মুমিনের ঘর-বাড়ি ঃ আলোকিত
ঠিকানায় সমৃদ্ধ জীবন-যাপন
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান
মানুষ সামাজিক জীব। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনে অভ্যস্থ। সমাজবদ্ধ জীবন-যাপনের প্রথম ভিত্তি হলো পরিবার। একজন মানুষের যে সমস্ত মৌলিক অধিকারগুলো রয়েছে তম্মধ্যে অন্যতম হলো বাসস্থান। প্রত্যেক মানুষই চাই নিজের মাথা গুজাবার একটি ঠিকানা। সেটি কারো জন্য হতে পারে ছনের ছাউনিতে তৈরি, কারো জন্য টিনের ছাউনি কিংবা কারো জন্য সুরম্য দালান-কোঠা। বাসস্থান শুধু বসবাসের জায়গা নয় বরং সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে সুখ-শান্তি অর্জনের অপূর্ব মিলন কেন্দ্র। কর্মজীবনের সারাদিনের ক্লান্তি, অবসাদ যাই হোক বেলা শেষে ঘরে ফিরে গেলে প্রশান্তিতে ভরে যায় মানুষের মন। মুমিনের ঘর-বাড়ি ঈমানের ছায়ায় শীতল, কুরআন-সুন্নাহর আলোতে আলোকিত। জাগতিক সুখ, অর্থের প্রাচুর্যতা না থাকলেও ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান হয়ে সুখের পরশ সর্বদা বিরাজমান। কোনো মুমিন বান্দা যদি তার পরিবারকে ইসলামী নিয়ম নীতির আলোকে ঈমানী চেতনায় সাজাতে পারে তাহলে সেই পরিবারই হবে প্রকৃত সুখÑশান্তিতে পরিপূর্ণ ও পরকালে মুক্তির অন্যতম অবলম্বন।
১. পৃথিবীতে মানব জাতির প্রথম ঘর-বাড়ি নির্মাণ
মানব ইতিহাসে প্রথম পরিবার গঠিত হয়েছিল প্রথম মানব ও প্রথম নবি হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম ও হযরত হাওয়া আলায়হাস্ সালামকে কেন্দ্র করে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বলেন, হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও, তবে ঐ বৃক্ষের কাছে যেওনা। [সূরা আরাফ-১৯]
অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম যখন পৃথিবীতে আগমন করেন তখন পৃথিবীতে সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনের উপযুক্ত পরিবেশ ছিলনা। পাহাড়-পর্বত ও বন-জঙ্গলে ভরপুর ছিল পৃথিবী। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম এর নাতি মাহলাইল ইবনে কায়নান পৃথিবীর বুকে সর্বপ্রথম মানুষের বাসযোগ্য ঘর-বাড়ি ও শহর স্থাপন করেন। তিনি দুটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। একটি হলো বাবিল বর্তমান ইরাক এবং সোস যা বর্তমান ইরানের খুজাস্তান নগরী। তার প্রতিষ্ঠিত শহরে তিনি বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, কৃষি কাজের উৎসাহ, জীব জন্তুর পশম দিয়ে কাপড় তৈরির পদ্ধতি অবিষ্কার করেন। [আল কামিল, ইবনুল আসির ঃ ৫৩-৫৪]
২. মানুষের ঘর আল্লাহরই একটি অনুগ্রহ
বিশে^ এখন প্রায় ৭৭৭ কোটি মানুষের বসবাস এদের মধ্যে অর্ধেক লোক নগরে বসবাস করে। শহরে বাসস্থান ও গ্রামে বাসস্থানের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা স্মরণ কর, যখন তোমাদেরকে আদ জাতির পরে সর্দার করেছেন, তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠিকানা দিয়েছেন। তোমরা নরম মাটিতে অট্টালিকা নির্মাণ কর এবং পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ কর সুতরাং তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ স্বরণ কর এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করোনা। [সূরা আরাফ-৭৪]
অন্য আয়াতে তিনি বলেছেন- আল্লাহ করে দিয়েছেন তোমাদের গৃহকে অবস্থানের জায়গা এবং চতুষ্পদ জন্তুর চামড়া দ্বারা করেছেন তোমাদের জন্য তাবুর ব্যবস্থা। তোমরা এগুলোকে সফরকালে ও অবস্থানকালে পাও। [সূরা আন নাহল-৮০]
ইমাম কুরতুবি রহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, যে বস্তু তোমাদের মাথার উপর রয়েছে এবং তোমাদেরকে ছায়া দান করে তাকে ছাদ ও আকাশ বলা হয়। যে বস্তু তোমাদের অস্তিত্বকে বহন করে তা হলো জমিন এবং যে বস্তু চারদিক থেকে তোমাকে আবৃত করে রাখে তা প্রাচীর। এসব গুলো কাছাকাছি একত্রিত হয়ে গেলে তাকে বলা হয় ঘর বা বাসস্থান। [তাফসীরে কুরতুবী]
৩. মুমিনের ঘর বাড়ির বৈশিষ্ট্য
মুমিনের ঘর কেমন হবে তার উত্তর খুঁজতে হবে প্রিয় নবি রাহমাতুল্লিল আলামীন (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর ঘর বাড়ির অবস্থা থেকে। তিনি কীভাবে বসবাস করতেন কীভাবে রাত্রি যাপন করতেন, কীভাবে ঘরে প্রবেশ করতেন, কীভাবে বের হতেন তার সকল কিছুই উম্মতের জন্য পরিপূর্ণ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। জাগতিক দিক থেকে সেখানে ছিলনা দামী বিছানা, মূল্যবান খাবার, এবং ছিলনা আরাম আয়েশের ও ভোগ বিলাসের কোনো উপকরণ। কিন্তু সেখানে ছিল আল্লাহর স্মরণে বা যিকিরের রুটিন, আনুগত্য ও ভালোবাসার পূর্ণাঙ্গ রূপ। প্রার্থী যেই আসুক খালি হাতে ফিরত না কেউ। আল্লাহর রহমতের অপূর্ব ¯িœগ্ধ প্রসারিত হতো সরাক্ষণ। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দোজাহানের বাদশাহ হয়েও অত্যন্ত সাদামাটা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। ঘরের কাজে আপন স্ত্রীদের সাহায্য করতেন। নিজের কাজ নিজেই করতে পছন্দ করতেন। হযরত হিশাম ইবনে উরওয়া জনৈক ব্যক্তি থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করা হলো, রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কীভাবে তার গৃহে সময় কাটাতেন? তিনি বললেন, তিনিও তোমাদের মতো গৃহস্থলীর কাজে মশগুল থাকতেন। নিজের কাপড় নিজেই সেলাই করতেন, নিজের জুতা নিজেই মেরামত করতেন।
একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) চাটাইয়ের উপর শুয়ে ছিলেন এতে তার শরীরে চাটাইয়ের দাগ বসে গেল। তখন আমরা (সাহাবারা) বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যদি আপনার জন্য নরম বিছানার ব্যবস্থা করে দেই? তখন তিনি বললেন দুনিয়ার সাথে আমার কী সর্ম্পক? আমিতো কেবলমাত্র একজন আরোহী যে একটা গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিল আবার কিছুক্ষণ পর তার গন্তব্যে চলে গেল। [তিরমিজী-২২৯৯]
৪. মুমিনের ঘর আল্লাহর যিকিরে সরব
মুমিনের বাড়ি একটি ঈমানি প্রতিষ্ঠান। এখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়ে ব্যস্ততা অনুভব হয়। যেখানে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব গৃহে সকাল-সন্ধ্যায় আল্লাহার পবিত্রতা বর্ণনা করা হয়ে থাকে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আল্লাহ যে সব গৃহকে মর্যাদায় উন্নীত করার এবং সেগুলোতে তার নাম উচ্চারণ করার আদেশ দিয়েছেন, সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। [সূরা আন-নূর : ৩৬]
রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয় আর যে ঘরে আল্লাহকে স্মরণ করা হয়না এরূপ দু’টি ঘরের তুলনা হচ্ছে জীবিত ও মৃতের সাথে। [সহীহ মুসলিম-৭৭৯]
ঘরের মধ্যে কুরআন তিলাওয়াত করলে আল্লাহ তায়ালা অপরিসীম বরকত দান করেন, শয়তান প্রবেশেও বাধা প্রাপ্ত হয়। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, তোমরা ঘরকে কবর বানাবেনা, যে ঘরে সূরা বাকারাহ তিলাওয়াত করা হয় সেই ঘর হতে শয়তান পলায়ন করে। [সহীহ মুসলিম-৭৮০]
৫. সালাম দিয়ে গৃহে প্রবেশ করা
সালাম ইসলামি সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন, সালামের বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, অতঃপর গৃহে প্রবেশ করার সময় তোমরা নিজেদের লোকদের সালাম করো, অভিবাদন স্বরূপ যা আল্লাহর নিকট থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র। এভাবে আল্লাহ তোমাদের সামনে বিশ^দ ভাবে বর্ণনা করেন আয়াত সমূহ যাতে তোমরা বুঝতে পার। [সূরা আন-নূর:৬১]
একদা একব্যক্তি প্রিয় নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর কাছে আসে এবং দরজা থেকে চিৎকার করে বলতে থাকে “আ-আলুজ?” আমি কী ভেতরে প্রবেশ করবো? নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় বাঁদী রওজাকে বলেন, এ ব্যক্তি অনুমতি চাওয়ার নিয়ম জানেনা। তাকে বলে এসো সে যেন ‘আস্সালামু আলাইকুম আ- আদখুলু’ অর্থ, সালাম দিয়ে আমি কি ভিতরে আসতে পারি? বলে অনুমতি চায়। (আবু দাউদ)
রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তিন ব্যক্তি আল্লাহর যিম্মায় থাকে। যদি তারা বেঁচে থাকে তাহলে রিজিকে প্রাপ্ত হয় এবং তা যথেষ্ট হয় এবং যদি তারা মৃত্যু বরণ করে তাহলে জান্নাতে প্রবেশ করে।
১. যে ব্যক্তি বাড়িতে প্রবেশ করে সালাম দেয় সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে।
২. যে ব্যক্তি মসজিদের উদ্দেশ্যে বের হয়, সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে।
৩. যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় বের হয় সে আল্লাহর যিম্মায় থাকে। [আবু দাউদ-২৪৯৪]
৬. অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করা
কারো ঘরে প্রবেশ করার সময় অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে মুমিনরা! তোমরা নিজেদের ঘর ব্যতীত অন্য ঘরে প্রবেশ করোনা যে পর্যন্ত আলাপ-পরিচয় না করো এবং গৃহবাসীকে সালাম না করো। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। যদি তোমরা গৃহে কাউকে না পাও, তবে অনুমতি গ্রহণ না করা পর্যন্ত সেখানে প্রবেশ করোনা। যদি তোমাদেরকে বলা হয় ফিরে যাও, তবে ফিরে যাবে। এতে তোমাদের জন্য অনেক পবিত্রতা আছে এবং তোমরা যা কর, আল্লাহ তা ভালোভাবে জানেন। [সূরা আন-নুর ঃ ২৭-২৮]
নবি করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর অভ্যাস ছিলো যখন কারো বাড়িতে যেতেন দরজার ঠিক সামনে কখনো দাড়াঁতেন না। কারণ সে যুগে দরজায় পর্দা লাগানো থাকতো না। তিনি দরজার ডান পাশে বা বাম পাশে দাঁিড়য়ে অনুমতি চাইতেন। [আবু দাউদ]
৭. ইসলামের বাসস্থান সম্পর্কিত নীতিমালা
আল্লাহ তায়ালাই পৃথিবীতে বাসস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য ইসলামের বিধানমতো ও নির্দেশিত নিয়ম মেনে ঘর বাড়ি নির্মাণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলামে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে গৃহ নির্মাণ ও অপচয় না করে সাজসজ্জা করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, মুসলিম ব্যক্তিকে তার ব্যয় করা প্রতিটি বস্তুর জন্য সাওয়াব দান করা হয়ে থাকে, তবে যা সে মাটিতে মিশিয়ে দেয় তার জন্য নয়। [সহীহ বুখারী-৫৬৭২]
সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে এমনভাবে ঘর-বাড়ি নির্মাণ করতে হবে যাতে পরিবারের সদস্যরা আপন আপন মর্যাদায় স্বাচ্ছন্দে আশ্রয় পায় এবং নিরাপত্তা লাভ করতে পারে। এজন্য রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, চারটি জিনিস সৌভাগ্যের প্রতীক। সতী-সাধ্বী স্ত্রীলোক, প্রশস্ত বাড়ি, সৎ প্রতিবেশী এবং ধৈর্যশীল (আরাম দায়ক) বাহন। [আল আদাবুল মুফরাদ-৪৫৯]
রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, সুসংবাদ ঐ ব্যক্তির জন্য যে তার জিহ্বাকে সংযত রাখতে পেরেছে, বাড়িকে প্রশস্ত করেছে এবং নিজের পাপের জন্য ক্রন্দন করেছে। [আত-তারগীব-২৮৫৫]
৮. ঘরকে প্রাণীর ছবি ও কুকুরমুক্ত রাখা
ঘরে কোনো প্রাণীর ছবি টাঙানো জায়েজ নেই। কারণ যে ঘরে প্রাণীর ছবি থাকে সে ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। হযরত আবু তালহা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন, ফেরেশতাগণ ঐ ঘরে প্রবেশ করে না যে ঘরে কুকুর অথবা ছবি থাকে।
[সহীহ বুখারী – ৩২২৫, মুসলিম – ২১০৬]
হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা একটি বালিশ ক্রয় করেছিলেন তাতে ছবি আঁকা ছিল। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে প্রবেশের সময় তা দেখতে পেলেন। তিনি ঘরে প্রবেশ না করে দরজায় দাড়িঁয়ে গেলেন। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা নবিজীর চেহারা মোবারক দেখে বুঝতে পেরে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমি আল্লাহ ও তার রাসূলে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট তাওবা করছি। আমি কী পাপ করেছি? নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, এই ছোট বালিশটি কোথায় পেলে! তিনি বললেন, এটি আপনার জন্য ক্রয় করেছি যাতে আপনি হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিতে পারেন। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, নিশ্চয় যারা ছবি তোলে বা অংকন করে কিয়ামতের দিন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং বলা হবে তোমরা যাদের তৈরি করেছ তাদেরকে জীবিত কর। তিনি বললেন, যে ঘরে ছবি থাকে রহমতের ফেরেশতা সেখানে প্রবেশ করেনা। [সহীহ বুখারী-৫৯৬১]
ঘরের মধ্যে কুকুর পালন করলে নেকী হ্রাস পায়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি শস্য ক্ষেতের পাহারা বা পশুর হিফাজতের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোনো উদ্দেশ্যে কুকুর পালন করে, প্রতিদিন তার আমল হতে এক কীরাত কমতে থাকবে।[সহীহ বুখারী-৩৩২৪, সহীহ মুসলিম-১৫৭৫]
]
৯. ঘর বাড়ির পরিবেশকে দূষণমুক্ত ও স্বাস্থ্যকর রাখা
আদর্শ ঘার বাড়ির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দূষণমুক্ত স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা। রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘর বাড়ির আঙ্গিনা ও এর আশেপাশের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্রতাকে ভালোবাসেন। তিনি নির্মল পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতাকে পছন্দ করেন। তিনি সুমহান, মহত্ত্বকে ভালোবাসেন। তিনি দানশীল, বদান্যতাকে ভালোবাসেন। সুতরাং তোমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখো। বর্ণনাকারী বলেন, আমি মনে করি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমাদের আঙ্গিনাসমূহ। তোমরা ইয়াহুদীদের মত হয়োনা। [তিরমিজী, আবওয়াবুল আদব-২৭৯৯]
সুন্দর পরিবেশের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ মলমূত্রের মাধ্যমেই সমাজে অধিকাংশ রোগজীবাণূ ছড়িয়ে পড়ে। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা তিনটি অভিশপ্ত কাজ পরিহার করো। তা হলো মানুষের ছায়া গ্রহণের স্থানে, যাতায়াতের স্থানে এবং পানির ঘাটে মলমূত্র ত্যাগ করা ।
[আবু দাউদ, কিতাবুত তাহারাত-২৬]
সুন্দর পরিবেশের জন্য যা যা প্রয়োজন পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালা তার সবকিছুই দান করেছেন। যেমন: মাটি, পানি, বায়ু, গাছপালা, ইত্যাদি মানব জাতির নিজেদের প্রয়োজনে আল্লাহর নিয়ামতের সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করবে এবং এর বিপর্যয় সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য। কেননা বায়ু যদি দূষিত হয়, জলাশয়গুলি যদি দূষিত হয়, পয়ঃপ্রণালী গুলি দুর্গন্ধযুক্ত ও স্যাঁতসেঁতে স্থানে হয় তাহলে ঐ বায়ু ও পরিবেশ দূষিত হয়ে সংশ্লিষ্ট জীবকূলকে রোগাক্রান্ত করে তোলো।[ইবনে খালদুন, আল মুকাদ্দিমা, ১ম খন্ড পৃ: ৫৮১]
১০. পানি ও খাবারের অপচয় রোধ করা
ঘর বাড়ি নির্মাণের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে যাতায়াতের পথ সুগম ও নিরাপদ হয়, অত্যাবশ্যকীয় নাগরিক সেবা প্রাপ্তি যাতে সহজ হয়। সু-শৃঙ্খল ও আরামদায়ক জীবন যাপনের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পানি বিদ্যুতের ব্যবস্থা স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা জরুরী। আল্লাহ তায়ালাই পৃথিবীর সকল সেবাকে মানুষের জন্য সহজ প্রাপ্যতার উপযুক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন হলো তিনি ভূপৃষ্ঠকে স্থিরতা দান করেছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদস্বরূপ স্থাপন করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে এর দ্বারা তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসেবে। [সূরা বাকারা-২২]
জীবনের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ হলো পানি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, এবং প্রাণবন্ত সবকিছুই আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম, এরপরও কী তারা ঈমান আনবেনা। [সূরা আম্বিয়া-৩০]
পানির অপচয় রোধ করতে ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, তোমরা খাও ও পান কর কিন্তু অপচয় করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেনা। [সূরা আরাফ-৩১]
রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তোমরা পানাহার করো, দান-সাদকা করো এবং পরিধান করো যতক্ষণ না তার সাথে অপচয় বা অহংকার যুক্ত হয়। [ইবনে মাজাহ-৩৬০৫]
১১. নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা
রাসূলে পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যখন সন্ধ্যা হয়, তখন তোমার সন্তানদের ঘরে প্রবেশ করাও। কেননা এসময় শয়তান ছড়িয়ে পড়ে। তবে রাতের কিছু অংশ অতিক্রম করলে তখন তাদের ছেড়ে দিতে পার। আর ঘরের দরজা বন্ধ করবে। কেননা শয়তান বন্ধ দরজা খুলতে পারেনা। আর তোমরা আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের মশকের মুখ বন্ধ করবে এবং আল্লাহর নাম নিয়ে তোমাদের পাত্রগুলোকে ঢেকে রাখবে। কমপক্ষে পাত্রগুলোর উপর কোন কিছুকে আড়াআড়ি করে রেখে দাও। আর শয্যা গ্রহণের সময় তোমরা তোমাদের প্রদীপগুলো নিভিয়ে দিবে। [সহীহ বুখারী-৫৬২৩, সহীহ মুসলিম-২০১২]
সামর্থানুযায়ী আরামপ্রদ ও মনোরম বাসস্থান তৈরি করে বসবাস করা মানুষ হিসেবে দায়িত্ব আর আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মুমিনের কর্তব্য। কেননা নিজের ঘরে থাকলে মানুষ নানারকম ফেতনা থেকে বাঁচতে পারে। ঘর বাড়ি হওয়া উচিত ইসলামি আদর্শের ভিত্তিতে যাতে করে ঘরের বাসিন্দারা নিজেদেরকে সার্বক্ষণিক আল্লাহর পথে চালাতে পারে। বিশেষত, কোনো পরিবার যদি আল্লাহ ও তার রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আদর্শে পরিচালিত হয় তাহলে ঐ পরিবারে বেড়ে উঠা শিশুরাও বেড়ে ওঠে নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে। তারা ভবিষ্যৎ জীবনের একটি সুন্দর ভিত্তি পরিবার থেকেই পেয়ে থাকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হয়ে উঠে আলোকিত ঠিকানা।
লেখক: সহকারি শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা), চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল, চট্টগ্রাম।