সফলতার দুটি পথ: রাগ সংবরণ করা ও সঠিক পথে স্থিরতা

0
সফলতার দুটি পথ: রাগ সংবরণ করা ও সঠিক পথে স্থিরতা
মাওলানা মুহাম্মদ আবুল হাশেম
রাগ
ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সহানুভূতি, ক্ষমা-মার্জনা মানব চরিত্রের সৌন্দর্যকে সমুজ্জ্বল করে; আর রাগ, ক্রোধ, রোষ, গযব ও প্রতিশোধস্পৃহার বহিঃপ্রকাশ ব্যক্তি মর্যাদাকে ধ্বংস করে দেয়। ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতাকে উত্তম চরিত্র আর ক্রোধ ও রাগকে মন্দ চরিত্রের আলামত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্বোরআনুল কারীমে রাগ সংবরণ করে ক্ষমা-মার্জনার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে-
الَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّاءِ وَالضَّرَّاءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
তরজমা: ওই সব লোক, যারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে সুখে ও দুঃখে, ক্রোধ সংবরণকারীগণ এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাপ্রদর্শনকারীগণ। আর আল্লাহ তা‘আলা সৎব্যক্তিবর্গকে ভালবাসেন।
পবিত্র আয়াতে وَالْكَاظِمِينَ বলে ক্রোধ সংবরণকারীদের কথা বলা হয়েছে। মশকের মুখ বন্ধ করা হলে, সেটার জন্য আরবিতে كظم ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মশকের মুখ এ জন্য বন্ধ করা হয় যাতে ভেতর থেকে কোন বস্তু বাহিরে না আসে। রহমতের কিতাব বলছে, মুত্তাক্বীর বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে তার ভেতরের উষ্ণ আবেগ, প্রতিশোধ গ্রহণের ইচ্ছা, বদলা নেয়ার সংকল্প, শয়তানী কুমন্ত্রণার প্রভাবাদি, উত্তেজনার চরম অবস্থা, স্বীয় আবেগ-অনুভূতিগুলোর উপর এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, যেমনিভাবে মশকের মুখ বন্ধ করে ভেতরের বস্তুগুলোকে ভেতরেই রূদ্ধ করে রাখা হয়, বাহিরে আসতে দেয়া হয়না, তেমনি তাক্বওয়ার পথ অবলম্বনকারী চরম উত্তেজনার সময়ে সৃষ্ট ক্রোধ, রাগ, গযবকে বাহিরে আসতে দেয়না, যাতে মন্দ চরিত্রের স্থলে উন্নত চরিত্র মাধুর্য ফুটে ওঠে।
রাগ সংবরণ করা ও ক্ষমা করা মুত্তাক্বীন ও খোদা তা‘আলার বান্দার পরিচয়। রাগ বলতে বুঝায়, অভ্যন্তরের উত্তাপ প্রকাশ করাকে। মানুষ যখন কোন আঘাত পায় এবং কষ্ট পায়, যেটার উপর সে স্বীয় আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তখন তার ভেতরে ভীষণ অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে যায়। ওই অস্থিরতা ও অশান্তি থেকে উত্তপ্ত অবস্থাদির প্রসার ঘটে। এ প্রসার অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট সৃষ্টি থেকে সঞ্চারিত হয়। আর অগ্নি দ্বারা সৃষ্ট সৃষ্টির মধ্যে শয়তান অন্যতম। বস্তুত রাগ, ক্রোধ, রোষ, গযব ও প্রতিশোধস্পৃহা, অধৈর্য্য হয়ে ওঠা, সহ্য শক্তি খর্ব করা, সহিষ্ণুতাকে চোখের আড়াল করা, ক্ষমা-মার্জনাকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা, ক্রোধ, রাগ প্রদর্শনের মডেল বনে যাওয়া- এ সবকিছু শয়তানের পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে। সুনানে আবূ দাঊদ শরীফের বর্ণনানুযায়ী হযরত ‘আত্বিয়্যাহ ইবনে ওরওয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন: পরম সহিষ্ণু ও দূরদৃষ্টির মালিক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
্রإِنَّ الْغَضَبَ مِنَ الشَّيْطَانِ، وَإِنَّ الشَّيْطَانَ خُلِقَ مِنَ النَّارِ، وَإِنَّمَا تُطْفَأُ النَّارُ بِالْمَاءِ، فَإِذَا غَضِبَ أَحَدُكُمْ فَلْيَتَوَضَّأْগ্ধ
“ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে আসে। আর শয়তানকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে, আগুনকে পানি দ্বারা নেভানো যায়। সুতরাং যখন তোমাদের কেউ ক্রোধান্বিত হয়, তবে সে যেন ওযূ করে নেয়।”
অপর এক হাদিসে রাগ দমন করার জন্য অবস্থা ও পদ্ধতি পরিবর্তন করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। কেউ দন্ডায়মান হলে, বসে যাবে; বসে থাকলে, শুয়ে যাবে; শুয়ে থাকলে পার্শ্ব পরিবর্তন করে নেবে; যাতে শয়তানী প্রভাব থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যায়। হাদিসে সুস্পষ্টভাবে এ বাস্তবতাকে ব্যক্ত করা হয়েছে যে, ক্রোধ শয়তানের পক্ষ থেকে, শয়তানের সৃষ্টি আগুন থেকে, আগুনের চিকিৎসা পানি দ্বারা হয়, রাগ এলে ওযূ কর। ওযূ পবিত্রতা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতার চিহ্ন। ক্রোধের সময় ভিন্ন অবস্থা তৈরী হয়, আল্লাহর সন্তুষ্টির বিপরীতে ক্রোধও নাপাকি, মলিনতা। আর অপবিত্র অবস্থায় ইবাদত-বন্দেগী করার পদ্ধতিগুলো অর্জন করা খুবই কঠিন, সুতরাং পবিত্রতা অর্জনে ওযূ করো। সেটা ইবাদত-বন্দেগীর নিকটে নিয়ে যায়, শয়তান থেকে দূরে নিয়ে যায়। আল্লাহর নৈকট্য অর্জন, আর শয়তানকে বর্জন করতে ওযূ করো; ক্রোধ শয়তানী অবস্থা, শয়তানী প্রভাবের চিকিৎসা করো। অবস্থার পরিবর্তন, পানি পান করা, নীরব থাকা, আউযুবিল্লাহ পাঠ করা, ‘লা-হাওলা ওয়ালা ক্বুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ পাঠ করা এবং ওযূ করা সেটার চিকিৎসা।
ক্রোধ মানব শরীর ও ব্যক্তিত্বে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সর্বদা ক্রোধান্বিত অবস্থায় থাকা মানব হৃদয় ও ¯œায়বিক অবস্থায় মন্দ প্রভাব ফেলে। আমেরিকান বিজ্ঞানী রেডফোর্ড বি উইলিয়াম বলেন: রাগ করার কারণে মানব হৃদয়ে এমনভাবে ক্ষতিসাধন হয়, যেমনিভাবে তামাক সেবন ও উচ্চ রক্তচাপ থেকে হয়। রাগান্বিত ব্যক্তি অতি দ্রুত মৃত্যুর উপত্যকায় পা রাখে। আর এতে সন্দেহ নেই যে, রাগ করার কারণে ¯œায়বিক অবস্থার প্রসারণ সৃষ্টি হয়, মানুষের স্মৃতিশক্তিতে প্রভাব পড়ে, রাগ করার কারণে চেহারার উজ্জ্বলতা, ঠোঁট ও চোখযুগলের চমক হ্রাস পায়, পরিপাকতন্ত্রের ব্যবস্থাপনা বিঘিœত হয়, এভাবে রাগ করার কারণে অগণিত ক্ষতি হয়ে থাকে। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন: “ক্রোধ থেকে বিরত থাকো, কেননা সেটার শুরু উন্মত্ততা, আর সমাপ্তি লজ্জা ও অনুশোচনা।” অপমান, লজ্জা, পেরেশানি থেকে সুরক্ষা পেতে ক্রোধ সংবরণ করা ও আত্মসংযম করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, অনেকসময় তাকে সারাজীবন সেটার ভোগান্তি সহ্য করতে হয়।
রাগ একটি অপারগতা ও দূর্বলতাও। হয়ত রাগের উত্তাপ প্রকাশকারী মনে করেন যে, আমি আমার শক্তি, সামর্থ্যের প্রকাশ করছি, বস্তুত সেটার বিপরীত হয়। রাগ তো সে দেখায়, যার মধ্যে সেটা সংবরণ ও নিয়ন্ত্রণের শক্তি নেই । যখন শক্তি, সামর্থ্য, ধৈর্য্য, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা কিছুই নেই, তাহলে রাগ একটি অপারগতা, একটি রোগ। এ রোগের চিকিৎসা করার নির্দেশও দেয়া হয়েছে। সেটা নিয়ন্ত্রণকারীকে বাহাদুর পলোয়ান আখ্যা দেয়া হয়েছে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রلَيْسَ الشَّدِيدُ بِالصُّرَعَةِ، إِنَّمَا الشَّدِيدُ الَّذِي يَمْلِكُ نَفْسَهُ عِنْدَ الغَضَبِ
“কোন ব্যক্তি কুস্তী দ্বারা পলোয়ান হয়না, বরং সে-ই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে আয়ত্বে রাখতে পারে।”
[বোখারী ও মুসলিম] ক্রোধ সংবরণ করা ও নিয়ন্ত্রণ করা শক্তি-সামর্থ্যরে পরিচায়ক। যে ব্যক্তি ক্রোধ দমন করতে পারেনা, সে পলোয়ান নয়। ইমাম গাযযালী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন: রাগ নিয়ন্ত্রণ ও আত্মসংযম করতে পারা পুরুষত্বের আলামত। আর পুরুষত্ব শক্তি-সামর্থ্যরে বহিঃপ্রকাশ।
রাগ ও ক্রোধ সংবরণের হুকুম হাদিসে দেয়া হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَوْصِنِي، قَالَ: ্রلاَ تَغْضَبْগ্ধ فَرَدَّدَ مِرَارًا، قَالَ: ্রلاَ تَغْضَبْগ্ধ
হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র দরবারে আরয করলেন,“আমাকে উপদেশ দিন!” তিনি বললেন, “তুমি রাগ করো না।” তিনি (লোকটি) এটা কয়েকবার আরয করলেন। তিনি (নবী করিম) প্রতিবারই বললেন: “তুমি রাগ করো না।”।
[বোখারী] রাগ দমন করার ব্যাপারে বারবার উপদেশ দেয়ার পেছনে অগণিত হিকমত রয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, রাগের কারণে ভারসাম্য স্থির থাকে না, আর যখন ভারসাম্য ঠিক থাকে না, তখন দৃষ্টিভঙ্গি ও আক্বিদাগুলোতে অনিয়ম এসে পড়ে। এ অবস্থায় ঈমানের স্বাদও বিনষ্ট হয়ে যায়। এজন্যই এরশাদ হচ্ছে,
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” إِنَّ الْغَضَبَ لَيُفْسِدُ الْإِيمَانَ كَمَا يُفْسِدُ الصَّبْرُ الْعَسَلَ ”
“রাগ ঈমানকে তেমনিভাবে বিগড়ে দেয়, যেভাবে মুসাব্বর মধুকে বিনষ্ট করে দেয়।
ঈলুয়া তিক্ত বৃক্ষ, যার রসে অতিমাত্রায় তিক্ততা রয়েছে যে, সেটা মধুর মিষ্টাতাকে পর্যন্ত নষ্ট করে দেয়। তিনি এরশাদ করেছেন, মুসাব্বর মধুকে যেমনিভাবে নষ্ট করে দেয়, তেমনি ক্রোধ ঈমানকে নষ্ট করে দেয়। ক্রোধ সংবরণ করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল হয়। মুসলমান ক্রোধ পান করে তথা আত্মসংযম করে আল্লাহকে রাজি করার দিকে অগ্রসর হয়। মিশকাত শরীফে হযরত ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা থেকে বর্ণিত, রসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ” مَا تَجَرَّعَ رَجُلٌ جُرْعَةً أَفْضَلَ مِنْ غَيْظٍ يَكْظِمُهُ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ ”
“কোন বান্দা আল্লাহ তা‘আলার দরবারে কোন ঢোক ওই রাগের ঢোকের চেয়ে উত্তম পান করেনি, যা বান্দা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অন্বেষণের জন্য পান করছে।” [শু‘আবুল ঈমান] ক্রোধ দমন করা উত্তম কাজ। ভালো ও কল্যাণের কাজ সেটিই, যা দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হয়ে যান। ইবনে জরীর ও ইবনে কাসির কর্তৃক বর্ণিত হাদিস লক্ষ্য করুন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ্রمَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ يَقْدِرُ عَلَى إِنْفَاذِهِ مِلْأَهُ اللهُ أَمْنًا وَإِيمَانًاগ্ধ رَوَاهُ ابْنُ جَرِيرٍ
অর্থ: যে ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্বীয় ক্রোধ ও গযবকে সংবরণ করেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে নিরাপত্তা, প্রশান্তি ও ঈমানের সম্পদ দ্বারা পরিপূর্ণ করেন। মানুষের হৃদয়ে যখন প্রশান্তি, নিরাপত্তা, সন্তোষ অর্জিত হয়, তখন সর্বদিক থেকে তার জন্য কল্যাণ বয়ে আনে। সে আধ্যাত্মিকভাবে এবং জাগতিকভাবেও পুরস্কৃত হয়। পার্থিব জীবনেও কল্যাণ লাভ করে, পরকালেও কল্যাণ অর্জন করবে। হাদিস শরীফে এসেছে,
أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: ্রمَنْ كَظَمَ غَيْظًا وَهُوَ قَادِرٌ عَلَى أَنْ يُنْفِذَهُ، دَعَاهُ اللهُ عَلَى رُءُوسِ الْخَلَائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، حَتَّى يُخَيِّرَهُ فِي أَيِّ الْحُورِ شَاءَগ্ধ
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের ক্রোধ চরিতার্থ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা সংবরণ করে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে কিয়ামতের দিনে সকল সৃষ্টির সামনে ডেকে আনবেন এবং জান্নাতের যেকোন হুর নিজের ইচ্ছেমতো বেছে নেয়ার অধিকার দান করবেন।” [ইবনে মাজাহ] এবার আসুন অন্য বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাক।
ইস্তিক্বামাত বা সঠিক পথে স্থিরতা
এক হাদীস শরীফে এসেছে,
عَنْ سُفْيَانَ بْنِ عَبْدِ اللهِ الثَّقَفِيِّ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، قُلْ لِي فِي الْإِسْلَامِ قَوْلًا لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ – وَفِي حَدِيثِ أَبِي أُسَامَةَ غَيْرَكَ – قَالَ: ” قُلْ: آمَنْتُ بِاللهِ، فَاسْتَقِمْ ”
হযরত সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ সাক্বাফী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আরয করলাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে এমন বিষয় বলুন, যা আপনার পরে সে সম্পর্কে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করবো না।” আবূ উসামার হাদিসে ‘গায়রাকা’ (আপনি ব্যতীত) রয়েছে। তিনি এরশাদ করলেন: “বলো, আমি আল্লাহ’র প্রতি ঈমান এনেছি।” অতঃপর সেটার উপর স্থির থাকো। [সহীহ মুসলিম] একই বিষয়ে সুনানু ইবনে মাজাহতে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ – صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -: “اسْتَقِيمُوا وَلَنْ تُحْصُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ مِنْ أَفْضَلِ أَعْمَالِكُمْ الصَّلَاةَ، وَلَا يُحَافِظُ عَلَى الْوُضُوءِ إِلَّا مُؤْمِنٌ”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: তোমরা সরল সোজা থাকো, কিন্তু তোমরা এটা করতে পারবে না। জেনে রাখো যে, তোমাদের সর্বোত্তম আমল হচ্ছে সালাত, আর ওযূর হিফাযত মু’মিনই করে থাকে।
ইসতিক্বামাত তথা স্থিরতার প্রাথমিক অবস্থা হলো, কর্মকান্ডে অলসতা হয় না; মধ্যম স্তরের ব্যক্তিদের ইসতিক্বামাত হচ্ছে, তারা আত্মিক উৎকর্ষ সাধনে এগুতে থাকে; আর ইসতিক্বামাতের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে, আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে কোন পর্দা বা অন্তরাল থাকে না।
হযরত আবূ বকর সিদ্দিক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর মতে, ইসতিক্বামাত হচ্ছে, শিরক থেকে বেঁচে থাকা; হযরত ওমর ফারুক্ব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলতেন, ইসতিক্বামাত মানে, মানুষ আল্লাহ তা‘আলার আনুগত্যের ব্যাপারে শিয়ালের মত যেন ছল চাতুরি (প্রতারণা) না করে; হযরত ইবনে আতার মতে তা হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে পরিপূর্ণ মনোনিবেশ করা; হযরত বু‘আলী জুরজানী বলেন, পদমর্যাদার প্রত্যাশা না করাই ইসতিক্বামাত; হযরত ওয়াসেতী বলেন, ইসতিক্বামাত হচ্ছে, ওই সকল স্বভাব ও চরিত্র, যেগুলোর মাধ্যমে মানবীয় সৌন্দর্য পূর্ণতা অর্জন করে; হযরত শিবলী বলেন, উপস্থিত সময়কে নিয়ামত মনে করেন যিনি, তিনি ইস্তিক্বামাতসম্পন্ন ব্যক্তি। [তাহযীবু মাদারিজিস সালিকীন,পৃ. ৫২৭-৫২৮] ইমাম ক্বুশায়রী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন, ইসতিক্বামাত-এর তিনটি স্তর রয়েছেঃ এক. কথাবার্তায় ইসতিক্বামাত হচ্ছে, মুখে গীবত না আসা; দুই. কাজকর্মে ইসতিক্বামাত হলো, মানুষ বিদ‘আতের নিকটেও যাবে না; তিন. আমলের ইসতিক্বামাত মানে অলসতা ত্যাগ করা। [রিসালাহ-ই ক্বুশায়রিয়াহ, বাবুল ইসতিক্বামাহ, পৃ.১৮২] ক্বোরআনুল কারীমে ইসতিক্বামাতসম্পন্ন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা মহাপুরস্কার দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন:- তাঁদের প্রতি ফিরিশতা অবতীর্ণ হয়, দুনিয়াতে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া, আখেরাতে দুশ্চিন্তা, অবমাননা, পেরেশানী থেকে পরিত্রাণ দেয়া, জান্নাতের সুসংবাদ, পার্থিব জীবনে খোদায়ী সাহায্যপ্রাপ্তির অঙ্গীকার, পরকালে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সাথে বন্ধুত্ব, আত্মার সকল আকাক্সক্ষা পূরণ, প্রতিটি চাহিদার পূর্ণতা এবং পরম ক্ষমাশীল, করুণাময়ের বিশেষ আতিথেয়তা। [হা-মীম সাজদাহ্, ৩০-৩৩] সুফীগণের মতে, ইসতিক্বামাত সমস্ত কারামত থেকে সর্বোত্তম। ইমাম গাজ্জালী (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন: ইসতিক্বামাত-এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা সর্বাধিক কঠিন কাজ। পূর্ববর্তী বুযুর্গগণ ও বড় বড় মনীষীদের বাণী থেকে যে কথা প্রতিয়মান হয়, সেটা হলো ইসতিক্বামাত’র প্রথম সম্পর্ক আক্বিদাহ ও ঈমানের সাথে। ইসলামে আক্বিদাহার নিসাব সুনির্দিষ্টÑ তাওহীদ, রিসালতের ঈমান, ঐশীগ্রন্থাবলির ঈমান, মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের ঈমান, হাশর-নশর’র ঈমান। আক্বিাদাহ ও ঈমানের দিকগুলো সুনির্ধারিত, এগুলোর মধ্যে নড়বড়ে না হওয়া-ই ইসতিক্বামাত। আমলের মধ্যে ইসতিক্বামাত হলো, আমলের স্থায়িত্ব, ফরয ও সুন্নাত হুকুমগুলোর উপর আমল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা। রুহানিয়ত তথা আত্মিক ইসতিক্বামাত হচ্ছে, স্বভাবের বৈচিত্র থেকে মুক্ত থেকে সর্বাবস্থায় একই রূপে থাকা।
রিসালাহ-ই ক্বুশায়রিয়াহ-তে সংকলক হযরত জোনায়দ (রহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র সূত্রে একটি হৃদয়স্পর্শী রেওয়ায়ত বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি একদিন জঙ্গলের দিকে ঘুরতে বের হলাম, সেখানে একটি বাবুল গাছের নিচে এক যুবকের সাথে সাক্ষাত হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কেন বসে আছো? সে বলল, আমার এক ‘হালত’ (অবস্থা) ছিল, সেটা হারিয়ে গেছে। পরে তাকে সেখানে রেখে আমি প্রত্যাবর্তন করলাম। ইত্যবসরে আমি হজ্জব্রত পালন করে ফিরে এসে দেখলাম সে যুবক তখনও ওই গাছের নিচে বসে আছে। পুনরায় আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি এখনো এ স্থানে বসে আছো, মূলত: কেন? সে প্রত্যুত্তরে বলল, আমি যে বস্তুর খোঁজ করছিলাম, সেটা আমি এ স্থানে পেয়ে গেছি। সুতরাং আমি এখানেই স্থির হয়ে বসে গেলাম। হযরত জোনায়দ (রহমাতুল্লাহি আলায়হি) বলেন, আমি অবগত হতে পারি নি, তার দু অবস্থার মধ্যে কোনটি উত্তম ছিল। একটি অন্বেষণকালীন অবস্থা, অপরটি উদ্দিষ্ট বস্তু অর্জিত হওয়ার পর এখানেই স্থির হয়ে যাওয়া।
[রিসালাহ-ই ক্বুশায়রিয়াহ, বাবুল ইসতিক্বামাহ, পৃ.১৮৪] ওইসব ব্যক্তি, বড় উন্নত সৌভাগ্যবান হন, যারা হাক্বীক্বত অন্বেষণ করে; আর প্রকৃত কাক্সিক্ষত পরশমণি তার কোলে এনে দেয়। সুতরাং সেটা নিয়ে তাঁরা স্থির হয়ে যান। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ইস্তিক্বামাত তথা স্থিরতার কল্যাণ নসীব করুন। আমীন। বিহুরমাতি সায়্যিদিল মুরসালীন। সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।
লেখক: পরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •