আল-ক্বোরআনের আলোকে গিয়ারভী শরীফ
গিয়ারভী শরীফ প্রকৃতপক্ষে মনগড়া ভিত্তিহীন কোন আবিষ্কার নয়; বরং ক্বোরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণাদি হচ্ছে- এর বৈধতার সুদৃঢ় ভিত্তি। মহান ওলী হযরত মাহবূবে সোবহানি শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র রুহ মুবারকে সওয়াব পৌঁছানার শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি হলো- গিয়ারভী শরীফ। ঈসালে সাওয়াবের বৈধতা ক্বোরআন, হাদীস ও বুযুর্গানে দ্বীনের নির্ভরযোগ্য কিতাবে উল্লেখিত অসংখ্য বর্ণনার আলোকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল পেশ করা হলঃ পবিত্র ক্বোরআনে এরশাদ হয়েছে- وَ الَّذِیْنَ جَآءُوْ مِنْۢ بَعْدِهِمْ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا
وَ لِاِخْوَانِنَا الَّذِیْنَ سَبَقُوْنَا بِالْاِیْمَانِ তরজমা: যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রণী ভ্রাতাদের ক্ষমা কর’।
পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِیْنَ یَحْمِلُوْنَ الْعَرْشَ وَ مَنْ حَوْلَهٗ یُسَبِّحُوْنَ بِحَمْدِ رَبِّهِمْ وَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَ یَسْتَغْفِرُوْنَ لِلَّذِیْنَ اٰمَنُوْاۚ-رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَیْءٍ رَّحْمَةً وَّ عِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِیْنَ تَابُوْا وَ اتَّبَعُوْا سَبِیْلَكَ وَ قِهِمْ عَذَابَ الْجَحِیْمِ তরজমা: যারা আরশ বহন করে আছে এবং যারা এর চর্তুপাশে ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে- হে আমাদের প্রতিপালক, তোমার দয়া ও গুণ সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তাওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো এবং তাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করে নাও।
পবিত্র ক্বোরআনের উল্লেখিত দু’টি আয়াত দ্বারা পরবর্তী ও পূর্ববর্তীদের পরকালীন মঙ্গল ও কল্যাণার্থে উত্তম আমল দান, সর্বদা ক্বোরআন খানি, ফাতেহাখানি ও ঈসালে ছওয়াব ইত্যাদি বরকতময় আমল করা শরীয়ত সম্মত।
আল-হাদীসের আলোকে প্রমাণ
মৃত ব্যক্তির প্রতি ঈসালে সাওয়াব -এর বৈধতা প্রমাণে হাদীস শরীফে অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে দু’টি উদ্ধৃতি পেশ করা হল-এক. হযরত আবূ উসাইদ যায়েদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রালুসুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট বসা ছিলাম, বনী-সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের প্রতি সদাচরণ করার মত কোন পথ অবশিষ্ট আছে? অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তো আমার মাতা-পিতার খেদমত ও সদাচরণ করেছি তাদের মৃত্যুর পরও কি এমন পন্থা আছে যে, তাঁদের সাথে সদাচরণ করব? হুযূর বললেন, ‘‘হ্যাঁ আছে, তাদের জন্য দো‘আ করা, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অপূর্ণ ওয়াদা পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
দুই. একদা প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মহান দরবারে আরয করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আমাদের মৃতদের পক্ষ থেকে সদক্বা ও হজ্ব আদায় করছি এসব কি তাদের নিকট পৌঁছবে? প্রিয় রসূল এরশাদ করেন, ‘‘হ্যাঁ নিশ্চয় সে সব আমলে তারা খুশী হয়, যেমনিভাবে তোমরা পরস্পরকে উপঢৌকন প্রদান করলে খুশী হয়ে থাক।
ঈসালে সওয়াব সম্পর্কে বুযুর্গ ওলামায়ে কেরামের অভিমত
হযরত শেখ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ‘ইবাদতে মালি’ বা আর্থিক ইবাদত তথা সদক্বা-খয়রাত প্রভৃতি দ্বারা মৃত ব্যক্তির কল্যাণ ও সাওয়াবের অধিকারী হওয়াতে সকলে ঐকমত্য পোষণ করেন। হযরত ইমাম-ই আ’যম আবূ হানীফা, ইমাম আহমদ এবং সালেহীনের অভিমত হলো, প্রত্যেক প্রকার ইবাদতের সাওয়াব মৃতের রূহে পৌঁছে থাকে। হযরত কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, অধিকাংশ ফোক্বাহায়ে কেরামের অভিমত হলো, প্রত্যেক ইবাদতের সওয়াব মৃতের নিকট পৌঁছে থাকে।
হযরত শাহ্ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ফাতেহা পাঠ করা এবং এর সওয়াব মৃতের রূহে পৌঁছানো প্রকৃত অর্থে জায়েজ ও সঠিক।
গিয়ারভী শরীফ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের অভিমত
অলীকুল সম্রাট হুযূর শাহানশাহে বাগদাদ গাউসুল আ’যম রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র যথার্থ মর্যাদা, শান-মান ও ব্যক্তিত্ব যেমনিভাবে মুসলিম বিশ্বের সাধারণ লোক থেকে আরম্ভ করে সর্বস্তরের আউলিয়ায়ে কেরামের নিকট পরিচিত ও সমাদৃত তেমনিভাবে তাঁর স্মরণে আয়োজিত মাসিক গিয়ারভী শরীফ তাঁর প্রতি ভক্তিÑশ্রদ্ধার এক অনুপম বহিঃপ্রকাশ। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, নজদী- ওহাবী বাতিল পন্থীরা গাউসে পাকের সুমহান মর্যাদা ও বেলায়তের অসাধারণ ক্ষমতাকে অস্বীকার করার সাথে সাথে গাউসুল আ’যম কর্তৃক প্রবর্তিত গিয়ারভী শরীফ ও মৃত ব্যক্তির কল্যাণ কামানার্থে ইসালে সাওয়াব-এর মাহফিল ও ফাতেহাখানির বিরুদ্ধে হারামও নাজায়েয ইত্যাদি ভিত্তিহীন ফাতওয়াবাজি এবং অপপ্রচারে লিপ্ত।
তাদের দাবী হলো গিয়ারভী শরীফে যেহেতু আল্লাহ ভিন্ন অন্য কারো নাম উল্লেখ করা হয় বিধায় তা হারাম। ক্বোরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা ও বিকৃতকারী বাতিলপন্থীদের ভিত্তিহীন দাবীর অসারতা প্রমাণিত বিধায় ক্বোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত ইসলামী শরীয়ত অনুমোদিত ও বরকতময় আমল, গাউসিয়া শরীফ, গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহাখানি ইসালে সাওয়াবের বৈধতা প্রমাণে ইসলামী পন্ডিত বিশেষজ্ঞদের প্রমাণ্য উদ্ধৃতি নিম্নে পেশ করা হলো-
এক. মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনে উল্লেখিত ‘‘ওয়ামা ওহিল্লা বিহী লেগায়রিল্লাহ’ আয়াতের ব্যাখ্যায় বাদশাহ্ আওরঙ্গজেব আলমগীর’র শিক্ষক মোল্লা আহমদ জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘তাফসীরাত-ই আহমদিয়া’ কিতাবে বলেন- আল্লাহ ছাড়া কারো নামে যদি পশু যবেহ করা হয় যেমন কাফেরগণ তাদের প্রতিমার নামে উৎসর্গ করে থাকে তা হারাম।
তবে যদি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে পশু জবেহের পূর্বে বা পরে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নাম উল্লেখ করাতে কোন দোষ নেই। যেমন হেদায়া কিতাবে উল্লেখ আছে। এতে প্রতীয়মান হলো- আউলিয়া কেরামের ইসালে সাওয়াবের জন্য যে গরু, ছাগল হালাল জন্তু মান্নত করা হয় যেমন- আমাদের দেশের মুসলমানগণ এ ধরনের মান্নত করে থাকেন তা ভক্ষণ করা হালাল ও পবিত্র। কারণ যবেহের সময় এ ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহর নাম নেয়া হয়নি।
হযরত মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর সুযোগ্য ছাহেবজাদা মোল্লা মুহাম্মদ গিয়ারভী শরীফের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে একথার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন যে, অন্যান্য মাশায়েখের ওরশ শরীফ বৎসরান্তে অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু গাউসে পাকের অনন্য মর্যাদার বৈশিষ্ট্য এ যে, বুযুর্গানে দ্বীন তাঁর স্মরণে গিয়ারভী শরীফ প্রতি মাসের ১১ তারিখ পালন করে থাকেন।
দুই. হযরত শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরত মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অনুরূপ ক্বোরআনুল করীমের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যবেহকালে যদি আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারো নাম নেয়া হয় তা হারাম হবে।
তিনি আরো বর্ণনা করেন যে, হযরত মির্যা মাজহার জানে জানাঁ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এরশাদ করেন যে, একদা আমি আউলিয়া কেরামের একদলকে ধ্যানমগ্ন মোরাক্বাবারত অবস্থায় একটি উচুস্থানে উপবিষ্ট দেখলাম। মাঝখানে হযরত খাজা নক্শবন্দ দোজানু অবস্থায় এবং হযরত জোনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ঠেঁস দিয়ে বসে আছেন। অতঃপর তাঁরা সবাই চলতে লাগলেন আমি তাঁদেরকে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। একজন উত্তর দিলেন- হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে অভিবাদন জানানোর জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। এদের সাথে আমি হযরত ওয়াইসুল করণী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকেও দেখলাম। অতঃপর একটি কক্ষ প্রত্যক্ষ করলাম, যেখানে নূরের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম ঐ গৃহে প্রবেশ করতে শুরু করলেন, আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে একজন উত্তর দিলেন- ‘ইমরোজ ওরসে হযরত গাউসুস সাকালাইন আস্ত, বতক্বরীবে ওরস তাশরীফ বরন্দ’ অর্থাৎ আজকে গাউসুল আ’যমের ওরস মুবারকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে যাচ্ছে।
তিন. শাহ আবদুল আযীয দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমার পিতা শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাগদাদ শরীফে সরকারীভাবে গিয়ারভী শরীফ উদ্যাপনের কথা অধিক গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। গাউসে পাকের রওযা শরীফে মাসের এগার তারিখে দেশের বাদশাহ্, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রীবর্গ উপস্থিত হতেন, আসরের নামাযের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত ক্বোরআন তিলাওয়াত, ক্বসীদা পাঠ ও জীবনী আলোচনা করা হতো। এতে এক ধরণের ধ্যানমগ্নতা ও প্রচন্ড ব্যাকুলতা সৃষ্টি হতো। অতঃপর খাদ্য-দ্রব্য তাবাররুক, শিরনী বিতরণ করা হতো। এশার নামায আদায়ের পর লোকজন বিদায় গ্রহণ করতো।
চার. হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমামে আরেফ শায়খে কামিল আবদুল ওহাব ওরসে গাউসিয়া শরীফ নিয়মিত উদ্যাপন করতেন। মূলতঃ গিয়ারভী শরীফ আমাদের শহরসমূহে প্রসিদ্ধ এবং আমাদের মাশায়েখ হযরাতের মধ্যে পরিচিত। কতেক পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম বলেন, আউলিয়ায়ে কেরামের ওফাতের দিন কল্যাণ, মর্যাদা ঈমানী আলো ও বরকত লাভের প্রত্যাশা অন্য দিনসমূহের তুলনায় অধিক হয়ে থাকে।
এ কারণে বুযুর্গানে দ্বীনের ওফাত দিবসে খতম শরীফ আয়োজন, ওরসে গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহা খানি ও ইসালে সাওয়াবের ব্যবস্থাপনা অতীব গুরুত্ব ও যতœ সহকারে আয়োজন করা হয়।
শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রখ্যাত অলীয়ে কামেল হযরত শায়খ আমান পানিপথি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সম্পর্কে বলেন, তিনি রবিউস সানির এগার তারিখে পীরান পীর গাউসুস সাক্বালাঈনের ওরস উদযাপন করতেন।
শাহ্জাদা দারাশিকো, ‘সফীনাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে, হযরত শাহ্ আবদুল মায়ালী ‘তোহফায়ে ক্বাদেরিয়া, গ্রন্থে এবং মুফতি গোলাম সরওয়ার লাহোরী, ‘খজীনাতুল আসফিয়া’ গ্রন্থে গিয়ারভী শরীফের ওরস ও বরকতময় অনুষ্ঠানকে পূণ্যময় আমল বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।