ক্ষমা ও উদারতার প্রতীক মহানবী
কুতুবউদ্দিন চৌধুরী
ক্ষমা একটি মহৎ গুণ। এটি একটি প্রবাদবাক্য হলেও চিরন্তন ও চির সত্যরূপে স্বীকৃত। বর্তমান যুগে এ বাক্যটি পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সীমাবদ্ধ। বাস্তবে এর কোন প্রতিফলন কোথাও পরিলক্ষিত হয় না বরং প্রতিশোধ প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হীন প্রবৃত্তি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এ রকম শ্বাসরূদ্ধকর পরিস্থিতিতে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় প্রায় পনের শত বছর পূর্বে এ দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত সৃষ্টির সেরা এক মহামানবের কথা, যাঁর আগমনে জাহিলিয়্যাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত পাশবিকতায় পদদলিত মানবতা শান্তির অমীয় ফল্গুধারায় সিক্ত হয়েছিল। তিনি হলেন আখেরী নবী সৈয়্যদুল মুরসালিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম। এমন এক ভয়াবহ পরিবেশে আল্লাহ পাক হেদায়তের উজ্জ্বল প্রদীপরূপে হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে ‘রহমাতুল্লিল আলামিন’রূপে এ দুনিয়ার বুকে প্রেরণ করেন। তাঁর আচার আচরণে তৎকালীন মুশরিক পৌত্তলিক মক্কাবাসীরা তাঁকে ‘আল আমিন’ উপাধীতে ভূষিত করে। যখন দ্বীনের দাওয়াত শুরু করেন তখন মক্কার গোত্রপতি ও সর্দারেরা তাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত বিবেচনা করে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাঁর প্রচারিত তৌহিদ ও রিসালতের দাওয়াত চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য এমন কোন পন্থা নেই, যা তারা অবলম্বন করেনি। তারা নানারকম কূটকৌশল, ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে নবীজিকে বশীভূত করতে না পেরে প্রকাশ্যে তাঁর উপর জুলুম নির্যাতন শুরু করে দেয়। ইসলামের চরম শত্রু আবু জেহেলের নির্দেশে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম কাবার অভ্যন্তরে নামাজরত অবস্থায় তাঁর শরীরের উপর তারা একদিন উঠের পঁচা নাড়ীভূড়ি তুলে দিয়েছিল। গলায় চাদর পেঁচিয়ে ফাঁসী দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছিল, যাতে তিনি কাঁটাবিদ্ধ হয়ে আহত হন। তাঁকে দাওয়াত দিয়ে খাদ্যের সাথে বিষ মিশিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সবচেয়ে জঘন্য ও নির্মম আচরণ করেছিল তায়েফবাসীরা। কালিমার দাওয়াত নিয়ে তিনি তায়েফ গেলে সেখানকার সর্দাররা গুন্ডা ও বখাটে ছেলেদেরকে তাঁর পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিল। তারা চলার পথে তাঁর দু’দিক থেকে পাথর নিক্ষেপ করে তাঁকে রক্তাক্ত করেছিল। ক্লান্ত ও আহত হয়ে তিনি যখন বসে পড়ছিলেন তখন তারা হাত ধরে তাঁকে উঠিয়ে দিয়ে বারবার পাথর নিক্ষেপ করে সমস্ত শরীর ক্ষত বিক্ষত করেছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের এ করুণ দশা দেখে আল্লাহ্পাকের নির্দেশে জিব্রাঈল আলায়হিস্ সালাম পাহাড়ের দায়িত্বে নিয়োজিত ফেরেশতাদের নিয়ে হাজির হন। ওইসব নরাধম পাপিষ্ঠদের ধৃষ্ঠতার জন্য তায়েফের দু’পাশের পাহাড়ের মধ্যখানে তাদের পিষে ফেলার জন্য দয়াল নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর অনুমতি চাইলে তিনি দু’হাত তুলে বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ্, তায়েফবাসীকে তুমি হেদায়ত করো, কেননা এরা জানেনা, আমি আল্লাহর সৃষ্টিজগতের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে করুণার উপহার’। শত্রুদের শায়েস্তা করার জন্য সব উপায় উপকরণ তাঁর আয়ত্বে ছিল। যেভাবে ইচ্ছা তিনি শত্রুর উপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন; কিন্তু তাঁর বিশ্বাস ছিল এরা হেদায়ত কবুল না করলেও এদের পরবর্তী প্রজন্ম ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করবে।
৮ম হিজরীতে (৬৩০ খ্রিস্টাব্দে) প্রায় দশ হাজার সশস্ত্র বিশাল মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম বিজয়ীর বেশে মক্কায় পদার্পণ করেন। নবীজির এ বাহিনীকে সেদিন বাধা দেয়ার জন্য কেউ সাহস পায়নি। মক্কার দিকে অগ্রসরমান মুসলিম বাহিনীর হাতে কুরাইশ সর্দার আবু সুফিয়ান বন্দী হয়। চিরশত্রুকে কাছে পেয়েও দয়ার সাগর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকে ক্ষমা করে দেন। হযরত আবু সুফিয়ান লজ্জিত ও মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করে সাহাবাগণের কাতারে শামিল হয়ে গেলেন। মক্কা বিজিত হারেম শরীফের প্রাঙ্গণে কুরাইশ সর্দাররা দলবলসহ তাদের কৃত অপরাধ ও ধৃষ্ঠতার স্মৃতি নিয়ে পরাজিত ও পর্যুদস্ত অবস্থায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মুখে জড়ো হল। সমবেতদের মধ্যে ওইসব লোকেরাও ছিল যারা হুযূর-এ পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের যাতায়তের পথে তাঁকে গালিগালাজ, কটুক্তি ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করত, যারা তাঁকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার জন্য প্রচারণা চালাত। যারা তাঁর চলার পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখত, যারা তাঁকে হত্যা করার জন্য গোপনে ষড়যন্ত্র করত, দাওয়াতের নামে খাদ্যে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করত, যারা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর প্রিয় চাচা, ইসলামের বীর যোদ্ধা হযরত হামযা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে যুদ্ধের ময়দানে শহীদ করেছিল, তাঁর নাক, কান কেটে গলার হার বানিয়েছিল, তাঁর রাশ ছিঁড়ে হৃদপিন্ড ও কলিজা দাত দিয়ে চিবিয়েছিল। ওইসব অপরাধীর পেছনে উন্মুক্ত তরবারি হাতে দশ হাজার মুজাহিদ হুযূরে পাক সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের হুকুমের অপেক্ষায় ছিল। প্রিয়নবীজির ইশারা পাওয়া মাত্র তরবারির আঘাতে শত্রুর মস্তক ভূলুণ্ঠিত হয়ে মক্কার পথে প্রান্তরে রক্তের বন্যা বয়ে যেত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম সমবেতদের উপর একবার চোখ বুলালেন। দয়াল নবীর হৃদয় সাগরে তখন ক্ষমা, উদারতা ও করুণার উত্তাল তরঙ্গ বয়ে উঠল। অতঃপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘হে কুরাইশগণ! বলো, তোমাদের সাথে আজ কেমন ব্যবহার করা উচিৎ।’ উপস্থিত লোকেরা বলল, ‘মুহাম্মদ, তুমি আমাদের শরীফ ভাই ও শরীফ ভাতিজা।’ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রতি এসব লোকের কৃত প্রতিটি অপরাধ যেকোন আইনে যদিও তাদের মৃত্যুদন্ড দাবী করছিল, ক্ষমা, উদারতা ও করুণার মূর্ত প্রতীক নবীজী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করলেন, ‘‘আজকের দিন তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। যাও, তোমরা সবাই মুক্ত। সেদিনের কাবা প্রাঙ্গনের পরিবেশ যদি আমাদের দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থার অনুরূপ হত তাহলে প্রতিশোধের চরম ও নৃশংস বহিঃপ্রকাশরূপে একটা ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হওয়া অবধারিত ছিল। অথচ সেখানে এক বিন্দু রক্তপাতবিহীন অভূতপূর্ব বিজয় অর্জিত হল যা পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে এ যাবৎ জগতবাসী প্রত্যক্ষ করেনি। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামের ক্ষমা, করুণা ও উদারতার মহান আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা কি অন্ততঃ আমাদের ভূখন্ডে শান্তির সুবাতাস বইয়ে েিত পারিনা?
লেখক: বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক