হুযূর-ই আকরামের বেলাদত শরীফের সময় থেকে শয়তানগণ আসমানের নিকট যেতেই উল্কাপিন্ডের মার খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়

0
শানে রিসালত
মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল মান্নান
হুযূর-ই আকরামের বেলাদত শরীফের সময় থেকে শয়তানগণ আসমানের নিকট যেতেই উল্কাপিন্ডের মার খেয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়
হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের সাথে সাথে আসমানও সংরক্ষিত হয়ে যায়। ইতোপূর্বে শয়তানগণ উড়ে গিয়ে প্রথম আসমানের কাছে পৌঁছে যেতো এবং চুপিসারে ফেরেশতাদের আলাপ-আলোচনা শুনে কিছু কথা চুরি করতে চেষ্টা করতো। তারপর সেগুলোর সাথে নিজেদের থেকে আরো কিছু মিথ্যা কথা জুড়ে দিয়ে দুনিয়ায় এসে উভয় ধরনের কথা কাহিন বা গণকদেরকে বলে দিতো। গণকগণ তা মানুষের কাছে বলতো। অতঃপর ফেরেশতাদের ব্যক্ত ও তাঁদের থেকে শ্রুত কথাগুলো সত্য হতো আর শয়তানদের জুড়ে দেওয়া কথাগুলো মিথ্যা হতো। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হতো। এজন্য হাদীস শরীফে কাহিন বা গণকদের কাছে যাওয়াকে নিষিদ্ধ এবং তাদের কথা বিশ্বাস করাকে কুফর বলা হয়েছে।
সমস্ত সৃষ্টির জন্য রহমতরূপে বিশ্বনবী হুযূর-ই আকরামের বেলাদত শরীফ হলে শয়তানদের জন্য আসমানের নিকটে যাওয়াও নিষিদ্ধ করা হলো; যাতে তারা ওই অপকর্মের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। আসমানকে আসমান-রক্ষক ফেরেশতা নিয়োগ করে আল্লাহ্ তা‘আলা সংরক্ষণ করে ফেলেন। ফলে শয়তানগণ আসমানের নিকটে যেতেই তাঁরা তাদের দিকে আগুনের উল্কা পিন্ড নিক্ষেপ করেন। এর প্রচন্ড মার খেয়ে শয়তানরা যমীনের দিকে পালিয়ে আসে। ক্বসীদা বোর্দায় আল্লামা বূসীরী বলেন-কাফিরগণ হুযূর-ই আক্রামের রিসালতকে অস্বীকার করার পূর্বে আসমানের প্রান্তগুলো থেকে জ্বলন্ত উল্কাপিন্ড ছিঁড়ে পড়তে দেখতো। আর যমীনে বোতগুলোকে মাটিতে পতিত অবস্থায় দেখতো।
আল্লামা খরপূতী বলেন-
رُوِىَ اَنَّ اللهَ تَعَالى اِذَا قَضى اَمْرًا كَانَ يَسْمَعُه حَمَلَةُ الْعَرْشِ فَيُسَبِّحُوْنَ فَسَبَّحَ مَنْ تَحْتَهُمْ اِلَى السَّمَآءِ الدُّنْيَا فَتَخْتَطِفُ وَتَسْتَرِقُهُ الشَّيَاطَيْنُ ثُمَّ يَأْتُوْنَ بِهِ الْكَهَنَةَ عَلَى الْاَرْضِ فَمَاجَآءُوْا بِه عَلى وَجْهٍ فَهُوَ حَقٌّ وَلكِنَّهُمْ يَزِيْدُوْنَ فَيُكَذِّبُوْنَ وَكَانَ ذلِكَ فِى الْجَاهِلِيَّةِ فَلَمَّا وُلِدَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ كَانَتِ الْشَّيَاطِيْنُ مَرْجُوْمِيْنَ مِنَ السَّمَآءِ وَمَمْنُوْعِيْنَ مِنَ الصُّعُوْدِ اِلَيْهَا بِنُجُوْمٍ وَنِيْرَانٍ تَرْمِيْهَا الْمَلئِكَةُ اِلَيْهِمْ
অর্থ: বর্ণিত আছে যে, যখন আল্লাহ্ তা‘আলার তরফ থেকে কোন হুকুম জারী করা হয়, তখন সেটাকে আরশবাহী ফেরেশতাগণ শুনে তাসবীহ্ পাঠ করেন, আর তাঁদের নিম্নবর্তী ফেরেশতাগণও তাসবীহ্ পড়েন। তখন অন্য ফেরেশতাগণ এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তখন তাঁদেরকে ওই হুকুম সম্পর্কে তাঁরা খবর দেন। এ পর্যন্ত যে, প্রথম আসমানের ফেরেশতাগণ পর্যন্ত এ খবর ব্যাপকাকারে ছড়িয়ে পড়ে। তখন শয়তানরা, যারা প্রথম আসমানের নিকটে উড়ে গিয়ে আত্মগোপন করে থাকে, ওই খবরগুলো (যতটুকু শুনতে পেয়েছে) উড়িয়ে এনে গণকদেরকে বলে দেয়। তখন যতটুকু সঠিক খবর তারা দিতো তা একেবারে সঠিক হতো। কিন্তু তারা বেশীরভাগ সময় অতিরিক্ত কিছু মিলিয়ে বলতো। তা ডাহা মিথ্যা হতো। এ অবস্থা জাহেলী যুগ পর্যন্ত ছিলো।
যখন হুযূর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র জন্ম হলো, তখন থেকে শয়তানদের এ রাস্তা বন্ধ হয়ে গেলো আর আসমানের রক্ষক ফেরেশতাদের উল্কাপিন্ড নিক্ষেপের ভয়ে শয়তানরা আসমানের নিকটে যেতো না। আর যারা যেতো তাদেরকে প্রজ্জ্বলিত তারকারাজি ও উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করে প্রচন্ড আঘাত করা হতো। সুতরাং ক্বোরআন-ই করীমেও এরশাদ হয়েছে-فَمَنْ يَّسْتَمِعُ الْانَ يِجِدْلَهٗ شِهَابًا رَصَدًا
তরজমা: অতঃপর এখন যে কেউ শুনতে চেয়েছে, সে আপন তাকের মধ্যে উল্কাপিন্ড পেয়েছে।[সূরা জিন: আয়াত-৯, কানযুল ঈমান] আরো এরশাদ হয়েছে-وَجَعَلْنَاهَارَجُوْمًا لِلشَّيَاطِيْنِ
তরজমা: এবং সেগুলোকে শয়তানদের জন্য নিক্ষেপ উপকরণ করেছি। [সূরা মূলক: আয়াত-৫, কানযুল ঈমান]
হুযূর-ই আক্রামের বেলাদত শরীফের সময় মূর্তিগুলো অধোমুখে পতিত হয়েছিলো। মূর্তিগুলো বুঝাতে যে ‘সানাম’ ও দু’টি শব্দ ব্যবহৃত হয়। সে দু’টির মধ্যে পার্থক্য আছে-‘ওয়াসান’ (وثن) হচ্ছে যার দেহ আছে; চাই কাঠের হোক, অথবা পাথরের হোক; অথবা হোক স্বর্ণ কিংবা রূপার। আর সামাম (صنم) ওই তাসভীর (ফটো বিশেষ)কে বলা হয়, যা পুরুত্ব বিশিষ্ট দেহবিহীন হয়। আল্লামা বুসীরীর পংক্তিতে صنم (সনম) ব্যবহৃত হয়েছে। তা এ জন্য যে, হুযূর-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর বেলাদত শরীফের সময় সমস্ত ‘সনম’, যেগুলোর ছবি দেওয়ালের উপর অঙ্কন করা হয়েছিলো, সবক’টি মুখের উপর উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলো। আর وثن (দেহবিশিষ্ট বোতগুলো) তো অবশ্যই মুখের উপর উপুড় হয়ে পতিত হয়েছিলো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ওই অগ্নিপূজারী ও মূর্তিপূজারী মুশরিকরা হিদায়তের পথ থেকে এমন অন্ধ ও বধির হয়ে গিয়েছিলো যে, তারা আসমানের পার্শ্বগুলো থেকে উল্কাপিন্ড পড়তে দেখেও ঈমান আনেনি। আগুনের ওই উল্কাপিন্ডগুলো জিন ও শয়তানদেরকে মারা হচ্ছিলো। ওইগুলোর আঘাতের চোটে তারা এমনভাবে পতিত হতো, যেমন ভূ-পৃষ্ঠের উপর বোতগুলো মাথার উপর উপুড় হয়ে মাটিতে পড়েছিলো। এসব শান অস্বীকারকারীগণ স্বচক্ষে দেখেছে। আর হুযূর-ই আক্রামের সুস্পষ্ট নিদর্শনগুলো থেকে একটি বড় নিদর্শন এও ছিলো যে, চুরি করে শোনার জন্য যেসব শয়তান আসমানের নিকটে যেতো তাদের উপর আগুনের শিখাগুলো পড়তো। আর আয়াতে বর্ণিত رَجُوْمًا لِلشَّيَاطِيْنَ-এর বহিঃপ্রকাশ ঘটতো। তাছাড়া বেলাদত শরীফের সময় সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠের সমস্ত বোত মুখের উপর উপুড় হয়ে পতিত হয়েছিলো।
সুতরাং খাজা আবদুল মুত্তালিবের ঘটনা আছে যে, তিনি যখন কা’বার বোতখানায় গিয়েছিলেন, তখন সমস্ত বোতকে মাথা নিচের দিকে উপুড় অবস্থায় দেখতে পেয়েছিলেন। আর হুবল বোতের মুখের এ চতুর্পদী কবিতা শুনতে পেয়েছিলেন-
تَرى بِمَوْلُدٍ اَضَاءَتْ بِنُوْرِه ـ جَمِيْعُ فَجَاجَةِ الْاَرْضِ مِنْ شَرْقٍ وَمِنْ غَرْبٍ
وَخَرَّتْ لَهُ الْاَوْثَانُ طُرًّا وَاَرْعَدَتْ ـ قُلُوْبَ مُلُوْكِ الْاَرْضِ جَمْعًا مِنَ الرُّعْبِ
অর্থ: হে আবদুল মুত্তালিব! তুমি ওই সৌভাগ্যবান নবজাতের সাক্ষাৎ পেয়েছো, যাঁর নূরের আলোতে পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিটি প্রান্ত ও অংশ আলোকিত হয়ে গেছে। আর সমগ্র ভূ-পৃষ্ঠের বোতগুলো মাথা নিচু করে ফেলেছে। আর বাঁকাটুপি পরিহিত বাদশাহদের হৃদয়গুলো তাঁর ভয়ে কাঁপছে।
এদিকে বেলাদত শরীফের রাতে ইরান-সম্রাট কিসরার রাজ প্রাসাদে এমন ভূকম্পন আরম্ভ হয়েছিলো যে, সেটার চৌদ্দটা কঙ্কর খসে পড়েছিলো, অগ্নিপূজারীদের অগ্নিকুন্ড, যা হাজারো বছর ধরে জ্বলছিলো, নিভে গিয়েছিলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের ‘সাওয়া-সাগর’ শুষ্ক হয়ে গিয়েছিলো। কিসরা (পারস্য সম্রাট) তাতে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। সে সমস্ত নজূমীকে ডেকে সমবেত করে কারণ জিজ্ঞাসা করেছিলো। সবাই এর কারণ উদ্ঘাটন করতে অপরাগতা প্রকাশ করেছিলো। শেষ পর্যন্ত ইরান-স¤্রাট ইয়ামনের গভর্ণর বাযানের নিকট চিঠি লিখেছিলো যেন শীঘ্র দক্ষ নজূমী প্রেরণ করে। সুতরাং সে আবদুল মসীহ্ ইবনে ওমর ইবনে বুক্বায়লাহ্ গাস্সানীকে প্রেরণ করেছিলো। সে কিস্রার নিকট থেকে সমস্ত ঘটনা শুনে বলেছিলো, ‘‘এ মামলার ফয়সালা আমার মামা সায়ত্বাহ্ কাহিন (সায়ত্বাহ্ নামক গনক), যে সিরিয়ায় থাকে, দিতে পারে। আমি এ সম্পর্কে নিজের কোন মতামত ব্যক্ত করতে পারছিনা। সুতরাং বাদশাহ্ (ইরান সম্রাট) তাকে সেখানে পাঠিয়েছিলো। যখন সে সায়ত্বাহর নিকট আসলো তখন তাকে মুমুর্ষ অবস্থায় পেয়েছিলো। সে তাকে অভিভাদন জানালো। তখন সে মাথা তুলে বললো, ‘‘হে আবদুল মাসীহ্! তুমি উটের উপর সাওয়ার হয়ে আমি সায়ত্বাহর নিকট এমন সময় এসেছো, যখন তার প্রাণবায়ু বের হয়ে যাচ্ছে। হে আবদুল মসীহ্! সাসানী বাদশাহ্ তোমাকে তার রাজপ্রাসাদ প্রকম্পিত হওয়া, অগ্নিপূজারীদের অগ্নিকুন্ড নির্বাপিত হওয়া ইত্যাদির কারণ জানার জন্য পাঠিয়েছে। হে আবদুল মসীহ্! যখন ‘সাওয়া-সাগর’ শুষ্ক হয়ে গেছে, সামাওয়া উপত্যকা সবুজ সজীব হয়ে গেছে, তখন নিঃসন্দেহে সাহেবুত্ তিলাওয়াত, শেষ যামানার নবী আত্মপ্রকাশ করেছেন। তাঁর মাধ্যমে সর্বোৎকৃষ্ট দ্বীন প্রকাশ পাবে। রাজ প্রাসাদ থেকে পতিত কঙ্করগুলোর সংখ্যানুসারে ততজন বাদশাহ্ সাসানের বাদশাহীতে টিকে থাকবে। অর্থাৎ এ বংশে আর মাত্র চৌদ্দজন বাদশাহ হবে। এর পর যা হবার তা-ই হবে। এরপর সায়ত্বাহ্ নজূমীর রূহ দেহ থেকে বের হয়ে গেছে।
আবদুল মাসীহ এসব কথা কিসরাকে শুনালো। তার মনে বহুগুণ প্রশান্তি পেলো। সে মনে করেছে একের পর এক করে চৌদ্দজন স¤্রাট অতিবাহিত হতে অনেক সময় লেগে যাবে।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায়, মাত্র চার বছরের মধ্যে দশজন বাদশাহ্ খতম হয়ে গেছে। আর যে চারজন অবশিষ্ট ছিলো, তারাও হযরত আমীরুল মু’মিনীন ওসমান রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুর খিলাফতকাল পর্যন্ত সময় সীমার মধ্যে খতম হয়ে গেছে।
হযরত সাওয়াদ ইবনে ক্বা-রিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, আমি গনক ছিলাম। আর জিন আমাকে খবর দিতো হুযূর-ই আক্রামের বেলাদত শরীফের সময় সে আমাকে বললো, ‘‘এখন থেকে আমরা তোমাকে খবর দিতে পারবো না। কারণ আমরা এখন আসমানের উপর যখনই যাই, তখন আমাদের উপর উল্কাপিন্ড এসে পড়ে। সুতরাং এখন থেকে তুমিও এ কাজ (গণনা) ছেড়ে দাও এবং ওই মহান পথ প্রদর্শকের সন্ধান করো, যিনি বনী লুআই ইবনে গালিবের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছেন। তিনি আল্লাহর সৃষ্টিকে হিদায়তের পথে ডাকেন; বোত পূজা করতে নিষেধ করেন।’’
তিনি (হযরত সাওয়াদ) বলেন, আমি একবার/দু’বার পর্যন্ত তার (জিনটি) কথায় কোন পরোয়া করিনি। যখন সে তৃতীয়বারও একই কথা বলেছে। তখন আমার মনে ইসলামের প্রতি ভালবাসাও প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হলো। সুতরাং আমি মক্কা মু‘আয্যামায় হুযূর-ই আকরামের পবিত্র দরবারে হাযির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হলাম।

লেখক: মহাপরিচালক – আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, ষোলশহর, চট্টগ্রাম।

শেয়ার
  •  
  •  
  •  
  •