খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী
রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র
জীবন পরিক্রমা
ড. মুহাম্মদ সাইফুল আলম
১.১(ক) জন্ম :
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ১২৬২ হিজরী মুতাবিক ১৮৪৪ খ্রীষ্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হরিপুর (তৎকালীন হাজারা) জেলার ’চৌহর’ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর উপনাম আবুল ফাদ্বলাইন (ابو الفضلين)। তাঁর জন্মস্থান চৌহরের দিকে সম্বোধন করে তাঁকে চৌহরভীও বলা হয়। তাঁর উপাধি ছিল ওলী-ই উম্মী (ولى امى )। তিনি খলীফা-ই-শাহ জীলান হিসেবেও পরিচিত। তাঁর নামের পূর্বে “খাজা” শব্দটি পরিলক্ষিত হয়। তাঁর ভক্তবৃন্দের কাছে তিনি এ নামে পরিচিত।
১.১(খ) বংশ পরিচয় :
হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বংশ পর¤পরায় ইসলামের চর্তুথ খলীফা হযরত আলী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সাথে স¤পৃক্ত এ জন্য তাঁকে আলভী ও বলা হয়। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র পিতা হযরত ফকীর মুহাম্মদ খিজ্রী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন একজন স্বনামধন্য উচ্চস্তরের আধ্যাতিœক ব্যক্তিত্ব। তিনি ‘হাজারা’র দরবেশ নামেও খ্যাত ছিলেন। তাঁর গভীর ধর্মজ্ঞান আধ্যাতিœক শক্তিমত্তায় বহুলোক সমৃদ্ধ ও উপকৃত হয়েছিল। তাঁর বহু কারামত এখনো লোক মুখে বিদ্যমান। তিনি ছিলেন আল্লাহ ও রাসূলের প্রেমে বিভোর। তিনি নির্জন স্থানে যখন একাকী হামদ্-না’ত পাঠ করতেন, তখন তাঁর প্রেম সু¯পষ্টভাবে ফুটে উঠত। তা এতটাই মর্ম¯পর্শী ও হৃদয়গ্রাহী ছিল যে, দূরের শ্রোতাকেও কাছে নিয়ে আসতো, তখন শ্রোতাও সীমাহীন মোহিত হয়ে যেত। এভাবে তিনি এক রাতে হযরত খিযির আলায়হিস্ সালাম এর সাক্ষাৎ লাভ করেছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এ সময় থেকে তিনি খিযরী নামে পরিচিত হন।
খাজা আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আট বছর বয়সে তাঁর পিতাকে হারান। খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র পিতামহ হযরত সায়্যিদ মুহাম্মদও ছিলেন একজন হাফিয ই-কুরআন ও সূফী-সাধক। সুতরাং পারিবারিক সূত্রে খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র ধমণিতে সূফী ধারার সবার্ধিক প্রভাব প্রবাহিত হয়। সাধনা ও আধ্যাত্মিকতা উপলব্ধিতে তাঁর জীবন গড়ে উঠে। ইবাদত-রিয়াযতের প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ।
১.২. শৈশবকাল ও শিক্ষাজীবন
খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি শৈশব হতেই ছিলেন ভিন্ন প্রকৃতির। তদুপরি পারিবারিক উপযুক্ত পরিবেশ ও তাঁর বুর্যগ পিতা ফকীর মুহাম্মদ খিযরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র সান্নিধ্যে থেকে আল্লাহ তা‘আলার নৈকট্য অর্জনের বিশেষ অবস্থা অর্জন করেন তিনি। তাই প্রচলিত জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত না হয়ে তিনি মা‘রিফাতের জ্ঞান সমুদ্রে ডুব দেন। কেননা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিচয় লাভ করাই প্রকৃত জ্ঞান। প্রাক ইসলামী যুগে আবু জাহাল আরবদের নিকট আবুল হাকাম (পন্ডিত) নামে খ্যাত ছিল, কিন্তু আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পরিচয় লাভে ব্যর্থ হওয়ায় পরবর্তীতে আবু জাহাল (গন্ড মূর্খ) নামে পরিচিত হয়। কাজেই শরী‘আত ত্বরীক্বাত এসবই মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নৈকট্য অর্জনের বিশেষ ব্যবস্থাপনা আর দ্বীনী জ্ঞার্নাজন এ লক্ষ্য অর্জনের সোপান মাত্র। এ জন্য সকল পীর-মাশায়িখ কোন না কোনভাবে এ উদ্দেশ্যে জ্ঞার্নাজন করেছেন। কেউ গ্রহণ করেছেন প্রথাগত ও স্ব যুগে প্রচলিত পদ্ধতি, আবার কেউ ত্বরীক্বাতে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে, কেউ বা আবার কামিল পীর এর শুভদৃষ্টিতে, কেউ বা আবার রিয়াযতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ অনুগ্রহে ‘ইলম-ই লাদুনী’ লাভে ধন্য হয়েছেন। খাজা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র জ্ঞার্নাজন পদ্ধতি ছিল কঠিন রিয়াযতপূর্ণ। তিনি স্বযুগে প্রচলিত প্রথানুযায়ী উস্তাদের নিকট শুধু পবিত্র কুরআন পড়েছিলেন।
পিতার ইন্তিকালের পর মাত্র নয় বছর বয়সে কঠোর রিয়াযতের আশ্চর্য্যকর প্রাণপাত চিল্লা করেন তিনি। খাওয়া-দাওয়া প্রায় বন্ধ রাখতেন। নির্দিষ্ট সময়ে একটা থালাতে রক্ত বমি করতে লাগলেন। কয়েকদিন রক্ত বমি হওয়ার পর যখন রক্তশূন্য হল, তখন বমির সাথে পানি আসতে লাগল। এভাবে ক্রমাগত চল্লিশ দিন পুর্ণ হল।
আল্লামা সায়্যিদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (র) বলেন,
‘‘নাবালেগ তথা বয়সের স্বল্পতায় এমনিতেই তিনি নি®পাপ ও মাসুম ছিলেন। তদুপরি এমন মৃত্যু তূল্য ‘চিল্লা’ অলি-আল্লাহদের কেউ করেছেন, না শুনেছিÑএমন কঠিন সাধনার মাধ্যমে কারোর শারীরিক জড়তা ও স্থুলতা এবং প্রাণীসুলভ স্বভাবের সব রকম অন্ধকার দূর ও বিনাশ হয়ে সূক্ষèধর্মী পূর্ণ আধ্যাতিœকতা লাভ হয়েছে।
ড.মুহাম্মদ মাস‘উদ আহমদ বলেন –
‘‘যা দুনিয়া বাসীর জন্য বোধগম্য নয়, আধ্যাতিœকতার অধিকারীর জন্য আর্শ্চয্য ও হতবাক করার কারণও বটে।’’
আতাউর রহমান ক্বাদিরী রিদ্বভী বলেন,
‘‘তিনি এমন এক বিস্ময়কর চিল্লার সংকল্প করেন,যার উদ্দেশ্য দৈহিক কলুষতা ও কদর্য্যতার পবিত্রতা । ………যখন চিল্লা পূর্ণ হল তখন তাঁর মন ও প্রতিভা পূর্ন দীপ্তমান হল।
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র এ ধরনের ‘চিল্লা’ সাধনা স¤র্পকে মহানবী’র একটি হাদীস বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,
كل ميسر لما خلق له
“প্রত্যেকটি সহজ; যেটার জন্য সৃষ্ট হয়েছে’’।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ان سعيكم لشتى فاما من اعطى و اتقى و صدق بالحسنى فسنيسره لليسرى
‘নিশ্চয় তোমাদের প্রচেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন। অত:পর যাকে দেওয়া হয়েছে, সে তাকওয়া অর্জন করেছে আর কল্যাণকরগুলো সত্যায়ন করেছে। অতিসত্ত্বর সহজ করে দেয়া হবে সহজতরগুলো।
কাজেই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আল্লাহ তা‘আলার মনোনীত মাতৃগর্ভে অলি হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছেন বলেই পরিশুদ্ধ মনে এ ধরনের চিল্লা সাধন তারঁ পক্ষে সম্ভবপর হয়েছে। এ রূপে চিল্লা সাধন মূলত: তাঁরই কারামত, যা দুনিয়ার কোন নিয়মে বা গন্ডীতে বিচার ও পরিমাপ করা যায় না। কারামত অস্বাভাবিক বলে এ বিষয়ে বুঝার সাধ্য সবার নেই, সকল যুক্তি-তর্ক হার মানে। সংঘটিত ঘটনাই যথেষ্ট, এটাই সত্য ও বাস্তব। যাঁরা বুঝেন; তারা মেনে নিয়ে থাকেন। এ কষ্টসাধ্য সাধনা করে আল্লামা চৌহরভী তাঁর শরীরে বিদ্যমান রিপু দমন করেন,নিজের দেহ-মনকে আরো স্বচ্ছ ও পুতঃপবিত্র করে তুলেন। যেমনটি স্বচ্ছ আয়না, আয়নার উপর যখন সূর্যরশ্মি পড়ে; তখন আলোতে উদ্ভাসিত হয়। ঠিক তেমনি, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নূরানী ঝলকে আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র দেহ-মন উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। এটি ছিল নফ্স-শয়তানের বিরুদ্ধে তাঁর জিহাদের প্রথম সোপান। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তিতে আরো দীপ্তিমান হন। এতে তিনি আল্লাহ তা‘আলা’র পক্ষ হতে প্রত্যাশিত সেই ইলম-ই লাদুনী লাভ করেন।
মুফ্তী ওবাইদুল হক না‘ঈমী বলেনÑ
‘‘হুজুরী তথা ‘আত্বায়ী; যা ঐশী প্রদত্ত, এ প্রকারের জ্ঞান অর্জনের জন্য না কোন শিক্ষকের সামনে শিক্ষার্থী হওয়া জরুরী, না পাঠদান বা গ্রহনের বাহ্যিক প্রয়োজনীয়তা আছে। যখন সর্বজ্ঞ, সর্ব-অবহিতকারী আল্লাহ তা’লা তাঁর বান্দাদের হতে কাউকে প্রিয়ভাজন করে নেন,তখন তাঁর জন্য আদি-অন্ত সকল প্রকার জ্ঞানের দরজা উম্মুক্ত করে দেন এবং তাঁকে অদৃশ্যজ্ঞানের গুপ্ত রহস্যেরও উপযুক্ত করেন। শিক্ষকের দরজায় কড়া নাড়ারও প্রয়োজন হয় না,কারোর শিষ্যত্বের মুখাপেক্ষী হতে হয় না। এ সত্যের প্রকৃষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত প্রমাণ-স্রষ্টার নৈকট্য প্রাপ্ত সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের ঝর্ণাধারা; ইলম-ই ইলাহীর ভান্ডার; জিলান নগরের রাজাধিরাজের স্থলাভিষিক্ত; খাজাদের খাজা; খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’ র পবিত্র সত্তা ও তাঁর মহা মূল্যবান গ্রন্থ মাজমূ’আহ্-ই সালাওয়াতির রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম।”
সুতরাং তাঁর জ্ঞার্নাজনের পন্থা ছিল কঠিন ও অস্বাভাবিক। প্রাণপণ চিল্লা সাধন করে তিনি যে মহান আল্লাহ’র প্রদত্ত জ্ঞানরতেœর মালিক হয়েছেন তাতে প্রতীয়মান হয় যে- স্থানীয়, সামাজিক, পারিপার্শ্বিক, ধর্মীয় ও ভাষাগত প্রয়োজনীয় বিষয় জ্ঞান তাঁর মাঝে বিদ্যামান ছিল। স্ব যুগের প্রচলিত পদ্ধতিতে আরবী ভাষার প্রয়োজনীয় বিষয় সমূহে যথারীতি অধ্যায়ন না করেও সেগুলো আয়ত্ব করতে সফলভাবে সক্ষম হন। তাঁর আঞ্চলিক ভাষা হিংকো হওয়া সত্ত্বেও উচ্চাঙ্গের আরবী ভাষায় বহু কিতাব রচনা করেন তিনি। তম্মধ্যে ‘মাজমূ‘আহ-ই সালাওয়াতির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামা’ গ্রন্থটি তাঁর স্বহস্তে লিখিত বিস্ময়কর সৃষ্টি। তিনি কারো থেকে প্রচলিত লিখার পদ্ধতি বা হস্তলিপি সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনও করেননি। সে-জন্য তিনি নিরক্ষরও ছিলেন না; রীতিমত লিখতেন, ভক্তদের চিঠি-পত্রের জবাবও দিতেন, অবশ্য তিনি সুন্দর-আকর্ষণ করে লিখতেন না; কিন্তু তাঁর লিখা এতটাই স্পষ্ট ছিল যে- অনায়সে তা পড়া যেত। তদুপরি যাদের আক্ষরিক জ্ঞান নেই, তারা যেমন পড়তে-লিখতে পারে না; তেমনি একজন অনারবী বা ভাষা জ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষেও হরকত বিহীন আরবী বাক্য উচ্চারণ ও পাঠ কল্পনাতীত ব্যাপার। এমতাবস্থায় আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি বাল্যকাল থেকে রীতিমত হাদীসের হরকত বিহীন কিতাবাদি পাঠ করতেন ও হাদীসের বর্ণনা অনুসারে ফযীলত বর্ণনা সমৃদ্ধ আমল করতেও সচেষ্ট ছিলেন। বুঝা গেল, তিনি শুধু পাঠোদ্ধারে সক্ষম ছিলেন তা নয়; বরং র্মম বুঝতেও পারঙ্গম ছিলেন। একজন জন্মগত অলির পক্ষে এরূপ পারঙ্গমতা অনস্বীকার্য। কবরের প্রশ্নোত্তর, হাশরে হিসাব-নিকাশ এবং জান্নাতের কথোপকথন সবই আরবী ভাষায় হবে। অথচ তা অর্জনে একজন মু’মিন বান্দাকে কোন প্রতিষ্ঠানে কিম্বা কোন শিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হবে না; বরং অনায়সে বুঝতে ও বলতে পারবে। আল্লাহ তা‘আলা মু’মিনের হৃদয়ে এ জ্ঞান ঢেলে দিয়ে থাকেন, যেরূপে হযরত মূসা আলায়হিস্ সালাম এর মায়ের মনে (তাঁর আর্বিভাবের পর) করনীয় ও অভয়বানী ঢেলে দিয়েছেন এবং হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র হৃদয়ে প্রত্যেক কিছুর নামের জ্ঞান দান করেছেন। এ কারণে আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিইলম-ই হাদীস, তাফসীর, ফিকহ্, উসুল, মানতিকসহ অপরাপর জাগতিক ও ধর্মীয় শাস্ত্রের জটিল -কঠিন বিষয়েও অতি সহজ পদ্ধতিতে অকাট্য যুক্তি – প্রমাণসহ চমৎকার ভাবে সঠিক সমাধান দিতেন। এ ব্যাপারে মুফ্তি ওবাইদুল হক না‘ঈমী অভিমত ব্যক্ত করেন এভাবেÑ
‘‘তাঁর সামনে যখন কোন জটিল সমস্যা উত্থাপিত হত,তৎক্ষনাৎ তিনি ধর্মীয় কিতাব সমুহ হতে সহজ সমাধান করে দিতেন’’।
অধিকন্তু তাঁর রচিত আরবী, উর্দূ, ফার্সী ভাষায় বহু কবিতারও সন্ধান পাওয়া যায়। বার্মার অধিবাসী আবদুল হামীদ নামক তাঁর এক ভক্তের চিঠির জবাবে তিনি লিখেন যে,
‘‘ বছরের পর বছর মেহনতে গ্রন্থ, ওযীফা ও দুরূদ শরীফ সংখ্যা শতাধিক এ নগন্য জমা করেছে’’।
আল কুরআনে আছে,
اتقواالله ويعلمكم الله- ان الله بكل شئ عليم –
তোমরা আল্লাহকে ভয় কর আর আল্লাহ তোমাদেরকে শিখান। বস্তুত আল্লাহ প্রত্যেক কিছু সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত আছেন।
এ আয়াতের পর্যায়নুক্রম বিশ্লেষণে স্পষ্ট হয় যে, মহান আল্লাহ’র প্রদত্ত জ্ঞান লাভের উপযুক্ততা হল তাক্ওয়া অর্জন করা। এ তাক্ওয়া অর্জন অনুপাতে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে তা‘লীম প্রদান করেন। আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি শৈশবে যে চিল্লা সাধন করেছেন, তাতে নি:সন্দেহে বলা যায় যে, তিনি তাক্ওয়ার উন্নত শিখরে উপনীত ছিলেন। কাজেই প্রতিভাত হয় যে, আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জীবনধারায় আল্লাহ তা‘আলার স্বতন্ত্র শিক্ষায় সুশিক্ষিত, তাত্ত্বিক ও আধ্যাতিœক জ্ঞানে পারদর্শী। তাঁর জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ইলম-ই লাদুনী’র প্রভাবই সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। তিনি মানব গড়া পদ্ধতি গ্রহণ না করে মহান আল্লাহ’র প্রদত্ত জ্ঞানে ধন্য হন, যা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে সুপ্ত বন্ধন। তা শুধু নবী-রাসুলগণের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; বরং মুত্তাকীদের বেলায়ও প্রযোজ্য। ইসলামের পরিভাষায় একে বলে ইলহাম।
এভাবে আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি অতি অল্প বয়সে কঠোর রিয়াযতের মাধ্যমে তদীয় পিতা হযরত ফক্বীর মুহাম্মদ খিযরী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র স্থলাভিষিক্ত হন। কুতুবিয়াত ও গাউসিয়াতের পদ মর্যাদা লাভ করেন। তা সত্ত্বেও তিনি কামিল পীরের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
চিল্লা সমাপ্ত করার পর তিনি সেই যুগের প্রখ্যাত কামিল পীর হযরত আখুন্দ রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র অবস্থানস্থল ‘‘সোয়াত উপত্যকায়’’ গমণ করেন। এমনিতে শৈশবকাল থেকেই তাঁর মাঝে কামালিয়াত ও কারামতের সু¯পষ্ট আলামতের বহিঃপ্রকাশ ঘটে খুবই দ্রুতভাবে। তথাপি সোয়াত শরীফে লাখো জনতার ভীড়ে বালক হযরত আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র গুণে মানে সমৃদ্ধির পরিচয় প্রকাশ হওয়া বিরল দৃষ্টান্তও বটে। সেখানে আগত জনতার চোখে-মুখে বিষ্ময়; হাজারার (হরিপুর) এই বালকের মাঝে এমন কী আছে! যদ্দরুন হুজুর লাখো দর্শনাথীদের হতে তাঁকে খুঁেজ বের করে আপন সাক্ষাৎ দানে ধন্য করেছেন। এখানে হযরত আখুন্দ রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুতাঁকে সু-সংবাদ প্রদান করেন যে,
‘‘আপনার পীর সাহেব আপনার বাড়ীতে এসে সদয় মুরীদ করাবেন’’।
উল্লেখ্য, তাঁর মনের ব্যাকুলতা এতই প্রবল ছিল যে, তিনি সোয়াত শরীফ হতে ফিরে এসে হযরত পীর ফদ্বল দ্বীন শাহ গোল্ডভী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র নিকট গমন করেন। সেখানেও তিনি একই ধরনের সংবাদ প্রাপ্ত হন এভাবে,
‘‘আখুন সাহেবের কথায় কি আপনার স্বস্তি আসেনি! আপনি ঘরে গিয়ে বসুন,আপনার ঐ চিল্লার স্থানে অবস্থান করুন, সেখানেই আপনার কাজ হবে’’।
এ প্রসঙ্গে আল্লামা মুহাম্মদ আবদুল হাকীম শরফ কাদিরী বলেন-
‘‘শৈশব হতেই ইবাদত-রিয়াযত ও সাধনায় তাঁর স্বভাবজাত উদ্দীপনা ছিল। তাঁর সৌভাগ্য ও অন্তরের পুত:পবিত্রতার ফসল হচ্ছে, তাঁর পীর হযরত শায়খ ইয়া‘কুব শাহ্ (রা:) আযাদ কাশ্মীর হতে চৌহর গ্রামে শুভাগমণ করেন এবং তাঁকে সিলসিলা-ই আলীয়া ক্বাদিরীয়াতে বায়‘আত করান। অতঃপর সবিশেষ দানে ও সানুগ্রহে প্রতিপালন করেন।
এ সময় হযরত ইয়া‘কুব শাহ রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু তাঁকে নসীহত করেন যে,
‘‘তোমার কাছে প্রত্যেক রোগ-শোক এবং অভাবগ্রস্ত মানুষ; বরং প্রত্যেক শ্রেণীর লোক আসবে কিন্তু কখনও কাউকে ‘না’ কর না; ইজাযত (বায়‘আত করানোর অনুমতি), ইরশাদ (নির্দেশনা) ও হিদায়ত চালু রাখবে। আল্লাহ পাক কবুল করবেন। যে কার্যকলাপ আমি তোমার সাথে করেছি, তা তুমি আগত সৃষ্টিকুলের সাথে করবে।
সুতরাং শৈশবে তিনি অন্যান্য বালক-বালিকাদের মত কখনো খেলা-ধূলায় লিপ্ত ছিলেন না। শান্ত, স্নিগ্ধ, পবিত্রাভায় আচছন্ন থাকতেন। ধর্মীয় আরাধনা-সাধনা তাঁর সহজাত ছিল। ধর্মাচার, কার্য- পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি যে একজন উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন অলি – এ আভাস পরিলক্ষিত হয়েছিল শৈশবেই।
১.৩. কর্ম ও রচনাবলী
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র পুরো জীবনই ছিল কর্মমুখর। সাধারণত: লেখাপড়া শেষে কর্মজীবন শুরু, তারপর একটি নির্দিষ্ট সময়ে অবসর গ্রহন করার যে প্রচলিত প্রথা মানব সমাজে বিদ্যমান, তিনি ছিলেন এর স¤পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি যেমন প্রথাগত জ্ঞানার্জন করেননি, তেমনি স্থায়ীভাবে কোন পেশায়ও জড়িত হননি; বরং সত্যিকার অর্থে দ্বীন ইসলাম প্রচার-প্রসারে এবং জনসাধারণকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিতে নিজকে উজাড় করে দেন। কেননা তাঁর পরিপূর্ণ আদর্শ ছিল প্রিয়নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম। তাই তিনি সারা জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে এ আদর্শ প্রতিষ্ঠা কর্মে ব্যস্ত ছিলেন। প্রচলিত আধুনিক শিক্ষা ধারায় দ্বীনী শিক্ষা ও সূফীবাদের সমন্বিত ত্বরীক্বাত চর্চাতে মানুষের মুক্তির দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। ভারী অস্ত্র গোলা-বারুদ এবং শাসন ক্ষমতার অধিকারী ইংরেজদের নির্যাতন ও উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু স¤প্রদায়ের চক্রান্ত থেকে মুসলমানদের মুক্ত করতে প্রয়োজন সাংগঠনিক তৎপরতায় কূটনৈতিক সংলাপ। কারণ, গুটি কয়েক গোলা-বারুদ, তীর-তলোয়ার এবং গাছ-বাশেঁর লাঠি-সোঁঠা নিয়ে আঞ্চালিক বা গোষ্ঠীগত আন্দোলন যেমন স্থায়ী ব্যবস্থা নয়, তেমনি পরিণতি যে, শুধু নির্ঘাত পরাজয়; তা নয় বরং চরম বিপর্যয়কেও ডেকে আনবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছেন, ইতিহাসের পাতায় তা-ই পরিলক্ষিত হয়েছে। ইসলাম ও মুসলমান হয়েছে কলংকিত। সে জন্য বিশ্ব স¤প্রদায় মুসলমানদেরকে জানার পরিবর্তে দমনের পথকে বেচে নিয়েছে। অথচ মদীনার সনদ ও মহানবী কর্তৃক আরবের বিভিন্ন গোত্রের সাথে সন্ধি স্থাপন প্রমাণ করে, সংলাপই ইসলামের নীতি; সংঘাত নয়। এই সংলাপের পথ সুগম করতে এমন এক নিরব আন্দোলনের প্রয়োজন যা মুসলমানদের মাঝে আত্মশুদ্ধি, গণজাগরণ ও ঐক্য সৃষ্টি করবে। এ লক্ষ্যে আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ত্বরীকত চর্চার যে সমন্বিত ধারাটি গ্রহণ করেছেন, তা মুরীদদেরকে আধ্যাত্মিকতায় যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি মুসলমানদের স্বতন্ত্র আন্দোলনের ভিত্ও রচনা করে। ইসলামী রেনেসাঁর এই দিকপালের সময়োচিত পদক্ষেপটি মুক্তিকামী মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে নতুন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়িমের নব দিগন্ত সূচনা করে। পরবর্তীকালে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার জন্য তাঁর প্রধান খলীফা আল্লামা সায়্যিদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বলিষ্ট ভূমিকা তাঁরই কর্মকান্ডের সত্যতাই স্বাক্ষ্য দেয়।
বলাবাহুল্য, সেদিন ইংরেজ শাসিত ভারত থেকে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে যদি পাকিস্তানের স্বাধীনতা অর্জন না হত, তবে হয়ত: এদেশের মুসলমানদেরকেও জম্মু কাশ্মীরের মুসলমানদের ভাগ্যই বরণ করতে হত। আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ সেদিনকার বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সুফল।
মোটকথা, আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর কর্মজীবনে ইসলাম ও মুসলিম জাতির জন্য যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা হল- তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের আত্মশুদ্ধিতার নিমিত্তে সূফীধারাকে গ্রহণ করেন আর তাঁদেরকে নবীর প্রেমে উজ্জীবিত করে সুন্নাত অনুসরণে গুরুত্বারোপ করেন। একই সাথে মহানবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র জীবনী, গুণাবলী ও মর্যাদা বর্ণনা সম্বলিত ‘‘মাজমু‘আহ-ই্ সালাওয়াতির রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম গ্রন্থটিসহ অনেক গ্রন্থ রচনা করেন তিনি; যা ছিল মুসলিম সমাজের তাত্ত্বিক নির্দেশনা। তা শিক্ষাদানের জন্য আধুুনিক যুগের প্রচলিত ধারায় নির্মান করেন মাদ্রাসা,মসজিদ ও খান্কাহ; যাতে একই সাথে শরী‘আত-ত্বরীকাতের চর্চা হয়। এ সবের প্রশিক্ষণের জন্য যোগ্য প্রশিক্ষক রূপে গড়ে তুলেন তাঁর খলীফাদের। যাঁরা ছিলেন সুন্নতের পদাঙ্ক অনুসারী ও আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র আর্দশের মূর্তপ্রতীক; আল্লামা সায়্যিদ আহমদ শাহ সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ছিলেন তাঁদের প্রধানতম ও স্বনাম ধন্য খ্যাতনামা একজন মহাপুরুষ। এ কারণে আল্লামা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যে রূপরেখা তৈরী করেছিলেন, তা বাস্তবায়নে তিনি জীবদ্দশাতেই আল্লামা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিকে ‘‘মাজমূ‘আহ্-ই সালাওয়াতির রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’’ ছাপানো ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব অর্পন করেন। পরবর্তীতে আল্লামা সিরিকোটি রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি-ই এ সিলসিলা প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
কাজেই বলা যায়, আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি তাঁর জীবনে পুঙ্খাণুপুঙ্খরূপে রাসূলের আদর্শের বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন ও সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কর্মজীবনের বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই ও সফলতার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র আদর্শই সর্বকালে মুক্তির সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ, এখানেই নিহিত প্রকৃত সুখ,শান্তি ও সমৃদ্ধি। এ স¤র্পকে সম্যক ধারনা লাভের জন্য তাঁর কর্মজীবন স¤র্পকে সম্যক আলোকপাত করা হল।
১.৩.(ক) ত্বরীক্বাতে অর্ন্তভূক্তি
শরী‘আত হল মূল আর ত্বরীকা¡ত হল শরী‘আতের সহায়ক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের উত্তম পন্থা। এ পন্থা মহানবী’র যুগে ও তৎপরবর্তী খোলাফায়ে রাশিদীনের যুগে বায়‘আত গ্রহণের যেরূপ প্রচলন ছিল, তদানুসারে পরবর্তীতে ইসলামের মহামনীষীগনও স্ব স্ব যুগে স্বনামধন্য ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আধ্যাতিœক ব্যক্তিবর্গের নিকট গিয়ে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এ ক্ষেত্রে চার মাযহাবের প্রসিদ্ধ চার ইমামের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। ইমাম আযম আবু হানিফা নূ‘মান বিন ছাবিত ও ইমাম মালিক বিন আনাস রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ছিলেন ইমাম জা‘ফর সাদিক রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মুরিদ আর ইমাম মুহাম্মদ বিন ইদ্রিস শাফি‘য়ী ছিলেন ইমাম মূসা কাযিম রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মুরিদ এবং ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল ছিলেন ইমাম শাফি‘য়ী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র মুরিদ। তাঁরা ছিলেন তাবি‘উন ও তাব‘উ- তাবি‘য়ীন শ্রেণীভূক্ত উত্তম যুগের। আর আধ্যাতিœক চর্চার এ ধারাটি ত্বরীক্বাতরূপে এ যুগেই ব্যাপক প্রকাশ ঘটে। পরে এ ধারাবাহিকতা ক্রমন্বয়ে ত্বরীক্বাতের শায়খগণের নাম ও জন্মস্থান অনুসারে ক্বাদিরীয়া, চিশ্তিয়া ইত্যাদি নামে ইসলামী জগতে প্রকাশ পায়। শায়খের নিকট গিয়ে বায়‘আত গ্রহণ ও ত্বরীক্বাতে অর্ন্তভূক্তির এই রীতির প্রচলন আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র যুগে; এমনকি বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আল্লামা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বেলায় তা ঘটেছে ভিন্নতর রূপে। হযরত আখুন্দ ও হযরত ফজল দ্বীন শাহ্ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র কথা মত এক বছর পর কাশ্মীর হতে হযরত ইয়া‘কুব শাহ গিন্ছাতরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি নিজেই বর্তমান পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের চৌহর গ্রামে আসেন এবং বালক আবদুর রহমান চৌহরভীকে বায়‘আত করান ও ত্বরীক্বাতে অর্ন্তভূক্ত করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল দশ বছর। তাঁর ত্বরীক্বাতে অর্ন্তভূক্তির এই প্রক্রিয়ায় নবধারা সূচিত হয়। এ ধারা অনুসারে তাঁর সিলসিলার পরবর্তী শায়খগণও মুরীদদের এলাকায় এসে বায়‘আত করানোর কার্য পরিচালনা করে আসছেন। তা নিঃসন্দেহে ইসলাম প্রচার-প্রসারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কারণ-
দৈনন্দিন রোজগারে কর্মব্যস্ত মানুষের ত্বরীক্বাত চর্চার প্রতি উদাসীনতা দূর হয় ও ধর্মকর্ম পালনে মনোযোগ সৃষ্টি হয় ।
অসহায়,গরীবদের অতি সহজে হক্কানী কামিল পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয়, ফলে এ শ্রেণীর লোক ধর্মচর্চায় আরো ধাবিত হয় ।
শরী‘আত ও ত্বরীক্বাতের প্রচার-প্রসার ঘটে খুবই দ্রুতভাবে।
ক্রমান্বয়ে ভন্ড পীরদের আয়-রোজগারের ফাঁদ বন্ধ হয় ।
ইসলাম বিরোধী সকল অপশক্তির মূলে কুঠারাঘাত করে এবং ইংরেজ মিশনারির অসৎ উদ্দেশ্য নস্যাৎ হয়।
ইসলামের সঠিক রূপরেখা সম্বন্ধে মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে দাওয়াত সহজে পৌছানো সম্ভবপর হয়।
মুসলমানদের মাঝে নৈতিক উন্নতির মাধ্যমে সমাজে ইসলামী ভাবধারা প্রতিষ্ঠা হয় ।
১.৩.(খ) আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র অনুসৃত পথ ও মত
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ইসলামের সঠিক রূপরেখা “আহলে সুন্নত ওয়াল জমা‘আত’’ এর আক্বীদায় বিশ্বাসী ছিলেন। শরী‘আতের বিধি বিধান পালনে হানাফী মাযহাব এর একনিষ্ট অনুসারী ছিলেন আর ত্বরীক্বাত চর্চায় ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বা র সফল ধারক ও প্রচারক ছিলেন।
১.৩.(গ) খিলাফত লাভ ও বায়‘আত করানোর দায়িত্ব পালন
হযরত মুহাম্মদ ইয়া‘কুব শাহ গিনছাতরী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি কে বায়‘আত করানোর পর পরই বহু তরীকায় খিলাফত প্রদান করেন। একই সাথে উম্মতে মুহাম্মদীকে বায়‘আত করানোর অনুমতিও প্রদান করেন। তা ছাড়া যখন তিনি হযরত গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র রওযা শরীফ যিয়ারতের জন্য সেখানে অবস্থান করেছিলেন তখন তাঁকে রওযা শরীফ থেকে সরাসরি খিলাফত প্রদান করা হয় বলে জানা যায়। এ জন্য তাঁকে “খলীফা-ই-শাহি জিলান’’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র দরবার শরীফের তদানীন্তন সাজ্জাদানশীল হযরত সায়্যিদ মোস্তফা ক্বাদিরী ইবন সায়্যিদ মুহাম্মদ ক্বাদিরী ইবন সায়্যিদ আবদুল আযীয রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি আদিষ্ট হয়ে তাঁকে ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বার ওযীফাসমূহ পাঠ করে শুনান এবং অনুমতি দান করেন। এ শুভক্ষণে তিনি গাউসুল আযম রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র প্রশংসায় তাৎক্ষণিক কবিতা রচনা করে পাঠ করতে থাকেন। তাঁর রচিত কবিতাটি হল:
‘‘ওহে! তুমি যদি আল্লাহর নৈকট্য চাও, তাহলে তুমি দ্বীনের বাদশাহ’র মাযারের অভিমুখী হও; তিনি যুগের সুলতান, দ্বীনের কুতুব, বিশ্বের প্রভূ (আল্লাহ)’র প্রিয়ভাজন; হে আল্লাহ ওয়ালা! যদি তুমি চাও, জযবা ও সদাশয়তা এ দুইটা হোক; তবে (জেনে রাখ) এই পবিত্র রওযা (মাযার) হতেই তোমার নিকট দ্বীনের ফয়েয পৌছবে; তিনি মুহিউদ্দীনও, দ্বীনের সুলতানও, দ্বীনের কুতুবও এবং দ্বীনের গাউসও; তিনিই বিশ্বপ্রভুর প্রিয়ভাজন, রাসূলগণের সর্দারের প্রেমাস্পদ; মোটকথা, তুমি যদি দু’জগতের যা কিছু পেতে চাও, ইলমে হক (হক্কের জ্ঞান), আইনে হক (হকের দর্শন), ওয়াস্লে হক (হক্বের মিলন), হক্বে ইয়াকীন (বাস্তব ইয়াকীন), সবই এখান হতে পাবে’’।
আল্লামা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি যে সকল ত্বরীক্বার খিলাফত ও বায়‘আত করানোর দায়িত্ব লাভ করেন। তা হল- ক্বাদিরীয়া, চিশতিয়া, নক্শবন্দীয়া, সোহরাওয়ার্দীয়া। এ চারটি ত্বরীক্বা মুসলিম বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত বড় ত্বরীকা। এতদসত্ত্বেও তাঁর জীবনে ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বার প্রচার-প্রসারে ব্যপ্তি ঘটে বেশী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-
“ যদিও এ নগন্য (আল্লামা চৌহরভী) চার খান্দান তথা ত্বরীক্বার কার্য প্রয়োগে অনুমতি প্রাপ্ত হই। কিন্তু নিজের অভ্যাস-নীতি হল ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বাই।”
এ ছাড়াও আরো অনেক ত্বরীক্বার খিলাফত ও বায়‘আত করানোর দায়িত্ব লাভ করেন। সে-গুলো এই-
‘ওয়াইসিয়া, জুনাঈদীয়া, রিফাঈয়া, কিবরাভীয়া, আকবরীয়া, শাযরিয়া, বাদুভিয়া, দাসুকিয়া, মাদারিয়া, খালাওয়াতিয়া, ইদ্রীসীয়া ইত্যাদি।’
স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আল্লামা চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বা সফলভাবে ধারণ ও প্রচার করেন। তাঁর প্রচারিত ক্বাদিরীয়া ত্বরীক্বা “সিলসিলায়ে আলীয়া ক্বাদিরীয়া’’ নামে সমধিক পরিচিত। মাত্র দশ বছর বয়সে এতগুলো ত্বরীক্বার খিলাফত লাভ এবং বায়‘আত করানোর মত গুরুদায়িত্ব পালন সত্যই বিরল। অবশ্য তিনি এ ত্বরীক্বাকে ‘ত্বরীক্বা-ই-মাহবুবীয়া’ আখ্যা দেন। তাঁর মতে,
‘‘ইশক্ব আছে তো, সবই আছে। বাকী সব লম্বা কাহিনী’’।
১.৩. (ঘ) সিলসিলায়ে আলীয়া ক্বাদিরীয়ার বৈশিষ্ট্যাবলী
১.৩. ঘ (১) শায়খগণের অসাধারণত্ব¡:
১. তাঁরা স্ব স্ব যুগে গাউসিয়াতের পদে অধিষ্ঠিত ।
২. রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নাত পালনে অভ্যস্ত ও সংসারী।
৩. ত্বরীকা¡ত বা মা‘রিফাত চর্চায় সুন্নাতের পরিপন্থ’ী কার্যকলাপ তাঁদের হতে কল্পনাতীত ব্যাপার।
৪. স্বীয় কামালিয়াত গোপন রাখতে সদা সচেষ্ট থাকেন ।
৫. সহজ-সরল,সাদা-মাঠা জীবন যাপন,সকল কাজ নিজেই করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে পীর-মুরীদের মাঝে কোন তফাৎ নেই।
৬. আল্লাহ ও রাসুলের সম্মানই তাঁদের জীবনের একমাত্র ব্রত।
৭. তাদেঁর নিকট স্থানের দূরত্ব কোন ব্যাপারই নয়; বরং মনের স¤পর্কটাই আসল।
৮. তাঁরা পরশ্রীকাতরতা মুক্ত, নিরহংকারী অথচ বাতুলতার বিপক্ষে দৃঢ় প্রতীজ্ঞাবদ্ধ যেন (اياكم واياهم) নীতিতে অটল।
৯. তাঁেদর মজলিসের প্রভাব এমন যে,পাপাচারের অন্ধকারে নিমজ্জিত ব্যক্তি অনায়সে ঈমানের আলোতে উদ্ভাসিত হয়।
১০.তাঁরা হলেন مستجاب الدعوات অর্থাৎ তাঁদের দু’আ আল্লাহ তা‘আলা সদা কবুল করে থাকেন।
১১. সকল সৃষ্টি তাঁদের হতে উপকৃত হয়।
১.৩.ঘ (২) সিলসিলার বৈশিষ্ট্যসমূহ
১. মাশায়িখ পর¤পরা বাতিল ও কলুষিত ব্যক্তির অনু প্রবেশ মুক্ত।
২. বায়‘আত করানো পদ্ধতি অতি উন্নত ও যথার্থ; সংক্ষিপ্ত অথচ ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য দ্বারা বিগত জীবনের পাপাচার থেকে নিষ্ঠাপূর্ণ তাওবা ও ভবিষ্যৎ জীবনে আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অনুসারে দিনাতিপাত করার দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহন করা।
৩. আক্বীদা বিশুদ্ধ হওয়া শর্ত ।
৪. প্রেম ও আদব মৌলিক উপাদান ।
৫. দুরূদ শরীফের চর্চা অনেক বেশী ।
৬. ওযীফা কম, যুগপোযোগী অথচ ফযীলত বহুবিধ।
৭. এ ত্বরীক্বা অনুসরণে আধ্যাত্মিক উন্নতি হয় ধীরে ধীরে; কিন্তু ত্রুটি-বিচ্যুতি কিম্বা গাফ্লতিতে তৎক্ষণাৎ পরিনাম ভোগ করতে হয় না; বরং সংশোধনের সুযোগ থাকে।
১.৩.ঘ (৩) মুরিদগণের বিশেষত্ব
১. মুরীদগণের চেহারা নূরানী হয়।
২. তাঁরা নবীর প্রেমে সিক্ত ও প্রতিষ্ঠিত হন ।
৩. কোন না কোন ভাবে ধর্ম ও মাযহাবের খিদমতে নিয়োজিত থাকেন ।
৪. আতিথেয়তা ও সেবামুলক কাজে অগ্রগামী হন।
৫. সমাজে সম্মানী এবং প্রভাবশালী হয়ে থাকেন ।
৬. শরী‘আতের বিধান তথা সুন্নাত অনুসরণে অদম্য ¯পৃহা বেশ লক্ষ্য করা যায় ।
৭. পর¯পর দু‘আ করলে, দু‘আ’র উদ্দেশ্য দ্রুত হাসিল হয় ।
৮. আত্মিক উন্নতির সাথে সাথে আর্থিক উন্নতি দস্তুর মতো প্রসিদ্ধই ।
৯. সত্যালাপে নির্ভীক, অকটপট ও উদারচিত্তের অধিকারী ।
১০. (خاتمه بالخير) অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বক্ষণে তাওবা নসীব হয় এবং ঈমান ও প্রশান্তির সাথে ইহকাল ত্যাগ করেন ।
১.৪. শায়খ পরম্পরার তালিকা:
ত্বরীক্বাতপন্থীদের আত্মিক উৎর্কষতা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য তাঁেদর পীর-মাশায়িখের পরম্পরার সম্পৃক্ত থাকা অপরিহার্য। যেমনটি হাদীস বিশারদের নিকট হাদীসের বিশুদ্ধতার জন্য বর্ণনাকারীর পরম্পরার সম্পৃক্ত থাকাটা জরুরী। এ প্রসঙ্গে আল্লামা সায়্যিদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র বাণীটি প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেন:
‘‘হুযুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র সত্তা রূহানিয়াতের কেন্দ্র। যদি বায়‘আতের সিলসিলা ত্বরীক্বাতের শায়খগণের মাধ্যমে তাঁর পর্যন্ত পৌঁছে,তবে ফয়েয তথা বিশেষ দান পাবে; অন্যথায় বিচ্ছিন্ন থাকবে’’।
আল্লামা আবদুর রহমান চৌহরভী রহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি’র প্রচারিত ও প্রসারিত সিলসিলা-ই আলীয়া ক্বাদিরীয়া মূলত হযরত গাউসুল আযম শায়খ আবদুল ক্বাদির জিলানী রাাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র প্রবর্তিত ত্বরীক্বা। এ ত্বরীক্বার শায়খগণের পরম্পরার তালিকা রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত স¤পৃক্ত। মাঝখানে কোন শায়খ বিচ্ছিন্ন নেই এবং ইসলামের সঠিক রূপরেখা ও মূলধারা হতেও বিচ্যুত নন। পরম্পরার এ তালিকাকে হাদীসবেত্তাদের পরিভাষায় সনদ এবং পীর-মাশায়িখের পরিভাষায় শাজরা বলা হয়। নীচে এ ত্বরীক্বার শায়খগণের পরম্পরার তালিকাটি তুলে ধরা হল: