَازِ تَقْلِيْدُهَا اِلَى يَوْمِنَا هَذَا،
এই মাযহাব চতুষ্টয় যা সুবিন্যস্তভাবে সংকলিত হয়ে আছে মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত মতে মাযহাব চতুষ্টয়ের অনুসরণ অপরিহার্য হওয়া প্রসঙ্গে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ ধারা বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে।
চার.
وَالْاِنْصَافُ اَنْ اِنْحَصَارَ اْلمَذْاهِبَ فِىْ الْاَرْبَعَةِ وَاِتَّبَاعِهِمْ فَضْلُ اِلَهِىِّ وَقُبُوْلِيَّةِ مِنْ عِنْدِ اللهِ لَامُجَالٌ فِيْهِ لِلتَّوْجِيْهَاتِ وَالْاَدِلَّةِ،
ইনসাফের কথা হলো মাযহাব চারটির মধ্যে সীমাবদ্ধ হওয়া এবং ঐগুলোর অনুসরণ করা মহান আল্লাহর অনুগ্রহ বিশেষ এবং আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার দলিল। এ প্রসঙ্গে কারণ অনুসন্ধান ও প্রমাণাদি অনুসরণের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
পাঁচ. আল্লামা ইবনে হাজর মক্কী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর অভিমতÑ
اَمَّا فِىْ زَمَانِنَا فَقَالَ أَئِمَّتُنَا لَا يَجُوْزُ تَقْلِيْدُ غَيْرِ الْاَئِمَّةِ الْاَرْبَعَةِ الشَّافِعِىِّ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالىَ وَمَالِكُ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى أَبِىْ حَنِيْفَةَ رَحِمَهُ اللهُ تَعَالَى رِضْوَانُ اللهِ تَعَالىَ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِيْنَ، (فتح المبين صفحه১৯৬)
আমাদের যুগের ইমামগণের অভিমত হচ্ছে যে, ইমাম চতুষ্টয় ব্যতিরেকে অন্য কারো তাকলিদ (অনুসরণ) জায়িজ নয়। ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি, ইমাম আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (আল্লাহ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হোন।
এভাবে হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘ইকদুলজীদ’ গ্রন্থে নিম্নোক্ত শিরোনামেরبَابُ تَاكِيْدُ الْاَخْذِ بِهَذِهِ الْمَذَاهِبُ الْاَرْبَعَةِ التَّشْدِيْدِ فِىْ تَرْكِهَا وَالْخُرُوْجِ عَنْهَا মাযহাব চতুষ্টয় গ্রহণের অপরিহার্যতা ও তা বর্জন করার কঠোর পরিণতি সম্পর্কিত অধ্যায়ে বলেনÑ
إِعْلَمْ اَنَّ فِىْ الْاَخْذِ بِهَذِهِ اْلمَذْاهِبِ الْاَرْبَعَةِ مُصْلِحَةٌ عَظِيْمَةٌ وَفِىْ الْأَعْرَاضِ عَنْهَا كُلُّهَا مُغْدَةٌ كَبِيْرَةٌ،
‘জেনে রেখো, এই মাযহাব চতুষ্টয় গ্রহণে অনেক কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তেমনি বর্জন করার মধ্যে রয়েছে বড় ধরণের বিপর্যয়।
ছয়. ইমাম তাহাভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অভিমত
ইসলামের দৃষ্টিতে আক্বিদা গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়। মাযহাবের ইমাম চতুষ্টয় আকাইদের ক্ষেত্রে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী। তিনি বলেনÑهَذِهِ الْمَذَاهِبُ الْاَرْبَعَةُ وَللهِ الْحَمْدُ فِىْ الْعَقَائِدِ وَاحِدَةٌ সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য চার মাযহাব আক্বিদার ক্ষেত্রে এক ও অভিন্ন।
—০—
ইমাম আ’যমের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ইমাম আযম আবু হানিফা নোমান ইবনে সাবিত ইবনে সাওতী’র জন্ম সম্পর্কে তাঁর পৌত্র হযরত ইসমাঈল ইবনে হাম্মাদ (ওফাত ২১২হি.) বর্ণণা করেনÑوُلِدَ جَدِّىْ فِىْ ثَمَانِيْنَ অর্থাৎ আমার দাদা হিজরি ৮০ সনে জন্ম গ্রহণ করেন।
ইমাম ইবনে হায়তমী মক্কী (৯৭৩হি.) এর মতেÑ
اَلْاَكْثَرُوْنَ عَلَى اَنَّهُ وُلِدَ سَنَةَ ثَمَانِيْنَ بِالْكُوْفَةِ فِيْ خِلَافَةِ عَبْدِ المَلِكِ بْنِ مَرْوَانِ،
অধিকাংশ ইমামের (সর্বসম্মত) মতানুসারে, ইমাম আবু হানিফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের খেলাফতকালে ৮০ হিজরিতে কুফায় জন্ম গ্রহণ করেন।
ইমাম আযমের প্রকৃত নাম নুমান, কুনিয়াত বা উপনাম আবু হানিফা, পিতার নাম সাবিত, দাদার নাম সাওতী, তিনি ছিলেন পারস্যের অধিবাসী, দাদা অগ্নি উপাসক ছিলেন, ৩৬ হিজরীতে ইসলামে দীক্ষিত হন, দাদা সাওতী স্ত্রীকে নিয়ে মক্কার পথে রওয়ানা হন সেখান থেকে কুফায় পৌঁছে হযরত মওলা আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সান্নিধ্য অর্জন করেন। তিনি কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন। ৪০ হিজরিতে সাওতীর এক পুত্র সন্তান জন্ম নেন। তাঁর নাম রাখা হলো সাবিত। দুআ’ ও বরকত নেয়ার জন্য পুত্রকে হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র দরবারে নেয়া হলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করেন। সাবিত এর শিশু অবস্থায় পিতা ইন্তেকাল করেন। মায়ের স্নেহে লালিত পালিত হন। তাঁর ৪০ বছর বয়সে পরিবারে এক নূরানী সন্তান জন্ম লাভ করেন। পিতা-মাতা স্নেহ করে নাম রাখেন নোমান। তিনি ছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ইমাম, হযরত ইমাম আবু হানিফা। যিনি ইমামুল মুহাদ্দিসীন উস্তাযুল আসাতিযা, যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ফক্বীহ, মুনাযির মুতাকাল্লিম, সর্বোপরি বিশ্বখ্যাত মুজতাহিদ প্রখ্যাত সাধক ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত। হযরত ইমাম আযম ছিলেন একজন তাবিঈ। মুহাদ্দিসিনে কেরাম তাবেঈ’র সংজ্ঞায় বলেনÑ
اَلتَّابِعِىُّ هُوَ مَنْ لَقِيَهُ الصَّحَابِىَّ وَاِنْ لَمْ يَصْحَبْهُ
অর্থাৎ “তাবেঈ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় সাহাবীর সাথে যার সাক্ষাৎ হয়েছে। যদিও তিনি সাহাবীর সান্নিধ্য লাভ করেননি।” ইমাম আযমকে ইবনে সাদ তাবেঈদের পঞ্চম স্তরের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (ওফাত ৯৩ হি.) কে দেখেছেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আযম বলেনÑ
رَأَيْتُ أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ قَائِمًا يُصَلِّىْ،
আমি হযরত আনাস ইবনে মালিককে নামায পড়তে দন্ডায়মান অবস্থায় দেখেছি।
ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন, হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু কুফায় এসে নাখা নামক স্থানে অবস্থান করতেন। তিনি লাল হেজাব লাগাতেন, আমি তাকে অনেকবার দেখেছি। আল্লামা ইবনে হাজর এর মতে, ইমাম আযম আট জন সাহাবীর সাক্ষাৎ লাভ করেন। এর মধ্যে হযরত আনাস ইবনে মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আবু আওফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সাহল ইবনে সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এবং হযরত আবুত তোফাইল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাজেই ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাবেঈ হওয়ার বিষয়টি স্বীকৃত ও প্রসিদ্ধ। সাহাবীদের যুগ শেষ হয় ১১০ হিজরিতে, তাবেঈদের যুগ শেষ হয় ১৭০ হিজরিতে। তবে-তাবেঈদের যুগ শেষ হয় ২২০ হিজরিতে।
ইমাম আযমের উস্তাদদের তালিকায় সাতজন সাহাবী এবং তিরানব্বই জন প্রসিদ্ধ তাবেঈ রয়েছে। তবে ফিক্বহ শাস্ত্রে তাঁর প্রধান ওস্তাদ হলেন হযরত হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান (ওফাত ১২০হি/ ৭৩৭ খ্রি.)।
ওস্তাদ হাম্মাদের মৃত্যুর পর ইমাম আযম ফিক্বহ শাস্ত্র প্রণয়নের কাজ শুরু করেন। শাফেয়ী মযহাব অনুসারী ইমাম হাফেজ জালালুদ্দিন সুয়ুতী এ অভিমত ব্যক্ত করেনÑ
أَنَّهُ اَوَّلُ مَنْ دُوِّنَ عِلْمَ الشَّرِيْعَةِ وَرَثَّبَهُ أَبْوَابًا ثُمَّ تَبِعَهُ مَالِكُ بْنُ أَنَسٍ فِيْ تَرْتِيْبِ المُوَطَا وَلَمْ يُسْبِقُ أَبَا حَنِيْفَةَ اَحَدٌ،
নিশ্চয়ই ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সর্বপ্রথম শরিয়তের বিভিন্ন বিধানাবলী (আহকামে শরিয়ত মাসআলা মাসায়েল) সংকলন করেন। বিভিন্ন অধ্যায় ভিত্তিক বিন্যাস করেন। অতঃপর ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু মুয়াত্তার বিন্যাসে ইমাম আযমের অনুসরণ করেন।
আল্লামা ইবনে কাসীর প্রণীত আল বিদায়া ওয়ান নিহায়ার ভাষ্যমতে, ইমাম আযম একাধারে চল্লিশ বছর এশার অযু দিয়ে ফজর নামায পড়েন।
তিনি ৫৫ বার পবিত্র হজ্ব ব্রত পালন করেন। তার নিকট তাকওয়া, ইবাদত বন্দেগী, তিলাওয়াত, মুরাকাবা-মুশাহাদা, সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যয়পরায়ণতা সত্যের উপর অবিচল দৃঢ়তা, ঈমান আক্বিদার প্রশ্নে আপোষহীন ভূমিকা মুসলিম মিল্লাতের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত। তাঁর গভীর গবেষণা, সাধনা ও প্রচেষ্টার বদৌলতে ইসলামী ফিক্বহশাস্ত্র পূর্ণতা লাভ করে। কুরআন-হাদীস, তাফসীর ফিক্বহ আকাঈদ, ফালসাফা ইলমে তাসাউফসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা পান্ডিত্য ধীশক্তি সকল মুজতাহিদ ইমামদের মধ্যে তাঁকে শীর্ষে অধিষ্ঠিত করেছে। সুদীর্ঘ ২২ বছর মতান্তরে ৩০ বছর সাধণার পর ১৪৪ হিজরি তথা ৭৬১ খ্রিস্টাব্দে এ মহান ইমামের তত্ত্বাবধানে ফিক্বাহ শাস্ত্র রচনা ও সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত হয়। যা ‘‘কুতুবে আবু হানিফা’’ নামে পরিচিত হয়। এতে মানব জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ব্যবসা-বাণিজ্য লেনদেন, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, আমদানী নীতি, রপ্তানীনীতি, বাণিজ্যনীতি, আইন-বিচার ব্যবস্থা, শাসন-ব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা, সংবিধান, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ক ৩৮ হাজার ইবাদত সম্পর্কিত, ৪৫ হাজার মানব জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ও বিভাগ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় মাসআলা। পরিবর্ধনের পর যা ছয়লাখে উপনীত হয়।
—০—
ইমাম আযম সম্পর্কে মুজতাহিদ
ইমাম ও মনীষীদের অভিমত
এক. ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর অবদান ও মাহাত্ম্য সম্পর্কে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভন্ন ভাষায় হাজার হাজার গ্রন্থাবলী রচিত হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে মুজতাহিদগণের প্রশংসাবলী ও মূল্যায়ন সূচক বক্তব্যগুলো একত্র করা হলে বিরাটাকারের স্বতন্ত্র গ্রন্থে পরিণত হবে। প্রবন্ধ সংক্ষিপ্ত করার প্রয়াসে কয়েকটি অভিমত উপস্থাপন করার ইচ্ছা করছি। গোটা বিশ্বে হানাফি মাযহাবের অনুসারী সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের দেশে শাফেয়ী, মালেকী, হাম্বলী মাযহাবের অনুসারী নেই বললেও চলে। তবুও আমরা যারা হানাফি মাযহাবের মুকাল্লিদ বা অনুসারী আমরাসহ বিশ্বের মাযহাবপন্থিরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। মাযহাবের ইমামগণের মধ্যেও পারস্পরিক এ শ্রদ্ধাবোধ পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিলো যা তাঁদের জীবনাদর্শ অধ্যয়নে যথাযথভাবে প্রতিভাত হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে একশ্রেণির ইসলাম নামধারী বাতিলপন্থি তাকলিদ বিরোধী লামাযহাবী আহলে হাদীস নামক ভ্রান্ত জনগোষ্ঠী হানাফি মাযহাবের বিরুদ্ধে অহরহ বিষোদগার করে চলছে। এ ধরনের অপপ্রচার ইসলামের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের নতুন কৌশল। তাদের অপপ্রচার ও বিভ্রান্তির দাঁতভাঙ্গা জবাব দান ও তাদের স্বরূপ উম্মোচনে মাযহাব পন্থিদের গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে। লিখনী, বক্তব্য, গ্রন্থ প্রকাশনা, পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ নিবন্ধ প্রকাশ ও মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে তাদের ধৃষ্টতা ও মাযহাব বিরোধী অপতৎপরতা সম্পর্কে জনগণকে সজাগ ও সতর্ক করতে হবে। অন্যথায় আমাদের অবহেলা, অলসতা বা নীরবতা তাদের বাতিল মতাদর্শ সম্প্রসারণের পথকে আরো সহজ ও সুগম করবে। বিশেষত উপমহাদেশে হানাফি ফিক্বহ শাস্ত্রের ব্যাপক প্রচার-প্রসারে আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (১২৭২Ñ১৩৪০হি.) প্রণীত বিশাল ফাতওয়া গ্রন্থ ‘ফাতওয়া-ই রেযভীয়্যাহ্’ যা বর্তমানে ৩০ খন্ডে উন্নীত। প্রতি খন্ডে আটশতাধিক পৃষ্ঠায় ৮০০ী৩০= ২৪০০০ চব্বিশ হাজার অধিক পৃষ্ঠা সম্বলিত যা ইসলামী আইনের বিশ্বকোষ বললেও অত্যুক্তি হবে না। উপমহাদেশে সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর কর্তৃক গঠিত পরিষদ কর্তৃক রচিত হানাফি ফিক্বহ এর বিশাল গ্রন্থ ‘ফাতওয়া-ই হিন্দিয়া বা ফাতওয়া-ই আলমগীরি’ গ্রন্থটি সর্বত্র সমাদৃত বিখ্যাত গ্রন্থ। এ বিশাল গ্রন্থের পর উপমহাদেশে হানাফি মাযহাবের উপর সর্ববৃহৎ ফাতওয়া গ্রন্থ হিসেবে ফাতওয়া-ই রেযভীয়্যাহ্’র স্থান গবেষক মহলে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ইমাম আহমদ রেযা খান বেরলভীর ফিক্বহী যোগ্যতা মূল্যায়নের উপর গবেষণা করে মাওলানা হাসান রেযা খান ভারতের পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৯ সনের ২২ ডিসেম্বর পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইমাম আহমদ রেযা বেরলভীর ফাতওয়া-ই রেযভীয়্যাহ্ অধ্যয়নে জানা যায়, একজন মুজতাহিদ এর জন্য যতগুলো গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকা অপরিহার্য ইমাম আহমদ রেযার মধ্যে সবগুলো শর্ত, পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান থাকা সত্বেও তিনি ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর মুকাল্লিদ বা অনুসারী ছিলেন।
প্রফেসর ড. মাসউদ আহমদ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর মতে, ইমাম আযম আবু হানিফা (৮০-১৫০হি.) এর তাকলিদ এর সমর্থনে অসংখ্য গ্রন্থ রচিত হয় যার তালিকা দীর্ঘ। যথা-
* কাযী আবদুর রহমান বিন আলী হানাফি ৪৩৬হি. ১০৪৪ ইং আখবারু আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু। * খতীবে বাগদাদ ৪৬২ হি. ১০৬৯ ইং তারিখে বাগদাদ। * ইবনে খালকান ৬৮১হি./ ১৩৮২ ওফায়াতুল আইয়ানে। * ইবনে আবদুল্লাহ্ ৪৬৩ হি./ ১০৭০ ইং কিতাবুল ইসতেগানা ওয়ালকুনায়া। * আল মুয়াফফক বিন আহমদ মক্কী ৫৬৮হি./ ১১৭২ ইং, আল মানাকিব। * ইবনে কাইয়ুম যওজী ৭৫১ হি. ১৩৫০ইং ইলামুল মুয়াক্কিইনে। * জালালুদ্দিন সুয়ুতী ৯১১হি. /১৫০৫ইং তাবিযুয সাহীফা। * মুহাম্মদ বিন ইউসুফ সালেমী ৯৪২হি./ ১৫৫৩ইং উকদুল জুম্মান। * ইবনে হাজর হায়ছমী ৯৭৩হি. ১৫৬৫ইং আল খায়রাতুল হিসান। * আবদুল ওহাব শারানী ৯৭৩হি./ ১৫৬৫ইং আল মিযানুল কুবরা। * ইমাম আহমদ রেযা ১২৭২হি. ১৮৫৬ইং ফাতওয়া-ই রেযভীয়্যাহ্ ।
—০—
ইমাম শাফেয়ী (রহ.)’র অভিমত
(জন্ম ১৫০হি./৭৬৭ খ্রি., ওফাত ২৪০হি./৮১৯ খ্রি.)
শাফেয়ী মাযহাবের প্রবক্তা হযরত ইমাম মুহাম্মদ ইদ্রিস আশশাফেয়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর প্রশংসায় বলেনÑ
اَلنَّاسُ فِىْ الْفِقْهِ عِيَالُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ، (تَارِيِخِ بَغْدَادِ).
ফিক্বহ শাস্ত্রের জগতে ফিক্বাহ বিদগণ ও মুজতাহিদগণ সবাই ইলমে ফিক্বহে ইমাম আবু হানিফার শিশু সন্তান।
তিনি ইমাম আযমের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন পূর্বক আরো বলেনÑ
مَنْ أَرَادَ أَنْ يَتَبَحَّرَ فِىْ الْفِقْهِ فُهَوَ عِيَالُ أَبِىْ حَنِيْفَةَ (رَضِىَ اللهُ عَنْهَ).
যে ব্যক্তি ইলমে ফিক্বহ ও ইজতিহাদে জ্ঞানের সমুদ্র হতে চায়, তার উচিত ইমাম আবু হানিফার নিকট শিশু সন্তানের মতো লালিত হওয়া।
ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (৯৩-১৭৯হি) এর অভিমত, ইমাম শাফেয়ী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেনÑ
قِيْلَ لِمَالِكِ بْنِ أَنَسٍ هَلْ رَأَيْتَ أَبَا حَنِيْفَةَ قَالَ نَعَمْ، رَأَيْتُ رَجُلاً لَوْ كَلَّمَكَ فِىْ هَذِهِ السَّارِيَةِ أَنْ يَجْعَلَهَا ذَهَبًا لَقَامَ بِحُجَّةِ [تَارِيْخِ بَغْدَادَ] ইমাম মালিককে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কি ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে দেখেছেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ দেখেছি। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্ব যে, তিনি যদি তাঁর ইলম দ্বারা এই খুঁটিটিকে স্বর্ণের বলে প্রমাণ করার লক্ষ্যে দলীল উপস্থাপন করেন তাহলে তিনি তাঁর দাবি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবেন।
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইয়াযীদ ইবনে হারুন বলেনÑ
كَانَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ أَحْفَظَ مِنْ أَهْلِ زَمَانِهِ،
ইমাম আযম আবু হানিফা স্বীয় যুগের সবচেয়ে বড় হাফেজে হাদীস ছিলেন।
হাদীস জগতের অবিসংবাদিত প্রখ্যাত ইমাম হযরত সুফিয়ান সওরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেনÑ
كُنَّا بَيْنَ أَبِىْ حَنِيْفَةَ كَالعَصَافِيْرِ بَيْنَ يَدَىَّ الْبَازِىِّ
وَأَنَّ أَبَا حَنِيْفَةَ سَيَّدَ الْعُلُمَاءِ،
আমরা ইমাম আবু হানিফার তুলনায় বাজপাখির সামনে চড়–ই পাখির মতো। নিশ্চয় ইমাম আবু হানিফা তো আলিম কূলের শিরোমণি।
হযরত ইমাম আ’মশ ইমাম আযমের হাদীস থেকে মাসআলা বের করার বিস্ময়কর প্রতিভা ও প্রজ্ঞা অবলোকন করে আশ্চর্যান্বিত হয়ে মন্তব্য করেনÑ
يَا مَعْشَرَ الْفُقَهَاءِ اَنْتُمُ الْاَطِبَّاءُ وَنَحْنُ الْصِّيَادَلَةُ
وَاَنْتَ أَخَذْتَ أَيُّهَا الرَّجُلُ بَكْلَ الطَّرْفَيْنِ،
হে ফক্বিহগণ! আপনারা হলেন ডাক্তার, আমরা হলাম কেবল ওষুধ বিক্রেতা ফার্মেসেীতে বিভিন্ন রোগের ওষুধের প্রচুর স্টক থাকে।
ওষুধ বিক্রেতা তার কার্যকারিতা বা গুণাগুণ সম্পর্কে অবগত নয়। ডাক্তার ওষুধের কার্যকারিতা, সেবনবিধি, গুণাগুণ সবটুকুই জানেন। আর আপনি (ইমাম আযম) ওষুধের বিক্রয় ও উপাদান উভয়টি সম্পর্কে অভিজ্ঞ।
ইমাম আহমদ ইবনু মুহাম্মদ ইবনে হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু (১৬৪-২৪১হি.) /৭৮০-৮৫৫খ্রি.) বলেন, কোন মাসআলায় তিন ব্যক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হলে বিরোধীতা গ্রহণযোগ্য হবে না।
প্রথম : ইমাম আবু হানিফা, যিনি কিয়াসে সবার শ্রেষ্ঠ।
দ্বিতীয় : ইমাম আবু ইউসুফ ইলমে হাদীসে সুদক্ষ পন্ডিত।
তৃতীয় : মুহাম্মদ ইবনুল হাসান আশ শায়বানী।
তাই আসুন মুসলিম উম্মাহর এই ক্রান্তিকালে মাযহাব বিরোধী সকল প্রকার অপপ্রচার উপেক্ষা করে তাকলিদ’র গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করি। আল্লাহ্ আমাদের সঠিক পথে হিদায়ত দান করুন। আমীন!
—০—
হানাফীদের নামায
পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাকলিদ তথা মাযহাব অনুসরণের অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। ইসলামের জটিল কঠিন সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম বিষয়াদির নির্ভরযোগ্য সমাধান নিরূপনে মাযহাবের সম্মানিত ইমামগণের প্রচেষ্টা ও গবেষণার নিরিখে ইসলামি ফিক্হ শাস্ত্রের সুবিশাল জ্ঞানভান্ডার আজ সমৃদ্ধ। এ ক্ষেত্রে খোদা প্রদত্ত অসাধারণ ব্যুৎপত্তি, গভীর প্রজ্ঞা ও পান্ডিত্যের অধিকারী ইমামুল আইম্মা ইমাম আযম আবু হানিফা নুমান ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অবদান সর্বোতভাবে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে ইসলাম নামধারী একশ্রেণির বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠী গায়রে মুকাল্লিদ, সালাফী, আহলে হাদীস ইত্যাদি নামে দেশে বিদেশে সর্বত্র লিখনী বক্তব্য ও বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে ইসলামের ধারক এবং বাহক সম্মানিত আইম্মায়ে মুযতাহেদীন বিশেষত ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও তাঁর প্রবর্তিত মাযহাব ও অনুসারীদের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত মিথ্যাচার ও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। গায়রে মুকাল্লিদ লা মাযহাবীদের পক্ষ থেকে এ অপবাদও নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে যে, হানাফী নামায হলো ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক প্রবর্তিত নামায। ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নাকি রাসূলুল্লাহর প্রবর্তিত নামায পদ্ধতির বিপরীত নিজের পক্ষ থেকে নামাযের ভিন্ন পদ্ধতি উদ্ভাবন কারেছেন, যা সুন্নাত ও হাদীস বিরোধী। বক্ষ্যমান নিবন্ধে কয়েকটি মাসআলার গবেষণামূলক আলোচনার নিরিখে তাদের মিথ্যা অপবাদের দাতভাঙ্গা জবাব দেয়ার প্রয়াস পাব। পাঠক সমাজ হাদীসে রসূলের আলোকে হানাফী নামাযের পদ্ধতির বাস্তবতা অনুধাবনে সক্ষম হবেন।
১. رَفْعُ الْيَدَيْنِ “রফএ ইয়াদাইন” তথা দুই হাত উঠানো ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র মতে নামাযে প্রথম তাকবির বলার সময়ই হাত উঠাতে হবে। এ ছাড়া রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত উত্তোলন করা সুন্নাতের পরিপন্থি। এভাবে সিজদায় যাওয়ার সময় এবং সিজদা হতে মাথা উঠানোর সময় হাত উঠানো যাবেনা। ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ দাবীর সমর্থনে দলীল হিসেবে অসংখ্য হাদীস পেশ করেছেন। নিম্নে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদীস এতদসংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলÑ
১. عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ قَالَ أَلَاأُصَلِّىُ بِكُمْ صَلَاةَ رَسُوْلِ اللِه صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ اِلاَّ فِىْ أَوَّلِ مَرَّةٍ-
অর্থ: হযরত আবদুল্লাহ্ ইবন মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি কি তোমাদেরকে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সালাত আদায় করে দেখাব না? তখন তিনি সালাত আদায় করেন, কিন্তু তিনি সালাতের মধ্যে শুধু প্রথমবার ছাড়া তাঁর দু’হাত উঠালেন না।
ইমাম আহমদ, আবু দাউদ ও তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, ইমাম তিরমিযী হাদীসটি ‘হাসান’ বলেছেন, ইমাম ইবনে হাযাম হাদীসটিকে ‘সহীহ’ বলেছেন, হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্ত অনুসারে ‘সহীহ’ এছাড়াও বর্ণিত হাদীসটি নিম্নোক্ত কারণে শক্তিশালী।
প্রথমত : হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যিনি সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে শীর্ষ ফকীহ সাহাবী হিসেবে প্রসিদ্ধ।
দ্বিতীয়ত :তিনি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র নামাযের পদ্ধতি একদল সাহাবীর সামনে পেশ করেছেন। তিনি কেবল প্রথম তাকবিরেই হাত উঠান। এতে কেউ আপত্তি করেননি। সকলেই সমর্থন করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের সকলেই রসুলুল্লাহ’র নামায দেখেছিলেন। উপস্থিত কেউ এ পদ্ধতি অস্বীকার না করাটা প্রমাণ করে যে, তাকবিরে তাহরীমা ছাড়া হাত উঠানো যাবে না।
তৃতীয়ত : ইমাম তিরমিযী এ হাদীসটি ‘হাসান’ বলেছেন। সুতরাং ইমামুল আইম্মা ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ হাদীসকে দলীলরূপে উপস্থাপন করা যথাযথ যুক্তিযুক্ত ও বাস্তব সম্মত।
২. عَنِ الْاَسْوَدِ قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ عُمَرَ فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ فِىْ شَىْءٍ مِّنْ صَلَاتِهِ اِلَّا حِيْنَ إِفْتِتَحِ الصَّلَاةِ،
অর্থ: তাবিয়ী হযরত আসওয়াদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে সালাত আদায় করেছি। তিনি শুধুমাত্র সালাত শুরু করার সময় ছাড়া সালাতের মধ্যে কোন সময়ে দু’হাত উঠাননি। (ইমাম ইবনে আবি শাইবা তাহাবী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন)।
৩. عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ  قَالَ صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم وَمَعَ أَبِى بَكْرٍ وَمَعَ عُمَرَ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمَا فَلَمْ يَرْفَعُوا أَيْدِيَهُمْ إِلاَّ عِنْدَ التَّكْبِيرَةِ الأُولَى فِى افْتِتَاحِ الصَّلاَةِ. (سنن الدار قطنى باب ذكر التكبير ورفع اليدين)-
Ñহযরত ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে সালাত আদায় করেছি, তাঁরা সালাত শুরু করার সময় ব্যতীত অন্য সময় তাঁদের হাত উঠাতেন না।
বর্ণিত হাদীসে চারটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে।
১. হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ তিনজনের প্রত্যেকেই রসূলুল্লাহ্র পেছনে নামায আদায় করেছেন।
২.রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রথম তাকবির ছাড়া হাত উঠাননি, এ কথাটি হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে অন্য সনদসূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
৩.হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামাযের শুরু ব্যতীত দু’হাত উঠাননি। এটা কোন সুন্নাত পরিপন্থীও হয়নি।
৪.হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নামাযের শুরু ব্যতীত رَفْعُ الْيَدَيْنِ “রফএ ইয়াদাইন” করেননি। এ বিষয়টি ইমাম বোখারী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এর ওস্তাদ ইমাম ইবনে শায়বা এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম তাহাবী নিজ নিজ কিতাবে সহীহ সনদে বর্ণনা করেছেন।
৪. عَنْ جَابِرِ بْنِ سَمُرَةَ قَالَ خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ مَا لِي أَرَاكُمْ رَافِعِي أَيْدِيكُمْ كَأَنَّهَا أَذْنَابُ خَيْلٍ شُمْسٍ اسْكُنُوا فِي الصَّلَاةِ، (مسلم كتاب الصلوة باب الامر بالسكون فى الصلوة).
Ñহযরত জাবির ইবনে সামুরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের কাছে এসে বললেন, কী ব্যাপার আমি তোমাদেরকে বারবার হাত উঠাতে দেখেছি? তোমাদের হাতগুলো মনে হচ্ছে যেন সদা অস্থির চঞ্চল ঘোড়ার লেজের ন্যায়। এখন থেকে তোমরা সালাতের মধ্যে শান্ত থাকবে।
হযরত ইবনে যুবাইর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এক ব্যক্তিকে রুকুতে যাওয়ার সময় ও রুকু থেকে উঠার সময় رَفْعُ الْيَدَيْنِ বা দু’হাত উঠাতে দেখলেন। অতঃপর তিনি তাৎক্ষণিক তাকে এ কাজ থেকে বারন করেন এবং বললেন রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রথমে দু’হাত উঠাতেন ثُمَّ تَرَكَهُ অতঃপর এ আমল দু’হাত উঠানো ছেড়ে দিয়েছেন।
হাকিম ও বায়হাকী হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস ও আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেনÑ
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রتُرْفَعُ الْأَيْدِي فِي سَبْعِ مَوَاطِنَ، فِي افْتِتَاحِ الصَّلَاةِ، وَعِنْدَ الْبَيْتِ، وَعَلَى الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ، وَبِعَرَفَاتٍ وَبِالْمُزْدَلِفَةِ، وَعِنْدَ الْجَمْرَتَيْنِগ্ধ
Ñপ্রিয় নবী রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সাত স্থানে হাত উঠানো হবে, নামায শুরু করার সময় ক্বাবার দিকে মুখ করার সময়, সাফা ও মারওয়ার পাহাড়ে দুই মাওকাফে তথা মিনা ও মুসদালিফায়। এবং দু’জামারার সামনে।
রফ-এ ইয়াদাইন বা রুকুর সময় দু’হাত উঠানো প্রসঙ্গে ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র একটি বিতর্ক:
একদিন পবিত্র মক্কা মুয়াযযামার ‘‘দারুল হানাতীন’’ নামক স্থানে ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ও ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দু’জনের সাক্ষাৎকালে رفع اليدين প্রসঙ্গে কিছু ইলমী বিতর্ক হয়। বর্ণিত বিতর্কটি পাঠক সমাজের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো। আশা রাখি লা মাযহাবী, সালাফী, আহলে হাদীস পন্থিরা তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া দু’হাত না উঠানো প্রসঙ্গে বিতর্কটি মনোযোগ সহকারে অনুধাবন করবেন। ইমাম আওযাঈ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকে লক্ষ্য করে বলেনÑ
لمَاَّ لَا تَرْفَعُوْنَ أَيْدِيَكُمْ عِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ مِنْهُ؟
Ñআপনারা রুকুতে যাওয়ার সময় এবং রুকু হতে উঠার সময় উভয় হাত উত্তোলন করেন না কেন?
ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেনÑ
لَاَنَّهُ لَمْ يُصَحَّ فِيْهِ شَئْ ٌعَنِ النَّبِىِّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ،
Ñকেননা এ সম্পর্কে রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম হতে কোন সহীহ হাদীস নেই।
ইমাম আওযাঈ বললেনÑ
وَكَيْفَ قَدْ حَدَّثَنِىْ الزُّهَرِىُّ عَنِ سَالِمٍ عَنِ أَبِيْهِ أَنَّ النَّبِىَّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ اِذَا إِفْتَحَ الصَّلوٰةِ وَعِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ الرَّفْعِ عَنْهُ،
Ñএ কেমন কথা, আমাকে যুহরী বর্ণনা করেছেন এবং যুহরী সালেম হতে সালেম তার পিতা আবদুল্লাহ্ বিন ওমর হতে বর্ণনা করেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নামায শুরু কালে হস্তদ্বয় উঠাতেন, আর যখন রুকুতে যেতেন এবং যখন রুকু থেকে উঠতেন তখন দুহাত উঠাতেন।
উত্তরে ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বললেনÑ
حَدَّثَنِىْ حَمَّادٌ عَنْ إِبْرَاهِيْمَ عَنْ عَلْقَمَةَ وَالْاَسْوَدَ عَنْهُ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُوْدٍ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ كَانَ لَايَرْفَعُ يَدَيْهِ اِلَّا عِنْدَ إِفْتِتَاحِ الصَّلوٰةِ وَلَا يَعُوْدُ اِلٰى شَيْئٍ مِّنْ ذَالِكَ،
অর্থ: হাম্মাদ আমাকে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তিনি ইবরাহীম নাখঈ হতে, ইবরাহীম আলকামা ও আসওয়াদ হতে এবং তারা উভয়ে আবদুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুমা হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কেবলমাত্র নামায শুরু করার সময় দু’হাত উঠাতেন আর কখনো হাত উঠাতেন না।
ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেনÑ
أَحْدَثُكَ عَنِ الزُّهَرِىِّ عَنْ سَالِمٍ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو وَتَقُوْلُ حَدَّثَنَا عَنْ إِبْرَاهِيْمَ،
Ñআমি তো যুহরী হতে যুহরী সালিম হতে সালিম আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা হতে সনদসূত্রে আপনার নিকট হাদীস বর্ণনা করেছি। আর আপনি বলেছেন হাম্মাদ ও ইবরাহীম সূত্রে আমাদের নিকট হাদীস বর্ণনা করেছেন। (হাম্মাদের সাথে যুহরীর এবং ইবরাহীমের সাথে সালিমের সম্পর্ক কি?)
ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন,
كَانَ حَمَّادٌ فَقِهً مِنَ الزُّهْرِىِّ وَكَانَ إِبْرَاهِيْمُ أَفْقَهُ مِنْ سَالِمٍ وَعَلْقَمَةَ لَيْسَ بِدُوْنَ ابْنِ عَمْرٍو إِنْ كَانَ لِاِبْنِ عُمَرَ صَحْبَةٌ فَالْاَسْوَدُ لَهُ فَضْلٌ كَبِيْرٌ،
অর্থ: হাম্মাদ যুহরীর চেয়ে বড় ফকীহ, ইবরাহীম সালিমের চেয়ে বড় ফকীহ্ এবং আলকামাও ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা’র ন্যায় একজন সাহাবা। আর আসওয়াদ অতিশয় মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।
অপর বর্ণনায় এসেছেÑ
إِبْرَاهِيْمُ أَفْقَهُ مِنْ سَالِمٍ وَلَوْلَا فَضْلٌ الصَّحْبَةِ قُلْتُ إِنَّ عَلْقَمَةَ أَفْقَهُ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو وَعَبْدِ اللهِ هُوَ عَبْدِ اللهِ،
Ñইবরাহীম সালিম থেকে শ্রেষ্ঠ ফকীহ্, যদি ইবনে ওমর সাহাবী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন না করতেন, তবে আমি বলতাম, আলকামা আবদুল্লাহ্ ইবন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে ফিকহ্ শাস্ত্রে শ্রেষ্ঠ, আর ইবনে মাসউদ আবদুল্লাহ্ তার উপর কে?
অতঃপর ইমাম আওযাই রাহমাতুল্লাহি আলায়হি চুপ হয়ে গেলেন, উক্ত বিতর্ক থেকে প্রতীয়মান হলো ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তাঁর অনুসৃত শর্ত মোতাবেক বর্ণনাকারীদের মধ্যে যে অধিকতর ফিকাহবিদ নীতিমালার ভিত্তিতে তাঁকে অর্থাৎ ইবনে মাসউদের হাদীসকে প্রাধাণ্য দিয়েছেন, ইমাম আওযাই ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর প্রাধান্য অস্বীকার করতে পারেননি বলেই নীরবতা পালন করেছেন।
গায়রে মুকাল্লিদ আহলে হাদীস লা মাযহাবী বন্ধুগণ উপরোল্লিখিত সনদ দেখুন, মাযহাব বিরোধী সম্মিলিতভাবে ত্রুটি বের করার চেষ্টা করুন। চেষ্টা সাধনার পরও ইমাম আওযাই এর নীরবতার কারণ খুঁজে পাবেন না, ব্যর্থতা স্বীকার করুন, মুসলিম জাহানের মহান ইমাম ইমামুল আইম্মা হযরত ইমাম আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর প্রতি বিদ্বেষ পরিহার করুন। মাযহাব বিরোধী অপপ্রচার বন্ধ করুন। কুরআন সুন্নাহ্ এজমা ও কিয়াসের আলোকে ন্যায় নিষ্ঠা ও ইনসাফ ভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ও মেনে চলার পথ অনুসরণ করুন। মাযহাবের সম্মানিত আইম্মায়ে কেরামের বিরুদ্ধে কুৎসা বর্ণনা পরিহার করুন। মুসলিম উম্মার শান্তি শৃঙ্খলা, ঐক্য সমৃদ্ধি ও সংহতি সৃষ্টিতে ইসলামের প্রকৃত সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আক্বিদা (বিশ্বাস) মেনে চলুন।
—০—
রুকুতে যাওয়া ও রুকু হতে উঠার সময়
দু’হাত না তোলার যৌক্তিকতা
যুক্তির দাবী হলো, তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত উত্তোলন করা হবে। আর তাকবিরে তাহরিমা হলো ফরজ। যা ছাড়া নামায হয় না। পক্ষান্তরে রুকু ও সাজদার তাকবিরগুলো সুন্নাত। এসব তাকবির ছাড়াও নামায হয়ে যায়। তাকবিরে তাহরিমা নামাযে একবার হয়। রুকু সাজদার তাকবিরগুলো বারবার হয়। তাকবিরে তাহরিমা দ্বারা মূল নামায আরম্ভ হয়। রুকু সাজদার তাকবিরগুলো দ্বারা নামাযের রুকন শুরু হয়। মূল নামায শুরু হয় না। তাকবিরে তাহরিমা দ্বারা নামাযীর উপর পার্থিব কাজ হারাম হয়ে যায়। যখন রুকুর তাকবির সাজদার তাকবিরের ন্যায়, তখন সিজদার তাকবিরে হাত উঠানো না হলে রুকুর তাকবিরে হাত উঠাতে হবে কেন? তাহলে উচিত হবে সিজদার তাকবিরে যেভাবে হাত তোলা হয় না সেভাবে রুকুর তাকবিরেও হাত তোলা হয় না, রুকুর সময় হাত তোলা হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাত ও সাহাবীদের আমলের পরিপন্থী। যেসব রেওয়ায়েতে রুকুতে যাওয়ার সময় ও উঠার সময় হাত উঠানোর কথা এসেছে, সেসব হাদীসের বিধান রহিত হয়েছে।
উল্লেখ্য পরিসংখ্যান মতে দেখা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান মাযহাব অনুসরণ করেন। লা-মাযহাবীদের সংখ্যা দশমিক ভগ্নাংশেরও কম। রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- তোমরা ফেৎনার যমানায় বৃহত্তম দলের অনুসরণ করবে। আর যে, বৃহত্তম দল থেকে আলাদা হবে সে সোজা জাহান্নামে যাবে। বর্তমানে এ সহীহ হাদীস থেকে লা-মাযহাবীদের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।
রফ’ই ইয়াদাইন বা দুই হাত উত্তোলনের ব্যাপারে ইমাম তাহাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন, তিনি বলেন, অন্যান্য বিষয় বাদ দিলেও বিষয়টির পক্ষে ও বিপক্ষে যেসব হাদীস বর্ণিত হয়েছে তার বর্ণনাকারীদের ইলম ও জ্ঞানের দিকটি বিচার বিশ্লেষণ করলেও হাত উত্তোলনের বিপক্ষের হাদীসই অধিকতর গ্রহণ যোগ্য বলে বিবেচিত হয়। সুতরাং ইমাম আবু হানিফা রাবীদের জ্ঞান ও বিচক্ষণতার দিক বিচার করে হাত উত্তোলনের বিপক্ষের হাদীসকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
উপরিউক্ত আলোচনা হতে প্রতীয়মান হলো যে, হাত উঠানোর পক্ষে ও বিপক্ষে হাদীসের প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু দুইটির উপর আমল করা সম্ভব নয়। বরং যে কোন একটির উপর আমল করতে হবে। তা করতে হলে দেখতে হবে হুযূর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম কোন্ আমলটি আগে করেছেন এবং কোন্টি পরে করেছেন। প্রমাণিত হলে পরের কাজটির উপর আমল করতে হবে। এসব কারণের ভিত্তিতেই দু’হাত উত্তোলনের হাদীসের উপর আমল করা যাবে না। কেবল তাকবিরে তাহরিমার সময় দুই হাত উঠানো যাবে।
যেসব রেওয়ায়েতে রুকুতে যাওয়ার পূর্বে বা পরে رفع اليدين তথা দুই হাত উত্তোলনের উল্লেখ আছে তা ছিল পূর্বের হুকুম। পরবর্তীতে তা রহিত করা হয়েছে।
২. قِرْاءَةُ خَلْفِ الْاِمَامِ বা ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরআত পড়া নিষেধ প্রসঙ্গে
ইসলামের দলিল চতুষ্টয় ক্বোরআন, সুন্নাহ্, ইজমা ও কিয়াসের বিধান অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয় যে, ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত পড়া সম্পূর্ণরূপে নিষেধ। গায়রে মুকাল্লিদ লা-মাযহাবী ওয়াহাবীরা এ প্রতিষ্ঠিত মাসআলা প্রসঙ্গেও বিতর্ক সৃষ্টি করে। তারা মুক্তাদির উপর সূরা ফাতিহা পড়াকে ওয়াজিব বলে থাকে। তাদের এ মতের বিপক্ষে ক্বোরআন-হাদীসের বক্তব্য ও মুজতাহিদ আইম্মায়ে কেরামের উদ্ধৃতির আলোকে আমরা প্রমাণ করব যে, ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত পড়া নিষেধ। পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছেÑ
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآَنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ (২০৪)
Ñআর যখন ক্বোরআন পাঠ করা হয়। তখন তা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয়।
এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তানভীরুল মিকয়াস মিন তাফসির ইবনে আব্বাস গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছেÑ
وَاِذَا قُرِءَ الْقُرْاَنُ فِىْ الصَّلَوةِ الْمَكْتُوبَة فَاسْتَمِعُوْا لَهُ اِلَى قِرَأَتِهِ وَاَنْصِتُوْا بِقِرَأَتِهِ،
Ñযখন ফরজ নামাযে ক্বোরআন তিলাওয়াত করা হয়, তখন তোমরা তা কান লাগিয়ে শ্রবণ কর, এবং ক্বোরআন পাঠ করার সময় চুপ থাক।
—০—
হাদীসের আলোকে প্রমাণ
عَن أَبِي مُوسَى قَالَ عَلَّمَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَلْيَؤُمَّكُمْ أَحَدُكُمْ وَإِذَا قَرَأَ الْإِمَامُ فَأَنْصِتُوا، وَلَفْظُ مُسْلِمٍ فِىْ حَدِيْثِ أَبِىْ مُوْسَى وَإِذَا قُرِءَ فَانْصِتُوْا، (رواه احمد).
Ñআবু মুসা আশআরি রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন তিনি বলেছেন, যখন তোমরা নামাযে দাঁড়াবে তখন তোমাদের মধ্য থেকে একজন ইমামতি করবে। এবং যখন ইমাম ক্বোরআন পাঠ করবে তখন তোমরা (মনোযোগী শ্রোতার ন্যায়) নীরব ও নিশ্চুপ থাকবে। ইমাম মুসলিমও হাদীসটি সংকলন করেছেন। তাঁর বর্ণনায় রয়েছে যখন ইমাম ক্বোরআন পাঠ করবে তখন মনোযেগী শ্রোতার ন্যায় নীরব -নিশ্চুপ থাকবে।
عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ مَرْفُوْعًا إِنَّمَا جُعِلَ الْاِمَامُ لَيُوْتَمَّ بِهِ فَاِذَا
كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَإِذَا قُرِءَ فَانْصَتُوْا،
Ñহযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে মারফু সূত্রে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ইমাম নিযুক্ত করা হয়েছে তার অনুসরণ করার জন্য। সুতরাং ইমাম যখন আল্লাহু আকবর বলবেন, তখন তোমরা আল্লাহু আকবর বলবে, আর যখন তিনি ক্বোরআন পাঠ করবেন তখন তোমরা মানোযোগী শ্রোতার ন্যায় নীরব থাকবে।
ইমাম আহমদ, ইমাম আবু দাউদ, ইমাম ইবনে মাজাহ ও ইমাম নাসাঈ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম মুসলিম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেনÑ
عَنْ زَيْدِ بْنِ ثَابِتٍ قَالَ لَا قِرَاءَةٌ مَعَ الْاِمَامِ فِىْ شَيْئٌ،
Ñহযরত যায়েদ ইবন সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন ইমামের পেছনে কোন অবস্থাতেই ক্বোরআন পাঠ নেই।
عَنْ جَابِرٍ عَنِ النَّبِىِّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ مَنْ صَلَّى خَلْفَ الْاِمَامِ فَقِرْأَةُ الْاِمَامِ لَهْ قِرْاءَةٌ،
অর্থ: জাবির রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি কেউ ইমামের পেছনে সালাত আদায় করে তাহলে ইমামের কিরআতই তার (মুক্তাদির) কিরআত।
ইমাম মুহাম্মদ, ইমাম আহমদ, ইমাম তাহাবী প্রমুখ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন, ইমাম বায়হাকী কিরআত প্রসঙ্গে হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেনÑ
أَنَّ النَّبِىَّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ كُلُّ صَلوٰةٍ لَا يَقْرَءُ بِأُمِّ الْكِتَابِ فَهِىَ خِدَاجُ اِلَّا صَلَوةْ خَلْفِ الْاِمَامِ،
অর্থ:নিশ্চয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে নামাযে সূরা ফাতিহা পাঠ করা হয়নি তা অসম্পূর্ণ, তবে ওই নামায নয়, যা ইমামের পেছনে পড়া হয়। (অর্থাৎ ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহাও না পড়লে তা খিদাজ বা অসম্পূর্ণ হবে না)।
ইমাম দারে কুতনী হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেনÑ
إِنَّهُ قَالَ قَالَ رَجُلُ النَّبِىَّ صَلىَّ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْرَءُ خَلْفَ الْاِمَامِ اَوْ أَنْصَتْ قَالَ بَلِ انْصِتْ فَاِنَّهُ يَكْفِيْكَ،
অর্থ: হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামার নিকট এক ব্যক্তি প্রশ্ন করলো- আমি কি ইমামের পেছনে কিরআত সম্পন্ন করব, না চুপ থাকব? রসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম বললেন, বরং চুপ থাকবে। এটাই তোমার জন্য যথেষ্ট।
বোখারী শরীফ ১ম খন্ড, ১৭৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে যেÑ
فَقَالَ لَهُ أَبُوْ بَكْرٍ فَحَدِيْثُ أَبِىْ هُرَيْرَةَ فَقَالَ هُوَ صَحِيْحٌ يَعْنِىْ وَاِذَا قِرْءٌ فَانْصِتُوْا،
অর্থ: আবু বকর সুলাইমান থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, আবু হুরায়রার হাদীস কেমন? তিনি জবাব দিলেন ‘সহীহ’ অর্থাৎ ইমাম কিরআত পাঠ করবে তখন তোমরা নীরব-নিশ্চুপ থাকবে।
قِرْأَةُ خَلْفِ الْاِمَامِ
ইমামের পিছনে মুক্তাদির কিরআত পড়া প্রসঙ্গে ফোকাহায়ে কেরামের অভিমত
বিখ্যাত ফিকহ গ্রন্থ ‘‘হেদায়া’’ প্রণেতা শায়খ বুরহানুদ্দিন আবুল হাসান আলী মুরগিনানী (৫১১-৫৯৩) বর্ণনা করেন, ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত না পড়ার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের ইজমা তথা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন,
لَايَقْرَءُ المْؤَتِّمَ خَلْفَ الْاِمَامِ وَعَلْيِهِ إِجْمَاعُ الصَّحَابَةِ،
Ñমুক্তাদি ইমামের পেছনে কিরআত পাঠ করবে না। এ বিষয়ে সাহাবাদের ঐকমত্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে হেদায়া’র ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রণেতা ইমাম আকমল উদ্দিন মুহাম্মদ বিন মাহমুদ বারবতি (৭১০-৭৮২) বলেন, সাহাবীদের ইজমা দ্বারা অধিকাংশ সাহাবার ঐকমত্য বুঝানো হয়েছে। ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত পাঠ করার নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কিত প্রখ্যাত আশিজন সাহাবা থেকে হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হযরত ইমাম শাবী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সত্তরজন সাহাবায়ে কেরামের সাথে সাক্ষাৎ করেছি, এরা সকলেই ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত পাঠ করাকে নিষেধ করেছেন। অনেকে বলেছেন, اِجْمَاعُ الصَّحَابَةِ দ্বারা মুজতাহিদ সাহাবা ও শীর্ষ স্থানীয় সাহাবাগণ উদ্দেশ্য।
হযরত আবদুল্লাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেন, আমার বুজুর্গ পিতা হযরত যায়দ ইবনে আসলাম রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা বলেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবাদের মধ্যে নিম্নোক্ত দশজন সাহাবায়ে কেরাম ইমামের পেছনে মুক্তাদির কিরআত পাঠ করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন, তারা হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওসমান ইবনে আফফান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আলী ইবনে আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত সাদ ইবনে ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত যায়দ ইবনে সাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, যহরত আবদুল্লাহ্ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা, হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা প্রমুখ সাহাবা।
ফিকহ শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘‘কিফায়া’’ এর মধ্যে ইমাম জালাল উদ্দিন খাওয়ারেজমী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন Ñ
يَمْنَعُ المُقْتَدِىُّ عَنِ الْقِرْاءَةِ مَا ثُوْرٌ عَنْ ثَمَانِيْنَ نَفْرًا مِنْ كَبَارِ الصَّحَابَهِ مِنْهُمْ المُرْتَضىَ وَالْعَبَادِلَةُ رَضِىَ اللهُ عَنْهُمْ،
অর্থাৎ প্রখ্যাত আশিজন শীর্ষ সাহাবা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তারা মুক্তাদিদেরকে কিরআত পাঠ করা থেকে নিষেধ করেছেন।
সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ্ শায়খ আলা উদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে আলী সকফী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি (১০২৫-১০৮৮) প্রণীত দূররে মোখতার ফাতওয়া গ্রন্থে উল্লেখ আছেÑ
اَلمُؤْتَمُ لَا يَقْرَءُ مُطْلَقًا فَاِنْ قِرْءَةُ كَرِهَ تَحْرِيْماً،
অর্থাৎ মুক্তাদি সূরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা কিরআত পাঠ করবে না। যদি কিরআত পাঠ করে মাকরূহে তাহরীমি হবে।
—০—
لَاصَلَوةَ اِلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ
হাদীসের ব্যাখ্যা
অর্থাৎ যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়বে না তার নামায হবে না। এ হাদীসের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ইমাম বুখারীর ওস্তাদ ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ও ওস্তাযুল আসাতিযা হযরত সুফিয়ান ইবন উয়াইনা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন,
إِذَا كَانَ وَحْدَهُ لِمَنْ يُّصَلِىَّ وَحْدَهُ،
Ñযে ব্যক্তি ইমাম ছাড়া একাকী নামায পড়বে সে অবশ্যই ফাতিহা পাঠ করবে, কেননা সূরা ফাতিহা ছাড়া তার নামায হবে না।
ইমাম মালিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু প্রণীত হাদীসের বিখ্যাত গ্রন্থ এবং ইমাম আবদুর রাজ্জাক স্বীয় মুসান্নাফে হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন,
قَالَ لَيْثُ فِىْ فَمِ الَّذِىْ يَقْرَءُ خَلْفَ الْاِمَامِ حِجْرًا،
Ñযে ব্যক্তি ইমামের পেছনে কিরআত পাঠ করবে তার মুখে পাথর হোক।
—০—
আমীন নীরবে বলা
হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর মতে, ইমাম হোক বা মুক্তাদি হোক, জামাতে হোক বা একাকী, প্রকাশ্য নামাযে হোক বা অপ্রকাশ্য নামাযে হোক, নামাযে নীরবে নিচু স্বরে ‘আমীন’ বলবে, লা-মাযহাবী আহলে হাদীস পন্থিরা নিজেদের নামাযকে ‘সালাতুর রাসূল’ বা রাসূলের নামায বলে দাবি করে থাকে। অথচ তারা হাদীসে রাসূলের বিরোধিতা করে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
পক্ষান্তরে হানাফী মাযহাব পন্থীদের নামাযকে হাদীস বিরোধী বলে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা ইমাম ও মুক্তাদির নামাযে উচ্চ স্বরে চিৎকার করে আমীন বলে থাকে। যা হাদীসের অর্থ বিরোধী হওয়ার কারণে সমর্থনযোগ্য নয়। নামাযে ‘আমীন’ নীরবে বলা প্রসঙ্গে ইমাম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু এর দৃষ্টিভঙ্গি ক্বোরআন হাদীস সম্মত। নিম্নে ক্বোরআন সুন্নাহর নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদির আলোকে বিষয়টি উপস্থাপনের প্রয়াস পাচ্ছি।
পবিত্র ক্বোরআনের আলোকে প্রমাণ
মহান গ্রন্থ আল ক্বোরআনুল করীম এরশাদ হয়েছেÑ
اُدْعُوْا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً،
Ñতোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে প্রার্থনা করো বিনয়ের সাথে এবং নিচু স্বরে।
একদিন হযরত মুসা আলায়হিস্ সালাম দুআ করলেন, হযরত হারুন আলায়হিস্ সালাম ‘আমীন’ বললেন, আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনÑ
قَدْ أُجِيبَتْ دَعْوَتُكُمَا،
Ñতোমরা উভয়ের দোয়া কবুল করা হয়েছে।
বুঝা গেল আমীনও এক প্রকার ‘দুআ’। বোখারী শরীফে এটাকে দুআ বলা হয়েছে, তাই দুআ নীরবে বলা শ্রেয়।
হাদীসের আলোকে প্রমাণ
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا أَمَّنَ الْإِمَامُ فَأَمِّنُوا فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ تَأْمِينُهُ تَأْمِينَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَقَالَ ابْنُ شِهَابٍ وَكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ آمِينَ،
Ñহযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন নামাযে ইমাম যখন আমীন বলেন তখন তোমরাও আমীন বলবে, কেননা যার আমীন ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যাবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করা হবে। ইবনে শিহাব বলেন, (নামাযে) হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমীন বলতেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِذَا قَالَ الْإِمَامُ [غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ] فَقُولُوا آمِينَ فَإِنَّهُ مَنْ وَافَقَ قَوْلُهُ قَوْلَ الْمَلَائِكَةِ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِه،
Ñহযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, হুযূর করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ইমাম যখন গাইরিল মাগদুবি আলায়হিম ওয়ালাদ্দোয়াল্লীন বলবেন তখন তোমরা আমীন বলবে, কেননা যার কথা ফেরেশতাদের কথার সাথে মিলে যায় তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ্ ক্ষমা করা হয়।
عَنْ وَائِلٍ عَنْ أَبِيهِ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ [غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ] فَقَالَ آمِينَ وَخَفَضَ بِهَا صَوْتَهُ،
Ñহযরত ওয়াইল ইবন হাজর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সাথে সালাত আদায় করেন, তিনি ‘গাইরিল মাগদুবি আলায়হিম ওয়ালাদ্দোয়াল্লীন’ পাঠান্তে ‘আমীন’ বললেন, আমীন বলার সময় তিনি তার কণ্ঠস্বর নিচু করলেন। দায়ালিমী আবু ইয়ালা হাকীম তিরমিযী আহমদ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন হাকীম হাদীসটি সহীহ বলেছেন।
সশব্দে আমীন বলা ও নীরবে আমীন বলার ব্যাপারে দুই ধরনের হাদীস বিদ্যমান থাকলে দুইটি বর্ণনা দুই সময়ের ঘটনা ছিল বলে ধারণা করে নিতে হবে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কখনো শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য উচ্চস্বরে আমীন বলতেন, হাফিজ আবু বিশর আদদুলাবী কর্তৃক হাসান সনদে সংকলিত হযরত ওয়াইল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীসে সে কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
এ ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত হাদীস থেকেও নীরবে আমীন বলার প্রমাণ পাওয়া যায়।
عَنْ سَمُرَةَ بْنِ جُنْدُبٍ ، أَنَّهُ كَانَ إِذَا صَلَّى بِهِمْ سَكَتَ سَكْتَتَيْنِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاَةَ ، وَإِذَا قَالَ : [وَلاَ الضَّالِّينَ] سَكَتَ أَيْضًا هُنَيَّةً ، فَأَنْكَرُوا ذَلِكَ عَلَيْهِ ، فَكَتَبَ إِلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ ، فَكَتَبَ إِلَيْهِمْ أُبَيٌّ أَنَّ الأَمْرَ كَمَا صَنَعَ سَمُرَةُ.
Ñহযরত সামুরাহ্ ইবন যুনদুব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যখন নামাযে ইমামতি করতেন, তখন তিনি দুবার চুপ করে থাকতেন, এক. যখন তিনি তাকবীর বলে নামায শুরু করতেন, দুই. যখন ওয়ালাদ্দোয়ালীন বলতেন, তখন সামান্য সময় চুপ থাকতেন, মুসল্লীগণ এতে আপত্তি করেন, তখন তিনি সমাধানের জন্য উবাই ইবনে কাবকে পত্র লিখেন। ওবাই উত্তরে তাদেরকে জানান যে, সামুরা যেরূপ করেছে প্রকৃত বিষয় অনুরূপই। ইমাম আহমদ দারে কুতনী বায়হাকী, সহীহ সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
উপরে বর্ণিত হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র হাদীস দ্বারা দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হলো যে, প্রথম ইমামের পেছনে মুক্তাদি সূরা ফাতিহা পাঠ করার আদেশ করা হত, তখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরূপ বলতেন যে, যখন তোমরা وَلاَ الضَّالِّينَ বলবে তখন আমীন বলা বুঝা গেল যে, মুক্তাদিগণ কেবল আমীন বলবে। আর وَلاَ الضَّالِّينَ বলা ইমামের কাজ। দ্বিতীয়ত বুঝা গেল আমীন নিচু স্বরে বলবে, যেহেতু ফেরেশতারাও নিচু স্বরে আমীন বলেন। এজন্য আমরা তাদের আমীন বলার শব্দ শুনতে পাইনা, সুতরাং উচ্চস্বরে আমীন বলাটা ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে বিরোধিতা হবে।
হযরত আলকামা ইবন ওয়ায়িল রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম وَلاَ الضَّالِّينَ বলে আমীন বলেছেন এবং وَخَفَضَ بِهَا صَوْتَهُ আমীন বলার সময় কণ্ঠ স্বর নিচু করেছেন। হযরত ইবরাহীম নাখঈ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বর্ণনা করেনÑ
قَالَ أَرْبعُ يَخْفِيْنَ الْاِمَامُ التَّعَوُّذِ وَبِسْمِ اللهِ وَسُبْحَانَكَ اَللَّهُمَّ وَأَمِيْنٌ، رَوَاهُ مُحَمَّدٌ فِىْ الْاَثَارِ وَعِبْدُ الرَّزَّاقِ فِىْ مُصَنِّفِهِ.
Ñতিনি বলেন, ইমাম চারটি বিষয় নীরবে পাঠ করবেন, আউজুবিল্লাহ্, বিসমিল্লাহ্, সুবহানাকা আল্লাহুম্মা এবং আমীন। ইমাম মুহাম্মদ তাঁর আছার এবং ইমাম আবদুর রাজ্জাক স্বীয় মুসান্নাফে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
শায়খ আবু বারাকাত আবদুল্লাহ্ বিন আহমদ নাসাফী প্রণীত ‘কানযুদ দাকায়েক’ ফিকহ গ্রন্থের ১ম খন্ড ৩১৩ পৃষ্ঠায় বর্ণনা করেন- اَمَّنَ الْاِمَامُ وَالْمَامُوْمُ سِرًّا অর্থাৎ ইমাম ও মুক্তাদি দুজনই নিচু স্বরে আমীন বলবে। আল্লামা শায়খ আলাউদ্দিন মুহাম্মদ বিন আলী হানাফী (১০২৫-১০৮৮) প্রণীত দুররে মোখতার ফিকহ গ্রন্থে বলেনÑ
اَمَّنَ الْاِمَامُ سِرًّا كَمَامُوْمُ سِرًّا وَمُنْفَرِدٌ،
Ñইমাম নিচুস্বরে আমীন বলবে, যেমনটা মুক্তাদি ও একাকী নামাযে আদায়কারী বলবে।
গায়রে মুকাল্লিদ লা মাযহাবীদের
অভিযোগ ও জবাব
উচ্চস্বরে আমীন বলা সুন্নাত গায়রে মুকাল্লিদরা তাদের দাবীর সমর্থনে আবু দাউদ শরীফে হযরত ওয়াইল ইবন হাজর কর্তৃক বর্ণিত নিম্নোক্ত হাদীস পেশ করেনÑ
قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلىَّ اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا قَرَءَ
وَلَا الضَّالِّيْنَ قَالَ اَمِيْنٌ وَرَفَعَ بِهَا صَوْته،
Ñতিনি বলেন, যখন রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম وَلاَ الضَّالِّينَ পড়তেন, তখন আমীন বলতেন এবং এতে আওয়াজ উঁচু করতেন, এতে প্রমাণ হয় আমীন উঁচু স্বরে পড়া সুন্নাত।
জবাব: উপর্যুক্ত হাদীসসহ উচ্চস্বরে আমীন বলার পক্ষের হাদীসগুলোর জবাবে লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশাঙ্কায় সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি জবাব নিম্নে পেশ করলাম।
১. তিরমিযী শরীফের বর্ণনায় مد রয়েছে এর অর্থ টানা বা দীর্ঘ করা, বর্ণনাকারী অর্থগত বর্ণনা করতে গিয়ে مد কে رفع দ্বারা বিশ্লেষণ করেছেন। হাদীসের উদ্দেশ্য টানা বা লম্বা করা , উঁচু করা নয়।
২. তিরমিযী ও আবু দাউদের বর্ণনায় নামাযের উল্লেখ নেই। সম্ভবত এর দ্বারা নামাযের বাইরের কিরআতের কথা বুঝানো হয়েছে।
৩. উঁচু আওয়াজে আমীন বলা সংক্রান্ত হাদীসটি ক্বোরআনের আয়াতের বিপরীত এজন্য আমলযোগ্য নয়।
৪. নিচু স্বরে আমীন বলার হাদীসগুলো ক্বোরআনের আয়াতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ এজন্য তা আমলযোগ্য।
৫. উচ্চ স্বরে আমীন বলা সংক্রান্ত হাদীসগুলোকে ক্বোরআনের আয়াত ও নিচু স্বরে আমীন বলা সম্পর্কিত হাদীসগুলো দ্বারা রহিত করা হয়েছে।
৬. উচ্চ স্বরে আমীন বলা সংক্রান্ত হাদীসগুলো রহিত না হলে সাহাবায়ে কেরাম এ আমল ছেড়ে দিলেন কেন?
৭. নিচু স্বরে আমীন বলা হাদীসগুলোর উপর বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর আমল রয়েছে এবং ইমামুল আয়িম্মা ইমাম আযম আবু হানিফা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হাদীসগুলো গ্রহণ করেছেন, উপরন্তু অসংখ্য সনদে হাদীসগুলো বর্ণিত হওয়ার কারণে হাদীসের কোন পর্যায়ে দুর্বলতা থাকলেও তা দূরীভূত হয়ে হাদীসগুলো শক্তিশালী হয়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ্, সংক্ষিপ্ত হলেও হাদীসে নববীর আলোকে হানাফীদের নামাযের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা ক্বোরআন, সুন্নাহ, এজমা কিয়াস, মুজতাহিদ ফোকায়ে কেরামের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা রাখি সরল প্রাণ ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ লা-মাযহাবী আহলে হাদীসের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। তাদের মিথ্যার অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচার সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। মুজতাহিদ ইমামগণের অনুসৃত বিধিমালা মেনে চলুন, আল্লাহ্ আমাদের সকলকে তাঁদের অনুসৃত পথে ও মতে অবিচল থাকার তৌফিক দান করুন। আমীন।
—*—
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •