পুণ্যময় শবে বারা‘আত : প্রমাণ ও আমল

0
পুণ্যময় শবে বারা‘আত : প্রমাণ ও আমল
মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম রেযা নঈমী
এটা দিবালোকের ন্যায় সত্য, পৃথিবীতে যেখানেই সিংসভাগ সুন্নী সত্যান্বেষী মহল ইসলামের আলোর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মত মহৎ কাজে ব্যস্ত, ঠিক তার বিপরীতে বাতিলপন্থিরাও থেমে নেই। তারাও পূর্বের ধারাবাহিকাতায় তাদের ভ্রান্ত পূর্বসূরীদের গড্ডালিকা প্রবাহ, নিজেদের অজ্ঞতা ও জ্ঞান পরিমন্ডল বিচরণে নিজেদের অযোগ্যতাকে অতি সূক্ষ¥ভাবে ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র মত শরীয়ত সমর্থিত অনেক বিষয়কে ধামাচাপা দিচ্ছে। তারা ইসলামের ব্যানারে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত বহু বিষয়কে অসার বলে উড়িয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হচ্ছে না। তাই বর্তমান সময়ের দাবি হলো, আমাদের সকলকেই ইসলাম ধর্মের সে সকল বাস্তব বিষয়গুলো অকুণ্ঠ চিত্তে প্রচার ও গ্রহণ করা। পবিত্র শবে বারা’আত হলো সেই সুস্পষ্ট প্রমাণিত বিষয়সমূহের একটি। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এই ধরনের পবিত্র রাতে যেখানে মানুষ আল্লাহ্র ইবাদত ও তাঁর কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করার পরম সুযোগ পাচ্ছে, ঠিক সেখানেই এসে ওই জ্ঞান পাপীরা সরলমনা মুসলমানদের মসজিদ ও ইবাদত বিমুখ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন-
وَ مَنْ أظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسجِدَ اللهِ أنْ يذُكَرَ فِيْهَا اسْمُه ـ
অর্থাৎ ‘তার চেয়ে অধিকতর যালিম কে, যে আল্লাহ্র মসজিদগুলোতে তাঁর নামের চর্চা হওয়া থেকে বাধা প্রদান করে।’ উক্ত আয়াতের আলোকে যারা এ ধরনের পবিত্র রাতে লোকদের ইবাদাতে বাধা দেয় তারাও তিরষ্কারের পাত্র বলে বিবেচিত হবে। আর এটাও চিরসত্য যে, সত্য মিথ্যার লড়াইয়ে সর্বদা সত্যই বিজয়ের মুকুট পরিধান করে। যেমন পবিত্র ক্বোর‘আনে ইরশাদ হচ্ছে-
وَقُلْ جَاءَ الْحَقُّ وَ زَهَقَ الْبَاطِلُ إنّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوْقًا
অর্থাৎ হে রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)! আপনি বলে দিন, সত্যের আগমন হয়েছে এবং অসত্যের মূলৎপাটন হয়েছে। নিশ্চয়ই অসত্য সর্বদা পরাভূত হয়ে থাকে । আর যারাই সর্ববিসর্জন দিয়ে নিজেদের লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে এই সঠিক বিষয়গুলোর প্রচার ও প্রসারে যুগ যুগ ধরে এ ধরনের গুরু দায়িত্ব পালন করে আসছেন, ঐতিহাসিকদের নির্ভরযোগ্য সূত্রে তাদেরকে বলা হয়েছে “ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত”। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই ধরনের জ্ঞানপাপীর সঙ্গ থেকে দূরে সরিয়ে রেখে, ইসলামের সঠিক রূপরেখা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত’র মতাদর্শ অনুসারে নিজেদের পরিচালিত করে তাঁর ও তাঁর প্রিয় রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সন্তুষ্টি অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
শবে বারা’আত পরিচিতি
শবে বারা’আত (شب برأت) যৌগিক শব্দ। শব ফার্সি শব্দ। যার অর্থ রাত। আরবীতে এর প্রতিশব্দ হলো ليلة । আর বারা’আত আরবি শব্দ, অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ, ভাগ্য, মুক্তি ইত্যাদি। সুতরাং শবে বারা’আতকে আরবিতে বলা হয় লাইলাতুল বারা’আত (ليلة البرأة) । যার সমষ্টিগত অর্থ হলো সম্পর্কচ্ছেদের রাত, মুক্তির রাত, ভাগ্য-রজনী ইত্যাদি। ইমাম রাগিব ইস্পাহানী (র.) শব্দটির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন-
أصْلُ الْبَرْأ وَ الْبَرَاءِ وَ التّبَرِّئ اَلتَّغَصِّىْ مِمَّا يُكْرَهُ مُجَاوَرَتُهُ وَ لِذلِكَ قِيْلَ بَرَأتُ مِنَ الْمَرَضِ وَ بَرَأتُ مِنْ فُلَانٍ الخ ـ
অর্থাৎ- برأ , براء ও تبرئ শব্দগুলোর আভিধানিক অর্থ যার সাহচর্য অপছন্দনীয় তার সঙ্গ ত্যাগ করা। যেমন বলা হয়, برأتُ مِنَ المَرَضِ আমি রোগ মুক্ত হলাম, برأتُ مِنْ فُلَانٍ আমি অমুক ব্যক্তির সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করলাম । ‘লাইলাতুল বারা’আত’ নামটি পবিত্র হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র শবে বারা’আত’র পক্ষে প্রমাণ আলোচনায় সে হাদীস খানা উপস্থাপিত হবে ইনশা’আল্লাহ। মূলত উক্ত রাতকে এ কারণে শবে বারা’আত বলা হয়েছে যেহেতু এ রাতে একদিকে যেমন আল্লাহ্র নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাহ্গণ জাগতিক লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত হয়ে যান, অন্যদিকে এ রাতে পাপিষ্ঠ লোকদের সাথে মহান আল্লাহ্র সর্ম্পকচ্ছেদ ঘটে। যেমন সর্বস্তর মুসলিম মনীষী কর্তৃক ‘গাউসুল আযম’ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ক্বাদিরিয়্যাহ তরীক্বাহ্‘র সফল প্রবর্তক নবী বংশধর বড়পীর সাইয়্যিদ মুহিউদ্দিন আবদুল ক্বাদির জিলানী ( রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ) তাঁর রচিত ‘আল-গুনিয়্যাহ্ লিতা¡লিবী ত্বরীকিল হক’¡ (যা পাঠক মহলের কাছে ‘গুনিয়্যাতুত ত্বালিবীন’ নামেই পরিচিত) গ্রন্থে এ বিষয়ে ব্যক্ত করেছেন-
اِنَّمَا سُمِّيَتْ لَيْلَةَ الْبَرَأةِ لِأنَّ فِيْهَا بَرَأتَيْنِ , بَرَأةٌ لِلْاَشْقِيَاءِ مِنَ الرَّحْمنِ وَ بَرَأةٌ لِلْاَوْلِيَاءِ مِنَ الْخَذْلاَنِ ـ
অর্থ এ রাতকে এ জন্যই বারা’আতে’র রাত বলা হয়েছে কেননা এ রাতে দু’ধরনের মুক্তি কিংবা সম্পর্কচ্ছেদ রয়েছে। প্রথমটি হলো এ রাতে পাপিষ্ঠরা সুমহান দয়ালু আল্লাহ তা‘আলা’র দয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে অর্থাৎ তাদের সাথে মহান আল্লাহ্র সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। আর দ্বিতীয়টি হলো, এ রাতে আল্লাহ্’র ওয়ালীগণ পার্থিব লাঞ্ছনামুক্তি লাভ করেন । উল্লেখ্য পবিত্র হাদীস শরীফ ও তাফসীর শাস্ত্রের সূত্রে আমরা জানতে পারি, এ পবিত্র রাতের উল্লিখিত নামগুলোর দ্বারা শা‘বান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকেই বোঝানো হয়েছে। যেমন বিশ^বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ তাফসীরুল জালালায়্ন’র অন্যতম ভাষ্যকার আল্লামা ফক্বীহ আহমদ ইবনে মুহাম্মদ সাভী মালিকী মিসরী (রাহ.) বলেন-
انَّ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنَ شَعْبَانَ لَهَا اَرْبِعةُ اَسْمَاءَ : اَللَّيْلَةُ الْمُبَارَكَةُ ؛ وَ لَيْلَةُ الْبَرَأةِ ؛ وَ لَيْلَةُ الرَّحْمَةِ ؛ وَ لَيْلَةُ الصَّكِّ .
অর্থাৎ শা‘বান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতের (প্রসিদ্ধ) ৪টি নাম রয়েছে, লাইলাতুম মোবারাকাহ (বরকতময় রাত), লাইলাতুল বারা’আত (মুক্তির রাত), লাইলাতুর রহমাহ (অনুকম্পা বর্ষণের রাত) ও লাইলাতুস সাক (চুক্তির রাত) । এর আরেকটি নাম রয়েছে। তা হলো لَيْلَةُ الْقَضَاءِ وَ الحُكْمِ অর্থ বিচার ও সিদ্ধান্তের রাত।
পবিত্র ক্বোর’আনের আলোকে শবে বারা’আত
পবিত্র ক্বোর’আনের আয়াতের পরোক্ষ মর্ম দ্বারা পবিত্র শবে বারা’আত প্রমাণিত। যেমন পবিত্র ক্বোর’আন মজিদে মহান আল্লাহ্ ইরশাদ করেন-
اِنَّا اَنْزَلْنهُ فِىْ لَيْلَةِ مُبَارَكَةٍ ـ اِنَّا كُنَّا مُنْذِرِيْنَ ـ فِيْهَا يُفْرَقُ كُلُّ أمْرٍ حَكِيْمٍ ـ
অর্থাৎ আমি এই সুস্পষ্ট কিতাব তথা ক্বোর’আন মজীদকে বরকতময় রজনীতে নাযিল করেছি। নিঃসন্দেহে আমি ভীতি প্রদর্শনকারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। হযরত আবূ হোরায়্রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ইকরামাহ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ‘আত্বা ইবনে ইয়াসার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু, হযরত ওসমান ইবনে মুগীরাহ ইবনে আখনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সহ একদল হাদীস বর্ণনাকারীর মতে উক্ত আয়াতে বর্ণিত লাইলাতুম মোবারাকাহ্ দ্বারা শা‘বান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে বোঝানো হয়েছে। যেমন فيها يفرق كل أمر حكيم – উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম দায়লামী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত আবূ হোরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র সূত্রে এবং হযরত ইবনে জারীর রাহমাতুল্লাহি আলায়হি হযরত ওসমান ইবনে মুগীরা ইবনে আখনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু সূত্রে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম)’র একটি হাদীস বর্ণনা করেন হাদীসটি হলো-
اِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قاَلَ تُقْطَعُ الآجَالُ مِنْ شَعْبَانَ اِلى شَعْبَانَ حَتى اَن الرَّجُلَ لَيَنْكِحُ وَ يُوْلَدُ لَهُ وَ قَدْ خَرَجَ اسْمُه فِىْ المَوْتى ـ
অর্থাৎ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন- এক শা‘বান থেকে অন্য শা‘বান পর্যন্ত মানুষের আয়ুষ্কাল চূড়ান্ত করা হয়, এমনকি তাদের মাঝে এমনও ব্যক্তি রয়েছে যে বিবাহ করলো এবং তার সন্তানও ভূমিষ্ট হলো অথচ তার নাম মৃতদের তালিকায় উঠে গেল।
পবিত্র হাদীসের আলোকে শবে বারা’আত
অসংখ্য হাদীস দ্বারা পবিত্র শবে বারা’আত প্রমাণিত। তন্মধ্যে কয়েকটি নি¤œরূপ-
ক. হযরত আ’ইশাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন-
فَقَدتُّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَاِذَا هُوَ بِالبَقِيْعِ فَقَالَ اَكُنْتَ تَخَافِيْنَ أنْ يَحِيْفَ اللهُ عَلَيْكَ وَ رَسُوْلُه ـ قُلْتُ يَا رَسُوْل اللهِ اِنِّىْ ظَنَنْتُ اَنَّكَ اَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ ـ فَقَالَ اِنًّ اللهَ تَعَالى يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ اِلى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِر لِاَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِغَنَمِ كَلبٍـ
অর্থাৎ : এক রাতে আমি রসূল-এ করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে হারিয়ে ফেললাম ( অর্থাৎ মধ্যরাতে আমি তাঁকে বিছানায় পেলাম না)। এরপর আমি ঘর থেকে বের হলাম, হঠাৎ করে আমি তাঁকে জান্নাতুল বাক্বী’তে দেখতে পেলাম। তিনি আমাকে দেখে বললেন, তুমি কি এই আশংকা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূল ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমার উপর যুলুম করেছেন ? আমি বললাম হে আল্লাহ্র রসূল! আমি মনে করলাম আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। অতঃপর নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) বললেন, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা‘আলা অর্ধ শা‘বানের (শা‘বানের ১৪ তারিখের) রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন অর্থাৎ তাঁর অসীম করুণা ও মাগফিরাত অবতীর্ণ হয়। এরপর (আরবের একটি সম্প্রদায়) কলব জনগোষ্ঠীর ছাগলের পশমের চেয়েও বেশী সংখ্যক লোককে (এ রাতে) ক্ষমা করেন। (সুবহানাল্লাহ)।
উল্লেখ্য, উক্ত হাদীস দ্বারা শবে বারা‘আতে ক্ববর যিয়ারত সুন্নত হওয়াটাও প্রমাণিত হলো।
খ. হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু হতে বর্ণিত-
قَالَ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اِذَا كَانَتْ لَيْلَةُ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَقُوْمُوْا لَيْلَهَا وَ صُوْمُوْا نَهَارَهَا فَاِنَّ اللهَ يَنْزِلُ فِيْهَا لِغُرُوْبِ الشَّمْسَ اِلى سَمَاءِ الدُّنْيَا فَيَقُوْلُ اَلاَ مِنْ مُسْتَغْفِرٍلِىْ فَاَغْفِرَ لَه اَلاَ مُسْتَرْزِقٍ فَاَرْزُقَه اَلاَ مُبْتَلًى فَاُعَافِيَه اَلاَ كَذَا اَلاَ كَذَا حَتى مَطْلَعِ الْفَجْرِ
অর্থাৎ – রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, যখন শা‘বানের ১৪ তারিখের দিবাগত রাত আসবে তখন তোমরা সে রাতে ইবাদতের জন্যে দাঁড়িয়ে যাবে এবং দিনের বেলায় (পরের দিন) রোযা রাখবে। কেননা আল্লাহ্ তা‘আলা এ রাতের সূর্যাস্তের সাথে সাথে পৃথিবীর আকাশে অবতরণ করেন (তাঁর অসীম করুণা ও মাগফিরাত অবতীর্ণ হয় ) এবং ঘোষণা করেন, ক্ষমা চাওয়ার কেউ আছে কি ? (সে ক্ষমা চাইলে আজ রাত) আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। রিযিক চাওয়ার কেউ আছে কি ? (যদি সে রিযিক চায় তবে আজ রাত) আমি তাকে রিযিক দেব। বিপদগ্রস্ত কেউ আছে কি? (যদি সে বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে আমার কাছে অনুনয়-বিনয় করে তবে আজ রাত) আমি তাকে বিপদ থেকে মুক্তি দেব। আর এভাবেই ফযর উদিত হওয়া পর্যন্ত মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কেউ আছে কি? কেউ আছে কি? বলে ঘোষণা আসতে থাকবে। (সুবহানাল্লাহ)
গ. হযরত আবূ মুসা আশ‘আরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) হতে বর্ণনা করেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহ ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন-
اِنَّ اللهَ تَعَالى لَيَطْلُعُ فِىْ لِيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيْعِ خَلْقِهِ اِلاَّ لِمُشْرِكٍ اَوْ مُشَاحِنٍ
অর্থ : নিশ্চয় শা‘বান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ্র অসীম রহমত ও অনুকম্পা সৃষ্টির মাঝে আতœপ্রকাশ করে এবং তিনি মুশরিক তথা কাফির ও চরম হিংসুক ব্যতীত সকল সৃষ্টিকে ক্ষমা করে দেন। (অর্থাৎ যতক্ষণ না এই দু‘শ্রেণির লোক উক্ত অপরাধ থেকে তাওবা না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এ রাতে যতই প্রার্থনা করুক না কেন তাদের আবেদন আল্লাহ্র দরবারে গৃহীত হবে না এবং তাঁর নিকট ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না )। (না‘উযুবিল্লাহ)।
ঘ. শায়খ আব্দুর রহমান ছাফূরী (রাহ.) বর্ণনা করেছেন-
ذُكِرَ فِي الإقْنَاعِ أنَّ جِبْرِيْلَ نَزَلَ عَلى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةَ الْبَرَاءةِ وَ قَالَ يَا مُحمَّدُ اِجْتَهِدْ فِى هَذِه اللَّيْلَةِ ـ فَيْهَا تُقْضَى الحَاجَةُ الخ ـ
অর্থ ‘ইক্বনা‘ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে একদা হযরত জিবরাঈল (আ.) লাইলাতুল বারা’আত তথা শবে বারা’আতে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র নিকট আগমন করেন এবং আরয করেন- হে মুহাম্মদ ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এই রাত্রিতে আপনি (ইবাদত-বান্দেগীতে) লিপ্ত থাকেন। এ রাত্রিতে (ব্যক্তির) কামনা-বাসনা পূরণ হবে…।
ঙ. বিখ্যাত তাবি’ঈ হযরত ‘আত্বা ইবনে ইয়াসার রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন-
مَا بَعْدَ لَيْلَةِ الْقَدْرِ أفْضَل مِنْ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ ـ وَ هِىَ مِنَ اللَّيَالِى الَّتِى يُسْتَجَابُ فِيْهَا الدُّعَاءُ ـ
অর্থ : লাইলাতুল ক্বদর’র পর অর্ধ শা‘বান’র রাত্রির চেয়ে উত্তম কোনো রাত নেই। আর এ রাত ঐ সকল রাতসমূহের একটি যে রাতে দে‘আ ক্ববূল হয়।
শবে বারা‘আতের কতিপয় ইবাদত ও আমল
এ রাতের সূর্যাস্তের পূর্বে গোসল করবার মাধ্যমে ইবাদত শুরু করাটা উত্তম। নি¤েœ এ রাতের কতিপয় ইবাদত ও আমল উল্লেখ করা হলো-
১. বেশী বেশী নফল নামায আদায় করা : এ রাতে যে যত বেশী নফল নামায পড়বে ততবেশী সওয়াব লাভ করবে। তবে কমপক্ষে বার রাকা‘আত পড়া উত্তম। যেমন ইমাম আবদুর রহমান ইবনে আবদুস সালাম ছাফুরী (র.) তাঁর রচিত ‘নুযহাতুল মাজালিস’ গ্রন্থে নবী (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সূত্রে এই মর্মের একটি হাদীস বর্ণনা করেন, নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন-
مَنْ صَلّٰى لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَان اِثْنَتَيْ عَشَرَةَ رَكْعَةً يَقْرَأ فِيْ كُلٍّ رَكْعَةٍ و قُلْ هُوَ اللهُ اَحَد احْدٰى عَشَرَةَ مَرَّةً مُحِيَتْ عَنْهُ سَيِّاٰتُهُ بَارك له فِيْ عُمْرِهِ
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি অর্ধ শা‘বান’র রাত্রিতে বারো রাক‘আত নামায আদায় করবে এবং প্রত্যেক রাক‘আতে সূরাহ ফাতিহা ও এগারো বার সূরাহ ইখলাছ তিলাওয়াত করবে তবে তার সমস্ত গোনাহ্ ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তার আয়ুষ্কালে বরকত দান করবেন।
২. পবিত্র ক্বোর’আন তিলাওয়াত করা : এ রাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো পবিত্র ক্বোর’আন তেলাওয়াত করা। যেহেতু পবিত্র ক্বোর’আনের আয়াতের পরোক্ষ মর্ম ও তাফসীরের বর্ণনা মতে এ রাতে সপ্ত আকাশ থেকে পৃথিবীর আকাশে পবিত্র ক্বোর’আন নাযিল হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। মূলত পবিত্র ক্বোর’আন নাযিল হওয়ার কারণে এ রাতের এতো মর্যাদা।
৩. মহান আল্লাহ্র যিকির ও নবী (দ.)‘র উপর দুরূদ পাঠ করা : এ রাতে মহান আল্লাহ্র যিকিরের পাশাপাশি অন্যান্য তাসবীহ ও তাহলীল পাঠ করা অতি পূণ্যময় একটি কাজ। আর এ রাতের আরেকটি বরকতময় কাজ হলো নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র উপর বেশী বেশী দুরূদ শরীফ পাঠ করা। কারণ আমাদের দো‘আ ক্ববূল হওয়ার বড় মাধ্যমই হলো নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র উপর দুরূদ শরীফ পাঠ করা। যেমন হযরত ‘উমার ফারূক্বে আযম (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন-
إنَّ الدُّعَاءَ مَوْقُوْفٌ بَيْنَ السَّمَاءِ وَ الأرْضِ لَا يَصْعَدُ مِنْهَا شَيْئٌ حَتّٰى تُصَلِّىَ عَلٰي نَبِيِّكَ ـ رَوَاه التِّرِمِذِىُّ
অর্থ : নিশ্চয়ই (তোমার) দো‘আ আকাশ ও যমীনের মাঝে ঝুলন্ত থাকবে, এর কোনো কিছুই ঊর্ধ্ব জগতে পৌঁছে না যতক্ষণ না তুমি তোমার নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র উপর দুরূদ পাঠ করবে। উক্ত হাদীস ইমাম তিরমিযী (রাহ.) বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ দুরূদ শরীফ বান্দাহ্র দো‘আ ক্ববূল হওয়ার অন্যতম ওয়াসীলাহ।
৪. ক্ববর যিয়ারত করা : এ রাতের আরেকটি আমল হলো, শরীয়ত সম্মত পন্থায় মা, বাবা নিকটাত্মীয়-স্বজন ও আল্লাহ্ তা‘আলার নৈকট্যপ্রাপ্ত বান্দাহ্গণের ক্ববর যিয়ারত করা।
৫. দান-দক্ষিণা করা : এ রাতের আরেকটি আমল হলো গরীব-মিসকিনদের সাধ্যানুসারে দান-দক্ষিণা করা। কেননা পবিত্র হাদীসে এসেছে, দান-সদক্বা বিপদাপদ দূরীভূত করে।
৬. হাদিয়া আদান-প্রদান করা : পাড়া-পড়শী ও নিকটাত্মীয়দের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ মনোভাব বজায় রাখতে বিভিন্ন হাদিয়া আদান প্রদান করা যেতে পারে। যেমন হযরত আবূ হোরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন تَهَادَوْا تَحَابُّوْا অর্থ : তোমরা একে অপরকে হাদিয়া দাও, এর মাধ্যমে তোমরা পারস্পরিক ভালোবাসা-সম্প্রীতি বজায় রাখো । আর ভালোবাসা বৃদ্ধি পেলে এ রাতে এক ভাইয়ের জন্যে অন্য ভাইয়ের আন্তরিক দো‘আ অবশ্যই আল্লাহ্র দরবারে ক্ববূল হবে ইনশাআল্লাহ। তবে আমাদের একটা বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, এ ধরনের কাজ যেন আমাদের ইবাদতের অন্তরায় না হয়। কারণ এ রাতে ইবাদাতই হলো মুখ্য বিষয়।
৭. তাওবা করা : এ রাতে প্রত্যেকেই পূর্বের যাবতীয় ছোট-বড় গুনাহের কথা স্মরণ করে সেগুলো থেকে একাগ্রচিত্তে মহান আল্লাহ্র দরবারে তাওবা করবে। নিজের জন্য দো‘আ করবার পাশাপাশি বিশে^র সকল সুন্নী মুসলিমের জন্য দো‘আ করবে।
৮. রোযা রাখা : পবিত্র হাদীসে এসেছে, নবী করীম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রমযান ব্যতীত অন্যান্য মাসের তুলনায় শা‘বান মাসে বেশী বেশী রোযা রাখতেন। পাশাপাশি উম্মতের জন্য নবী ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র নসীহত হলো শবে বারা‘আতের পরের দিন রোযা রাখা। আর এ রোযা রাখা উত্তম। রাখলে অধিক পূণ্যের অধিকারী হবে। উল্লেখ্য ৮ শ্রেণীর ব্যক্তি এ রাতে ক্ষমা প্রাপ্তির অযোগ্য হবে। তারা হলো – ১. মুশরিক তথা কাফির। ২. যাদুকর। ৩. ব্যভিচারী। ৪. মাদক সেবনে অভ্যস্ত। ৫. মাতা-পিতার অবাধ্য। ৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী। ৭. গণক। ৮. চরম হিংসুক। আর যদি তারা উক্ত মারাত্মক গুনাহ থেকে দৃঢ়তার সহিত তাওবা করে তবে এ রাতে ক্ষমা প্রাপ্ত হবে ইনশাআল্লাহ।
মহান আল্লাহ্ শবে বারা‘আতের তাৎপর্য ও গুরুত্ব বুঝে আমল করার তাওফিক দান করুন- আ-মী-ন।

লেখক: আরবী প্রভাষক, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ্মহিলা মাদরাসা, চট্টগ্রাম

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •