সিয়ামঃ এক আধ্যাত্মিক সাধনার নাম

0
সিয়ামঃ এক আধ্যাত্মিক সাধনার নাম
মাওলানা মোহাম্মদ আবুল কালাম আমিরী
সাওম বা সিয়াম আরবি শব্দ। বাংলায় প্রতিশব্দ রোযা ব্যবহার হয়। সাওম বা সিয়াম’র আভিধানিক অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা ইত্যাদি। শরীয়তের পরিভাষায় একজন মুসলমান সুবহি সাদেক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়্যত সহকারে পানাহার এবং যৌনাচার থেকে বিরত থাকাকে সাওম বা রোযা বলা হয়।
মূলত রোযা পালনের নিয়ম সর্বকালে, সর্বযুগেই প্রচলিত ছিল। হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম থেকে আরম্ভ করে হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম পর্যন্ত সকল নবী-রসূলের উপর সিয়াম বা রোযা ফরয ছিল। যদিও ধরন ও প্রক্রিয়াগতভাবে তাদের রোযা আমাদের রোযা থেকে কিছুটা ভিন্নতর ছিল।
হযরত আদম আলায়হিস্ সালাম’র উপর চন্দ্র মাসের তের, চৌদ্দ ও পনের তারিখের রোযা ফরয ছিল, হযরত মুসা আলায়হিস্ সালামের উম্মতদের উপর আশুরা’র রোযা ফরয ছিল। এক বর্ণনায় রয়েছে সর্বপ্রথম নুহ্ আলায়হিস্ সালাম রোযা পালন করেছেন। নবীদের মধ্যে হযরত দাউদ আলায়হিস্ সালামের রোযার গুরুত্ব হাদীসে পাকে বিশেষভাবে উল্লেখ রয়েছে। তিনি একদিন রোযা রাখতেন, অপরদিন রোযা রাখতেন না। এককথায় প্রাচীনকালে গ্রীক, পারসিক ও মিসরীয় ধর্মসহ সকল ধর্ম বিশ্বাসে রোযার প্রচলন দেখা যায়।
ইসলাম পূর্ব সকল ধর্মে রোযার প্রচলন থাকলেও তারা রোযা পালনের ব্যাপারে নিজেদের অবাধ স্বাধীনতা, রোযার ভাবমুর্তি ও প্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিয়েছিল। তাদের ধর্মে রোযার মত নির্মল, পরিচ্ছন্ন, পবিত্র এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম এ এবাদত অন্তঃসারশূন্য নিছক এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়। এ অবস্থা হতে ফিরিয়ে আনতে এবং একে আত্মিক, নৈতিক ও চারিত্রিক কল্যাণের ধারক ও বাহক করার নিমিত্তে আল্লাহ্ তা‘আলা উম্মতে মুহাম্মদী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র উপর রোযা ফরয করে এরশাদ করেন-‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রমযানের রোযা ফরয করা হলো, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে সক্ষম হও। [সূরা বাক্বারা, আয়াত-১৮৩]
উপরোক্ত আয়াত নাযিল করে আল্লাহ্ তা‘আলা অন্যান্য এবাদতের ন্যায় মুসলমানের উপর রমযান মাসের রোযার ফরয্যিত অবতীর্ণ করেছেন। তবে এতে বেশ কিছু মৌলিক চিন্তা চেতনার সংস্কার সাধন করেছেন। মুসলিম সমাজের সর্বস্তরে এর সুদূর প্রসারী প্রভাব সুস্পষ্ট।
রোযাদার রোযা পালনের মাধ্যমে হৃদয়ের পবিত্রতা ও চিন্তাধারার বিশুদ্ধতা অর্জন করে। রোযার মাধ্যমে বান্দা এক রূহানী তৃপ্তি, নতুন উদ্যম ও প্রেরণা লাভ করে। আল্লাহ্ তা‘আলা রোযার জন্য যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, তা স্মরণে রোযাদার এক মুহূর্তে ভোগে তুষ্ট, ত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠে বলীয়ান।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেছেন- ‘রোযা আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর পুরস্কার দান করবো।’ [মিশকাত শরীফ] অপর এক হাদীসে এসেছে- রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন ‘‘রোযাদার ব্যক্তির দু’টি আনন্দ। একটি হলো ইফতারের মুহূর্তে আর অপরটি তার রবের সাথে সাক্ষাতের মুহূর্তে।’’
প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাসে রোযার ব্যাপারে অনেক সীমাবদ্ধতা ও বাড়াবাড়ি ছিল। ইসলাম এ ক্ষেত্রে উদারতার পরিচয় দিয়েছে। যেমন- রোযাদারের যেন সাধ্যাতীত কষ্ট না হয় এর জন্য নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম সাহ্রীকে সুন্নাত এবং বিলম্বে সাহরী গ্রহণ করাকে মুস্তাহাব করেছেন। এমনিভাবে ইফতারের সময় অযথা বিলম্ব না করে সময় হওয়ার সাথে সাথেই ইফতার করার নির্দেশ দিয়েছেন। অনুরূপভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের রোযার বিষয়টি বিবেচনায় এনে ওযর দূর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে রোযা না রাখার অনুমতি ও রাতভর পাহানাহারসহ যাবতীয় বৈধ কাজ করার অনুমতি প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে এরশাদ হয়েছে- ‘‘তোমরা কেউ পীড়িত কিংবা সফরে থাকলে অন্য সময় এ রোযা পূর্ণ করতে হবে। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৮৫] ‘‘আর তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ রাতের কালো রেখা হতে ভোরের সাদা রেখা তোমাদের নিকট প্রতিভাত না হয়। [সূরা বাক্বারা: আয়াত-১৮]
পূর্বের প্রায় সকল ধর্মেই রোযা সৌরমাস হিসাবে রাখার বিধান ছিল। এতে প্রতি বছর একই সময় নির্দিষ্ট মাসে রোযা রাখা হত। কোন রদবদল হতো না। তাতে রোযাদারদের মধ্যে কিছুটা একঘেয়েমি মনোভাব সৃষ্টি হত। ইসলাম সৌর মাসের পরিবর্তে চান্দ্র মাসের হিসাবে রোযা ফরয করায়, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষ সহজে রোযা রাখতে সক্ষম হয় এবং চান্দ্র মাসের কারণে ধীরে ধীরে রমযানের সময় বদল হয়ে যায়। রমযান কখনো আসে গরমে আবার কখনো শীতে। সময়ের এ পরিবর্তনের ফলে নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া যায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘চাঁদ দেখে রোযা আরম্ভ কর এবং চাঁদ দেখে তা ভঙ্গ কর।’’ [মিশকাত শরীফ]
রোযার আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
রোযার মৌলিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব হলো ‘‘তাকওয়া’ অর্জন। হৃদয়ের নির্মল পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার নাম তাকওয়া। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা রোযার তাৎপর্য আলোচনায় এরশাদ করেছেন, ‘‘যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’’ ‘‘তাকওয়া’’ হচ্ছে হৃদয়ের এক বিশেষ অবস্থা। যা মানুষকে গুনাহ্ হতে বিরত রাখে। মানুষ গুনাহ্ করে নাফস’র কারণে। পানাহার দ্বারা নাফস শক্তিশালী হয়। রোযা যেহেতু পানাহার হতে বিরত রাখে, তাতে নাফস দুর্বল হয়ে পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ কমে যায়। এছাড়াও তাকওয়া অর্জিত হলে মানুষ আল্লাহর প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে তাতে পাপাচারের প্রতি আকর্ষণ দিন দিন কমতে থাকে। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য প্রাপ্ত যে তোমাদের মধ্যে বেশী মুত্তাকী।’’
মুসলমানদের নিকট রোযা যেন গুরুত্বহীন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয় তা যেন একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে পালিত হয় তার জন্য রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম রোযার সাথে ঈমান ও এহতিসাব তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও উত্তম বিনিময় লাভের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি ঈমানসহ নেকী হাসিলের আশায় রমযানের রোযা রাখবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ্ মাফ করে দেয়া হবে।’’ [মিশকাত শরীফ] মূলত যে রোযা তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও হৃদয়ের পবিত্রতা শূন্য সে রোযা প্রকৃত অর্থে রোযাই নয়। আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট এ রূপ রোযার কোন গুরুত্ব নেই। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও তদানুযায়ী আমল বন্ধ করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।’’ [বোখারী শরীফ]
এছাড়াও যে সব কাজ রোযার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিপন্থী, রোযা অবস্থায় সে সব কাজ হতে বিরত থাকতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাকিদ দিয়েছেন, তিনি বলেছেন, ‘‘রোযা অবস্থায় তোমাদের কেউ যেন অশ্লীল কাজে লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয় তবে সে যেন বলে, আমি রোযাদার। [মিশকাত শরীফ]
একজন মুসলমান রোযার সুফল পেতে হলে সংযত হওয়ার পাশাপাশি চোখ, কান, জিহ্বা এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে সংযমী করে তুলতে হবে। হারাম জিনিস দেখা, নিষিদ্ধ কথা বলা ও শোনা এবং হারাম কাজ করা থেকে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে অবশ্যই বিরত রাখতে হবে।
এমনিভাবে রোযার কাক্সিক্ষত সুফল পাওয়ার জন্য হালাল উপার্জন অপরিহার্য। হারাম খেয়ে রোযা রাখলে, এতে নাফসের পাশবিকতা অবদমিত হওয়ার পরিবর্তে তা আরো উত্তেজিত হবে।
রোযার আধ্যাত্মিক উপকারিতা
রোযার মধ্যে অনেক আধ্যাত্মিক উপকারিতা রয়েছে এর মধ্যে থেকে কতিপয় নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
১. ‘রূহ’ বৈশ্বিক জগতে আসার পূর্বে পানাহারের প্রয়োজনীয়তা ছিলনা। এ কারণে গুনাহ্ হতে মুক্ত ছিল। এ জগতে যখন রূহ ও নাফস একত্রিত হলো, তাতে খাদ্যের প্রয়োজন অনুভব হলো। এতে উভয়ে যেন তাদের পূর্বের অবস্থা স্মরণ করার জন্য কিছুদিন উপবাস থাকার বিধান প্রদান করেছেন।
২. নাফ্স ও রূহ পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। তাদের অবস্থান শরীর। নাফস’র জন্য শক্তি প্রয়োজন যা পানাহার দ্বারা অর্জিত হয়। আর রূহের জন্য প্রয়োজন দুর্বলতা তা নেক আমলের দ্বারা অর্জিত হয়। নাফসকে কিছুদিন উপবাস রেখে দুর্বল করলে রূহ শক্তিশালী হয়।
৩. রোযার মাধ্যমে ক্ষুধা পিপাসার কষ্ট অনুভব হয় যাতে পানাহারের গুরুত্ব অনুভব করে আল্লাহ্ তা‘আলার শোকরিয়া আদায় করা যায়।
৪. রোযার দ্বারা মানুষের স্বভাবে ন¤্রতা ও বিনয়ীভাব সৃষ্টি হয় এবং মানব মনে আল্লাহর মহত্বের ধারণা জাগ্রত হয়।
৫. রোযার দ্বারা মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ এবং পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা ও ভালবাসা সৃষ্টি হয়। কেননা যে ব্যক্তি কোন দিনও ক্ষুধার্ত ও পিপাসিত থাকেনি সে কখনো ক্ষুধার্ত মানুষের দুঃখ, কষ্ট বুঝতে পারে না। অপরদিকে কোন ব্যক্তি যখন রোযা রাখে এবং উপবাস থাকে তখন সে উপলব্ধি করতে পারে যে, যারা অনাহারে, অর্দ্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, তারা কত কষ্টে আছে, ফলে গরীব অসহায় মানুষের প্রতি তার সহানুভূতি হয়।
৬. রোযার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হলো দৈহিক সুস্থতা অর্জন। চিকিৎসা বিজ্ঞানও স্বীকার করে নিয়েছে যে, শারীরিক সুস্থতার জন্য উপবাসের কোন বিকল্প নেই। তাই তারা বৎসরে কয়েকদিন উপবাস থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তাদের মতে, স্বল্প খাদ্য গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্বল্প খাদ্য গ্রহণ করতে বলেছেন। সূফি সাধকদের মতে, হৃদয়ের স্বচ্ছতা অর্জনে স্বল্প খাদ্য গ্রহণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। রোযা পালনের মাধ্যমে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শরীর ক্ষতিকর চর্বি জমতে পারে না। পক্ষান্তরে মাত্রাতিরিক্ত পানাহারের ফলে শরীরে অধিকাংশে রোগ ব্যাধির সৃষ্টি হয়।

লেখক : অধ্যক্ষ- হযরত কালু শাহ্ সুন্নিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •