রোহিঙ্গা ও উইঘুর সমস্যার সমাধান হবে কি?
অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান
রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রায় সকলেই মুসলমান। স্বদেশ মায়ানমারে (বার্মা) যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমে বসবাস করেও তারা প্রবাসী, উদ্ভাস্তু, এদের অনেকেই পার্লামেন্ট সদস্যও নির্বাচিত হন, সরকারি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেও নিয়োজিত ছিলেন। তবুও তারা মায়ানমারবাসী নয়। রোহিঙ্গা শব্দটি সরকার স্বীকৃতি দিতে নারাজ। অনেক সময় আরাকান মুসলিম বলে সম্বোধন করে। রোহিঙ্গাদের উপর বছরের পর বছর চালানো নির্যাতন, বেকারত্ব, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্য মুসলমানদের সম্পদ লুন্ঠন বিশেষ করে নারী নির্যাতনের কারণে রোঙ্গিাদের একটি অংশ আরাকান প্রদেশে স্বায়ত্বশাসন পরে স্বাধীনতার দাবী নিয়ে অজঝঅ নামে একটি গোপন সংঠন গড়ে তোলে। এদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল পাকিস্তান সহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ এবং কতিপয় এন.জি.ও.। এ সংগঠনের নেতাদের (মায়ানমার) সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় বলেও গুজব রয়েছে। মাঝে মধ্যে মায়ানমার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে দু’একটি ছোট-খাট আক্রমণ চালিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। সরকারি মহল প্রতিশোধ নিতে রোহিঙ্গাদের উপর নিপীড়নের ষ্টিম রোলার চালিয়ে দেয়। এতে দেখা গেছে গত পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য সহ অনেক দেশে অন্তত: ত্রিশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি তাদের ওপর চলে চরম নির্যাতন। ১৯৮০ সাল থেকে আরাকানের লক্ষ লক্ষ লোক বাংলাদেশের সীমান্ত জেলা কক্সবাজার, টেকনাফ, উকিয়ায় এসে জড়ো হতে শুরু করে। সময় ও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশি পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। অনেকেই স্থানীয়দের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশেই স্থায়িভাবে বসবাস করছে। কক্সবাজার জেলার বহু লোক এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করে দেশের ক্ষতি করছে। মূলত: এ সকল কারণে রোহিঙ্গারা অনুপ্রাণিত হয়ে চোরাপথে নিয়মিত বর্ডার ক্রস করছে, আর্থিক লেনদেন মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে অনেক ক্ষেত্রে, সর্বশেষ ধাক্কাটা আসে কয়েক বছর পূর্বে। একযোগে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা গোষ্ঠী নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে চলে আসে। এদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা দেখে মানবদরদী শেখ হাসিনা (বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত উম্মুক্ত করে দেয়। সরকারি হিসেবে সাড়ে সাত লক্ষ হলেও এখন পর্যন্ত দশ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু বাংলাদেশে অবস্থান করছে। ক্রমাগত এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
মায়ানমার সরকার বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে ভিঠে খালি করে অর্থনৈতিক জোন করে চীন ভারতসহ বিভিন্ন দেশকে ইজারা দিচ্ছে। এর পিছনের বড় মদদ দাতা চীন, রাশিয়া, থাইল্যান্ডসহ দূর প্রাচ্যের অনেক দেশ এতে জড়িত। জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, ওআইসিসহ অনেকের প্রতিবাদ সত্ত্বেও দফায় দফায় সালিশ-বৈঠক ও চুক্তি হলেও মায়ানমার সরকার কোন ছাড় দিতে নারাজ। জাতিসংঘের প্রস্তাবের বিপক্ষে চীন ও রাশিয়া ভেটো দেয়ায় এবং ভারতসহ পাশ্ববর্তী অনেক দেশের নীরবতায় স্পষ্ট যে, আরাকানের মাটিঐ সব দেশের প্রয়োজন, বাসিন্দাদের কোন প্রয়োজন নেই।
চুক্তি, আলোচনা চলবে, মোড়ল রাষ্ট্রসমূহ বিবৃতি দেবে মানবাধিকার সংস্থা চেঁচামেচি করবে সময়ে সময়ে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলি দাতা দেশসমূহ প্রয়োজনের তুলনায় অতি সমান্য ত্রাণ সামগ্রী, অর্থ বিলাবে, আর কান্না করবে। সমস্যা সমস্যাই থেকে যাবে। বাংলাদেশের ওপর সওয়ারি হওয়া লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা আমাদের দেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে থাকবে অনন্তকাল। বাংলাদেশ সরকার কুটনৈতিকভাবে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা বৈঠক অব্যাহত রাখলেও মায়ানমার সরকার ও মদদ দাতাদের অনীহায় কোন কিছুই ফলপ্রসু হচ্ছে না। এর সমাধান সুদূর পরাহত মনে হয়। মায়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে পারবে একমাত্র চীন, রাশিয়া। চীন, রাশিয়া বাংলাদেশের বন্ধু প্রতিম রাষ্ট্র, উন্নয়নের অংশীদার। তারা চাইলে সমস্যার সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউউ’র চাহিদাও মায়ানমারের উন্নয়নে অংশীদার হওয়া অর্থাৎ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও আর্থিক আনুকুল দু’টিরই সম্পর্ক রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যার অন্তরালে। সামরিক জান্তা মায়ানমারকে পুনরায় চেপে ধরেছে। গত ৬০ বছরের মধ্যে মাত্র ৭/৮ বছর নামমাত্র গণতন্ত্র চর্চা হয়েছে মায়ানমারে। সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গতিশীল হচ্ছে ক্রমাগত। অভ্যন্তরীন সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের কোন অপশন নেই। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া। অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব, সামরিক বনাম বেসামারিক আন্দোলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন কোন সিদ্ধান্ত নেবে না কেউই।
চীন সরকার জিনজিয়ান প্রদেশের প্রায় দেড় কোটি নৃ-জাতিগোষ্ঠী উইঘুর মুসলমানদের ওপর কয়েক যুগ ধরে অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন চালিয়ে একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কারণে এ কথা বিশ্ববাসী জানতে পেরেছে। পুন:প্রশিক্ষণ দেয়ার নামে লক্ষ লক্ষ উইঘুরদের শত শত শিবিরে বন্দী করে রেখেছে। নিজ ধর্ম কৃষ্টি সভ্যতা বিশ্বাস’র স্থলে চীনা কৃষ্টি সভ্যতা শেখানোর নামে বছরের পর বছর মগজ ধোলায়’র নির্যাতন চালাচ্ছে চীন সরকার।
সম্প্রতি বিবিসি অনলাইনের খবরে বলা হয় জিনজিয়ান প্রদেশ হতে উইঘুর সহ অন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমিয়ে আনতে নয়া পদক্ষেপ নিয়েছে চীন। উইঘুরদের জিনজিয়ান হতে অনেক দূরে পাঠানো হচ্ছে চাকুরীর নাম করে। যাতে ওইসব জায়গায় বিয়ে করে সংসার পাততে পারে। এ সূত্র প্রয়োগ করতে চীন সরকার দীর্ঘদিন গবেষণা করেছে। সরকার বলছে জিনজিয়ানের দূর্গম ও প্রাচীন জনপদে কর্ম সংস্থান বাড়াতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। প্রচারনা চালাতে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে উইঘুর নিশ্চিহ্ন করতে কি পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি ভিডিও দৃশ্যেও দেখা যাচ্ছে টাকালামাকান মরুভূতিতে বহু উইঘুরকে জড়ো করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে ভিডিওতে বলা হচ্ছে আপনাদের এখান থেকে চার হাজার কিলোমিটার দূরে আনহুই প্রদেশে ভাল চাকুরী দেয়া হবে। জিনজিয়ান থেকে আরো উন্নত জীবন পাবেন। একই সাথে সরকারি কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে এসব তত্ত্ব প্রচার করছে। উইঘুর, কাজাখ ও অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাই প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে এ সকল কর্মকান্ড পরিচালনা করে আসছে চীন কম্যুানিষ্ঠ সরকার। এখবর এতদিন গণমাধম্যের নজরে আসেনি। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এক চীনা কর্মকর্তা এক মেয়েকে বলছেন, তুমি জিনজিয়ান ছাড়লে খুব দ্রুত তোমার বিয়ে হবে। উন্নত জীবন পাবে, পরের প্রশ্ন তুমি কি জিনজিয়ান চাড়তে চাও? এ সময় ওই মেয়েকে বলতে শোনা যায় ‘না’। আমি জিনজিয়ান ছাড়ছি না। বৃটিশ মানবাধিকার কর্মী লা সার্ফি এ সংক্রান্ত তথ্যকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন। উইঘুর সম্প্রদায়ের নির্যাতনের আর একটি বিষয় সম্প্রতি চাউর হয়, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষ দর্শীরা জানিয়েছে চীন কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হলো, উইঘুরদের সবাইকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। চীনের জিনজিয়ান প্রদেশে কথিত পুনঃশিক্ষা শিবিরে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের নারীরা পদ্ধতিগত ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন। উইঘুর বন্দী শিবিরে নারীরা যৌন নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ, চীন সরকার ধীরে ধীরে উইঘুরদের ধর্মীয়সহ অন্যান্য স্বাধীনতাই কেড়ে নিচ্ছে। বহু জিনজিয়ান শিবিরে নারীদের প্রজনন ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হচ্ছে, অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন চালানো হচ্ছে। জোর করে বিশেষ মতবাদ শেখানো হচ্ছে। জিনজিয়ান শিবিরে নয় মাস বন্দী ছিলেন তুরসুনাই জিয়াউদুন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে শিবির থেকে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে কাযাখাস্তান হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এখন সেখানেই অবস্থান করছেন। জিয়াউদুনের ভাষ্য শিবিরে করোনার প্রভাব নেই, তবুও শিবিরের দায়িত্বে থাকা পুরুষেরা সব সময় মাস্ক পরে থাকেন। স্যুট পড়েন তবে তা পুলিশের ঊর্দির মতো নয়। জিয়াউদুন বলেন, তারা কখনো কখনো মধ্য রাতের পর শিবিরের সেলে আসেন। [বিবিসি অনলাইন]
চীন-মায়ানমার একই বৃক্ষের দুটি কাঁটা। উভয়েই মুসলিম নিধন প্রক্রিয়া শুরু করেছে জোরে শোরে। একটু ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে, মুসলিম বিশ্ব বহুধা-বিভক্ত। একেক দেশ একেক নীতি ও স্বার্থ নিয়ে বিভোর। দেখে যেন মনে হয় কেউ কারো নয়। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা!
মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধভাবে এর প্রতিবাদ না করলে সময়ের ব্যবধানে সমূহ বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। আসুন, ধর্মীয় ও জাতিগোষ্ঠী নিধনের বিরুদ্ধে সকলেই সোচ্চার হই।
লেখক: প্রেস এণ্ড পাবলিকেশন সেক্রেটারী আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট।