মুসলিম বিবাহ: প্রচলিত রীতি-নীতি ও শরয়ী বিধান

0
মুসলিম বিবাহ: প্রচলিত রীতি-নীতি ও শরয়ী বিধান
মুহাম্মদ আবদুল্লাহ্ আল মাসুম
দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনাপর্ব হলো বিয়ে, যা আদর্শ পরিবার গঠন, মানুষের জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং মানসিক প্রশান্তি লাভের প্রধান উপকরণ। এটা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক ইবাদত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নতও বটে। এতে রয়েছে প্রভুত কল্যাণ ও উপকারিতা। বিয়ের বিবিধ কল্যাণের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ তায়ালা তাই ইরশাদ করেন,
وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُون
অর্থাৎ ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে সে কওমের জন্য, যারা চিন্তা করে।’ অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে – ‘তোমরা বিবাহযোগ্যদের বিবাহ সম্পন্ন করো, তারা অভাবগ্রস্থ হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছলতা দান করবেন; আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞানী।’
মূলত বিবাহ তখনই সুফল বয়ে আনবে, যখন তা হবে আল্লাহ্ ও রাসূলের নির্দেশিত পন্থার আলোকে যেখানে থাকবে না পশ্চিমাদের কোনো কৃষ্টি-কালচার। অথচ অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে- আজ ইহুদী-খৃষ্টানদের বিয়ের প্রথা গুলো আমাদের মুসলিম সমাজে এতটাই ছেয়ে গেছে যে, সমাজের লোকের নিকট তা খুবই পছন্দনীয় এবং তা দাম্ভিকতার সাথে পালন করছে; যা আদর্শ মুসলিমের জন্য শোভা পায় না। ফলে আজ মানুষ বিয়ে করে থাকে ঠিকই, কিন্তু এর ভেতর থাকেনা কুরআন-হাদিসের বর্ণিত বরকত। থাকেনা সংসারে প্রশান্তি। বর্তমান বিয়ে অনুষ্ঠান দেখলে প্রথমে ভুল মনে হবে, এটা কি বিয়ের অনুষ্ঠান না নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার স্থান। নববধু ও বরের সাথে অবিরাম ছবি তুলছে আগত কিছু লোক। শরীয়ত নির্দেশিত পর্দার কোন নিয়ম মানা হয় না। এ এক নির্লজ্জ বেহায়াপনার আরেক নাম। যেন একদল যুবক খেয়াল খুশী মতো আনন্দ ফুর্তিতে মেতে উঠার নাম আলোচ্য নিবন্ধে এ বিষয়ে আলোকপাত করার প্রয়াস পেলাম।
বিয়ে করা যুবক-যুবতীদের জন্য ক্ষেত্র ভেদে ফরজ আবার কখনো সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বিবাহ করেছেন এবং এর প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলেছেন,
أَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي.
অর্থাৎ ‘আমি নারীকে বিবাহ করি। (তাই বিবাহ আমার সুন্নত) অতএব যে (বিয়ে করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও) আমার সুন্নত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’
কারো কারো ক্ষেত্রে বিবাহ করা ওয়াজিব হয়ে পড়ে। যেমন : যদি কেউ বিবাহ না করলে হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা করে, ভরণ পোষনে সামর্থও রাখে তখন নিজেকে পবিত্র রাখতে এবং হারাম কাজ থেকে বাঁচতে বিয়ে করা ওয়াজিব হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
يَا مَعْشَرَالشَّبَابِ مَنِ اسْتَطَاعَ الْبَاءَةَ فَلْيَتَزَوَّجْ فَإِنَّهُأَ غَضُّ لِلْبَصَرِ وَ أَحْصَنُ لِلْفَرْجِ، وَمَنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَعَلَيْهِ بِالصَّوْمِ فَإِنَّهُ لَهُ وِجَاء.
অর্থাৎ ‘হে যুব সম্প্রদায়, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে সে যেন বিয়ে করে। কেননা তা চক্ষুকে অবনত করে এবং লজ্জাস্থানকে হেফাযত করে। আর যে এর সামর্থ্য রাখে না, তার কর্তব্য রোযা রাখা। কেননা তা যৌন উত্তেজনার প্রশমন ঘটায়।’
ইমাম রাগিব ইস্পাহানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, বিয়েকে দুর্গ বলা হয়েছে, কেননা (বিয়ে) স্বামী-স্ত্রী উভয়কে সকল প্রকার লজ্জাজনক কাজ থেকে দুর্গবাসীদের মতো বাঁচিয়ে রাখে।
তবে এই পবিত্র কর্ম পালন করতে গিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কু-প্রথা মানা হয় যা অনুচিত।
বিবাহে প্রচলিত কু-প্রথা
১. বিশেষ কোন মাসে বা যে কোন দিনে বিয়ে করা যাবে না মনে করা: চন্দ্র বর্ষের কোন মাসে বা কোন দিনে অথবা বর/কনের জন্ম তারিখে বা তাদের পূর্ব পুরুষের মৃত্যুর তারিখে বিবাহ শাদী হতে বিরত থাকার ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তে কোন বিধি নিষেধ নেই। বরং বিশেষ কোন মাসে বা যে কোন দিনে বিয়ে করা যাবে না মনে করাই গুনাহ।
২. আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য।
৩. আতশবাজি, রং বাজী: বিবাহ উৎসবে পটকা-আতশবাজি ফুটান, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, রং বাজী করা বা রঙ দেওয়ার ছড়াছড়ি ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ।
৪. চন্দন-হলুদ..মাখা : আমাদের সমাজে কোথাও বিবাহ-শাদীতে বাঁশের কুলায় চন্দন,মেহদি, হলুদ, কিছু ধান-দূর্বা ঘাস কিছু কলা, সিঁদুর ও মাটির চাটি নেওয়া হয়। মাটির চাটিতে তেল নিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। স্ত্রী ও বরের কপালে তিনবার হলুদ লাগায় এমনকি মূর্তিপূজার ন্যায় কুলাতে রাখা আগুন জ্বালানো চাটি বর-কনের মুখের সামনে ধরা হয় ও আগুনের ধুঁয়া ও কুলা হেলিয়ে-দুলিয়ে বাতাস দেওয়া হয়। এসব হিন্দুয়ানী প্রথা ও অনৈসলামিক কাজ বর্জন করা অত্যাবশ্যক। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, من تشبه بقوم فہو منہم۔
অর্থাৎ যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে তথা সংস্কৃতির অনুসরণ করবে, সে তাদেরই বলে গণ্য হবে।
৫. কনেকে কোলে তোলে আনা: বরের কিংবা কনের আত্মীয় কনেকে কোলে তুলে বাসর ঘর বা গাড়ী পর্যন্ত পৌছে দেওয়া অথবা বরের কোলে করে মুরুব্বীদের সামনে স্ত্রীর বাসর ঘরে গমনের নীতি একটি বেহায়াপনা, নির্লজ্জ ও অনৈসলামিক কাজ।
৬. বরের ভাবী ও অন্য যুবতী মেয়েরা বরকে সমস্ত শরীরে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে দেওয়া নির্লজ্জ কাজ যা ইসলাম সমর্থন করে না। বর ও কনেকে হলুদ বা গোসল করতে নিয়ে যাওয়ার সময় মাথার উপর বড় চাদর এর চার কোনা চার জনের ধরা এবং গোসলের জন্য যুবতীরা সাত পুকুরের পানি তুলে আনা হিন্দুয়ানী প্রথা।
৭. বিবাহ করতে যাওয়ার সময় বরকে পিড়িতে বসিয়ে বা সিল-পাটাই দাড় করিয়ে দই-ভাত খাওয়ানো ইসলামিক প্রথা নয়।
৮. শর্ত আরোপ করে বর যাত্রীর নামে বরের সাথে অধিক সংখ্যাক লোকজন নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়ীতে মেহমান হয়ে কনের পিতার উপর বোঝা সৃষ্টি করা আজকের সমাজের একটি জঘন্য কু-প্রথা, যা সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাগ করা আবশ্যক।
৯. পুরুষ দাড়ি মুন্ডন করা : আল্লাহর রাসূলের নির্দেশ অমান্য করে বিয়ে উপলক্ষে দাড়ি মুন্ডানো তো এখন অনেকের কাছেই অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দাড়ি না কামিয়ে বিয়েতে যাওয়াকে অনেকে দোষের মনে করেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
خَالِفُوا الْمُشْرِكِين َوَفِّرُوا اللِّحَى وَأَحْفُوا الشَّوَارِبَ
অর্থাৎ ‘তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো : দাড়ি বড় করো এবং গোঁফ ছোট করো।’ হাদীসে দাড়ি রাখতে সুস্পষ্ট নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় দাড়ি রাখা ওয়াজিব। কোনো অজুহাত দাঁড় করিয়ে দাড়ি কাটার অবকাশ নেই।
১০. বিয়েতে নারীদের বর্জনীয় কাজসমূহ
ক. ভ্রু উপড়ানো: ভ্রু উপড়ানো বা পাতলা করা এমন একটি কাজ, যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হারাম করেছেন এবং এ কাজ করা ব্যক্তির ওপর অভিশাপ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন সেসব মহিলার ওপর যারা সৌন্দর্যের জন্য উল্কি অঙ্কন করে ও করায়, ভ্রু উৎপাটন করে ও করায় এবং দাঁত ফাঁকা করে।’
খ. চুল কাটা : চুল কাটার তিনটি ধরন রয়েছে : পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে চুল কাটা। এটি হারাম এবং কবীরা গুনাহ। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারীদের অভিসম্পাত করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিন ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদের দিকে তাকাবেন না : পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান, পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বনকারী নারী এবং ব্যভিচারের দূত।’
যদি চুল ছোট করা হয় এমনভাবে যে, তাতে পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ হয় না তবে ইমাম আহমদ রহমাতুল্লাহি আলাইহির মতে তা মাকরূহ। যদি অমুসলিম রমণীদের অনুকরণে চুল ছোট করা হয়, তবে তা হারাম। কেননা , রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’
গ. অশ্লীল কিংবা প্রসিদ্ধি ও অহংকারের পোশাক পরা : অতি টাইট, পাতলা ও গোপন সৌন্দর্যকে প্রস্ফূটিত করে এমন পোশাক পরা। বক্ষ, বাহু ও কটি (কোমর) ইত্যাদি দৃশ্যমান হয় এমন দৃষ্টিকটু পোশাক পরে অহংকার দেখানো এবং পর পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুই শ্রেণীর জাহান্নামী লোক যাদের আমি এখনো দেখিনি। (তবে তারা অচিরেই সমাজে দেখা দেবে) এক. সন্ত্রাসী দল, তাদের সাথে গরুর লেজ সদৃশ চাবুক থাকবে। তারা এর দ্বারা লোকজনকে আঘাত করবে। দুই. এমন নারী যারা (পাতলা ফিনফিনে কাপড়) পরিহিতা অথচ উলঙ্গ, অপরকে আকর্ষণকারিণী আবার নিজেরাও অপরের দিকে আকৃষ্ট। তাদের মস্তকগুলো হবে বুখতি উটের হেলানো কুজের মতো। এরা জান্নাতে প্রবেশ করবে না, এমনকি জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের ঘ্রাণ বহু দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ অন্যত্র রয়েছে -‘যে ব্যক্তি প্রসিদ্ধির পোশাক পরিধান করবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।’
ঘ. সুগন্ধি ব্যবহার করা : বিবাহ অনুষ্ঠানে ইদানীং মেয়েরা বিশেষত তরুণীরা মহা উৎসাহে সেন্ট ব্যবহার করে অংশগ্রহণ করে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে নারী সুগন্ধি ব্যবহার করে অতঃপর মানুষের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাতে তার সুগন্ধি পায়, সে ব্যভিচারিণী।’
১১. খাবারে অপচয় করা: খাবারে অপচয় করা, খাদ্য নষ্ট করা, ফেলে দেয়া ইত্যাদি বস্তুত মেহমানদের সম্মানের খাতিরে নয় এসব করা হয় মূলত বিত্ত ও আভিজাত্য প্রকাশের জন্য। এরা শয়তানের দোসর।
ইরশাদ হচ্ছে –
إِنَّ الْمُبَذِّرِين َ كَانُواإِخْوَانَ الشَّيَاطِينِۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا
অর্থাৎ “নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড় অকৃতজ্ঞ।”
সুপ্রিয় পাঠক! এসব কাজ থেকে একটু বিরত হোন। নিজেকে রক্ষা করুন এবং আল্লাহ হিসাব নেয়ার আগে নিজে নিজের হিসাব নিন। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لاَتَزُولُ قَدَمَاعَبْدٍ يَوْمَ الْقِيَامَةِ حَتَّى يُسْأَلَ عَنْ عُمْرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَا فَعَلَ وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَا أَنْفَقَهُ وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَا أَبْلاَهُ.
অর্থাৎ ‘কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা নড়বে না যতক্ষণ না তাকে প্রশ্ন করা হবে তার হায়াত সম্পর্কে : কোন কাজে তা ব্যয় করেছে, জিজ্ঞেস করা হবে তার ইলম সম্পর্কে : সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে, প্রশ্ন করা হবে তার সম্পদ বিষয়ে : কোত্থেকে তা উপার্জন করেছে এবং কোথায় তা খরচ করেছে এবং জিজ্ঞেস করা হবে তার দেহ সম্পর্কে : কোথায় তা কাজে লাগিয়েছে।’
আর বিবাহের ক্ষেত্রেও রয়েছে কিছু নিয়মাবলি। এসব মেনে সুন্নত পন্থায় বিবাহ সম্পাদন করা বরকতময়। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সেই অনুপম আদর্শগুলো গ্রহণ করা। যেমন-
১. পরামর্শ করা: বিবাহ করতে চাইলে করণীয় হলো বিয়ে ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ, পাত্রী ও তার পরিবার সম্পর্কে ভালো জানাশুনা রয়েছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাহাবীদের সঙ্গে অধিক পরিমাণে পরামর্শ করতেন। আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
مَارَأَيْتُ أَحَدًا أَكْثَرَ مَشُورَةً لأَصْحَابِهِ مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.
অর্থাৎ ‘আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে অন্য কাউকে আপন সাথীদের সঙ্গে বেশি পরামর্শ করতে দেখি নি।’
২. পাত্র-পাত্রী নির্বাচন: পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় অনেক দিক রয়েছে। সামাজিক, আর্থিক, ধর্মীয়, আচার-ব্যবহার, মন-মনন, যোগ্যতা শিক্ষা, গুণ, চরিত্র, খেদমত, মিযায, মানসিকতা শারীরিকগঠন, বুদ্ধিমত্তা, ভক্তি, রুচি, পরিবার, বংশ সৌন্দর্য, প্রভৃতি মানদন্ডে পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা যেতে পারে। এ সবের মধ্যে দ্বীনদারীর দিকটা প্রাধান্য দিতে হবে। কেননা, হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে সাধারণত সৌন্দর্য, অর্থবিত্ত, বংশ ও দ্বীনদারীর দিক লক্ষ্য করা হয়। তবে তোমরা দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দিবে।”
সৎ ও খোদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিবাহের পূর্বে পয়গাম পাঠানোর ক্ষেত্রে কোন বাহানা বা সুযোগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানোর যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত তা সুন্নতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য। হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ,
إِذَاخَطَبَ أَحَدُكُمُ الْمَرْأَةَ فَقَدَرَعَلَى أَنْ يَرَى مِنْهَا مَا يُعْجِبُهُ وَيَدْعُوهُ إِلَيْهَا فَلْيَفْعَلْ.
অর্থাৎ ‘তোমাদের কেউ যখন কোন নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়, অতঃপর তার পক্ষে যদি ওই নারীর এতটুকু সৌন্দর্য দেখা সম্ভব হয়, যা তাকে মুগ্ধ করে এবং মেয়েটিকে (বিবাহ করতে) উদ্বুদ্ধ করে, সে যেন তা দেখে নেয়।’
অপর এক হাদীসে হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
كُنْتُ عِنْدَ النَّبِىِّ –صلى الله عليه وسلم- فَأَتَاهُ رَجُلٌ فَأَخْبَرَهُ أَنَّهُ تَزَوَّجَ امْرَأَةً مِنَ الأَنْصَارِ فَقَالَ لَهُ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنَظَرْتَإِ لَيْهَا. قَالَ لاَ. قَالَ فَاذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّ فِى أَعْيُنِ الأَنْصَارِشَيْئًا.
অর্থাৎ ‘একদা আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটে ছিলাম। এমতাবস্থায় তাঁর কাছে এক ব্যক্তি এসে জানাল যে, সে একজন আনসারী মেয়েকে বিয়ে করেছে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি তাকে দেখেছো?’ সে বললো, না। তিনি বললেন, যাও, তুমি গিয়ে তাকে দেখে নাও। কারণ আনসারীদের চোখে (সমস্যা) কিছু একটা রয়েছে’।’
ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘উপরোক্ত হাদীস থেকে জানা যায়, যাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক তাকে দেখে নেয়া মুস্তাহাব।’
৩.বর-কনের পারস্পরিক যোগাযোগ: প্রস্তাব দেয়া নারীর সঙ্গে ফোন বা মোবাইলে কিংবা চিঠি ও মেইলের মাধ্যমে শুধু বিবাহের চুক্তি ও শর্তাদি বোঝাপড়ার জন্য যোগাযোগের অনুমতি রয়েছে। তবে এ যোগাযোগ হতে হবে ভাব ও আবেগ বিবর্জিত ভাষায়। কেননা, বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণকারী কনের কেউ নন, যতক্ষণ না তারা বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। উল্লেখ্য, এ যোগাযোগ উভয়ের অভিভাবকের সম্মতিতে হওয়া শ্রেয়।
৪.একজনের প্রস্তাবের ওপর অন্য জনের প্রস্তাব না দেয়া : যে নারীর কোথাও বিয়ের কথাবার্তা চলছে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়া বৈধ নয়। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
لاَيَخْطُبُ الرَّجُلُ عَلَى خِطْبَةِ أَخِيهِ حَتَّى يَنْكِحَ، أَوْ يَتْرُكَ.
অর্থাৎ ‘কেউ তার ভাইয়ের প্রস্তাবের ওপর যেন প্রস্তাব না দেয়, যতক্ষণ না সে তাকে বিবাহ করে অথবা প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়।’ হ্যা, দ্বিতীয় প্রস্তাবদাতা যদি প্রথম প্রস্তাবদাতার কথা না জানেন তবে তা বৈধ। এ ক্ষেত্রে ওই নারী যদি প্রথমজনকে কথা না দিয়ে থাকেন তবে দু’জনের মধ্যে যে কাউকে গ্রহণ করতে পারবে।
৫. ইদ্দতে থাকা নারীকে প্রস্তাব না দেয়া : বায়ান তালাক বা স্বামীর মত্যুতে ইদ্দত পালনকারী নারীকে সুস্পষ্ট প্রস্তাব দেয়া হারাম। ইঙ্গিতে প্রস্তাব দেয়া বৈধ। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَاجُنَاحَ عَلَيْكُمْ فِيمَاعَرَّضْتُمْ بِهِ مِنْ خِطْبَةِ النِّسَاءِ
অর্থাৎ ‘আর এতে তোমাদের কোন পাপ নেই যে, তোমরা নারীদেরকে ইশারায় যে প্রস্তাব করবে।’ তবে ‘রজঈ’ তালাকপ্রাপ্তা নারীকে সুস্পষ্টভাবে তো দূরের কথা আকার-ইঙ্গিতে প্রস্তাব দেয়াও হারাম। তেমনি এ নারীর পক্ষে তালাকদাতা ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও প্রস্তাবে সাড়া দেয়াও হারাম। কেননা এখনো সে তার স্ত্রী হিসেবেই রয়েছে। (সুস্পষ্ট প্রস্তাব : যেমন এ কথা বলা যে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই। অস্পষ্ট প্রস্তাব : যেমন এ কথা বলা যে, আমি তোমার মতো মেয়েই খুঁজছি ইত্যাদি বাক্য।)
৬.উপযুক্ত পাত্রের প্রস্তাব প্রত্যাখান না করা: উপযুক্ত পাত্র পেলে তার প্রস্তাব নাকচ করা উচিত নয়। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ,
إِذَا خَطَبَ إِلَيْكُمْ مَنْ تَرْضَوْنَ دِينَهُ وَخُلُقَهُ فَزَوِّجُوهُ إِلاَّ تَفْعَلُوا تَكُنْ فِتْنَةٌ فِى الأَرْضِ وَ فَسَادٌ عَرِيضٌ.
অর্থাৎ ‘যদি এমন কেউ তোমাদের বিয়ের প্রস্তাব দেয় যার ধার্মিকতা ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট তবে তোমরা তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। আর যদি তা দ্বারা পৃথিবীতে ব্যাপক অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে প্রত্যাখান করো।’
৭.অলংকার ও যৌতুক: কোন পক্ষ স্বর্ণালংকারের শর্ত দেয়া নিষেধ এবং ছেলের পক্ষ থেকে যৌতুক চাওয়া হারাম।
৮. উকীল নিযুক্তকরণ: মেয়ের কোন মুহরিম (এমন ব্যক্তি, যাকে বিবাহ করা হারাম) বিবাহের এবং উকীল হওয়ার অনুমতি নিবে।
৯. বিবাহের মোহর: বিবাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মোহর নির্ধারণ। বিবাহের মোহর নির্ধারণ ওয়াজিব। এটা সম্পূর্ণ স্ত্রীর অধিকার। তার নারীত্বের সম্মান। মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ ১০ দেরহাম তথা বর্তমান দেশীয় মূল্যমানে প্রায় ৫০০ থেকে ৯০০ টাকা। সর্বোচ্চ কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট নেই। তবে এক্ষেত্রে স্বামীর আর্থিক অবস্থা বিচেনায় রেখে মোহর নির্ধারণ করা কর্তব্য। এমন পরিমাণ সে নির্ধারণ করবে, যা সে নগদে বা পরবর্তীতে আদায়ে সক্ষম। হবু স্ত্রীর বংশীয়া মহিলার মোহর এবং স্বামীর আর্থিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ একটা পরিমাণ বিবেচনা করে অংক নির্ধারণ করা যেতে পারে। প্রচার-প্রসারের উদ্দেশ্যে এমন পরিমাণ নির্ধারণ করা ঠিক নয়, যা স্বামীর পক্ষে আদায় করা আদৌ সম্ভব নয়। এমনটি করলে সে অবশ্যই গুনাহগার হবে। কেননা, মোহর একটি অবশ্যই আদায়যোগ্য ঋণ, অন্যান্য ঋণ অনাদায়ী থাকলে তার জন্য যেমন জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি এর জন্যও আখেরাতে জবাবাদিহি করতে হবে।
১০. বিবাহের দিন নির্ধারণ: শাউয়াল মাসে এবং জুমুয়ার দিনে মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করা উত্তম। উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে।
১১. বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং বিবাহের পরে আকদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লোকদের মাঝে খেজুর বন্টন করা সুন্নাত।
১২.বিয়ের নিয়ত শুদ্ধ করা : নারী-পুরুষের উভয়ের উচিত বিয়ের মাধ্যমে নিজকে হারামে লিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচানোর নিয়ত করা। তাহলে উভয়ে এর দ্বারা ছাদাকার ছাওয়াব লাভ করবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের সবার স্ত্রীর যোনিতেও রয়েছে ছাদাকা। সাহাবীরা জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমাদের কেউ কি তার জৈবিক চাহিদা মেটাবে আর তার জন্য সে কি নেকী লাভ করবে? তিনি বললেন, ‘তোমরা কি মনে করো যদি সে ওই চাহিদা হারাম উপায়ে মেটাতো তাহলে তার জন্য কোনো গুনাহ হত না? (অবশ্যই হতো) অতএব তেমনি সে যখন তা হালাল উপায়ে মেটায়, তার জন্য নেকী লেখা হয়।’
১৩. মাসনূন বিবাহ সাদা সিধে ও অনাড়ম্বর হবে, যা অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি মুক্ত হবে এবং যৌতুকের শর্ত বা সামর্থের অধিক মহরানার শর্ত থেকেও মুক্ত হবে।
এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় সে বিয়ে বেশি বরকতপূর্ণ হয়, যে বিয়েতে খরচ কম হয়।
১৪. নির্দোষ সঙ্গীত ও দফ বাজানো: বিয়ের ঘোষণার স্বার্থে শুধু দফ বাজানো এবং নির্দোষ সঙ্গীত গাওয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে সে সঙ্গীত রূপের বর্ণনা কিংবা অবৈধ কিছুর আহ্বান মুক্ত হতে হবে।
১৫.বিয়ের দা‘ওয়াত গ্রহণ করা: কেউ যদি বিয়ের দা‘ওয়াত দেয় তাহলে সে দা‘ওয়াত কবুল করা সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কাউকে যখন বৌভাতের (ওয়ালিমা) দাওয়াত দেয়া হয়, সে যেন তাতে অংশ নেয়।’
অন্যত্র রয়েছে, ‘আর যে দাওয়াত কবুল করল না সে যেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যাচরণ করল।’
তবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যদি নিষিদ্ধ কিছুর আয়োজন থাকে তবে তাতে অংশ নেয়ার অনুমতি নেই। হযরত আলী রাদ্বিল্লাহু আনহু বলেন,
صَنَعْتُ طَعَامًا وَدَعَوْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَجَاءَ، فَرَأَى فِي الْبَيْتِ تَصَاوِيرَ فَرَجَعَ، فَقُلْتُ : يَارَسُولَ اللهِ لِمَ رَجَعْتَ؟ قَالَ : إِنَّ فِي الْبَيْتِ شَيْئًا فِيهِ تَصَاوِيرُ وَ أَنَّ الْمَلاَئِكَةَ لاَتَدْخُلُ بَيْتًا فِيهِ تَصَاوِيرُ.
অর্থাৎ ‘আমি একটি খাবার তৈরি করলাম এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দাওয়াত দিলাম। ফলে তিনি এলেন। তারপর ঘরে ছবি দেখতে পেয়ে ফেরত এলেন। আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি ফিরে এলেন কেন? তিনি বললেন, ‘ঘরে কিছু রয়েছে যাতে ছবি আঁকা। আর যে ঘরে ছবি থাকে তাতে ফেরেশতা প্রবেশ করেন না।
উক্ত হাদীসের আলোকে আলিমগণ বলেন, যে দাওয়াতে নিষিদ্ধ বিষয় রয়েছে, তা বর্জন করা উচিত। ইমাম আওযায়ী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, ‘সে ঘরে বিয়ের দাওয়াতে যাওয়া যাবে না, যেখানে তবলা এবং বাদ্যযন্ত্র রয়েছে।’
১৬. নব দম্পতির জন্য দু‘আ করা : নব দম্পতির জন্য নিম্নোক্ত দু’আ করা সুন্নত। হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যখন কোন ব্যক্তি বিবাহ করত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন,
بَارَكَ اللَّهُ لَكَ، وَبَارَكَ عَلَيْكَ، وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا فِي خَيْرٍ.
অর্থাৎ ‘আল্লাহ তোমার জন্য বরকত দিন, তোমার ওপর বরকত দিন এবং তোমাদের উভয়েক কল্যাণে মিলিত করুন।’
১৭. বাসর ঘরে স্ত্রীর মাথার অগ্রভাগে ডান হাত রেখে দু’আ পড়া : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,‘তোমাদের কেউ যখন কোনো নারী, ভৃত্য বা বাহন থেকে উপকৃত হয় (বিয়ে বা খরিদ করে) তবে সে যেন তার মাথার অগ্রভাগ ধরে, বিসমিল্লাহ পড়ে এবং বলে :
اللّٰهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ خَيْرَهَا وَخَيْرَمَا جُبِلَتْ عَلَيْهِ وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جُبِلَتْ عَلَيْهِ.
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে এর ও এর স্বভাবের কল্যাণ প্রার্থনা করছি এবং এর ও এর স্বভাবের অকল্যাণ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’
১৮. স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সালাত আদায় করা : হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, স্ত্রী যখন স্বামীর কাছে যাবে, স্বামী তখন ওযু সহকারে দাঁড়িয়ে যাবে। আর স্ত্রীও দাঁড়িয়ে যাবে তার পেছনে। অতঃপর তারা একসঙ্গে দুই রাকা‘ত সালাত আদায় করবে এবং বলবে :
اللّٰهُمَّ بَارِكْ لِي فِي أَهْلِي، وَبَارِكْ لَهُمْ فِيَّ، اللّٰهُمَّ ارْزُقْنِي مِنْهُمْ وَارْزُقْهُمْ مِنِّي، اللّٰهُمَّ اجْمَعَ بَيْنَنَا مَا جَمَعْتَ إِلَى خَيْرٍ، وَفَرِّقْ بَيْنَنَا إِذَا فَرَّقْتَ إِلَى خَيْرٍ.
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দিন আর আমার ভিতরেও বরকত দিন পরিবারের জন্য। হে আল্লাহ! আপনি তাদের থেকে আমাকে রিযক দিন আর আমার থেকে তাদেরও রিযক দিন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদের যতদিন একত্রে রাখেন কল্যাণের সাথে একত্র রাখুন আর আমাদের মাঝে যখন বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিবেন তখন কল্যাণের পথেই বিচ্ছেদ ঘটাবেন।’
১৯. স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের দু‘আ পড়া : স্ত্রী সহবাসকালে নিচের দু’আ পড়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি স্ত্রী সঙ্গমের প্রাক্কালে বলে :
بِاسْمِ اللهِ اللّٰهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطَانَ مَارَزَقْتَنَا
অর্থাৎ আল্লাহর নামে শুরু করছি, হে আল্লাহ! আমাদেরকে শয়তানের কাছ থেকে দূরে রাখুন আর আমাদের যা দান করেন তা থেকে দূরে রাখুন শয়তানকে। তবে সে মিলনে কোনো সন্তান দান করা হলে শয়তান কখনো তার ক্ষতি করতে পারবে না।’
উপরোক্ত দোয়া না পড়লে শয়তানের তাছীরে বাচ্চার উপর কু-প্রভাব পড়ে। অতঃপর সন্তান বড় হলে, তার মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে এবং বাচ্চা নাফরমান ও অবাধ্য হয়। সুতরাং স্বামী- স্ত্রী এ ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকা জরুরী।
২০. নিষিদ্ধ সময় ও জায়গা থেকে বিরত থাকা: হযরত আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ঋতুবতী মহিলার সঙ্গে কিংবা স্ত্রীর পেছনপথে সঙ্গম করে অথবা গণকের কাছে যায় এবং তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সে যেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অস্বীকার করলো।’
২১. ঘুমানোর আগে অযূ বা গোসল করা : স্ত্রী সহবাসের পর সুন্নত হলো অযূ বা গোসল করে তবেই ঘুমানো। অবশ্য গোসল করাই উত্তম। হযরত আম্মার বিন ইয়াসার রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন , ‘তিন ব্যক্তির কাছে ফেরেশতা আসে না : কাফের ব্যক্তির লাশ, জাফরান ব্যবহারকারী এবং অপবিত্র শরীর বিশিষ্ট ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে অযূ করে।’
২২.ঋতুবতীর স্ত্রীর সঙ্গে যা কিছুর অনুমতি রয়েছে : স্বামীর জন্য ঋতুবতী স্ত্রীর সঙ্গে যোনি ব্যবহার ছাড়া অন্য সব আচরণের অনুমতি রয়েছে। স্ত্রী পবিত্র হবার পর গোসল করলে তার সঙ্গে সবকিছুই বৈধ। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে বলেন, ‘(ঋতুবতীর স্ত্রীর সঙ্গে) সঙ্গম ব্যতিত সবই করতে পারবে।’
২৩. স্ত্রী সান্বিধ্যের গোপন তথ্য প্রকাশ না করা : বিবাহিত ব্যক্তির আরেকটি কর্তব্য হলো নিজ স্ত্রী সংশ্লিষ্ট গোপন তথ্য কারো কাছে প্রকাশ না করা। কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি সবচেয়ে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে, যে তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয়; অতঃপর সে এর গোপন বিষয় অপরের নিকট প্রচার করে।’
২৪. ওয়ালিমা করা: বিয়ের (বাসর রাতের) পরদিন বা পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো নিকটতম সময়ের মধ্যে স্বীয় আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাংখী এবং গরীব মিসকীনদের দাওয়াত দিয়ে ওয়ালিমা করা বিধেয়। তবে তিন দিনের মধ্যে করা উত্তম। যেকোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ওয়ালিমা করা যায়। বাংলায় ওয়ালিমাকে বউভাত বলা হয়ে থাকে। এক দিন ওয়ালিমা করা সুন্নত, দুই দিন ওয়ালিমা করা মুস্তাহাব, তিন দিন ওয়ালিমা করা জায়েজ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ওয়ালিমা করেছেন এবং সাহাবিদের করতে বলেছেন। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন হযরত জয়নব বিনতে জাহাশ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করার পরদিন ওয়ালিমা করেছিলেন। আর হযরত ছাফিয়াহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ের পর তিন দিন যাবৎ ওয়ালিমার ব্যবস্থা করেছিলেন।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জয়নব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে বিয়ে করার পর যত বড় ওয়ালিমা করেছিলেন, তত বড় ওয়ালিমা তিনি তাঁর অন্য কোনো স্ত্রীর বেলায় করেননি এবং মানুষকে রুটি-গোশত দিয়ে তৃপ্তি সহকারে আপ্যায়ন করেছিলেন।
আর উম্মুল মুমিনীন ছাফিয়া রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে মুক্ত করে বিবাহ করার সময় তাঁর মোহর নির্ধারণ করলেন তাঁর মুক্তিপণ। তিনি তাঁর বিবাহের ওয়ালিমা করেছিলেন ‘হায়স’ নামক খাদ্য দিয়ে, যা খেজুর, পনির ও ঘি দ্বারা তৈরি ছিল।
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর গায়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, এটা কী? তিনি বললেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এক খেজুর আঁটির ওজন স্বর্ণ দিয়ে একজন মহিলাকে বিবাহ করেছি। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দান করুক। একটি ছাগল দ্বারা হলেও তুমি ওয়ালিমা করো।’
ওলীমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরী নয়। বরং সামর্থানুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওলীমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয়, দ্বীনদার ও গরীব গরীব-মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয়না, সে ওলীমাকে হাদিসে নিকৃষ্টতম ওলীমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সুতরাং এ ধরনের ওলীমা আয়োজন থেকে বিরত থাকা উচিত।
বর্তমান যুগে ওয়ালিমার এই সুন্নত বর্জনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। বিশেষত মেয়ে পক্ষের ওপর আপ্যায়নের যে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা সম্পূর্ণ হারাম। সর্বোপরি শর্ত আরোপ করে বরযাত্রীর নামে বরের সঙ্গে অধিকসংখ্যক লোক নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়িতে মেহমান হয়ে কনের পিতার ওপর বোঝা সৃষ্টি করা আজকের সমাজের একটি জঘন্য কুপ্রথা, যা শরীয়ত বিরোধী এবং সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা আবশ্যক। এতে অংশগ্রহণ করাও হারাম ও পাপ কাজ। কেননা, কারও ওপর জোর প্রয়োগ করে কোনো খাবার গ্রহণ করা জুলুমের শামিল।
অতএব, নিজের একাকীত্ব জীবনের অবসান ঘটিয়ে যুগল জীবনে পদার্পণের পর্বটি শরয়ী নির্দেশনা অনুসরণে সম্পন্ন করা একজন মুসলমানের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কেননা, যারা নিজের জীবনের প্রতিটি পর্বকে কুরআন-সুন্নাহর আদলে গড়ে তোলেন এবং সর্ব প্রকার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকেন, আশা করা যায় তারাই হবেন সফল ও সার্থক। তাদের মৃত্যু হবে পরম সৌভাগ্যময়। আর তারাই হবেন সে দলের অন্তর্ভুক্ত, যাদের কথা আল্লাহ তায়ালা এভাবে বলেছেন, ‘আর যারা বলে, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন, যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন’। তারাই, যাদেরকে [জান্নাতে] সুউচ্চ কক্ষ প্রতিদান হিসাবে দেয়া হবে- যেহেতু তারা ধৈর্যধারণ করেছিল। আর তাদের সেখানে অভ্যর্থনা জানানো হবে অভিবাদন ও সালাম দ্বারা। সেখানে তারা স্থায়ী হবে। অবস্থানস্থল ও আবাসস্থল হিসেবে তা কতইনা উৎকৃষ্ট!’

লেখক: আরবি প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন
হামেদিয়া ফাযিল মাদরাসা, রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •